ভাষাশহীদের সংখ্যা কত? by মহিউদ্দিন আহমদ
ছোটবেলায়
স্কুলে পড়ার সময় দুটো শব্দের সঙ্গে পরিচয় হয়: শহীদ দিবস এবং প্রভাতফেরি।
শহীদ দিবস হলো একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের ওই দিনে ঢাকায় কয়েকজন তরুণের
বুকের রক্ত ঝরেছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে।
প্রতিবছর ওই দিনটি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। স্কুল বন্ধ থাকে। সব বয়সের
মানুষ ভোরবেলা হাতে ফুল নিয়ে জামায় বা শাড়িতে কালো ব্যাজ পরে খালি পায়ে
হেঁটে শহীদ মিনারে যান শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানাতে—এটাই
প্রভাতফেরি। এখন প্রভাতফেরি উঠে গেছে। ইউরোপীয় কেতায় রাত ১২টা বাজার সঙ্গে
সঙ্গে আমাদের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সরকারপ্রধান শহীদ মিনারে পুষ্পাঞ্জলি দেন।
তা ছাড়া শহীদ দিবস কথাটা আর তেমন শোনা যায় না। এই অভাগা দেশে বছরের এমন
কোনো দিন নেই, যেদিন কোনো না কোনো মায়ের বুক খালি হচ্ছে। এঁদের মধ্যে
কেউ কেউ তারকাখ্যাতি পেয়েছেন। আমরা ঘটা করে তাঁদের নামে দিবস পালন করি।
যারা ‘ইতরজন’ তাদের জন্য কোনো দিবস নেই। সারা বছর ধরেই যেহেতু শহীদেরা
সংবাদ শিরোনাম হন, তাঁদের নিয়ে আলোচনা, সেমিনার কিংবা খবরের কাগজে
ক্রোড়পত্র ছাপা হয়, বায়ান্নর শহীদদের আলাদা করে বোঝানোর ও চেনানোর
উপায় একটা বের হয়েছে। আমরা এখন বলি ‘ভাষাশহীদ’। অর্থাৎ মাতৃভাষার মর্যাদা
রক্ষার জন্য যাঁরা জীবন দিয়েছেন। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমাদের এ
অঞ্চলের সাম্প্রতিক ইতিহাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা।
একাত্তর সালে আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম।
স্বাধীনতার বীজটি কিন্তু বোনা হয়েছিল
ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই। সুতরাং বলা চলে, ভাষাশহীদেরাই আমাদের
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ। মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ শুরু হয়ে ১৬
ডিসেম্বর শেষ হয়ে গেল, এ রকম একটি সরল গল্পে আমরা অনেকেই বুঁদ হয়ে আছি।
মুক্তিযুদ্ধের যে দীর্ঘ বিস্তৃত পটভূমি, তাকে উপেক্ষা করে বা হিসাবে না
রেখে এ দেশের ইতিহাস হবে খণ্ডিত, অসম্পূর্ণ। বায়ান্নর ভাষাশহীদেরাই
আত্মবিসর্জনের মধ্য দিয়ে আমাদের পথচলার শুরুটা করে দিয়েছিলেন এবং নানা
চড়াই-উতরাই পার হয়ে একটা সর্বাত্মক জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা আলাদা
রাষ্ট্র পেয়েছি। বায়ান্নর ফেব্রুয়ারি নিয়ে অনেক লেখাজোকা হয়েছে। আরও হবে।
আমরা পাঁচজন শহীদের নাম বেশি বেশি শুনতে পাই: সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও
শফিউর। এঁদের মধ্যে বরকত ও জব্বার ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। রফিক
ছিলেন বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে। এঁরা তিনজন নিহত হন ২১
তারিখে। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে মারা যান রিকশাচালক সালাম এবং
হাইকোর্টের কর্মচারী শফিউর। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক অলি আহাদের
ভাষ্যে জানা যায়, ২২ ফেব্রুয়ারি ভিক্টোরিয়া পার্কের (বর্তমান বাহাদুর শাহ
পার্ক) আশপাশে, নবাবপুর রোড ও বংশাল রোডে গুলিতে কতজন মারা গেছেন, তার
সঠিক সংখ্যা কারও জানা নেই। আহমদ রফিক তাঁর একুশ থেকে একাত্তর বইয়ে নিহতদের
মধ্যে আবদুল আউয়াল, কিশোর অহিউল্লাহ ও সিরাজুদ্দিনের নাম উল্লেখ করেছেন।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে প্রথম স্মারকগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৩
সালের মার্চে। এর প্রকাশক ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম
সভাপতি মোহাম্মদ সুলতান। সম্পাদক ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। ওই বইয়ে কবির
উদ্দিন আহমেদ ‘একুশের ঘটনাপুঞ্জী’ নামে একটি প্রতিবেদনে লিখেছেন, ‘শহীদদের
লাশগুলো চক্রান্ত করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
মেডিকেল হোস্টেলের ভেতর “গায়েবি জানাজা” পড়া হলো।...(পরদিন) সকাল নয়টায়
জনসাধারণের এক বিরাট অংশ মর্নিং নিউজ অফিস জ্বালিয়ে দেয় এবং সংবাদ অফিসের
দিকে যেতে থাকে। সংবাদ অফিসের সম্মুখে মিছিলের ওপর মিলিটারি বেপরোয়া গুলি
চালায়। অনেকেই হতাহত হয় এখানে।’ প্রশ্ন হলো ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি মোট কতজন
‘হতাহত’ হয়েছিলেন, কতজন ‘নিহত’ হয়েছিলেন তার সঠিক সংখ্যাটি কি আমরা জানি?
কখনো জানার চেষ্টা করেছি? কবির উদ্দিন আহমেদের বিবরণ অনুযায়ী, ২৪
ফেব্রুয়ারি ‘সর্বদলীয় কর্মপরিষদের’ পক্ষ থেকে ‘সর্বমোট ৩৯ জন শহীদ হয়েছেন
বলে দাবি করা হয়’ এবং একই সঙ্গে সরকারের কাছে একটি ‘নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন
নিয়োগের’ আহ্বান জানানো হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের প্রতিবাদ হয়েছিল
ব্যাপক। ওই দিন সন্ধ্যায় গণতান্ত্রিক যুবলীগের চট্টগ্রাম জেলা শাখার
আহ্বায়ক এবং সীমান্ত পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী
রোগশয্যায় বসে ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ শিরোনামে একটি
দীর্ঘ কবিতা লেখেন। কবিতার প্রথম কয়েকটি লাইন ছিল:
ওরা চল্লিশজন কিংবা আরও বেশি
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে রমনার রোদ্রদগ্ধ
কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায়...
চল্লিশটি তাজা প্রাণ আর অঙ্কুরিত বীজের খোসার মধ্যে
আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের অসংখ্য বুকের রক্ত
রামেশ্বর, আবদুস সালামের কচি বুকের রক্ত...
এখানে কবি যে ৪০ সংখ্যাটি উল্লেখ করলেন, তা কি নিছক ছন্দ মেলানোর জন্য, নাকি এর মধ্যে সত্যতা আছে? আমরা এযাবৎ আটজন শহীদের নাম পেয়েছি। সংখ্যাটি কি এখানেই শেষ? এ দেশে পুলিশের বিরুদ্ধে লাশ গুম করার অভিযোগ তো নতুন নয়। পাকিস্তানের নির্বাসিত লেখক লাল খান তাঁর পাকিস্তানস আদার স্টোরি: দ্য ১৯৬৮-৬৯ রেভল্যুশন বইয়ে লিখেছেন, পুলিশের গুলিতে ২৬ জন নিহত এবং ৪০০ জনের মতো আহত হয়েছিলেন। বইটি ২০০৮ সালে লাহোরে প্রকাশিত হয়। তাঁর ওই বইয়ে তথ্যসূত্রের উল্লেখ নেই। তিনি পুলিশ বা গোয়েন্দা রিপোর্টের সাহায্য নিয়েছিলেন কি না জানি না। বায়ান্নর ২১-২২ ফেব্রুয়ারি তারিখে যাঁরা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তাঁরা আমাদের জাতীয় বীর। তাঁদের রক্তের পথ বেয়েই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। অথচ তাঁরা সংখ্যায় কতজন, কী তাঁদের নাম, কোথায় তাঁদের বাড়ি, কী ছিল তাঁদের পেশা—এ নিয়ে অনুসন্ধানের কোনো আগ্রহ আমরা দেখাইনি। এটা সত্য যে ভাষা আন্দোলনে ওই সময়ের কোনো নেতা বা অ্যাকটিভিস্ট প্রাণ দেননি। প্রাণ দিয়েছিলেন সাধারণ মানুষ। ইতিহাসে আমজনতা বরাবরই থাকেন উপেক্ষিত, এলিটরা পদ-পদক-পদবি পাওয়া কিংবা না-পাওয়া নিয়ে মান-অভিমান করেন। পুলিশের কাজের ধরন আমার জানা নেই। তাদের মহাফেজখানায় কি পুরোনো কোনো রেকর্ড নেই, যার সূত্র ধরে আমরা ভাষাশহীদদের সংখ্যা ও পরিচয় জানতে পারব? আমার জানতে ইচ্ছে হয়, এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ কখনো নেওয়া হয়েছে কি না, অথবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে? অনাদরে, অবহেলায় আমরা ইতিহাসের অনেক তথ্য-উপাত্ত হারিয়েছি। অথচ একটু উদ্যোগ নিলে, একটু সদিচ্ছা দেখালে এ বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান চালানো যায়। আমরা ইতিহাস নিয়ে রাজনীতি করি, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ইতিহাস বিকৃতির নালিশ জানাই। কিন্তু ইতিহাসের সত্য জানার জন্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে ইতস্তত করি। শহীদেরা কি সব সময় রাজনীতির কাঁচামাল এবং ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবেই ব্যবহৃত হবেন? বছরে একদিন তাঁদের স্মরণে একটি বিবৃতি দিয়েই কি আমরা দায়িত্ব সারব? এ দেশে সর্বজনীন ‘শহীদ’ কয়জন? রাজনীতির বিভাজনের কারণে এক পক্ষের শহীদ অন্য পক্ষের কাছে খলনায়ক। কিন্তু ভাষাশহীদেরা তো সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। তাঁরা আমাদের সবার। এখন হয়তো তাঁদের নিয়ে মাতম হয় না। কিন্তু যত দিন বাংলা ভাষা থাকবে, আমরা বায়ান্নর কথা স্মরণ করব। ভাষাশহীদদের জন্য আমরা আবেগ অনুভব করব। আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু তৈরি হচ্ছে। আমি প্রস্তাব করছি, এই সেতু ভাষাশহীদদের নামে উৎসর্গ করা হোক, নাম রাখা হোক ভাষাশহীদ সেতু। আমাদের পূর্বসূরিদের রক্তের ঋণ শোধ করার এটি হবে একটি অকিঞ্চিৎকর প্রয়াস। শহীদস্মৃতি অমর হোক।
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
mohi2005@gmail.com
ওরা চল্লিশজন কিংবা আরও বেশি
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে রমনার রোদ্রদগ্ধ
কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায়...
চল্লিশটি তাজা প্রাণ আর অঙ্কুরিত বীজের খোসার মধ্যে
আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের অসংখ্য বুকের রক্ত
রামেশ্বর, আবদুস সালামের কচি বুকের রক্ত...
এখানে কবি যে ৪০ সংখ্যাটি উল্লেখ করলেন, তা কি নিছক ছন্দ মেলানোর জন্য, নাকি এর মধ্যে সত্যতা আছে? আমরা এযাবৎ আটজন শহীদের নাম পেয়েছি। সংখ্যাটি কি এখানেই শেষ? এ দেশে পুলিশের বিরুদ্ধে লাশ গুম করার অভিযোগ তো নতুন নয়। পাকিস্তানের নির্বাসিত লেখক লাল খান তাঁর পাকিস্তানস আদার স্টোরি: দ্য ১৯৬৮-৬৯ রেভল্যুশন বইয়ে লিখেছেন, পুলিশের গুলিতে ২৬ জন নিহত এবং ৪০০ জনের মতো আহত হয়েছিলেন। বইটি ২০০৮ সালে লাহোরে প্রকাশিত হয়। তাঁর ওই বইয়ে তথ্যসূত্রের উল্লেখ নেই। তিনি পুলিশ বা গোয়েন্দা রিপোর্টের সাহায্য নিয়েছিলেন কি না জানি না। বায়ান্নর ২১-২২ ফেব্রুয়ারি তারিখে যাঁরা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তাঁরা আমাদের জাতীয় বীর। তাঁদের রক্তের পথ বেয়েই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। অথচ তাঁরা সংখ্যায় কতজন, কী তাঁদের নাম, কোথায় তাঁদের বাড়ি, কী ছিল তাঁদের পেশা—এ নিয়ে অনুসন্ধানের কোনো আগ্রহ আমরা দেখাইনি। এটা সত্য যে ভাষা আন্দোলনে ওই সময়ের কোনো নেতা বা অ্যাকটিভিস্ট প্রাণ দেননি। প্রাণ দিয়েছিলেন সাধারণ মানুষ। ইতিহাসে আমজনতা বরাবরই থাকেন উপেক্ষিত, এলিটরা পদ-পদক-পদবি পাওয়া কিংবা না-পাওয়া নিয়ে মান-অভিমান করেন। পুলিশের কাজের ধরন আমার জানা নেই। তাদের মহাফেজখানায় কি পুরোনো কোনো রেকর্ড নেই, যার সূত্র ধরে আমরা ভাষাশহীদদের সংখ্যা ও পরিচয় জানতে পারব? আমার জানতে ইচ্ছে হয়, এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ কখনো নেওয়া হয়েছে কি না, অথবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে? অনাদরে, অবহেলায় আমরা ইতিহাসের অনেক তথ্য-উপাত্ত হারিয়েছি। অথচ একটু উদ্যোগ নিলে, একটু সদিচ্ছা দেখালে এ বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান চালানো যায়। আমরা ইতিহাস নিয়ে রাজনীতি করি, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ইতিহাস বিকৃতির নালিশ জানাই। কিন্তু ইতিহাসের সত্য জানার জন্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে ইতস্তত করি। শহীদেরা কি সব সময় রাজনীতির কাঁচামাল এবং ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবেই ব্যবহৃত হবেন? বছরে একদিন তাঁদের স্মরণে একটি বিবৃতি দিয়েই কি আমরা দায়িত্ব সারব? এ দেশে সর্বজনীন ‘শহীদ’ কয়জন? রাজনীতির বিভাজনের কারণে এক পক্ষের শহীদ অন্য পক্ষের কাছে খলনায়ক। কিন্তু ভাষাশহীদেরা তো সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। তাঁরা আমাদের সবার। এখন হয়তো তাঁদের নিয়ে মাতম হয় না। কিন্তু যত দিন বাংলা ভাষা থাকবে, আমরা বায়ান্নর কথা স্মরণ করব। ভাষাশহীদদের জন্য আমরা আবেগ অনুভব করব। আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু তৈরি হচ্ছে। আমি প্রস্তাব করছি, এই সেতু ভাষাশহীদদের নামে উৎসর্গ করা হোক, নাম রাখা হোক ভাষাশহীদ সেতু। আমাদের পূর্বসূরিদের রক্তের ঋণ শোধ করার এটি হবে একটি অকিঞ্চিৎকর প্রয়াস। শহীদস্মৃতি অমর হোক।
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
mohi2005@gmail.com
No comments