বিচারের অপেক্ষায় ১১ বছর by টিপু সুলতান ও প্রশান্ত কর্মকার
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর ঘটনাস্থল |
প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে চালানো ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ১১ বছর পার
হলো। এখনো বিচারের অপেক্ষায় আছে ওই ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের পরিবার।
কিন্তু এ বছরও মামলার বিচারকাজ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে আইনমন্ত্রী
আনিসুল হক গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, বিচারকাজ শেষ পর্যায়ে আছে।
এ বছরের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করা যাবে বলে তিনি আশাবাদী । তিনি বলেন,
মামলার গুরুত্ব বিবেচনা করে দ্রুত নিষ্পত্তি করার জন্য আরও একজন বিশেষ পিপি
নিয়োগ করা হয়েছে।
এ মামলার ৪৯১ জন সাক্ষীর মধ্যে গত বুধবার পর্যন্ত ১৭৬ জনের সাক্ষ্য-জেরা শেষ হয়েছে। অন্যদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ওবায়দুল কাদেরসহ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অভিযোগ প্রমাণের জন্য যাঁকে যাঁকে প্রয়োজন মনে হবে, তাঁদের সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আদালতে ডাকা হবে বলে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা জানান।
বিচারকাজ শেষ হতে আর কত সময় লাগতে পারে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কত দিন লাগবে তা বলা ঠিক হবে না। তবে চলতি বছরের মধ্যে বিচারকাজ শেষ না হলেও একটি বিশেষ পর্যায়ে কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া হবে।
অপর দিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া দাবি করেন, এ মামলার বিচারকাজের গতি-প্রকৃতি অনেকাংশেই নির্ভর করছে সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর। সপ্তাহে দু-তিন দিন সাক্ষ্য নেওয়া হচ্ছে। ফলে আসামিপক্ষ সাক্ষীকে জেরা ও প্রস্তুতির পর্যাপ্ত সময় পাচ্ছে না। অবশ্য সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, এটা ঠিক নয়। আসামিপক্ষ অনেক ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় জেরা করে সময়ক্ষেপণ করছে।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট নৃশংস ওই হত্যাযজ্ঞের তদন্ত ভিন্ন খাতে নিতে নানা চেষ্টা করা হয়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে নতুন করে তদন্ত শুরু করায়। বেরিয়ে আসে অনেক অজানা তথ্য। ২০০৮ সালের জুনে বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এরপর মামলার বিচার শুরু হয়। ৬১ জনের সাক্ষ্য নেওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার এসে এর অধিকতর তদন্ত করে। এরপর বিএনপির নেতা তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবর, হারিছ চৌধুরীসহ আরও ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দিলে আবার বিচার শুরু হয়। তারপর পেরিয়ে গেছে আরও সাড়ে তিন বছর।
এ মামলার মোট ৫২ জন আসামির মধ্যে তারেক রহমানসহ ১৮ জনকে পলাতক দেখিয়ে তাঁদের অনুপস্থিতিতে বিচার চলছে। ইতিমধ্যে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে চারজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন, যাঁরা জোট সরকারের আমলে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) ও র্যাবের গোয়েন্দা শাখায় কর্মরত ছিলেন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ওই হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২২ জন নিহত হন। আহত হন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কয়েক শ নেতা-কর্মী। এঁদের অনেকে আজও শরীরে গ্রেনেডের স্প্লিন্টার নিয়ে দুঃসহ জীবন যাপন করছেন। আহত ব্যক্তিরাসহ নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা বিচারের অপেক্ষায় আছেন।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে অবস্থিত ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিশেষ এজলাসে মামলার বিচারকাজ চলছে।
বিএনপি সরকারের সাজানো তদন্ত: গ্রেনেড হামলার দিনই পুলিশ বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় একটি মামলা করে। পরদিন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মামলা দিতে গেলে পুলিশ তা নেয়নি। মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি। শুরু থেকেই তদন্তের গতি ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করে তৎকালীন সরকার। তদন্তের নামে বিষয়টিকে বিতর্কিত করার কাজ শুরু হয় সিআইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে তৎকালীন জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ একটি মহলের প্রভাব ছিল বলে শুরু থেকেই অভিযোগ ছিল। পরে একাধিক তদন্তে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে।
ঘটনার গুরুত্ব নষ্ট করতে হামলার শিকার আওয়ামী লীগের দিকেই সন্দেহের আঙুল তুলেছিল বিএনপি। ওই সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও নেতা তাঁদের বক্তৃতায় আওয়ামী লীগ নিজেরাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে প্রচার চালান। হামলার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত বলেও তখন একটা মহল থেকে প্রচারণা চালানো হয়।
ঘটনা তদন্তে ২০০৪ সালের ২২ আগস্ট বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনকে চেয়ারম্যান করে এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে চারদলীয় জোট সরকার। সেই কমিশনও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অপপ্রচারের পথ ধরেই চলেছিল। ১ মাস ১০ দিনের মাথায় কমিশন সরকারের কাছে ১৬২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দিয়ে বলে, কমিশনের সংগৃহীত তথ্য-প্রমাণ সন্দেহাতীতভাবে ইঙ্গিত করে, এই হামলার পেছনে একটি শক্তিশালী বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত ছিল। প্রতিবেদনে বিদেশি শক্তি বলতে কোনো দেশের নাম বলা হয়নি। তবে ২০০৪ সালের ৪ অক্টোবর প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীন বৃহৎ প্রতিবেশী শক্তি হিসেবে ভারতের প্রতি ইঙ্গিত করেন।
অবশ্য কেবল এ ঘটনাই নয়, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর দেশে জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। বেশ কিছু নাশকতামূলক বোমা-গ্রেনেড হামলা চালায়। জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান, তৎপরতা এবং এ ব্যাপারে সরকারের নির্লিপ্ততা নিয়ে তখন গণমাধ্যমে ব্যাপক লেখালেখি হয়। কিন্তু ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী বোমা হামলার আগ পর্যন্ত তৎকালীন সরকার জঙ্গিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব অস্বীকার করে গেছে। শুধু তা-ই নয়, ২০০৪ সালের এপ্রিল-মে মাসে রাজশাহীর তিন উপজেলায় সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে জেএমবির তাণ্ডবে বিএনপির একাধিক মন্ত্রী ও সাংসদের সহযোগিতা ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। তখন শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী বলেছিলেন, বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি। এরপর ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা নিয়েও বিভ্রান্তি ছড়ানো শুরু করে। প্রথমে পার্থ সাহা নামে এক নিরীহ যুবককে আটক করে। তাঁকে নির্যাতন করে সাজানো জবানবন্দি আদায় করে তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু গণমাধ্যমের কারণে ওই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
জজ মিয়া উপাখ্যান: ঘটনার ১০ মাসের মাথায় ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার বীরকোট গ্রামের বাড়ি থেকে জজ মিয়া নামের এক যুবককে সিআইডি আটক করে। ১৭ দিন রিমান্ডে রেখে জজ মিয়ার কাছ থেকে সিআইডি সাজানো জবানবন্দি নেয়।
এই জজ মিয়াকে দিয়েই গ্রেনেড হামলার ঘটনায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করে তদন্তের নামে ‘আষাঢ়ে গল্প’ প্রচার করেছিলেন মামলার তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির এএসপি আবদুর রশিদ ও তৎকালীন বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন। সিআইডির এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনিও এই সাজানো ছকে কথিত তদন্তকে এগিয়ে নিয়ে যান। এই গল্প সাজানোর ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তাদের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন বলে পরে তদন্তে জানা গেছে।
ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেওয়া সেই সাজানো জবানবন্দিতে জজ মিয়া বলেছিলেন, তিনি আগে কখনো গ্রেনেড দেখেননি; গ্রেনেড ও বোমার মধ্যে পার্থক্য তিনি জানেন না। পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে বড় ভাইদের নির্দেশে তিনি অন্যদের সঙ্গে গ্রেনেড হামলায় অংশ নেন। আর বড় ভাইয়েরা হচ্ছেন সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদ, মুকুল প্রমুখ। উল্লিখিত সন্ত্রাসীদের বেশির ভাগ চারদলীয় জোট সরকারের সময় ভারতে পালিয়ে যায়।
এর প্রায় দুই বছর পর ২০০৬ সালের আগস্টে এই নাটকের পেছনের ঘটনা ফাঁস করে দেন জজ মিয়ার মা জোবেদা খাতুন। প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, জজ মিয়াকে গ্রেপ্তারের পর থেকেই সিআইডি তাঁর পরিবারকে মাসে মাসে ভরণপোষণের টাকা দিয়ে আসছে। জজ মিয়াকে গ্রেনেড হামলা মামলায় রাজসাক্ষী করতে সিআইডির প্রস্তাবের কথাও ফাঁস করে দেন তিনি। (সূত্র: প্রথম আলো, ২১ আগস্ট ২০০৬)
সত্য উদ্ঘাটনের শুরু: ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে নতুন করে এ মামলা তদন্তের উদ্যোগ নেয়। তাতে বেরিয়ে আসে, বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর সহযোগিতায় গোপন জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের (হুজি-বি) জঙ্গিরা শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে ওই হামলা চালিয়েছিল।
তদন্ত শেষে সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার ফজলুল কবির ২০০৮ সালের ১১ জুন হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে আদালতে দুটি অভিযোগপত্র জমা দেন। তাতে হুজি-বির নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ও সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তাঁর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। পিন্টু ছাড়া বাকি সবাই হুজি-বির জঙ্গি।
অধিকতর তদন্ত: ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সিআইডি এ মামলার অধিকতর তদন্ত করে এবং ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়। তাতে আরও ৩০ জনকে আসামি করা হয়। উভয় অভিযোগপত্র মিলে মোট আসামির সংখ্যা ৫২।
আসামিরা হলেন তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামীর নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সাবেক সাংসদ শাহ মোহাম্মদ কায়কোবাদ, খালেদা জিয়ার ভাগনে সাইফুল ইসলাম (ডিউক), এনএসআইয়ের সাবেক দুই মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার (অব.) আবদুর রহিম ও মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার, ডিজিএফআইয়ের মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল (বরখাস্ত) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, পুলিশের সাবেক তিন আইজি আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী, সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি খান সাইদ হাসান ও মো. ওবায়দুর রহমান, জোট সরকারের আমলে মামলার তিন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান ও এএসপি আবদুর রশিদ, হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ এবং হুজি-বির ১০ জন নেতা।
২০১২ সালের ১৮ মার্চ হত্যা মামলায় ৫২ জনের বিরুদ্ধে এবং বিস্ফোরক মামলায় ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। আসামিদের মধ্যে পুলিশের সাবেক ছয় কর্মকর্তা, খালেদা জিয়ার ভাগনে সাইফুল ইসলাম ও সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর আরিফুর রহমান জামিনে আছেন। বাবর, পিন্টু, মুজাহিদসহ ২৬ জন আসামি কারাগারে আছেন। পলাতক রয়েছেন ১৮ জন।
এ মামলার ৪৯১ জন সাক্ষীর মধ্যে গত বুধবার পর্যন্ত ১৭৬ জনের সাক্ষ্য-জেরা শেষ হয়েছে। অন্যদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ওবায়দুল কাদেরসহ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অভিযোগ প্রমাণের জন্য যাঁকে যাঁকে প্রয়োজন মনে হবে, তাঁদের সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আদালতে ডাকা হবে বলে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা জানান।
বিচারকাজ শেষ হতে আর কত সময় লাগতে পারে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কত দিন লাগবে তা বলা ঠিক হবে না। তবে চলতি বছরের মধ্যে বিচারকাজ শেষ না হলেও একটি বিশেষ পর্যায়ে কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া হবে।
অপর দিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া দাবি করেন, এ মামলার বিচারকাজের গতি-প্রকৃতি অনেকাংশেই নির্ভর করছে সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর। সপ্তাহে দু-তিন দিন সাক্ষ্য নেওয়া হচ্ছে। ফলে আসামিপক্ষ সাক্ষীকে জেরা ও প্রস্তুতির পর্যাপ্ত সময় পাচ্ছে না। অবশ্য সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, এটা ঠিক নয়। আসামিপক্ষ অনেক ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় জেরা করে সময়ক্ষেপণ করছে।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট নৃশংস ওই হত্যাযজ্ঞের তদন্ত ভিন্ন খাতে নিতে নানা চেষ্টা করা হয়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে নতুন করে তদন্ত শুরু করায়। বেরিয়ে আসে অনেক অজানা তথ্য। ২০০৮ সালের জুনে বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এরপর মামলার বিচার শুরু হয়। ৬১ জনের সাক্ষ্য নেওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার এসে এর অধিকতর তদন্ত করে। এরপর বিএনপির নেতা তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবর, হারিছ চৌধুরীসহ আরও ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দিলে আবার বিচার শুরু হয়। তারপর পেরিয়ে গেছে আরও সাড়ে তিন বছর।
এ মামলার মোট ৫২ জন আসামির মধ্যে তারেক রহমানসহ ১৮ জনকে পলাতক দেখিয়ে তাঁদের অনুপস্থিতিতে বিচার চলছে। ইতিমধ্যে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে চারজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন, যাঁরা জোট সরকারের আমলে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) ও র্যাবের গোয়েন্দা শাখায় কর্মরত ছিলেন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ওই হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২২ জন নিহত হন। আহত হন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কয়েক শ নেতা-কর্মী। এঁদের অনেকে আজও শরীরে গ্রেনেডের স্প্লিন্টার নিয়ে দুঃসহ জীবন যাপন করছেন। আহত ব্যক্তিরাসহ নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা বিচারের অপেক্ষায় আছেন।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে অবস্থিত ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিশেষ এজলাসে মামলার বিচারকাজ চলছে।
বিএনপি সরকারের সাজানো তদন্ত: গ্রেনেড হামলার দিনই পুলিশ বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় একটি মামলা করে। পরদিন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মামলা দিতে গেলে পুলিশ তা নেয়নি। মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি। শুরু থেকেই তদন্তের গতি ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করে তৎকালীন সরকার। তদন্তের নামে বিষয়টিকে বিতর্কিত করার কাজ শুরু হয় সিআইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে তৎকালীন জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ একটি মহলের প্রভাব ছিল বলে শুরু থেকেই অভিযোগ ছিল। পরে একাধিক তদন্তে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে।
ঘটনার গুরুত্ব নষ্ট করতে হামলার শিকার আওয়ামী লীগের দিকেই সন্দেহের আঙুল তুলেছিল বিএনপি। ওই সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও নেতা তাঁদের বক্তৃতায় আওয়ামী লীগ নিজেরাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে প্রচার চালান। হামলার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত বলেও তখন একটা মহল থেকে প্রচারণা চালানো হয়।
ঘটনা তদন্তে ২০০৪ সালের ২২ আগস্ট বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনকে চেয়ারম্যান করে এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে চারদলীয় জোট সরকার। সেই কমিশনও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অপপ্রচারের পথ ধরেই চলেছিল। ১ মাস ১০ দিনের মাথায় কমিশন সরকারের কাছে ১৬২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দিয়ে বলে, কমিশনের সংগৃহীত তথ্য-প্রমাণ সন্দেহাতীতভাবে ইঙ্গিত করে, এই হামলার পেছনে একটি শক্তিশালী বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত ছিল। প্রতিবেদনে বিদেশি শক্তি বলতে কোনো দেশের নাম বলা হয়নি। তবে ২০০৪ সালের ৪ অক্টোবর প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীন বৃহৎ প্রতিবেশী শক্তি হিসেবে ভারতের প্রতি ইঙ্গিত করেন।
অবশ্য কেবল এ ঘটনাই নয়, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর দেশে জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। বেশ কিছু নাশকতামূলক বোমা-গ্রেনেড হামলা চালায়। জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান, তৎপরতা এবং এ ব্যাপারে সরকারের নির্লিপ্ততা নিয়ে তখন গণমাধ্যমে ব্যাপক লেখালেখি হয়। কিন্তু ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী বোমা হামলার আগ পর্যন্ত তৎকালীন সরকার জঙ্গিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব অস্বীকার করে গেছে। শুধু তা-ই নয়, ২০০৪ সালের এপ্রিল-মে মাসে রাজশাহীর তিন উপজেলায় সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে জেএমবির তাণ্ডবে বিএনপির একাধিক মন্ত্রী ও সাংসদের সহযোগিতা ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। তখন শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী বলেছিলেন, বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি। এরপর ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা নিয়েও বিভ্রান্তি ছড়ানো শুরু করে। প্রথমে পার্থ সাহা নামে এক নিরীহ যুবককে আটক করে। তাঁকে নির্যাতন করে সাজানো জবানবন্দি আদায় করে তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু গণমাধ্যমের কারণে ওই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
জজ মিয়া উপাখ্যান: ঘটনার ১০ মাসের মাথায় ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার বীরকোট গ্রামের বাড়ি থেকে জজ মিয়া নামের এক যুবককে সিআইডি আটক করে। ১৭ দিন রিমান্ডে রেখে জজ মিয়ার কাছ থেকে সিআইডি সাজানো জবানবন্দি নেয়।
এই জজ মিয়াকে দিয়েই গ্রেনেড হামলার ঘটনায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করে তদন্তের নামে ‘আষাঢ়ে গল্প’ প্রচার করেছিলেন মামলার তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির এএসপি আবদুর রশিদ ও তৎকালীন বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন। সিআইডির এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনিও এই সাজানো ছকে কথিত তদন্তকে এগিয়ে নিয়ে যান। এই গল্প সাজানোর ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তাদের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন বলে পরে তদন্তে জানা গেছে।
ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেওয়া সেই সাজানো জবানবন্দিতে জজ মিয়া বলেছিলেন, তিনি আগে কখনো গ্রেনেড দেখেননি; গ্রেনেড ও বোমার মধ্যে পার্থক্য তিনি জানেন না। পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে বড় ভাইদের নির্দেশে তিনি অন্যদের সঙ্গে গ্রেনেড হামলায় অংশ নেন। আর বড় ভাইয়েরা হচ্ছেন সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদ, মুকুল প্রমুখ। উল্লিখিত সন্ত্রাসীদের বেশির ভাগ চারদলীয় জোট সরকারের সময় ভারতে পালিয়ে যায়।
এর প্রায় দুই বছর পর ২০০৬ সালের আগস্টে এই নাটকের পেছনের ঘটনা ফাঁস করে দেন জজ মিয়ার মা জোবেদা খাতুন। প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, জজ মিয়াকে গ্রেপ্তারের পর থেকেই সিআইডি তাঁর পরিবারকে মাসে মাসে ভরণপোষণের টাকা দিয়ে আসছে। জজ মিয়াকে গ্রেনেড হামলা মামলায় রাজসাক্ষী করতে সিআইডির প্রস্তাবের কথাও ফাঁস করে দেন তিনি। (সূত্র: প্রথম আলো, ২১ আগস্ট ২০০৬)
সত্য উদ্ঘাটনের শুরু: ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে নতুন করে এ মামলা তদন্তের উদ্যোগ নেয়। তাতে বেরিয়ে আসে, বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর সহযোগিতায় গোপন জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের (হুজি-বি) জঙ্গিরা শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে ওই হামলা চালিয়েছিল।
তদন্ত শেষে সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার ফজলুল কবির ২০০৮ সালের ১১ জুন হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে আদালতে দুটি অভিযোগপত্র জমা দেন। তাতে হুজি-বির নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ও সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তাঁর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। পিন্টু ছাড়া বাকি সবাই হুজি-বির জঙ্গি।
অধিকতর তদন্ত: ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সিআইডি এ মামলার অধিকতর তদন্ত করে এবং ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়। তাতে আরও ৩০ জনকে আসামি করা হয়। উভয় অভিযোগপত্র মিলে মোট আসামির সংখ্যা ৫২।
আসামিরা হলেন তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামীর নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সাবেক সাংসদ শাহ মোহাম্মদ কায়কোবাদ, খালেদা জিয়ার ভাগনে সাইফুল ইসলাম (ডিউক), এনএসআইয়ের সাবেক দুই মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার (অব.) আবদুর রহিম ও মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার, ডিজিএফআইয়ের মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল (বরখাস্ত) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, পুলিশের সাবেক তিন আইজি আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী, সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি খান সাইদ হাসান ও মো. ওবায়দুর রহমান, জোট সরকারের আমলে মামলার তিন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান ও এএসপি আবদুর রশিদ, হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ এবং হুজি-বির ১০ জন নেতা।
২০১২ সালের ১৮ মার্চ হত্যা মামলায় ৫২ জনের বিরুদ্ধে এবং বিস্ফোরক মামলায় ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। আসামিদের মধ্যে পুলিশের সাবেক ছয় কর্মকর্তা, খালেদা জিয়ার ভাগনে সাইফুল ইসলাম ও সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর আরিফুর রহমান জামিনে আছেন। বাবর, পিন্টু, মুজাহিদসহ ২৬ জন আসামি কারাগারে আছেন। পলাতক রয়েছেন ১৮ জন।
No comments