তাহেরকে নিয়ে কেন এই মিথ্যাচার? by মো. আনোয়ার হোসেন
প্রথম আলোয় প্রকাশিত যেকোনো নিবন্ধ বা প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য সত্য উদ্ঘাটন; কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করা নয়। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে প্রথম আলোয় যেসব নিবন্ধ ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, লেখক–গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের নিবন্ধটি ছিল তার একটি। প্রকাশিত নিবন্ধটি সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেন যে প্রতিক্রিয়া পাঠিয়েছেন, তা এখানে প্রকাশ করা হলো। বি.স. প্রথম আলো
কদিন ধরে মন ছিল বিষণ্ণ। প্রথম আলো ও মানবজমিন পত্রিকায় কয়েক কিস্তিতে কর্নেল তাহের ও আমার সম্পর্কে কিছু নির্জলা মিথ্যা ও বানোয়াট কল্পকাহিনি প্রকাশিত হয়েছে। তা-ও শোকের মাস আগস্টে। চমক হিসেবে হয়তো শেষ কিস্তি ছাপা হয়েছে ১৫ আগস্ট কালরাত্রির আগের দিন। আমি ক্ষুদ্র ব্যক্তি, নিতান্ত সাধারণ। আমার সম্পর্কে মিথ্যাচারে দেশ ও জাতির তেমন কিছু এসে-যায় না। কিন্তু কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম সাধারণ ব্যক্তি নন। অসাধারণ তিনি হয়ে উঠেছেন নিজ কর্ম দিয়ে। তা কেউ করে দেয়নি। জীবনও দিয়েছেন আপন বিশ্বাসে অটল ও পবিত্র থেকে।
আর সেই মৃত মানুষটিকে নিয়ে নির্জলা মিথ্যাচার ও নিম্নমানের কল্পকাহিনি প্রথম আলো পত্রিকায়! গণতান্ত্রিক সমাজে মত প্রকাশের স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কথা থাকে এই যে প্রকাশিত মতটি যুক্তিনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর কি না; বিনা অপরাধে অন্যকে তা আঘাত করে কি না, অন্যায়ভাবে তাঁর মান-মর্যাদা ও অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কি না; দায়িত্বশীল সংবাদপত্র তা পর্যালোচনা করে কিছু প্রকাশের আগে।
সমাজের অসংগতি ও অবিচার বিষয়ে প্রথম আলো নানা সময়ে কথা বলেছে। সত্য প্রকাশে সহায়তা করেছে। অন্যায়ভাবে তাহেরকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা; তাঁর বিরুদ্ধে তাহের পরিবারের আইনি লড়াই বিষয়ে প্রথম আলোর ভূমিকা আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। জনাব মহিউদ্দিন আহমদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অসত্য লেখাকে প্রথম আলো প্রশ্রয় দিয়েছে, এটা বেদনাদায়ক।
১৪ আগস্ট প্রথম আলোয় ‘বাকশালকে বাদ দিয়ে তাহেরের জাতীয় সরকার?’ কিস্তির শিরোনামটি দেখুন। জাসদ বা তার মুখ্য নেতা সিরাজুল আলম খান নন, ‘তাহেরের জাতীয় সরকার!’ সত্য হলো, তাহের যা কিছু করেছেন তা দলীয় সিদ্ধান্তেই করেছেন। বলা হয়েছে, ‘সন্ধ্যায় খন্দকার মোশতাক আহমদ বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তাহের উপস্থিত ছিলেন।’ এটা সর্বৈব মিথ্যা। তাহের সেখানে ছিলেন না।
এই কিস্তিতে শুরুতেই জাসদ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বর্তমানে একটি এনজিওর প্রধান আবুল হাসিব খানের কথা বলা হয়েছে। ১৫ আগস্ট সকালে মুহসীন হলের ছাত্র নূর মোহাম্মদ নাকি আমার চিরকূট দিয়েছেন আবুল হাসিবকে, যাতে গণবাহিনীর জরুরি সভার কথা উল্লেখ ছিল। আবুল হাসিব খানকে আমি নিজেই ফোন করেছি। তিনি বলেছেন, ‘এসব লুজ টক’। নূর মোহাম্মদ পরে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে পুলিশের সর্বোচ্চ আইজি পদ অলংকৃত করেন। তিনি তো বেঁচে আছেন। তিনিই বলুন মহিউদ্দিনের এসব কথা সঠিক কি না।
গণবাহিনীতে আমার সক্রিয় অবস্থান কোনো অজানা বিষয় নয়। ইতিমধ্যে প্রকাশিত দুটি পুস্তকে (মাওলা ব্রাদার্স প্রকাশিত তাহেরের স্বপ্ন এবং আগামী প্রকাশিত মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ৭ই নভেম্বর অভ্যুত্থানে কর্নেল তাহের) তার অনুপুঙ্খ বিবরণ আছে। সামান্য বিচার-বুদ্ধি থাকলে জনাব মহিউদ্দিন আমার প্রকাশিত পুস্তকের ভাষ্য থেকে জানতেন গণবাহিনীর মতো গোপন সংগঠনে ভাই, ভাইজান—এসব সম্বোধনের এবং তাঁর উক্তি উদ্ধৃত করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তাই মহিউদ্দিনের ভাষ্য, ‘সভা শুরু হলে আনোয়ার হোসেন উপস্থিত সবাইকে বলেন, ভাইজান (লে. কর্নেল আবু তাহের) সকালে রেডিও স্টেশনে গিয়েছিলেন। তিনি মেজর ডালিমকে বকাঝকা করে বলেছেন, ‘... মেজর হয়েছ, এখন পর্যন্ত একটা মার্শাল ল প্রক্লেমেশন ড্রাফট করতে পারলে না। জান, কাল ইউনিভার্সিটিতে কারা বোমা ফাটিয়েছে? দে আর মাই বয়েজ’—এসব যে সম্পূর্ণ বানোয়াট ও হাস্যকর, তা নিশ্চয়ই পাঠক বুঝবেন।
১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা নঈম জাহাঙ্গীরের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ‘১৭ আগস্ট সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নঈম জাহাঙ্গীর নারায়ণগঞ্জে তাহেরের বাসায় যান পরিস্থিতি সম্পর্কে আঁচ করতে। ১৯৭১ সালে নঈম ১১ নম্বর সেক্টরে তাহেরের সহযোদ্ধা ছিলেন এবং প্রায়ই তাঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতেন। তাহের আক্ষেপ করে নঈমকে বললেন, “ওরা বড় রকমের একটা ভুল করেছে। শেখ মুজিবকে কবর দিতে অ্যালাও করা ঠিক হয়নি। এখন তো সেখানে মাজার হবে। উচিত ছিল লাশটা বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেয়া।”’
১৯৭৬ সালে কারাভ্যন্তরে গোপন প্রহসন বিচারের জবানবন্দিতে
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে তাহের বলেন,
‘সকাল ১১টা ৩০ মিনিটের দিকে গভীর উদ্বেগ নিয়ে আমি বাংলাদেশ বেতারের কার্যালয় থেকে বের হই। ধারণা করলাম, জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কোনো বিদেশি শক্তি জড়িত।... ১৭ আগস্ট আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়, পুরো ঘটনাটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মদদে ঘটেছে। খন্দার মোশতাকও এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। এই গ্রুপটি আগে থেকেই সব ঠিকঠাক করে রেখেছিল।’ (‘At 11:30 in the morning I left Bangladesh Betar with a feeling of deep concern. I sensed that some outside power was involved in the killing of the Father of the Nation. [...] On August 17, it became clear to me that the whole game was backed by the United States of America and Pakistan. I also understood that Khondokar Mushtaque was directly involved in the killing of Sheikh Mujib. This group it was also clear, had a pre-determined course set for them.’)- ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত Economic and Political Weekly 33/34, p. 1350-1351)।
তাহের যখন বলছেন, ‘ফাদার অব নেশন’, সেখানে ওপরে কথিত ‘উচিত ছিল লাশটা বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেয়া’ যে কোন স্তরের মিথ্যা, তা সহজেই অনুমেয়। কর্নেল তাহের রাজনৈতিকভাবে বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করেছেন, কোনো ষড়যন্ত্র করেননি, ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুকে সাবধান করেছেন (১৯৭২ সালের ২২ সেপ্টেম্বরে লেখা তাহেরের পদত্যাগপত্র, মার্শাল ল ট্রাইব্যুনালে তাহেরের জবানবন্দি দ্রষ্টব্য)। তাহের রাজনৈতিক বিরোধিতা সত্ত্বেও অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করতেন জাতির জনককে।
আমি মুক্তিযুদ্ধের সময় সেক্টর কমান্ডারের স্টাফ অফিসার এবং পরে সব কর্মের সাথি হিসেবে ছায়ার মতো কর্নেল তাহেরের পাশে থেকেছি। নঈম জাহাঙ্গীর নামের কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে তাহের ভাইয়ের বাসায় কখনো দেখিনি। খবর নিয়ে জানলাম, বিভিন্ন সময়ে বিএনপি এবং নানা সংগঠনের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। আমার ভাবি সংসদ সদস্য লুতফা তাহেরও তাঁর কথা কিছুই জানেন না। সর্বোপরি আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা সাংসদ ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল বীর প্রতীক প্রথম আলোর সংবাদ পড়ে মোবাইল ফোনে তাঁকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে নঈমও বলেন এসব ‘লুজ টক’। বিশদ কিছু না বলে তিনি ফোন কেটে দেন। সেসব ‘লুজ টকের’ বরাত দিয়ে মহিউদ্দিনের নানা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আবিষ্কার জনমনে কী বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে, একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দৈনিক কি তা ভাববে না?
এমন উদ্ভট বক্তব্য আরও আছে। জেনারেল জিয়ার সঙ্গে নাকি আমার ছোট ভাই ‘বাহারের সখ্য ছিল।... ছুটির দিনে প্রায়ই জিয়া সস্ত্রীক নারায়ণগঞ্জে তাহেরের বাসায় চলে যেতেন। বাহার ছিলেন জিয়ার খুবই প্রিয় এবং জিয়া ও বাহার পরস্পরকে ‘দোস্ত’ বলে সম্বোধন করতেন। এমন অবাস্তব বক্তব্যও মহিউদ্দিন লিখেছেন। বাস্তব সত্য হলো, কখনো জেনারেল জিয়া নিজে বা সস্ত্রীক নারায়ণগঞ্জে তাহেরের বাসায় আসেননি।
এই কিস্তিতে মহিউদ্দিন বলেন, ‘কর্নেল তাহের সম্ভবত জানতেন না, ১৫ আগস্ট তারিখটিই অভ্যুত্থানের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে আছে। তবে এ রকম একটা ঘটনা যে ঘটতে পারে, তা তাঁর অজানা থাকার কথা নয়।’ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে কত তদন্ত, বছরের পর বছর ধরে সাক্ষী-সওয়াল-জবাব, জজকোর্ট, হাইকোর্ট, আপিল বিভাগ পেরিয়ে রায় হলো। কোথাও তাহেরের সংশ্লিষ্টতা নেই। আর এখন মহিউদ্দিন সাহেব যিনি ছাত্রলীগ, জাসদ বা গণবাহিনীর কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদেও ছিলেন না, তিনি এমন রায় দিয়ে দিলেন!
১২ আগস্ট তারিখে প্রকাশিত ‘তাজউদ্দীন খুনিদের প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন’ শিরোনামের কিস্তিতে মহিউদ্দিন বলেন, ‘পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে আসবেন …আনোয়ার তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার হিসেবে কর্মরত। রসায়ন তিনি ভালো বোঝেন। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের আগমন যাতে নির্বিঘ্ন না হয়, সে জন্য তাঁর নির্দেশে গণবাহিনীর সদস্যরা ১৪ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে তিনটি “নিখিল” ফোটায়।’ এই নির্জলা মিথ্যা তিনি অবলীলায় বলে দেন কোনো তথ্য–প্রমাণ ছাড়াই।
জনাব মহিউদ্দিনের গল্পের যে কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা নেই তা ওপরের কয়েকটি উদাহরণ থেকে পাঠক বুঝতে পারবেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে এমন শক্তি, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও জাসদ যে আজ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, তাকে ভেঙে ফেলা এবং জিয়াউর রহমানকে মহিমান্বিত করার এক গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে যে মহিউদ্দিনের এই প্রকল্প ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, সময়ই তা বলে দেবে।
মো. আনোয়ার হোসেন: অধ্যাপক, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
কদিন ধরে মন ছিল বিষণ্ণ। প্রথম আলো ও মানবজমিন পত্রিকায় কয়েক কিস্তিতে কর্নেল তাহের ও আমার সম্পর্কে কিছু নির্জলা মিথ্যা ও বানোয়াট কল্পকাহিনি প্রকাশিত হয়েছে। তা-ও শোকের মাস আগস্টে। চমক হিসেবে হয়তো শেষ কিস্তি ছাপা হয়েছে ১৫ আগস্ট কালরাত্রির আগের দিন। আমি ক্ষুদ্র ব্যক্তি, নিতান্ত সাধারণ। আমার সম্পর্কে মিথ্যাচারে দেশ ও জাতির তেমন কিছু এসে-যায় না। কিন্তু কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম সাধারণ ব্যক্তি নন। অসাধারণ তিনি হয়ে উঠেছেন নিজ কর্ম দিয়ে। তা কেউ করে দেয়নি। জীবনও দিয়েছেন আপন বিশ্বাসে অটল ও পবিত্র থেকে।
আর সেই মৃত মানুষটিকে নিয়ে নির্জলা মিথ্যাচার ও নিম্নমানের কল্পকাহিনি প্রথম আলো পত্রিকায়! গণতান্ত্রিক সমাজে মত প্রকাশের স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কথা থাকে এই যে প্রকাশিত মতটি যুক্তিনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর কি না; বিনা অপরাধে অন্যকে তা আঘাত করে কি না, অন্যায়ভাবে তাঁর মান-মর্যাদা ও অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কি না; দায়িত্বশীল সংবাদপত্র তা পর্যালোচনা করে কিছু প্রকাশের আগে।
সমাজের অসংগতি ও অবিচার বিষয়ে প্রথম আলো নানা সময়ে কথা বলেছে। সত্য প্রকাশে সহায়তা করেছে। অন্যায়ভাবে তাহেরকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা; তাঁর বিরুদ্ধে তাহের পরিবারের আইনি লড়াই বিষয়ে প্রথম আলোর ভূমিকা আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। জনাব মহিউদ্দিন আহমদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অসত্য লেখাকে প্রথম আলো প্রশ্রয় দিয়েছে, এটা বেদনাদায়ক।
১৪ আগস্ট প্রথম আলোয় ‘বাকশালকে বাদ দিয়ে তাহেরের জাতীয় সরকার?’ কিস্তির শিরোনামটি দেখুন। জাসদ বা তার মুখ্য নেতা সিরাজুল আলম খান নন, ‘তাহেরের জাতীয় সরকার!’ সত্য হলো, তাহের যা কিছু করেছেন তা দলীয় সিদ্ধান্তেই করেছেন। বলা হয়েছে, ‘সন্ধ্যায় খন্দকার মোশতাক আহমদ বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তাহের উপস্থিত ছিলেন।’ এটা সর্বৈব মিথ্যা। তাহের সেখানে ছিলেন না।
এই কিস্তিতে শুরুতেই জাসদ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বর্তমানে একটি এনজিওর প্রধান আবুল হাসিব খানের কথা বলা হয়েছে। ১৫ আগস্ট সকালে মুহসীন হলের ছাত্র নূর মোহাম্মদ নাকি আমার চিরকূট দিয়েছেন আবুল হাসিবকে, যাতে গণবাহিনীর জরুরি সভার কথা উল্লেখ ছিল। আবুল হাসিব খানকে আমি নিজেই ফোন করেছি। তিনি বলেছেন, ‘এসব লুজ টক’। নূর মোহাম্মদ পরে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে পুলিশের সর্বোচ্চ আইজি পদ অলংকৃত করেন। তিনি তো বেঁচে আছেন। তিনিই বলুন মহিউদ্দিনের এসব কথা সঠিক কি না।
গণবাহিনীতে আমার সক্রিয় অবস্থান কোনো অজানা বিষয় নয়। ইতিমধ্যে প্রকাশিত দুটি পুস্তকে (মাওলা ব্রাদার্স প্রকাশিত তাহেরের স্বপ্ন এবং আগামী প্রকাশিত মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ৭ই নভেম্বর অভ্যুত্থানে কর্নেল তাহের) তার অনুপুঙ্খ বিবরণ আছে। সামান্য বিচার-বুদ্ধি থাকলে জনাব মহিউদ্দিন আমার প্রকাশিত পুস্তকের ভাষ্য থেকে জানতেন গণবাহিনীর মতো গোপন সংগঠনে ভাই, ভাইজান—এসব সম্বোধনের এবং তাঁর উক্তি উদ্ধৃত করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তাই মহিউদ্দিনের ভাষ্য, ‘সভা শুরু হলে আনোয়ার হোসেন উপস্থিত সবাইকে বলেন, ভাইজান (লে. কর্নেল আবু তাহের) সকালে রেডিও স্টেশনে গিয়েছিলেন। তিনি মেজর ডালিমকে বকাঝকা করে বলেছেন, ‘... মেজর হয়েছ, এখন পর্যন্ত একটা মার্শাল ল প্রক্লেমেশন ড্রাফট করতে পারলে না। জান, কাল ইউনিভার্সিটিতে কারা বোমা ফাটিয়েছে? দে আর মাই বয়েজ’—এসব যে সম্পূর্ণ বানোয়াট ও হাস্যকর, তা নিশ্চয়ই পাঠক বুঝবেন।
১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা নঈম জাহাঙ্গীরের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ‘১৭ আগস্ট সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নঈম জাহাঙ্গীর নারায়ণগঞ্জে তাহেরের বাসায় যান পরিস্থিতি সম্পর্কে আঁচ করতে। ১৯৭১ সালে নঈম ১১ নম্বর সেক্টরে তাহেরের সহযোদ্ধা ছিলেন এবং প্রায়ই তাঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতেন। তাহের আক্ষেপ করে নঈমকে বললেন, “ওরা বড় রকমের একটা ভুল করেছে। শেখ মুজিবকে কবর দিতে অ্যালাও করা ঠিক হয়নি। এখন তো সেখানে মাজার হবে। উচিত ছিল লাশটা বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেয়া।”’
১৯৭৬ সালে কারাভ্যন্তরে গোপন প্রহসন বিচারের জবানবন্দিতে
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে তাহের বলেন,
‘সকাল ১১টা ৩০ মিনিটের দিকে গভীর উদ্বেগ নিয়ে আমি বাংলাদেশ বেতারের কার্যালয় থেকে বের হই। ধারণা করলাম, জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কোনো বিদেশি শক্তি জড়িত।... ১৭ আগস্ট আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়, পুরো ঘটনাটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মদদে ঘটেছে। খন্দার মোশতাকও এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। এই গ্রুপটি আগে থেকেই সব ঠিকঠাক করে রেখেছিল।’ (‘At 11:30 in the morning I left Bangladesh Betar with a feeling of deep concern. I sensed that some outside power was involved in the killing of the Father of the Nation. [...] On August 17, it became clear to me that the whole game was backed by the United States of America and Pakistan. I also understood that Khondokar Mushtaque was directly involved in the killing of Sheikh Mujib. This group it was also clear, had a pre-determined course set for them.’)- ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত Economic and Political Weekly 33/34, p. 1350-1351)।
তাহের যখন বলছেন, ‘ফাদার অব নেশন’, সেখানে ওপরে কথিত ‘উচিত ছিল লাশটা বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেয়া’ যে কোন স্তরের মিথ্যা, তা সহজেই অনুমেয়। কর্নেল তাহের রাজনৈতিকভাবে বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করেছেন, কোনো ষড়যন্ত্র করেননি, ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুকে সাবধান করেছেন (১৯৭২ সালের ২২ সেপ্টেম্বরে লেখা তাহেরের পদত্যাগপত্র, মার্শাল ল ট্রাইব্যুনালে তাহেরের জবানবন্দি দ্রষ্টব্য)। তাহের রাজনৈতিক বিরোধিতা সত্ত্বেও অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করতেন জাতির জনককে।
আমি মুক্তিযুদ্ধের সময় সেক্টর কমান্ডারের স্টাফ অফিসার এবং পরে সব কর্মের সাথি হিসেবে ছায়ার মতো কর্নেল তাহেরের পাশে থেকেছি। নঈম জাহাঙ্গীর নামের কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে তাহের ভাইয়ের বাসায় কখনো দেখিনি। খবর নিয়ে জানলাম, বিভিন্ন সময়ে বিএনপি এবং নানা সংগঠনের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। আমার ভাবি সংসদ সদস্য লুতফা তাহেরও তাঁর কথা কিছুই জানেন না। সর্বোপরি আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা সাংসদ ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল বীর প্রতীক প্রথম আলোর সংবাদ পড়ে মোবাইল ফোনে তাঁকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে নঈমও বলেন এসব ‘লুজ টক’। বিশদ কিছু না বলে তিনি ফোন কেটে দেন। সেসব ‘লুজ টকের’ বরাত দিয়ে মহিউদ্দিনের নানা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আবিষ্কার জনমনে কী বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে, একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দৈনিক কি তা ভাববে না?
এমন উদ্ভট বক্তব্য আরও আছে। জেনারেল জিয়ার সঙ্গে নাকি আমার ছোট ভাই ‘বাহারের সখ্য ছিল।... ছুটির দিনে প্রায়ই জিয়া সস্ত্রীক নারায়ণগঞ্জে তাহেরের বাসায় চলে যেতেন। বাহার ছিলেন জিয়ার খুবই প্রিয় এবং জিয়া ও বাহার পরস্পরকে ‘দোস্ত’ বলে সম্বোধন করতেন। এমন অবাস্তব বক্তব্যও মহিউদ্দিন লিখেছেন। বাস্তব সত্য হলো, কখনো জেনারেল জিয়া নিজে বা সস্ত্রীক নারায়ণগঞ্জে তাহেরের বাসায় আসেননি।
এই কিস্তিতে মহিউদ্দিন বলেন, ‘কর্নেল তাহের সম্ভবত জানতেন না, ১৫ আগস্ট তারিখটিই অভ্যুত্থানের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে আছে। তবে এ রকম একটা ঘটনা যে ঘটতে পারে, তা তাঁর অজানা থাকার কথা নয়।’ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে কত তদন্ত, বছরের পর বছর ধরে সাক্ষী-সওয়াল-জবাব, জজকোর্ট, হাইকোর্ট, আপিল বিভাগ পেরিয়ে রায় হলো। কোথাও তাহেরের সংশ্লিষ্টতা নেই। আর এখন মহিউদ্দিন সাহেব যিনি ছাত্রলীগ, জাসদ বা গণবাহিনীর কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদেও ছিলেন না, তিনি এমন রায় দিয়ে দিলেন!
১২ আগস্ট তারিখে প্রকাশিত ‘তাজউদ্দীন খুনিদের প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন’ শিরোনামের কিস্তিতে মহিউদ্দিন বলেন, ‘পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে আসবেন …আনোয়ার তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার হিসেবে কর্মরত। রসায়ন তিনি ভালো বোঝেন। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের আগমন যাতে নির্বিঘ্ন না হয়, সে জন্য তাঁর নির্দেশে গণবাহিনীর সদস্যরা ১৪ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে তিনটি “নিখিল” ফোটায়।’ এই নির্জলা মিথ্যা তিনি অবলীলায় বলে দেন কোনো তথ্য–প্রমাণ ছাড়াই।
জনাব মহিউদ্দিনের গল্পের যে কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা নেই তা ওপরের কয়েকটি উদাহরণ থেকে পাঠক বুঝতে পারবেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে এমন শক্তি, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও জাসদ যে আজ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, তাকে ভেঙে ফেলা এবং জিয়াউর রহমানকে মহিমান্বিত করার এক গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে যে মহিউদ্দিনের এই প্রকল্প ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, সময়ই তা বলে দেবে।
মো. আনোয়ার হোসেন: অধ্যাপক, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments