বাঙালির বিদ্যাভ্যাস ও পরীক্ষায় পাস-ফেল by সৈয়দ আবুল মকসুদ
যুগে যুগে বাঙালির আনন্দ-উল্লাস ও দুঃখ-শোক প্রকাশের ধরন বদলায়। ১৯৪৪ বা ৫৪ কিংবা ৬৪-তে বাঙালি যে ভঙ্গিতে আনন্দ-উল্লাস করত, ২০০৪ বা ২০১৪-তে সে ভঙ্গিতে করবে না। ভিজ্যুয়াল মিডিয়া আজ মানুষকে বদলে দিয়েছে। কারও আনন্দ-উল্লাস প্রকাশের দৃশ্যও আজ একটি পণ্য। জীবনের সবকিছুই—সুখ ও দুঃখ—আজ বিক্রয়যোগ্য পণ্য।
নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী তর্জনী ও মধ্যমা ফাঁক করে ইংরেজি ‘ভি’ চিহ্ন দেখাতেন। এখন পরীক্ষায় যারা ভালো ফল করছেন, তাঁরাও আনন্দ প্রকাশের অতীতের সব পদ্ধতি বাতিল করে সম্মিলিতভাবে ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে আনন্দ প্রকাশ করছেন। আনন্দ একটি ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে, কারও কারও আনন্দ-উল্লাসের দৃশ্য পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেলের জন্য বিশেষ প্রয়োজন। রেডিওর সম্প্রচার চোখে দেখা যায় না বলে আজ তার দাম নেই।
আনুষ্ঠানিক হাসি-কান্না শুধু বাঙালিরই রয়েছে। আনুষ্ঠানিক কান্না ও শোক প্রকাশের জন্য বাঙালির প্রয়োজন শুধু একটি জুতসই উপলক্ষ। কবি শামসুর রাহমানের মৃত্যুর সময় হাসপাতালের বারান্দায় তাঁর অনেক গুণগ্রাহী ও কবি-সাহিত্যিক ছিলেন। কবির শেষনিঃশ্বাস ত্যাগের কথা শুনে নয়, ঘণ্টা খানেক পরে কয়েকটি টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা তাঁর দিকে আসায় শামসুর রাহমানের সমসাময়িক এক কবি-কথাশিল্পীর কান্নার বেগ অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। টিভি ক্যামেরা সরে যেতেই তাঁর শোক প্রশমিত হয়।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা তাঁদের শাসনব্যবস্থা পাকাপোক্ত করতে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। সেই পদ্ধতিটিই মোটামুটি চালু রয়েছে ভারত ও বাংলাদেশে। গত ৫০ বছরে তার কিছু সংস্কার হয়েছে, তবে অধঃপতনই হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যাচর্চা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় পাস ও ফেল। বালক-বালিকাকে বিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট বিষয়ে পাঠদান করা হয়। নির্দিষ্ট সময়ের পর তারা কতটা বিদ্যা অর্জন করেছে, তার একটা পরীক্ষা নেওয়া হয়। সেই পরীক্ষায় কেউ উত্তীর্ণ হয়, কেউ বা অকৃতকার্য। যার প্রচলিত নাম পাস বা ফেল। ফেলের কোনো ডিভিশন বা গ্রেড নেই, কিন্তু পাসের ডিভিশন বা গ্রেড রয়েছে। এই উপমহাদেশে পরীক্ষায় অতি ভালো ফলাফল করে কেউ আনন্দ-উল্লাস করতে গিয়ে বুক ফেটে মারা যায়নি। কিন্তু পরীক্ষায় ফেল করে গত ১০০ বছরে আত্মহত্যা করেছে অন্তত হাজার খানেক ছাত্রছাত্রী। দুঃখে হার্টফেল করে মারা গেছেন বহু বাবা-মা।
আশির দশকের প্রথম দিকে একবার স্ত্রী-ছেলেমেয়েকে নিয়ে গ্রামে যাচ্ছিলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। গ্রামের ভেতর দিয়ে সড়ক। এক বাড়ি থেকে সমস্বরে কান্নার রোল শোনা গেল। সেটি আমার পরিচিত বাড়ি। মনে হলো, কেউ মারা গেছে। গেলাম বাড়ির ভেতরে। শুনলাম, ওই বাড়ির এক শরিকের ছেলেটি এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল। পাস করতে পারেনি। আগেরবারও সে ফেল করেছে। ছেলেটির বাবা অনেক আশা নিয়ে স্কুলে গিয়েছিলেন, শুনবেন, ছেলে এবার পাস করেছে। ফেল করার কথা শুনে বিষণ্ন মনে বাড়ি ফিরছিলেন। কেউ একজন বলল, গরু বাঁধার একটি মোটা দড়ি নিয়ে তাঁর ছেলেকে গ্রামের প্রান্তে গাছপালার দিকে যেতে দেখেছে। ফেলের শোকের মধ্যে ছেলের দড়ি হাতে আম-জাম বাগানের দিকে যাওয়ার কথা শুনে তিনি রাস্তার মধ্যেই লুটিয়ে পড়েন। ধরাধরি করে তাঁকে বাড়িতে আনা হয়। অবস্থা খুবই খারাপ। আমি যখন দেখি, তখন তিনি অচেতন। এক দিন কি দুই দিন পর ওই বাড়ি থেকে দ্বিতীয়বার কান্নার রোল শোনা যায়। ফেল করা ছেলে নয়, তার বাবাই চিরবিদায় নিয়েছেন।
এবার এসএসসি ও এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় অকৃতকার্য ১৫ থেকে ১৬টি ছেলেমেয়ে আত্মহত্যা করেছে। এসব আত্মহত্যার কথা শুনে খুব খারাপ লাগে। মনে হয় আমরাই—আমাদের সমাজ—তাদের আত্মহত্যার জন্য দায়ী। আমরা পরীক্ষায় ভালো ফলাফলকে অতি মাত্রায় গুরুত্ব দিয়ে হইচই করি বলেই তারা লজ্জায় আত্মহননের পথ বেছে নেয়। বিদ্যার্জন সম্পর্কে আমাদের ধারণা বৈষয়িক বলেই পাস-ফেল নিয়ে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। দেশে গণতন্ত্র নেই, কিন্তু পাস-ফেল একটি রাজনৈতিক বিষয়।
নব্বইয়ের শুরুতে আজকের কাগজ-এ কলাম লিখতাম। তখন আমি কৌতূহলবশত একটি সমীক্ষা করে লিখেছিলাম। ১৯৪৬ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত কুড়ি বছরে ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েটে যাঁরা প্রথম ১০ জনের মধ্যে ছিলেন, তেমন ২০০ জন কর্মজীবনে কে কী হয়েছিলেন, তার অনুসন্ধান করেছিলাম। যাঁরা ম্যাট্রিক ও আইএ, আইএসসি ও আইকমে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হয়েছিলেন, তাঁদেরও খোঁজ করেছিলাম। ৩০০-এর মধ্যে ১১ জন জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, যদি মন্ত্রণালয়ের সচিব বা পিডব্লিউডি/ সড়ক ও জনপথের প্রধান বা তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হওয়া সাফল্যজনক বিষয় হয়ে থাকে। কেউ কেউ শিক্ষা বিভাগে গিয়েছিলেন, কিন্তু সমাজে তাঁদের দাম ছিল না।
পরীক্ষায় ভালো ফল করা খুবই গৌরবের কথা। কিন্তু ফেল করলেই জীবন ব্যর্থ হয়ে গেল, এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। বাংলা ভাষার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গদ্যলেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলায় ফেল করেছিলেন। ১৮৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বিএ পরীক্ষা প্রবর্তন করে। প্রথম বছর বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম ও বার্মা (মিয়ানমার) থেকে ১৩ জন পরীক্ষা দিয়েছিলেন। পাস করেছিলেন দুজন এবং ফেল করেছিলেন ১১ জন। টেনেটুনে দ্বিতীয় বিভাগে যে দুজন পাস করেছিলেন, তাঁরা হলেন যদুনাথ বসু ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্থান অধিকারী গ্র্যাজুয়েট যদুনাথ বাবু কোথায়? আর বঙ্কিমচন্দ্র কোথায়?
বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু প্রথমবার বিএ পরীক্ষায় ফেল করেন। তাঁর পরবর্তীকালের বিএসসি, এমএসসি, ডিএসসির কাজ ঈর্ষণীয়। বিশ শতকের উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসক স্যার নীলরতন সরকার (আমাদের বাংলাদেশের মানুষ) কোনোরকমে বিএ পাস করে চাতরা হাইস্কুলে শিক্ষকতা করছিলেন। তাঁর মনে হলো, মানুষের সেবা করতে ডাক্তারি পড়া দরকার। স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৮৮৫ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। শুনেছি, তাঁকে লন্ডনে গিয়ে এমডি পড়ার জন্য এক অজ্ঞাত হিন্দু বিধবা অর্থসাহায্য করেছিলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন আর জি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, কুমুদশঙ্কর যক্ষ্মা হাসপাতাল, চিত্তরঞ্জন হাসপাতাল প্রভৃতি। তিনি ছিলেন সর্বভারতীয় মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। মৃত্যুর পর তাঁর নামে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ’। প্রথম জীবনে এন্ট্রান্স, আইএ, বিএ পরীক্ষায় তেমন ভালো ফল করেননি। কোনো পরীক্ষায় পাস করে ‘ভি’ চিহ্ন দেখানোর সৌভাগ্য স্যার নীলরতনের হয়নি। কিন্তু তাঁর মেধা ছিল, সংকল্প ছিল আর ছিল মানুষ ও জাতির কল্যাণ করার অনমনীয় স্পৃহা।
১৮৪০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত বাঙালির শিক্ষার মান ছিল বিশ্বমানের, নিশ্চয়ই ইউরোপের মতো নয়, কিন্তু অধিকাংশ কমনওয়েলথ দেশের চেয়ে নিচে নয়। উন্নত ছিল সেকালের কি স্কুল-কলেজের শিক্ষা, কি মাদ্রাসার শিক্ষা৷ উপমহাদেশের প্রথম শ্রেষ্ঠ মুসলমান পদার্থবিজ্ঞানী মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা ছিলেন মাদ্রাসার ছাত্র। প্রাবন্ধিক-কথাশিল্পী আবুল ফজল এবং ঔপন্যাসিক শওকত ওসমান মাদ্রাসায় পড়েছেন। কলকাতা ও ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষা ছিল আন্তর্জাতিক মানের। শুনলে অনেকে অবাক হবেন, ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার একজন প্রিন্সিপাল ছিলেন হিন্দু। বহু মেধাবী ছাত্র বেরিয়েছেন আলিয়া মাদ্রাসা ও অন্যান্য মাদ্রাসা থেকে। এখনকার মাদ্রাসাশিক্ষার মান সম্পর্কে আমার মতো অল্প শিক্ষিত লোকের ধারণা নেই, কামরাঙ্গীরচরের মানুষ ভালো জানেন।
গতবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন ঢাকার কয়েকটি নামী স্কুলে গিয়েছিলাম। একটি স্কুল ও কলেজে গিয়ে দেখি, মেয়েরা হাসাহাসি করে স্বাভাবিকভাবে গল্প-গুজব করছে। এসব পাবলিক পরীক্ষা জীবনের দরজা খুলে দেয়। এর পরই উচ্চতর শিক্ষাজীবনে তারা প্রবেশ করবে। এ এক মহা-আনন্দের দিন। গাছতলায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। এমন সময় বিকট হইচই দল বেঁধে। লাফালাফি, হট্টগোল। পেছনে তাকিয়ে দেখি, তিনটি টিভি চ্যানেলের সংবাদকর্মীরা উপস্থিত। পরিস্থিতি সামাল দেওয়া তাঁদের পক্ষেও কঠিন হয়ে গেল। তারা কোমলমতি। তাদের দোষ নেই। যেখানে মন্ত্রী ও বড় বড় দলের নেতারা ক্যামেরা দেখলে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন, অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়েরা তা থেকে শিখবে না কেন?
এখন যাঁরা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করলেন, তাঁদের প্রায় সবাই সাত-আট বছরের মধ্যে কর্মজীবনে প্রবেশ করবেন। কেউ হবেন চিকিৎসক, কেউ প্রকৌশলী-স্থপতি, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা প্রভৃতি। কুড়ি থেকে পঁচিশ বছরের মধ্যে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব বর্তাবে তাঁদের ওপর। কেউ হবেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক, কলেজের অধ্যক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সেনাবাহিনীর জেনারেল, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসক, পোশাকশিল্প ও কলকারখানার মালিক। যাঁরা কোনো কিছুই হতে পারবেন না, তাঁরা পত্রিকায় কলাম লিখবেন। যাঁরা খুব বুদ্ধিমান, তাঁরা সরকারকে প্রবল প্রশংসা করে লিখবেন। সরকারের প্রতিটি কাজকে সমর্থন দেবেন। আহাম্মক গোছের যাঁরা, তাঁরা সরকারের সব ব্যাপারেই সমালোচনা করবেন।
আজকের তরুণ-তরুণীদের কেউ রাজনীতিতে যাবেন। প্রথমে সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনে। তারপর যুব সংগঠনে। তারপর উপজেলা চেয়ারম্যান বা সংসদ সদস্য। শেষ পর্যন্ত মন্ত্রী। কারও দুদকে ডাক পড়বে। সবার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি। তবে এ কথাও বলি, যে শিক্ষা আপনকে পর করে, শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে, সে শিক্ষা নিয়ে কী লাভ? যে চিকিৎসক ঢাকা মেডিকেল থেকে পাস করে একটি বছরও তাঁর গ্রামের মানুষকে চিকিৎসা দেবেন না, তাঁর ভালো ফলাফলে গ্রামের মানুষের অহংকার করার কী আছে?
বাংলাদেশকে অধ্যবসায়, পরিশ্রম ও আত্মবিশ্বাসের দ্বারা একটি মর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্রে পরিণত করার দায়িত্ব আজ যাঁরা মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন, তাঁদের। তখন সারা দেশের মানুষ আনন্দ করবে। সে আনন্দ ক্যামেরানির্ভর নয়। নির্মল আনন্দ। বাধ্যতামূলক আনন্দ-উল্লাস নয়। নির্মল আনন্দ আপনা-আপনি উদ্ভাসিত হয় চোখেমুখে স্বর্গীয় আভার মতো। সুদর্শন গুটি কয়েকের মধ্যে কৃত্রিম আনন্দ-উল্লাস নয়, ১৬ কোটির চোখেমুখে সেই আনন্দের আভা দেখতে চাই।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী তর্জনী ও মধ্যমা ফাঁক করে ইংরেজি ‘ভি’ চিহ্ন দেখাতেন। এখন পরীক্ষায় যারা ভালো ফল করছেন, তাঁরাও আনন্দ প্রকাশের অতীতের সব পদ্ধতি বাতিল করে সম্মিলিতভাবে ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে আনন্দ প্রকাশ করছেন। আনন্দ একটি ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে, কারও কারও আনন্দ-উল্লাসের দৃশ্য পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেলের জন্য বিশেষ প্রয়োজন। রেডিওর সম্প্রচার চোখে দেখা যায় না বলে আজ তার দাম নেই।
আনুষ্ঠানিক হাসি-কান্না শুধু বাঙালিরই রয়েছে। আনুষ্ঠানিক কান্না ও শোক প্রকাশের জন্য বাঙালির প্রয়োজন শুধু একটি জুতসই উপলক্ষ। কবি শামসুর রাহমানের মৃত্যুর সময় হাসপাতালের বারান্দায় তাঁর অনেক গুণগ্রাহী ও কবি-সাহিত্যিক ছিলেন। কবির শেষনিঃশ্বাস ত্যাগের কথা শুনে নয়, ঘণ্টা খানেক পরে কয়েকটি টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা তাঁর দিকে আসায় শামসুর রাহমানের সমসাময়িক এক কবি-কথাশিল্পীর কান্নার বেগ অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। টিভি ক্যামেরা সরে যেতেই তাঁর শোক প্রশমিত হয়।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা তাঁদের শাসনব্যবস্থা পাকাপোক্ত করতে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। সেই পদ্ধতিটিই মোটামুটি চালু রয়েছে ভারত ও বাংলাদেশে। গত ৫০ বছরে তার কিছু সংস্কার হয়েছে, তবে অধঃপতনই হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যাচর্চা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় পাস ও ফেল। বালক-বালিকাকে বিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট বিষয়ে পাঠদান করা হয়। নির্দিষ্ট সময়ের পর তারা কতটা বিদ্যা অর্জন করেছে, তার একটা পরীক্ষা নেওয়া হয়। সেই পরীক্ষায় কেউ উত্তীর্ণ হয়, কেউ বা অকৃতকার্য। যার প্রচলিত নাম পাস বা ফেল। ফেলের কোনো ডিভিশন বা গ্রেড নেই, কিন্তু পাসের ডিভিশন বা গ্রেড রয়েছে। এই উপমহাদেশে পরীক্ষায় অতি ভালো ফলাফল করে কেউ আনন্দ-উল্লাস করতে গিয়ে বুক ফেটে মারা যায়নি। কিন্তু পরীক্ষায় ফেল করে গত ১০০ বছরে আত্মহত্যা করেছে অন্তত হাজার খানেক ছাত্রছাত্রী। দুঃখে হার্টফেল করে মারা গেছেন বহু বাবা-মা।
আশির দশকের প্রথম দিকে একবার স্ত্রী-ছেলেমেয়েকে নিয়ে গ্রামে যাচ্ছিলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। গ্রামের ভেতর দিয়ে সড়ক। এক বাড়ি থেকে সমস্বরে কান্নার রোল শোনা গেল। সেটি আমার পরিচিত বাড়ি। মনে হলো, কেউ মারা গেছে। গেলাম বাড়ির ভেতরে। শুনলাম, ওই বাড়ির এক শরিকের ছেলেটি এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল। পাস করতে পারেনি। আগেরবারও সে ফেল করেছে। ছেলেটির বাবা অনেক আশা নিয়ে স্কুলে গিয়েছিলেন, শুনবেন, ছেলে এবার পাস করেছে। ফেল করার কথা শুনে বিষণ্ন মনে বাড়ি ফিরছিলেন। কেউ একজন বলল, গরু বাঁধার একটি মোটা দড়ি নিয়ে তাঁর ছেলেকে গ্রামের প্রান্তে গাছপালার দিকে যেতে দেখেছে। ফেলের শোকের মধ্যে ছেলের দড়ি হাতে আম-জাম বাগানের দিকে যাওয়ার কথা শুনে তিনি রাস্তার মধ্যেই লুটিয়ে পড়েন। ধরাধরি করে তাঁকে বাড়িতে আনা হয়। অবস্থা খুবই খারাপ। আমি যখন দেখি, তখন তিনি অচেতন। এক দিন কি দুই দিন পর ওই বাড়ি থেকে দ্বিতীয়বার কান্নার রোল শোনা যায়। ফেল করা ছেলে নয়, তার বাবাই চিরবিদায় নিয়েছেন।
এবার এসএসসি ও এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় অকৃতকার্য ১৫ থেকে ১৬টি ছেলেমেয়ে আত্মহত্যা করেছে। এসব আত্মহত্যার কথা শুনে খুব খারাপ লাগে। মনে হয় আমরাই—আমাদের সমাজ—তাদের আত্মহত্যার জন্য দায়ী। আমরা পরীক্ষায় ভালো ফলাফলকে অতি মাত্রায় গুরুত্ব দিয়ে হইচই করি বলেই তারা লজ্জায় আত্মহননের পথ বেছে নেয়। বিদ্যার্জন সম্পর্কে আমাদের ধারণা বৈষয়িক বলেই পাস-ফেল নিয়ে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। দেশে গণতন্ত্র নেই, কিন্তু পাস-ফেল একটি রাজনৈতিক বিষয়।
নব্বইয়ের শুরুতে আজকের কাগজ-এ কলাম লিখতাম। তখন আমি কৌতূহলবশত একটি সমীক্ষা করে লিখেছিলাম। ১৯৪৬ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত কুড়ি বছরে ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েটে যাঁরা প্রথম ১০ জনের মধ্যে ছিলেন, তেমন ২০০ জন কর্মজীবনে কে কী হয়েছিলেন, তার অনুসন্ধান করেছিলাম। যাঁরা ম্যাট্রিক ও আইএ, আইএসসি ও আইকমে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হয়েছিলেন, তাঁদেরও খোঁজ করেছিলাম। ৩০০-এর মধ্যে ১১ জন জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, যদি মন্ত্রণালয়ের সচিব বা পিডব্লিউডি/ সড়ক ও জনপথের প্রধান বা তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হওয়া সাফল্যজনক বিষয় হয়ে থাকে। কেউ কেউ শিক্ষা বিভাগে গিয়েছিলেন, কিন্তু সমাজে তাঁদের দাম ছিল না।
পরীক্ষায় ভালো ফল করা খুবই গৌরবের কথা। কিন্তু ফেল করলেই জীবন ব্যর্থ হয়ে গেল, এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। বাংলা ভাষার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গদ্যলেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলায় ফেল করেছিলেন। ১৮৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বিএ পরীক্ষা প্রবর্তন করে। প্রথম বছর বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম ও বার্মা (মিয়ানমার) থেকে ১৩ জন পরীক্ষা দিয়েছিলেন। পাস করেছিলেন দুজন এবং ফেল করেছিলেন ১১ জন। টেনেটুনে দ্বিতীয় বিভাগে যে দুজন পাস করেছিলেন, তাঁরা হলেন যদুনাথ বসু ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্থান অধিকারী গ্র্যাজুয়েট যদুনাথ বাবু কোথায়? আর বঙ্কিমচন্দ্র কোথায়?
বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু প্রথমবার বিএ পরীক্ষায় ফেল করেন। তাঁর পরবর্তীকালের বিএসসি, এমএসসি, ডিএসসির কাজ ঈর্ষণীয়। বিশ শতকের উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসক স্যার নীলরতন সরকার (আমাদের বাংলাদেশের মানুষ) কোনোরকমে বিএ পাস করে চাতরা হাইস্কুলে শিক্ষকতা করছিলেন। তাঁর মনে হলো, মানুষের সেবা করতে ডাক্তারি পড়া দরকার। স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৮৮৫ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। শুনেছি, তাঁকে লন্ডনে গিয়ে এমডি পড়ার জন্য এক অজ্ঞাত হিন্দু বিধবা অর্থসাহায্য করেছিলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন আর জি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, কুমুদশঙ্কর যক্ষ্মা হাসপাতাল, চিত্তরঞ্জন হাসপাতাল প্রভৃতি। তিনি ছিলেন সর্বভারতীয় মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। মৃত্যুর পর তাঁর নামে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ’। প্রথম জীবনে এন্ট্রান্স, আইএ, বিএ পরীক্ষায় তেমন ভালো ফল করেননি। কোনো পরীক্ষায় পাস করে ‘ভি’ চিহ্ন দেখানোর সৌভাগ্য স্যার নীলরতনের হয়নি। কিন্তু তাঁর মেধা ছিল, সংকল্প ছিল আর ছিল মানুষ ও জাতির কল্যাণ করার অনমনীয় স্পৃহা।
১৮৪০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত বাঙালির শিক্ষার মান ছিল বিশ্বমানের, নিশ্চয়ই ইউরোপের মতো নয়, কিন্তু অধিকাংশ কমনওয়েলথ দেশের চেয়ে নিচে নয়। উন্নত ছিল সেকালের কি স্কুল-কলেজের শিক্ষা, কি মাদ্রাসার শিক্ষা৷ উপমহাদেশের প্রথম শ্রেষ্ঠ মুসলমান পদার্থবিজ্ঞানী মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা ছিলেন মাদ্রাসার ছাত্র। প্রাবন্ধিক-কথাশিল্পী আবুল ফজল এবং ঔপন্যাসিক শওকত ওসমান মাদ্রাসায় পড়েছেন। কলকাতা ও ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষা ছিল আন্তর্জাতিক মানের। শুনলে অনেকে অবাক হবেন, ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার একজন প্রিন্সিপাল ছিলেন হিন্দু। বহু মেধাবী ছাত্র বেরিয়েছেন আলিয়া মাদ্রাসা ও অন্যান্য মাদ্রাসা থেকে। এখনকার মাদ্রাসাশিক্ষার মান সম্পর্কে আমার মতো অল্প শিক্ষিত লোকের ধারণা নেই, কামরাঙ্গীরচরের মানুষ ভালো জানেন।
গতবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন ঢাকার কয়েকটি নামী স্কুলে গিয়েছিলাম। একটি স্কুল ও কলেজে গিয়ে দেখি, মেয়েরা হাসাহাসি করে স্বাভাবিকভাবে গল্প-গুজব করছে। এসব পাবলিক পরীক্ষা জীবনের দরজা খুলে দেয়। এর পরই উচ্চতর শিক্ষাজীবনে তারা প্রবেশ করবে। এ এক মহা-আনন্দের দিন। গাছতলায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। এমন সময় বিকট হইচই দল বেঁধে। লাফালাফি, হট্টগোল। পেছনে তাকিয়ে দেখি, তিনটি টিভি চ্যানেলের সংবাদকর্মীরা উপস্থিত। পরিস্থিতি সামাল দেওয়া তাঁদের পক্ষেও কঠিন হয়ে গেল। তারা কোমলমতি। তাদের দোষ নেই। যেখানে মন্ত্রী ও বড় বড় দলের নেতারা ক্যামেরা দেখলে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন, অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়েরা তা থেকে শিখবে না কেন?
এখন যাঁরা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করলেন, তাঁদের প্রায় সবাই সাত-আট বছরের মধ্যে কর্মজীবনে প্রবেশ করবেন। কেউ হবেন চিকিৎসক, কেউ প্রকৌশলী-স্থপতি, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা প্রভৃতি। কুড়ি থেকে পঁচিশ বছরের মধ্যে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব বর্তাবে তাঁদের ওপর। কেউ হবেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক, কলেজের অধ্যক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সেনাবাহিনীর জেনারেল, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসক, পোশাকশিল্প ও কলকারখানার মালিক। যাঁরা কোনো কিছুই হতে পারবেন না, তাঁরা পত্রিকায় কলাম লিখবেন। যাঁরা খুব বুদ্ধিমান, তাঁরা সরকারকে প্রবল প্রশংসা করে লিখবেন। সরকারের প্রতিটি কাজকে সমর্থন দেবেন। আহাম্মক গোছের যাঁরা, তাঁরা সরকারের সব ব্যাপারেই সমালোচনা করবেন।
আজকের তরুণ-তরুণীদের কেউ রাজনীতিতে যাবেন। প্রথমে সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনে। তারপর যুব সংগঠনে। তারপর উপজেলা চেয়ারম্যান বা সংসদ সদস্য। শেষ পর্যন্ত মন্ত্রী। কারও দুদকে ডাক পড়বে। সবার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি। তবে এ কথাও বলি, যে শিক্ষা আপনকে পর করে, শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে, সে শিক্ষা নিয়ে কী লাভ? যে চিকিৎসক ঢাকা মেডিকেল থেকে পাস করে একটি বছরও তাঁর গ্রামের মানুষকে চিকিৎসা দেবেন না, তাঁর ভালো ফলাফলে গ্রামের মানুষের অহংকার করার কী আছে?
বাংলাদেশকে অধ্যবসায়, পরিশ্রম ও আত্মবিশ্বাসের দ্বারা একটি মর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্রে পরিণত করার দায়িত্ব আজ যাঁরা মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন, তাঁদের। তখন সারা দেশের মানুষ আনন্দ করবে। সে আনন্দ ক্যামেরানির্ভর নয়। নির্মল আনন্দ। বাধ্যতামূলক আনন্দ-উল্লাস নয়। নির্মল আনন্দ আপনা-আপনি উদ্ভাসিত হয় চোখেমুখে স্বর্গীয় আভার মতো। সুদর্শন গুটি কয়েকের মধ্যে কৃত্রিম আনন্দ-উল্লাস নয়, ১৬ কোটির চোখেমুখে সেই আনন্দের আভা দেখতে চাই।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments