মাহমুদুর রহমানের মন্তব্য প্রতিবেদনঃ অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তি
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মোগল ভারতে বাণিজ্য করতে এসে এক সময় উপমহাদেশের মালিক বনে গিয়েছিল। তাদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের প্রথম বলি আমরাই হয়েছিলাম। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি মীরজাফর এবং অন্যান্য সেনাপতি ক্ষমতার প্রলোভনে এবং ঘুষের বিনিময়ে বিশ্বাসঘাতকতা করলে পলাশীর প্রান্তরে ১৭৫৭ সালের চূড়ান্ত যুদ্ধে লর্ড ক্লাইভের নেতৃত্বে কোম্পানির বাহিনী অপ্রত্যাশিতভাবে জয়লাভ করে। দেশের স্বাধীনতা রক্ষার সেই যুদ্ধে মীরমদন এবং মোহনলাল অবশ্য ব্যতিক্রম ছিলেন। সেনাপতি মীরমদন যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হন। অপর দেশপ্রেমিক সেনাপতি মোহনলালের পরিণতি ইতিহাসের বই থেকে নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও নাটক, সিনেমায় তার ফাঁসি হয়েছিল বলেই দেখানো হয়ে থাকে। মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতামূলক তাবত্ কাজকর্মে সেই সময়কার বিত্তশালী ব্যবসায়ীরা মদত জুগিয়েছিলেন।
সেই ব্যবসায়ীদের অন্যতম ছিলেন ধনকুবের আমির চাঁদ বা উমিচাঁদ এবং জগেশঠ। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনার কাজে সহায়ক হবে মনে করেই তরুণ নবাব সিরাজের বেদনাবিধুর ইতিহাস নিয়ে আমার এই নাড়াচাড়া। পলাশী যুদ্ধপরবর্তী ১৯০ বছরে প্রথমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং ১৮৫৭ সালের মহান সিপাহী বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার পর ইংরেজ সরকার সরাসরি ভারতের শাসনভার গ্রহণ করে। এই বিশাল উপমহাদেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি দুই শতকে পর্যায়ক্রমে নানারকম কৌশল প্রয়োগ করেছিল। চারশ’ বছরব্যাপী মোগল সাম্রাজ্যের একেবারে শেষলগ্নে কেন্দ্রের দুর্বলতায় পলাশী যুদ্ধের আগেই উপমহাদেশ জুড়ে অনেক স্বাধীন রাজ্যের উত্থান ঘটেছিল। বাংলা করায়ত্ত করার পর এসব স্বাধীন রাজন্যবর্গকে পরাভূত করতে ব্রিটিশরা কখনও সরাসরি সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেছে, আবার কখনও বা বন্ধুত্বের ছলনায় একে একে রাজ্যসমূহ কুক্ষিগত করেছে। মিত্রতার নামে রাজ্য অধিকারে লর্ড কর্নওয়ালিসের অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তির কৌশল ইতিহাসের সব ছাত্রেরই জানা। মহীশুরের হায়দর আলী এবং তার পুত্র টিপু সুলতান তাদের জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অবশ্য ব্রিটিশদের সব ষড়যন্ত্র ও অপকৌশলের বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়ে যান। যুদ্ধ করতে করতে ‘মহীশুরের ব্যাঘ্র’ নামে আখ্যায়িত মহাবীর ও নিখাদ দেশপ্রেমিক টিপু সুলতান শহীদ হলে মহীশুরও সাম্রাজ্যবাদীদের করায়ত্ত হয়। যুদ্ধক্ষেত্রেই টিপু সুলতানের নিষ্প্রাণ দেহ পড়ে ছিল।
সে আরেক বীরত্ব ও দেশপ্রেমের মহান অথচ ট্র্যাজিক কাহিনী। বিশ্ব ইতিহাসে বীরত্বের অধিকাংশ কাহিনীই বোধহয় ট্র্যাজেডিতে শেষ হয়েছে। মহীশুরের ক্ষেত্রেও ইংরেজরা শঠতা ও বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিয়েছিল। টিপু সুলতান যখন সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে একাকী লড়ছেন, সেই মুহূর্তে নিজাম, পেশোয়া এবং মারাঠারা ইংরেজদের তল্পিবাহক হয়ে উচ্ছিষ্ট ঘরে তুলতে ব্যস্ত থেকেছে।
যাক সেসব কথা। ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সম্প্রসারণকালে ব্যবহৃত ‘Protectorate’ শব্দটি বর্তমানের শেখ হাসিনার বাংলাদেশে প্রাসঙ্গিক বলেই এত পুরনো কথার অবতারণা করলাম। আন্তর্জাতিক আইনে এই ইংরেজি ঢ়ত্ড়ঃবপঃড়ত্ধঃব শব্দটির আধুনিক যুগের সংজ্ঞা পাঠকের জ্ঞাতার্থে উদ্ধৃত করছি,
"It is an autonomous territory that is protected diplomatically or militarily against third parties by a stronger state. In exchange for this, the protectorate usually accepts specific obligations. However, it retains some measure of sovereignty."
(এটি এমন একটি ভূখণ্ড যা অপর একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র কর্তৃক কূটনৈতিক ও সামরিক নিরাপত্তা প্রদত্ত। এই নিরাপত্তা প্রদানের বিনিময়ে আশ্রিত রাষ্ট্রের কিছু দায়বদ্ধতা থাকে। যাই হোক, এই প্রকার ভূখণ্ডের খানিকটা সার্বভৌমত্ব রয়েছে) ঔপনিবেশিক আমলের ‘Colonial Protectorate’-এর ক্ষেত্রে অবশ্য আশ্রিত রাষ্ট্রের কোনোরকম সার্বভৌমত্বের বালাই ছিল না। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি Protectorate-এর দুই সংজ্ঞার মধ্যে বর্তমানে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, সেই বিষয় নিয়ে বিতর্ক উসকে দেয়ার উদ্দেশ্যেই আমার আজকের এই লেখা।
বাংলাদেশের চিন্তাশীল ও প্রকৃত স্বাধীনতাকামী নাগরিকদের কাছে ক্রমেই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, লাখ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে প্রাপ্ত স্বাধীন ভূখণ্ডটিকে ভারতের protectorate-এ পরিণত করার আকাঙ্ক্ষাতেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সে দেশের শাসকশ্রেণী সহায়তা প্রদান করেছিল। ইন্দিরা গান্ধীর মহত্ত্ব প্রদর্শন কিংবা বাংলাদেশের অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো ছিল সম্পূর্ণ গৌণ বিষয়। ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়ে লেখা গত দুই কিস্তির মন্তব্য প্রতিবেদনে বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ উদ্ধৃত করে ভারতের গুপ্ত বাসনার কথা যথাসাধ্য প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি। আজকের শেষ কিস্তিতে গত চল্লিশ বছরে দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত রাজনৈতিক চুক্তিগুলো নিয়ে খানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের চেষ্টা করব।
১৯৭২ সালের মার্চে স্বাক্ষরিত বাণিজ্য চুক্তি এবং প্রথম নৌ-ট্রানজিট চুক্তি, ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি এবং ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রতারণা করে ফারাক্কা বাঁধ চালুর সব প্রাসঙ্গিক দলিল গত দুই বুধবারে উপস্থাপন করেছি। আজ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালীন প্রণীত Framework Agreement নিয়েই মূলত আলোচনার ইচ্ছে থাকলেও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ধারাবাহিকতার বিষয়টি তুলে ধরার জন্য আবারও ১৯৭২ সালে ফিরে যেতে হচ্ছে। সে বছর ঢাকায় ইন্দিরা গান্ধীর সফরকালে ১৯ মার্চ Treaty of friendship, Cooperation and peace between the Republic of India and the People's Republic of Bangladesh নামক বিতর্কিত পঁচিশ বছর মেয়াদি চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তিতেই ভারতীয় সংবিধানের আদলে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ঝবপঁষধত্রংস আমদানি করা হয়, যদিও এ দেশের ভারতপন্থী বুদ্ধিজীবীকুল ও সুশীল (?) সমাজ দীর্ঘদিন ধরে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এ দেশে Secularism প্রতিষ্ঠা ও বিসমিল্লাহর বিরুদ্ধে করা হয়েছিল বলে সর্বৈব মিথ্যা ও ইসলাম ধর্মবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছেন। বারোটি অনুচ্ছেদবিশিষ্ট পঁচিশ বছর মেয়াদি চুক্তিটি বাংলাদেশকে প্রকারান্তরে ভারতের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত করার অসত্ উদ্দেশ্যে যে সম্পাদিত হয়েছিল, সেটি নিচে উদ্ধৃত অনুচ্ছেদ ৪, ৯ এবং ১০ থেকেই প্রমাণিত :
Article 4 : "The High Contracting Parties shall maintain regular contacts with each other on major international problems affecting the interests of both States, through meetings and exchange of views at all levels."
(চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয় তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সমস্যা প্রসঙ্গে সকল পর্যায়ে সভা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করবে।)
Article 9 : "Each of the High Contracting Parties shall refrain from giving any assistance to any third party taking part in and armed conflict against the other party. In case either party is attacked or threatened with attack, the High Contracting Parties shall immediately enter into mutual consultations in order to take appropriate effective measures to eliminate the threat and thus ensure the peace and security of their countries."
(চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয় কোনো তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত হলে কোনো পক্ষই সেই তৃতীয় পক্ষকে কোনোরূপ সহায়তা প্রদান করবে না। যে কোনো পক্ষ আক্রান্ত হলে অথবা হুমকির সম্মুখীন হলে সেই আক্রমণ অথবা হুমকি মোকাবেলা করে শান্তি স্থাপন ও নিরাপত্তা বিধানে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার লক্ষ্যে চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয় জরুরি আলোচনায় মিলিত হবে।)
Article 10 : "Each of the High Contracting Parties solemnly declares that it shall not undertake any commitments, Secret or open, toward one or more States which may be incompatible with the present Treaty."
(চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয় এই মর্মে ঘোষণা দিচ্ছে যে, তারা অন্য কোনো এক বা একাধিক রাষ্ট্রের সঙ্গে গোপন অথবা প্রকাশ্য এমন কোনো প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হবে না যা এই চুক্তির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে।)
উপরিউক্ত চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের আধিপত্যের কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করেন এবং বিশেষত অনুচ্ছেদ ১০-এ সম্মত হয়ে তিনি তৃতীয় দেশের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপনের সুযোগও রহিত করেন। ভারতের সঙ্গে ২৫ বছর মেয়াদি এই চুক্তির কারণেই চীন ও সৌদিআরবসহ বহু রাষ্ট্র বাংলাদেশকে সেই সময় স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক অবশ্য দাবি করে থাকেন যে, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে ভারতেই ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ভারত-পাকিস্তান চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরুর আগেই অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ শেষে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর ঢাকায় ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ১৯ মার্চ যে চুক্তি স্বাক্ষর করেন, সেটি আগেকার বশ্যতা স্বীকারের এক প্রকার আনুষ্ঠানিকতা ছিল মাত্র। বাংলাদেশের জন্য অসম্মানজনক চুক্তি চাপিয়ে দেয়া হলেও দিল্লি কিন্তু তার সুবিধামত চুক্তির শর্ত ভাঙতে কোনো দিনই দ্বিধা করেনি।
চুক্তির ৮ নম্বর অনুচ্ছেদে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিবাদে কোনো বিদ্রোহী পক্ষকে সহায়তা না করার সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও ভারত অবলীলায় চুক্তি ভঙ্গ করে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এবং তথাকথিত শান্তি বাহিনীকে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ, অর্থ এবং অন্যান্য সহায়তা দিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ পরিচালনায় সরাসরি অংশগ্রহণ করছে। ভারত সরকার সে দেশের ভূখণ্ডকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে ব্যবহৃত হতে দিয়ে চুক্তির ৮ অনুচ্ছেদের নিম্নোক্ত অংশ বছরের পর বছর ধরে পরিষ্কারভাবে লঙ্ঘন করেছে,
"Each of the High Contracting parties shall refrain from any aggression against the other party and shall not allow the use of its territory of committing any act that may cause military damage to or constitute a threat to the security of the other High Contracting Party."
(চুক্তিবদ্ধ পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে সর্বপ্রকার আগ্রাসী তত্পরতা থেকে বিরত থাকবে এবং নিজের ভূখণ্ড অন্য পক্ষের সামরিক ক্ষয়ক্ষতি কিংবা তার নিরাপত্তার বিরুদ্ধে হুমকি সৃষ্টিকারী কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হতে দেবে না।)
বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কাদের সিদ্দিকী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং ভারত সরকারের সহায়তাক্রমে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষিপ্ত যুদ্ধে লিপ্ত হন। ইন্দিরা গান্ধী পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলে মোরারজী দেশাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং তিনি বাংলাদেশ বিরোধী এই অপতত্পরতায় শেষ অবধি ইতি টানেন। অপরদিকে প্রায় দুই যুগ ধরে সন্তু লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বিশেষত চাকমারা ভারতে ক্যাম্প স্থাপন করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই অব্যাহত রাখে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার প্রথম দফা ক্ষমতা গ্রহণের প্রেক্ষাপটে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে দীর্ঘ দুই যুগব্যাপী সেই বিদ্রোহের অবসান ঘটে। আজকের বাংলাদেশে চট্টগ্রামের চাঞ্চল্যকর দশ ট্রাক অস্ত্র মামলাকে কেন্দ্র করে জাতীয় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার দু’জন সাবেক মহাপরিচালককে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে। অভিযোগ করা হচ্ছে, তারা নাকি চীন থেকে পাঠানো এই অস্ত্রের চালান বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের আসাম রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী উলফাকে (ULFA) হস্তান্তরের কাজে সহায়তা করেছিলেন। অভিযোগ যদি সত্য হয়ে থাকে এবং সেই কারণে বর্তমান সরকার যদি দুই সাবেক জেনারেলকে অপরাধী বিবেচনা করেন, তাহলে নৈতিকতার মানদণ্ডেই কাদের সিদ্দিকী এবং সন্তু লারমাকে অস্ত্র সরবরাহকারী ও প্রশিক্ষণদানকারী ভারতীয় জেনারেলদের বিচারও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ভারতের কাছে দাবি করা উচিত। ভারতীয় জেনারেলদের বিচারের বিষয়টি প্রসঙ্গক্রমে এসেছে এবং এটি আজকের মন্তব্য প্রতিবেদনের মূল বিষয় নয় বিধায় এই লেখায় সে সম্পর্কে বিশদ আলোচনায় আর যাচ্ছি না। এ বিষয়ে ভবিষ্যতে লেখার ইচ্ছা রইল।
মুজিব-ইন্দিরা স্বাক্ষরিত ২৫ বছর মেয়াদি তথাকথিত Treaty of Friendship চুক্তির আলোকে এবার সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখে মুজিব তনয়ার সই করা Framework Agreement নিয়ে আলোচনা করা যাক। কাকতালীয়ভাবে এবারের চুক্তিটিও পূর্ববত্ বারোটি ধারাসংবলিত এবং চুক্তি স্বাক্ষরের স্থানও সেই ঢাকাতেই। চুক্তির প্রথম ধারাতেই বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে আধিপত্যবাদী ভারতের জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে করিডোর নেয়ার আয়োজন পাকাপোক্ত করা হয়েছে,
"........... facilitate trade, by road, rail, inland waterways, air and shipping. Both parties will encourage the development of appropriate infrastructure, use of sea ports, multi-modal transportation and standardization of means of transport for bilateral as well as sub-regional use."
(...রাস্তা, রেল, অভ্যন্তরীণ নদীপথ, আকাশপথ এবং জাহাজযোগে বাণিজ্যে সহায়তা প্রদান। যথাযথ অবকাঠামো নির্মাণ, সমুদ্র বন্দর ব্যবহার, বিভিন্ন প্রকার পরিবহন ব্যবস্থা ও যানবাহনের মধ্যে এক প্রকার সমমানদণ্ড বিধানের জন্য উভয়পক্ষ উত্সাহিত করবে যাতে সেগুলোর দ্বিপাক্ষিক এবং উপ-আঞ্চলিক ব্যবহার সম্ভব হয়।)
পাঠক, একটু মনোযোগ দিয়ে পড়লেই বুঝতে সক্ষম হবেন যে ধারাটি কেবল ভারতের স্বার্থ পূরণে প্রণীত হয়েছে। এই একতরফা ধারা বাংলাদেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করে জায়েজ করার অপকৌশল হিসেবেই অনর্থক উপ-অঞ্চলকে কোনোরূপ সংজ্ঞায়িত না করেই টেনে আনা হয়েছে। এখানে দক্ষিণ এশিয়া, সার্ক কিংবা এই অঞ্চলের অন্য রাষ্ট্রগুলোর নাম নির্দিষ্ট না করে কেবল উপ-অঞ্চল বলার অর্থই হচ্ছে পরবর্তীকালে বড়জোর নেপাল ও ভুটানকে চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অথবা সামরিক, কোনো বিবেচনাতেই কেবল নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে আমাদের এই প্রকার সংযোগ স্থাপনের তেমন কোনো মূল্য নেই। অর্থাত্ চুক্তিতে ব্যবহৃত ভাষাগত দুর্বোধ্যতা (Jargon) ও অস্বচ্ছতার মাধ্যমে ভারতের করিডোর পাওয়াটাই মূল উদ্দেশ্য। চুক্তির সাত নম্বর অনুচ্ছেদে 'physical connectivity' অর্থাত্ প্রাকৃতিক সংযোগের বিষয় উল্লেখ করে আবার প্রচ্ছন্নভাবে সেই ভারতীয় করিডোরকেই সামনে নিয়ে আসা হয়েছে।
মুজিব-ইন্দিরার অতীব বিতর্কিত পঁচিশ বছর মেয়াদি চুক্তির চেয়েও অধিকতর নগ্নভাবে যে এইবার বাংলাদেশকে দিল্লির অধীনস্থ করে ফেলা হয়েছে সেটি চুক্তির ৮, ৯, ১০ এবং ১১ নম্বর ধারাতেই প্রমাণিত। পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে চারটি ধারাই আমি এখানে উদ্ধৃত করছি,
Article 8 : "To cooperate closely on issues relating to their national interests, Both parties shall work together to create a peaceful environment conducive for inclusive economic growth and development."
(উভয় রাষ্ট্র পরিবেষ্টক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ প্রতিষ্ঠায় জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করবে।)
Article 9 : "To cooperate on security issues of concern to each other while fully respecting each other's sovereignty. Neither party shall allow the use of its territory for activities harmful to the other."
(পরস্পরের সার্বভৌমত্বের প্রতি পরিপূর্ণভাবে শ্রদ্ধাশীল থেকে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট উদ্বেগের বিষয়ে সহযোগিতা করবে। কোনো দেশই তার ভূখণ্ডকে অন্য দেশের জন্য ক্ষতিকারক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত হতে দেবে না।)
Article 10 : "To establish a joint Consultative Commission for effective and smooth implementation of this Agreement that shall meet once a year."
(চুক্তির কার্যকর ও স্বচ্ছন্দ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত যৌথ পরামর্শক কমিটি বছরে অন্তত একবার সভা অনুষ্ঠান করবে।)
Article 11 : "The Agreement may be amended by mutual consent in order to enhance, deepen and widen the scope of cooperation, including regional/sub-regional expansion."
(সহযোগিতার পরিধিকে বিস্তৃত এবং গভীরতর করার লক্ষ্যে এই চুক্তি পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে এমনভাবে সংশোধন করা যাবে যাতে করে চুক্তির আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সম্প্রসারণ সম্ভব হয়।)
বর্তমান ভারতবান্ধব সরকারের আমলে বাংলাদেশকে দিল্লির নিয়ন্ত্রণাধীন করার পর ভবিষ্যতের কোনো দেশপ্রেমিক সরকার যাতে আমাদের মাতৃভূমিকে শৃঙ্খলমুক্ত না করতে পারে, সেই উদ্দেশ্য সাধনে অত্যন্ত আপত্তিকর ১২ নং ধারা প্রণীত হয়েছে। শাসক গোষ্ঠীর মধ্যে দেশপ্রেমের লেশমাত্র থাকলে তারা এই ধারাটি অন্তত মানতে পারতেন না। ধারাটিতে বলা হয়েছে,
"This Agreement shall come into force on the date of its signing by the two parties and shall remain in force until terminated by mutual consent in accordance with Para 2 of this Article.
Either Party may seek termination of this Agreement by giving a written notice to the other Party providing the reasons for seeking such termination. Before this Agreement is terminated, the Parties shall consider the relevant circumstances and hold consultations to address the reasons cited by the Party seeking termination in the Joint Consultative Commission."
(উভয়পক্ষ কর্তৃক চুক্তি স্বাক্ষরের দিন থেকে চুক্তি কার্যকর হবে এবং এই অনুচ্ছেদের ২য় অংশে বর্ণিত পন্থা অনুযায়ী পারস্পরিক সম্মতিতে অবসান করার পূর্ব পর্যন্ত চুক্তি বলবত্ থাকবে।
যে কোনো পক্ষ সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখপূর্বক চুক্তি বাতিলের জন্য লিখিত নোটিশ দিতে পারবে। চুক্তি বাতিলের আগে পক্ষদ্বয় প্রাসঙ্গিক পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করবে এবং যৌথ পরামর্শক কমিটি চুক্তি বাতিলের কারণ পর্যালোচনাপূর্বক তার সমাধানের প্রচেষ্টায় আলোচনা করবে।)
এখানেই শেষ নয়। শেখ হাসিনা জাতীয় স্বার্থবিরোধী যে ভয়ঙ্কর চুক্তি ষোল কোটি জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন সেই চুক্তির অধীনে একবার কোনো ব্যবস্থা অথবা কার্যক্রম গৃহীত হলে সেটি চুক্তি বাতিল হলেও রহিত করা যাবে না। চুক্তির শেষাংশটি নিম্নরূপ—
"Actions taken or agreements reached pursuant to this Agreement shall not be affected by its expiry or termination."
(অত্র চুক্তির অধীন কোনো কার্যক্রম গৃহীত হলে অথবা কোনো চুক্তিতে উপনীত হলে সেটি বর্তমান চুক্তির মেয়াদ অতিক্রম অথবা চুক্তি অবসান হওয়া দ্বারা প্রভাবিত হবে না।)
আশা করি, নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা চুক্তির উপরিউক্ত অংশটি নিয়ে তাদের লেখালেখি এবং বক্তব্য-বিবৃতিতে বিশদভাবে আলোচনা করবেন। তবে, আমি এখানে চিরস্থায়ী পরাধীনতারই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাচ্ছি। ধরা যাক, নিরাপত্তার অজুহাতে ভারত চুক্তি বলবত্কালীন বাংলাদেশে একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করল। তারপর ভবিষ্যতে দেশে স্বাধীনতার প্রকৃত চেতনায় বিশ্বাসী কোনো সরকার ক্ষমতাসীন হয়ে Framework Agreement বাতিল করল। তখন আমরা কি সেই সামরিক ঘাঁটি সরাতে বৃহত্ প্রতিবেশীকে বাধ্য করতে পারব? নাকি ভারত চুক্তির শেষাংশের অজুহাতে আমাদের দাবি মানতে অস্বীকার করবে? সে রকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নাগরিকদের ১৯৭১ সালের মতো আবারও কি সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিতে হবে?
ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের ঠিক ২৪ ঘণ্টা আগে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় আমি মন্তব্য করেছিলাম যে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে Framework Agreement স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশ তার ‘প্রকৃত স্বাধীনতা’ হারাবে। আমার সেই মন্তব্যে ভারতপন্থী বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকগোষ্ঠী অতিশয় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। আওয়ামী ঘরানার এক ব্যাংকার বুদ্ধিজীবী ও বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান আমার সেই মন্তব্যে কুপিত হয়ে ‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকায় তার কলামে আমার নাম উল্লেখ না করে কঠোর সমালোচনা করেছেন। পাঠকদের স্মরণে থাকার কথা যে, এই ব্যক্তিটি বর্তমান সরকার কর্তৃক শেয়ারবাজার কারসাজির উপর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান রূপে নিযুক্তি লাভ করে যে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছিলেন, সেটিকে দেশের অধিকাংশ অর্থনীতিবিষয়ক বোদ্ধামহল জঞ্জাল রূপেই বিবেচনা করেছিলেন। সেই ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ মার্কা রিপোর্ট দ্বারা না কোনো অপরাধী শনাক্ত করা গেছে, না ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা লাভবান হয়েছেন। ভারতের প্রতি নতমস্তক এই প্রকৃতির দলবাজ ব্যক্তি আমার প্রতি বিরূপ মন্তব্য করায় আমি বরঞ্চ সন্তোষই বোধ করেছি।
বাংলাদেশের এই গোষ্ঠীভুক্তরা দেশ বিক্রি কিংবা স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করলে সর্বদাই ঠাট্টা-তামাশা করেছেন, বিদ্রূপ করে ভারতীয় জুজুর ভয় দেখানোর কথা বলেছেন। আজ প্রকৃত স্বাধীনতা হরণ হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে দেশপ্রেমিক জনগণ অবশ্যই জানার অধিকার রাখেন যে, এসব বুদ্ধিজীবী কী জেনেশুনে, বিশেষ উদ্দেশ্যে ওইসব মন্তব্য করতেন, নাকি ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী নীতি সম্পর্কে তারা প্রকৃতই অজ্ঞ ছিলেন? যদি জেনেশুনে তারা জনগণকে বিভ্রান্ত করে থাকেন, তবে অবশ্যই দেশদ্রোহিতার অভিযোগে তাদের বিচারের দাবি ওঠা উচিত। আর অজ্ঞতার কারণে এই ভুল করে থাকলে জাতির কাছে করজোড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করা আবশ্যক।
ভারতপন্থী আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা সত্যকে স্বীকার না করলেও আমি নিশ্চিত মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনায় বিশ্বাসী এ দেশের প্রতিজন স্বাধীনতাকামী নাগরিক ধর্ম, বর্ণ, দল ও মতকে অতিক্রম করে সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখে ঢাকায় স্বাক্ষরিত হাসিনা-মনমোহন চুক্তিকে নির্দ্বিধায় প্রত্যাখ্যান করবেন। ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষ তিস্তার পানি না পেলেও অথবা ভারত ও বাংলাদেশের ছিটমহলবাসীদের দীর্ঘ ৬৪ বছরের বঞ্চনার অবসান না হলেও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী কিন্তু ঠিকই আমাদের রাষ্ট্রটিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির মতো করেই অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তিতে আবদ্ধ করে গেছেন। আমাদের মাতৃভূমিকে আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত করার অপকর্মের জন্য বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির আত্মা বর্তমান শাসকগোষ্ঠীকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারে না। আসুন, আমরা মহাবীর টিপু সুলতানের বীরত্ব ও স্বাধীনতার চেতনা হৃদয়ে ধারণ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে প্রয়োজনে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত হই।
সে আরেক বীরত্ব ও দেশপ্রেমের মহান অথচ ট্র্যাজিক কাহিনী। বিশ্ব ইতিহাসে বীরত্বের অধিকাংশ কাহিনীই বোধহয় ট্র্যাজেডিতে শেষ হয়েছে। মহীশুরের ক্ষেত্রেও ইংরেজরা শঠতা ও বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিয়েছিল। টিপু সুলতান যখন সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে একাকী লড়ছেন, সেই মুহূর্তে নিজাম, পেশোয়া এবং মারাঠারা ইংরেজদের তল্পিবাহক হয়ে উচ্ছিষ্ট ঘরে তুলতে ব্যস্ত থেকেছে।
যাক সেসব কথা। ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সম্প্রসারণকালে ব্যবহৃত ‘Protectorate’ শব্দটি বর্তমানের শেখ হাসিনার বাংলাদেশে প্রাসঙ্গিক বলেই এত পুরনো কথার অবতারণা করলাম। আন্তর্জাতিক আইনে এই ইংরেজি ঢ়ত্ড়ঃবপঃড়ত্ধঃব শব্দটির আধুনিক যুগের সংজ্ঞা পাঠকের জ্ঞাতার্থে উদ্ধৃত করছি,
"It is an autonomous territory that is protected diplomatically or militarily against third parties by a stronger state. In exchange for this, the protectorate usually accepts specific obligations. However, it retains some measure of sovereignty."
(এটি এমন একটি ভূখণ্ড যা অপর একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র কর্তৃক কূটনৈতিক ও সামরিক নিরাপত্তা প্রদত্ত। এই নিরাপত্তা প্রদানের বিনিময়ে আশ্রিত রাষ্ট্রের কিছু দায়বদ্ধতা থাকে। যাই হোক, এই প্রকার ভূখণ্ডের খানিকটা সার্বভৌমত্ব রয়েছে) ঔপনিবেশিক আমলের ‘Colonial Protectorate’-এর ক্ষেত্রে অবশ্য আশ্রিত রাষ্ট্রের কোনোরকম সার্বভৌমত্বের বালাই ছিল না। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি Protectorate-এর দুই সংজ্ঞার মধ্যে বর্তমানে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, সেই বিষয় নিয়ে বিতর্ক উসকে দেয়ার উদ্দেশ্যেই আমার আজকের এই লেখা।
বাংলাদেশের চিন্তাশীল ও প্রকৃত স্বাধীনতাকামী নাগরিকদের কাছে ক্রমেই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, লাখ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে প্রাপ্ত স্বাধীন ভূখণ্ডটিকে ভারতের protectorate-এ পরিণত করার আকাঙ্ক্ষাতেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সে দেশের শাসকশ্রেণী সহায়তা প্রদান করেছিল। ইন্দিরা গান্ধীর মহত্ত্ব প্রদর্শন কিংবা বাংলাদেশের অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো ছিল সম্পূর্ণ গৌণ বিষয়। ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়ে লেখা গত দুই কিস্তির মন্তব্য প্রতিবেদনে বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ উদ্ধৃত করে ভারতের গুপ্ত বাসনার কথা যথাসাধ্য প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি। আজকের শেষ কিস্তিতে গত চল্লিশ বছরে দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত রাজনৈতিক চুক্তিগুলো নিয়ে খানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের চেষ্টা করব।
১৯৭২ সালের মার্চে স্বাক্ষরিত বাণিজ্য চুক্তি এবং প্রথম নৌ-ট্রানজিট চুক্তি, ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি এবং ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রতারণা করে ফারাক্কা বাঁধ চালুর সব প্রাসঙ্গিক দলিল গত দুই বুধবারে উপস্থাপন করেছি। আজ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালীন প্রণীত Framework Agreement নিয়েই মূলত আলোচনার ইচ্ছে থাকলেও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ধারাবাহিকতার বিষয়টি তুলে ধরার জন্য আবারও ১৯৭২ সালে ফিরে যেতে হচ্ছে। সে বছর ঢাকায় ইন্দিরা গান্ধীর সফরকালে ১৯ মার্চ Treaty of friendship, Cooperation and peace between the Republic of India and the People's Republic of Bangladesh নামক বিতর্কিত পঁচিশ বছর মেয়াদি চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তিতেই ভারতীয় সংবিধানের আদলে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ঝবপঁষধত্রংস আমদানি করা হয়, যদিও এ দেশের ভারতপন্থী বুদ্ধিজীবীকুল ও সুশীল (?) সমাজ দীর্ঘদিন ধরে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এ দেশে Secularism প্রতিষ্ঠা ও বিসমিল্লাহর বিরুদ্ধে করা হয়েছিল বলে সর্বৈব মিথ্যা ও ইসলাম ধর্মবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছেন। বারোটি অনুচ্ছেদবিশিষ্ট পঁচিশ বছর মেয়াদি চুক্তিটি বাংলাদেশকে প্রকারান্তরে ভারতের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত করার অসত্ উদ্দেশ্যে যে সম্পাদিত হয়েছিল, সেটি নিচে উদ্ধৃত অনুচ্ছেদ ৪, ৯ এবং ১০ থেকেই প্রমাণিত :
Article 4 : "The High Contracting Parties shall maintain regular contacts with each other on major international problems affecting the interests of both States, through meetings and exchange of views at all levels."
(চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয় তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সমস্যা প্রসঙ্গে সকল পর্যায়ে সভা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করবে।)
Article 9 : "Each of the High Contracting Parties shall refrain from giving any assistance to any third party taking part in and armed conflict against the other party. In case either party is attacked or threatened with attack, the High Contracting Parties shall immediately enter into mutual consultations in order to take appropriate effective measures to eliminate the threat and thus ensure the peace and security of their countries."
(চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয় কোনো তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত হলে কোনো পক্ষই সেই তৃতীয় পক্ষকে কোনোরূপ সহায়তা প্রদান করবে না। যে কোনো পক্ষ আক্রান্ত হলে অথবা হুমকির সম্মুখীন হলে সেই আক্রমণ অথবা হুমকি মোকাবেলা করে শান্তি স্থাপন ও নিরাপত্তা বিধানে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার লক্ষ্যে চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয় জরুরি আলোচনায় মিলিত হবে।)
Article 10 : "Each of the High Contracting Parties solemnly declares that it shall not undertake any commitments, Secret or open, toward one or more States which may be incompatible with the present Treaty."
(চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয় এই মর্মে ঘোষণা দিচ্ছে যে, তারা অন্য কোনো এক বা একাধিক রাষ্ট্রের সঙ্গে গোপন অথবা প্রকাশ্য এমন কোনো প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হবে না যা এই চুক্তির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে।)
উপরিউক্ত চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের আধিপত্যের কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করেন এবং বিশেষত অনুচ্ছেদ ১০-এ সম্মত হয়ে তিনি তৃতীয় দেশের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপনের সুযোগও রহিত করেন। ভারতের সঙ্গে ২৫ বছর মেয়াদি এই চুক্তির কারণেই চীন ও সৌদিআরবসহ বহু রাষ্ট্র বাংলাদেশকে সেই সময় স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক অবশ্য দাবি করে থাকেন যে, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে ভারতেই ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ভারত-পাকিস্তান চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরুর আগেই অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ শেষে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর ঢাকায় ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ১৯ মার্চ যে চুক্তি স্বাক্ষর করেন, সেটি আগেকার বশ্যতা স্বীকারের এক প্রকার আনুষ্ঠানিকতা ছিল মাত্র। বাংলাদেশের জন্য অসম্মানজনক চুক্তি চাপিয়ে দেয়া হলেও দিল্লি কিন্তু তার সুবিধামত চুক্তির শর্ত ভাঙতে কোনো দিনই দ্বিধা করেনি।
চুক্তির ৮ নম্বর অনুচ্ছেদে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিবাদে কোনো বিদ্রোহী পক্ষকে সহায়তা না করার সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও ভারত অবলীলায় চুক্তি ভঙ্গ করে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এবং তথাকথিত শান্তি বাহিনীকে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ, অর্থ এবং অন্যান্য সহায়তা দিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ পরিচালনায় সরাসরি অংশগ্রহণ করছে। ভারত সরকার সে দেশের ভূখণ্ডকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে ব্যবহৃত হতে দিয়ে চুক্তির ৮ অনুচ্ছেদের নিম্নোক্ত অংশ বছরের পর বছর ধরে পরিষ্কারভাবে লঙ্ঘন করেছে,
"Each of the High Contracting parties shall refrain from any aggression against the other party and shall not allow the use of its territory of committing any act that may cause military damage to or constitute a threat to the security of the other High Contracting Party."
(চুক্তিবদ্ধ পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে সর্বপ্রকার আগ্রাসী তত্পরতা থেকে বিরত থাকবে এবং নিজের ভূখণ্ড অন্য পক্ষের সামরিক ক্ষয়ক্ষতি কিংবা তার নিরাপত্তার বিরুদ্ধে হুমকি সৃষ্টিকারী কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হতে দেবে না।)
বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কাদের সিদ্দিকী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং ভারত সরকারের সহায়তাক্রমে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষিপ্ত যুদ্ধে লিপ্ত হন। ইন্দিরা গান্ধী পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলে মোরারজী দেশাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং তিনি বাংলাদেশ বিরোধী এই অপতত্পরতায় শেষ অবধি ইতি টানেন। অপরদিকে প্রায় দুই যুগ ধরে সন্তু লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বিশেষত চাকমারা ভারতে ক্যাম্প স্থাপন করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই অব্যাহত রাখে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার প্রথম দফা ক্ষমতা গ্রহণের প্রেক্ষাপটে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে দীর্ঘ দুই যুগব্যাপী সেই বিদ্রোহের অবসান ঘটে। আজকের বাংলাদেশে চট্টগ্রামের চাঞ্চল্যকর দশ ট্রাক অস্ত্র মামলাকে কেন্দ্র করে জাতীয় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার দু’জন সাবেক মহাপরিচালককে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে। অভিযোগ করা হচ্ছে, তারা নাকি চীন থেকে পাঠানো এই অস্ত্রের চালান বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের আসাম রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী উলফাকে (ULFA) হস্তান্তরের কাজে সহায়তা করেছিলেন। অভিযোগ যদি সত্য হয়ে থাকে এবং সেই কারণে বর্তমান সরকার যদি দুই সাবেক জেনারেলকে অপরাধী বিবেচনা করেন, তাহলে নৈতিকতার মানদণ্ডেই কাদের সিদ্দিকী এবং সন্তু লারমাকে অস্ত্র সরবরাহকারী ও প্রশিক্ষণদানকারী ভারতীয় জেনারেলদের বিচারও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ভারতের কাছে দাবি করা উচিত। ভারতীয় জেনারেলদের বিচারের বিষয়টি প্রসঙ্গক্রমে এসেছে এবং এটি আজকের মন্তব্য প্রতিবেদনের মূল বিষয় নয় বিধায় এই লেখায় সে সম্পর্কে বিশদ আলোচনায় আর যাচ্ছি না। এ বিষয়ে ভবিষ্যতে লেখার ইচ্ছা রইল।
মুজিব-ইন্দিরা স্বাক্ষরিত ২৫ বছর মেয়াদি তথাকথিত Treaty of Friendship চুক্তির আলোকে এবার সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখে মুজিব তনয়ার সই করা Framework Agreement নিয়ে আলোচনা করা যাক। কাকতালীয়ভাবে এবারের চুক্তিটিও পূর্ববত্ বারোটি ধারাসংবলিত এবং চুক্তি স্বাক্ষরের স্থানও সেই ঢাকাতেই। চুক্তির প্রথম ধারাতেই বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে আধিপত্যবাদী ভারতের জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে করিডোর নেয়ার আয়োজন পাকাপোক্ত করা হয়েছে,
"........... facilitate trade, by road, rail, inland waterways, air and shipping. Both parties will encourage the development of appropriate infrastructure, use of sea ports, multi-modal transportation and standardization of means of transport for bilateral as well as sub-regional use."
(...রাস্তা, রেল, অভ্যন্তরীণ নদীপথ, আকাশপথ এবং জাহাজযোগে বাণিজ্যে সহায়তা প্রদান। যথাযথ অবকাঠামো নির্মাণ, সমুদ্র বন্দর ব্যবহার, বিভিন্ন প্রকার পরিবহন ব্যবস্থা ও যানবাহনের মধ্যে এক প্রকার সমমানদণ্ড বিধানের জন্য উভয়পক্ষ উত্সাহিত করবে যাতে সেগুলোর দ্বিপাক্ষিক এবং উপ-আঞ্চলিক ব্যবহার সম্ভব হয়।)
পাঠক, একটু মনোযোগ দিয়ে পড়লেই বুঝতে সক্ষম হবেন যে ধারাটি কেবল ভারতের স্বার্থ পূরণে প্রণীত হয়েছে। এই একতরফা ধারা বাংলাদেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করে জায়েজ করার অপকৌশল হিসেবেই অনর্থক উপ-অঞ্চলকে কোনোরূপ সংজ্ঞায়িত না করেই টেনে আনা হয়েছে। এখানে দক্ষিণ এশিয়া, সার্ক কিংবা এই অঞ্চলের অন্য রাষ্ট্রগুলোর নাম নির্দিষ্ট না করে কেবল উপ-অঞ্চল বলার অর্থই হচ্ছে পরবর্তীকালে বড়জোর নেপাল ও ভুটানকে চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অথবা সামরিক, কোনো বিবেচনাতেই কেবল নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে আমাদের এই প্রকার সংযোগ স্থাপনের তেমন কোনো মূল্য নেই। অর্থাত্ চুক্তিতে ব্যবহৃত ভাষাগত দুর্বোধ্যতা (Jargon) ও অস্বচ্ছতার মাধ্যমে ভারতের করিডোর পাওয়াটাই মূল উদ্দেশ্য। চুক্তির সাত নম্বর অনুচ্ছেদে 'physical connectivity' অর্থাত্ প্রাকৃতিক সংযোগের বিষয় উল্লেখ করে আবার প্রচ্ছন্নভাবে সেই ভারতীয় করিডোরকেই সামনে নিয়ে আসা হয়েছে।
মুজিব-ইন্দিরার অতীব বিতর্কিত পঁচিশ বছর মেয়াদি চুক্তির চেয়েও অধিকতর নগ্নভাবে যে এইবার বাংলাদেশকে দিল্লির অধীনস্থ করে ফেলা হয়েছে সেটি চুক্তির ৮, ৯, ১০ এবং ১১ নম্বর ধারাতেই প্রমাণিত। পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে চারটি ধারাই আমি এখানে উদ্ধৃত করছি,
Article 8 : "To cooperate closely on issues relating to their national interests, Both parties shall work together to create a peaceful environment conducive for inclusive economic growth and development."
(উভয় রাষ্ট্র পরিবেষ্টক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ প্রতিষ্ঠায় জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করবে।)
Article 9 : "To cooperate on security issues of concern to each other while fully respecting each other's sovereignty. Neither party shall allow the use of its territory for activities harmful to the other."
(পরস্পরের সার্বভৌমত্বের প্রতি পরিপূর্ণভাবে শ্রদ্ধাশীল থেকে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট উদ্বেগের বিষয়ে সহযোগিতা করবে। কোনো দেশই তার ভূখণ্ডকে অন্য দেশের জন্য ক্ষতিকারক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত হতে দেবে না।)
Article 10 : "To establish a joint Consultative Commission for effective and smooth implementation of this Agreement that shall meet once a year."
(চুক্তির কার্যকর ও স্বচ্ছন্দ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত যৌথ পরামর্শক কমিটি বছরে অন্তত একবার সভা অনুষ্ঠান করবে।)
Article 11 : "The Agreement may be amended by mutual consent in order to enhance, deepen and widen the scope of cooperation, including regional/sub-regional expansion."
(সহযোগিতার পরিধিকে বিস্তৃত এবং গভীরতর করার লক্ষ্যে এই চুক্তি পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে এমনভাবে সংশোধন করা যাবে যাতে করে চুক্তির আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সম্প্রসারণ সম্ভব হয়।)
বর্তমান ভারতবান্ধব সরকারের আমলে বাংলাদেশকে দিল্লির নিয়ন্ত্রণাধীন করার পর ভবিষ্যতের কোনো দেশপ্রেমিক সরকার যাতে আমাদের মাতৃভূমিকে শৃঙ্খলমুক্ত না করতে পারে, সেই উদ্দেশ্য সাধনে অত্যন্ত আপত্তিকর ১২ নং ধারা প্রণীত হয়েছে। শাসক গোষ্ঠীর মধ্যে দেশপ্রেমের লেশমাত্র থাকলে তারা এই ধারাটি অন্তত মানতে পারতেন না। ধারাটিতে বলা হয়েছে,
"This Agreement shall come into force on the date of its signing by the two parties and shall remain in force until terminated by mutual consent in accordance with Para 2 of this Article.
Either Party may seek termination of this Agreement by giving a written notice to the other Party providing the reasons for seeking such termination. Before this Agreement is terminated, the Parties shall consider the relevant circumstances and hold consultations to address the reasons cited by the Party seeking termination in the Joint Consultative Commission."
(উভয়পক্ষ কর্তৃক চুক্তি স্বাক্ষরের দিন থেকে চুক্তি কার্যকর হবে এবং এই অনুচ্ছেদের ২য় অংশে বর্ণিত পন্থা অনুযায়ী পারস্পরিক সম্মতিতে অবসান করার পূর্ব পর্যন্ত চুক্তি বলবত্ থাকবে।
যে কোনো পক্ষ সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখপূর্বক চুক্তি বাতিলের জন্য লিখিত নোটিশ দিতে পারবে। চুক্তি বাতিলের আগে পক্ষদ্বয় প্রাসঙ্গিক পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করবে এবং যৌথ পরামর্শক কমিটি চুক্তি বাতিলের কারণ পর্যালোচনাপূর্বক তার সমাধানের প্রচেষ্টায় আলোচনা করবে।)
এখানেই শেষ নয়। শেখ হাসিনা জাতীয় স্বার্থবিরোধী যে ভয়ঙ্কর চুক্তি ষোল কোটি জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন সেই চুক্তির অধীনে একবার কোনো ব্যবস্থা অথবা কার্যক্রম গৃহীত হলে সেটি চুক্তি বাতিল হলেও রহিত করা যাবে না। চুক্তির শেষাংশটি নিম্নরূপ—
"Actions taken or agreements reached pursuant to this Agreement shall not be affected by its expiry or termination."
(অত্র চুক্তির অধীন কোনো কার্যক্রম গৃহীত হলে অথবা কোনো চুক্তিতে উপনীত হলে সেটি বর্তমান চুক্তির মেয়াদ অতিক্রম অথবা চুক্তি অবসান হওয়া দ্বারা প্রভাবিত হবে না।)
আশা করি, নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা চুক্তির উপরিউক্ত অংশটি নিয়ে তাদের লেখালেখি এবং বক্তব্য-বিবৃতিতে বিশদভাবে আলোচনা করবেন। তবে, আমি এখানে চিরস্থায়ী পরাধীনতারই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাচ্ছি। ধরা যাক, নিরাপত্তার অজুহাতে ভারত চুক্তি বলবত্কালীন বাংলাদেশে একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করল। তারপর ভবিষ্যতে দেশে স্বাধীনতার প্রকৃত চেতনায় বিশ্বাসী কোনো সরকার ক্ষমতাসীন হয়ে Framework Agreement বাতিল করল। তখন আমরা কি সেই সামরিক ঘাঁটি সরাতে বৃহত্ প্রতিবেশীকে বাধ্য করতে পারব? নাকি ভারত চুক্তির শেষাংশের অজুহাতে আমাদের দাবি মানতে অস্বীকার করবে? সে রকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নাগরিকদের ১৯৭১ সালের মতো আবারও কি সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিতে হবে?
ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের ঠিক ২৪ ঘণ্টা আগে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় আমি মন্তব্য করেছিলাম যে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে Framework Agreement স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশ তার ‘প্রকৃত স্বাধীনতা’ হারাবে। আমার সেই মন্তব্যে ভারতপন্থী বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকগোষ্ঠী অতিশয় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। আওয়ামী ঘরানার এক ব্যাংকার বুদ্ধিজীবী ও বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান আমার সেই মন্তব্যে কুপিত হয়ে ‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকায় তার কলামে আমার নাম উল্লেখ না করে কঠোর সমালোচনা করেছেন। পাঠকদের স্মরণে থাকার কথা যে, এই ব্যক্তিটি বর্তমান সরকার কর্তৃক শেয়ারবাজার কারসাজির উপর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান রূপে নিযুক্তি লাভ করে যে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছিলেন, সেটিকে দেশের অধিকাংশ অর্থনীতিবিষয়ক বোদ্ধামহল জঞ্জাল রূপেই বিবেচনা করেছিলেন। সেই ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ মার্কা রিপোর্ট দ্বারা না কোনো অপরাধী শনাক্ত করা গেছে, না ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা লাভবান হয়েছেন। ভারতের প্রতি নতমস্তক এই প্রকৃতির দলবাজ ব্যক্তি আমার প্রতি বিরূপ মন্তব্য করায় আমি বরঞ্চ সন্তোষই বোধ করেছি।
বাংলাদেশের এই গোষ্ঠীভুক্তরা দেশ বিক্রি কিংবা স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করলে সর্বদাই ঠাট্টা-তামাশা করেছেন, বিদ্রূপ করে ভারতীয় জুজুর ভয় দেখানোর কথা বলেছেন। আজ প্রকৃত স্বাধীনতা হরণ হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে দেশপ্রেমিক জনগণ অবশ্যই জানার অধিকার রাখেন যে, এসব বুদ্ধিজীবী কী জেনেশুনে, বিশেষ উদ্দেশ্যে ওইসব মন্তব্য করতেন, নাকি ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী নীতি সম্পর্কে তারা প্রকৃতই অজ্ঞ ছিলেন? যদি জেনেশুনে তারা জনগণকে বিভ্রান্ত করে থাকেন, তবে অবশ্যই দেশদ্রোহিতার অভিযোগে তাদের বিচারের দাবি ওঠা উচিত। আর অজ্ঞতার কারণে এই ভুল করে থাকলে জাতির কাছে করজোড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করা আবশ্যক।
ভারতপন্থী আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা সত্যকে স্বীকার না করলেও আমি নিশ্চিত মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনায় বিশ্বাসী এ দেশের প্রতিজন স্বাধীনতাকামী নাগরিক ধর্ম, বর্ণ, দল ও মতকে অতিক্রম করে সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখে ঢাকায় স্বাক্ষরিত হাসিনা-মনমোহন চুক্তিকে নির্দ্বিধায় প্রত্যাখ্যান করবেন। ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষ তিস্তার পানি না পেলেও অথবা ভারত ও বাংলাদেশের ছিটমহলবাসীদের দীর্ঘ ৬৪ বছরের বঞ্চনার অবসান না হলেও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী কিন্তু ঠিকই আমাদের রাষ্ট্রটিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির মতো করেই অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তিতে আবদ্ধ করে গেছেন। আমাদের মাতৃভূমিকে আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত করার অপকর্মের জন্য বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির আত্মা বর্তমান শাসকগোষ্ঠীকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারে না। আসুন, আমরা মহাবীর টিপু সুলতানের বীরত্ব ও স্বাধীনতার চেতনা হৃদয়ে ধারণ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে প্রয়োজনে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত হই।
No comments