যে কারণে হুয়াওয়েকে নিয়ে উদ্বিগ্ন পশ্চিমা বিশ্ব
গুগল
ঘোষণা করেছে যে, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্মার্টফোন কোম্পানি
হুয়াওয়েকে গুগলের অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের কিছু আপডেট ব্যবহার
করতে দেয়া হবে না। এর মানে হচ্ছে যে হুয়াওয়ের নতুন স্মার্টফোনগুলোতে
গুগলের বেশকিছু অ্যাপ আর ব্যবহার করা যাবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত সপ্তাহে 'বিদেশি শত্রুদের' কাছ থেকে তার দেশের কম্পিউটার নেটওয়ার্ক রক্ষায় জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই পদক্ষেপের আসল টার্গেট ছিল আসলে চীনা কোম্পানি হুয়াওয়ে।
হুয়াওয়ে সবচেয়ে বেশি পরিচিত তার স্মার্টফোনের কারণে। কিন্তু তারা আরও বহু রকম কমিউনিকেশন ইকুইপমেন্ট তৈরি করে।
যদি হুয়াওয়ে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের যন্ত্রপাতি বিক্রি করতে নাও পারে, তারপরও বিশ্বজুড়ে কমিউউনিকেশন নেটওয়ার্কের ৪০ হতে ৬০ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করবে হুয়াওয়ে।
কী কারণে হুয়াওয়েকে নিয়ে এতটা চিন্তিত বিভিন্ন দেশ?
এর পেছনে আছে খুবই জটিল কিছু অভিযোগ। এর মধ্যে গুপ্তচরবৃত্তি থেকে শুরু করে চুরি যাওয়া রোবট, হীরের প্রলেপ দেয়া গ্লাসস্ক্রিন থেকে ইরানের সঙ্গে গোপন চুক্তি- অনেক কিছুই আছে।
ফাইভ-জি: সুপারফার্স্ট কিন্তু নিরাপদ নয়?
মোবাইল টেলিফোনের ক্ষেত্রে পরবর্তী বিপ্লব হিসেবে ধরা হয় ফাইভ-জি নেটওয়ার্ককে। হুয়াওয়ে এই ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক বসানোর জন্য অনেক দেশের সঙ্গেই আলোচনা চালাচ্ছে। এই নতুন নেটওয়ার্ক এত দ্রুতগতির হবে যে এটি ব্যবহার করা হবে বহু নতুন কাজে। যেমন চালকবিহীন গাড়ি চালানোর কাজে।
এখন হুয়াওয়ে যদি কোনো দেশের ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করে, চীন ঐ দেশের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি চালাতে পারবে বলে দাবি করছে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো। তারা চাইলে এই ফাইভ-জি নেটওয়ার্কে আদান-প্রদান করা বার্তা পড়তে পারবে, চাইলে নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দিতে পারবে বা সেখানে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারবে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের আগেই অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো হুয়াওয়ের সঙ্গে ব্যবসা না করার জন্য একটা চাপ সৃষ্টি করেছিল। এই দেশগুলোর মধ্যে আছে 'ফাইভ আই'স' বলে পরিচিত একটি গ্রুপ। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া গ্রুপের বাকী চারটি দেশ হচ্ছে যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড। এই পাঁচটি দেশের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের জন্য খুবই ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা আছে। এর বেশিরভাগটাই করা হয় ইলেকট্রনিক উপায়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে এই পাঁচ দেশের কোনো দেশ যদি হুয়াওয়ের নেটওয়ার্ক তাদের গুরুত্বপূর্ণ কোনো ইনফরমেশন সিস্টেমে বসায়, তাহলে সেই দেশের সঙ্গে তারা আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য শেয়ার করতে পারবেন না।
হুয়াওয়ে অবশ্য বারবার জোর দিয়ে বলেছে, তারা কখনোই চীন সরকারের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করবে না। কিন্তু সমালোচকরা একটি চীনা আইনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন যার কারণে কোনো কোম্পানির পক্ষে গোয়েন্দা তথ্য চেয়ে চীনা সরকারের অনুরোধ উপেক্ষা করা প্রায় অসম্ভব হবে।
হুয়াওয়ে আরও বলছে, যদি তাদের যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করা হয় সেটি মার্কিন ভোক্তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করবে। কারণ এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে হুয়াওয়ের বিকল্প হিসেবে তার চেয়ে অনুন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে এবং ফাইভ-জি প্রযুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্র যে এ ধরণের 'প্রযুক্তি গুপ্তচরবৃত্তির' ভয় করছে, তার কারণ হয়তো তারা নিজেরাই এরকম কাজ করেছে বছরের পর বছর। এনএসএ'র সাবেক কন্ট্রাক্টর এডওয়ার্ড স্নোডেন তার ফাঁস করা তথ্যে দেখিয়েছেন কীভাবে মার্কিন নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বড় বড় মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানির নেটওয়ার্ক হ্যাক করে তথ্য চুরি করতো। এর মধ্যে গুগল এবং ইয়াহুর মতো কোম্পানি পর্যন্ত আছে।
কাজেই প্রতিদ্বন্দ্বী একটি দেশের কোম্পানিকে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ যুক্তরাষ্ট্রের আছে।
রোবট এবং অস্ত্র কেলেংকারি
অতিদ্রুত গতির ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কের উদাহরণ দিয়ে জিনিসটা বোঝানো হয়তো কঠিন। কিন্তু হুয়াওয়েকে ঘিরে অন্য কেলেংকারিটি বোঝা অতটা কঠিন নয়। তাদের এক প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে একটি রোবটের হাত চুরির অভিযোগ আনা হয়। তবে এই প্রকৌশলী অভিযোগ করছেন, এটি চুরি ছিল না, দুর্ঘটনাবশত ব্যাপারটি ঘটেছে।
তিনি টি-মোবাইলের ডিজাইন ল্যাবে গিয়েছিলেন। সেখানে একটি রোবটের হাত ব্যবহার করে স্মার্টফোনের স্ক্রীন পরীক্ষা করা হয়। এই যন্ত্রটি দুর্ঘটনাবশত তার ব্যাগের মধ্যে পড়ে যায়। যখন তিনি ল্যাব থেকে বেরিয়ে আসছিলেন, তখন বিষয়টি খেয়াল করেননি।
জার্মান কোম্পানি টি-মোবাইলের সঙ্গে তখন হুয়াওয়ের পার্টনারশীপ ছিল। টি-মোবাইল এই কথা বিশ্বাস করেনি। এরপর দুই কোম্পানির মধ্যে সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়।
নতুন কিছু ইমেল ফাঁস হওয়ার পর এই কেলেংকারি নিয়ে আবার কথাবার্তা শুরু হয়েছে। এসব ইমেলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে এই প্রকৌশলী হয়তো চীনে তার উর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তার নির্দেশে এই কাজ করেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে গত বছর যে কানাডায় হুয়াওয়ের চীফ ফিনান্সিয়াল অফিসার মেং ওয়ানজুকে গ্রেফতার করা হয়, তার একটি কারণ এটি।
ইরানের সঙ্গে গোপন আঁতাত?
মিজ মেং ওয়ানজু তাকে কানাডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়ার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালাচ্ছেন। গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেছেন। ইরানের সঙ্গে কোনো গোপন আঁতাতের কথাও তিনি উড়িয়ে দিচ্ছেন।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছিল যে তেহরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা কীভাবে ফাঁকি দেয়া যায়, সেরকম এক ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তিনিও যোগ দিয়েছিলেন স্কাইকম নামের একটি কোম্পানির মাধ্যমে।
ইরানের সঙ্গে তার ব্যবসায়িক লেনদেনের অনেক কিছুর ব্যাপারে তিনি ব্যাংকগুলোকে এবং মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে মিথ্যে কথা বলেছেন বলেও অভিযোগ আছে।
মিজ মেং হচ্ছেন হুয়াওয়ের প্রতিষ্ঠাতার কন্যা। যদি তাকে বিচারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয় এবং তিনি দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে ৩০ বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে তার।
স্মার্টফোনের ভাঙ্গা স্ক্রীন এবং অঙ্গীকার খেলাপ
ব্লুমবার্গের দেয়া তথ্য অনুসারে, হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে আরও কিছু অভিযোগ তদন্ত করছে যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই। এর একটি হচ্ছে তারা পরীক্ষা করে দেখার নামে ধার নেয়া একটি স্মার্টফোনের স্ক্রিনের নমুনা যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে পাচার করে দিয়েছিল।
মোবাইল ফোনের স্ক্রিন খুব সহজেই ভেঙ্গে যায়। কাজেই এমন একটি স্ক্রিন যদি তৈরি করা যায়, যেটি কোনভাবেই ভাঙ্গবে না, সেটি যেকোন প্রযুক্তি কোম্পানির জন্যই একটি বিরাট আশীর্বাদ হয়ে উঠতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে আখান সেমিকন্ডাক্টার নামের একটি কোম্পানি এরকম একটি কাঁচ তৈরি করে হুয়াওয়েকে দেয়ার প্রস্তাব দেয়। এটি নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা চলছিল। তারা হীরের প্রলেপ দেয়া যে কাঁচের স্ক্রিনটি হুয়াওয়েকে দেয়, সেটি যখন কয়েক মাস পর ফেরত আসে, দেখা গেল সেটি ভাঙ্গা। ব্লুমবার্গের ভাষ্য অনুযায়ী, এটি যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
এফবিআই এটি তদন্ত করছে। যুক্তরাষ্ট্রের আইনে এভাবে এটি দেশের বাইরে নেয়া অবৈধ ছিল। হীরের প্রলেপ দেয়া কোনো জিনিস এভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে নেয়া যায় না, কারণ এ ধরনের জিনিস লেজার অস্ত্রে ব্যবহার করা যায়।
চীনা কোম্পানি হুয়াওয়ে এই অভিযোগও অস্বীকার করছে।
এখানেই গল্পের শেষ নয়
কিন্তু এসব কেলেংকারি, গুগলের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ সত্ত্বেও বিশ্বের প্রযুক্তি জগতে হুয়াওয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানি হিসেবে রয়েই যাবে।
আফ্রিকা এবং এশিয়ার অনেক দেশেই হুয়াওয়ের প্রযুক্তির দাম ইউরোপ এবং আমেরিকার প্রযুক্তির চেয়ে কম। কাজেই এসব দেশে হুয়াওয়ের ব্যবসা বাড়তেই থাকবে।
এমনকি যুক্তরাজ্যে, যারা কীনা যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র, এখনো তীব্র বিতর্ক চলছে হুয়াওয়েকে ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক তৈরি করতে দেয়া উচিত কীনা। সম্প্রতি ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে বরখাস্ত করা হয়েছিল চীনা প্রযুক্তি ব্যবহার নিয়ে এই বিতর্কে।
হুয়াওয়েকে ব্যবসা করতে দেয়া হবে কি হবে না, সেই সিদ্ধান্ত এখনো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। হুয়াওয়েকে ঘিরে আর সব কিছুর মতো, এক্ষেত্রেও কী হবে, তা এখনো অনিশ্চিত। সূত্র : বিবিসি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত সপ্তাহে 'বিদেশি শত্রুদের' কাছ থেকে তার দেশের কম্পিউটার নেটওয়ার্ক রক্ষায় জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই পদক্ষেপের আসল টার্গেট ছিল আসলে চীনা কোম্পানি হুয়াওয়ে।
হুয়াওয়ে সবচেয়ে বেশি পরিচিত তার স্মার্টফোনের কারণে। কিন্তু তারা আরও বহু রকম কমিউনিকেশন ইকুইপমেন্ট তৈরি করে।
যদি হুয়াওয়ে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের যন্ত্রপাতি বিক্রি করতে নাও পারে, তারপরও বিশ্বজুড়ে কমিউউনিকেশন নেটওয়ার্কের ৪০ হতে ৬০ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করবে হুয়াওয়ে।
কী কারণে হুয়াওয়েকে নিয়ে এতটা চিন্তিত বিভিন্ন দেশ?
এর পেছনে আছে খুবই জটিল কিছু অভিযোগ। এর মধ্যে গুপ্তচরবৃত্তি থেকে শুরু করে চুরি যাওয়া রোবট, হীরের প্রলেপ দেয়া গ্লাসস্ক্রিন থেকে ইরানের সঙ্গে গোপন চুক্তি- অনেক কিছুই আছে।
ফাইভ-জি: সুপারফার্স্ট কিন্তু নিরাপদ নয়?
মোবাইল টেলিফোনের ক্ষেত্রে পরবর্তী বিপ্লব হিসেবে ধরা হয় ফাইভ-জি নেটওয়ার্ককে। হুয়াওয়ে এই ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক বসানোর জন্য অনেক দেশের সঙ্গেই আলোচনা চালাচ্ছে। এই নতুন নেটওয়ার্ক এত দ্রুতগতির হবে যে এটি ব্যবহার করা হবে বহু নতুন কাজে। যেমন চালকবিহীন গাড়ি চালানোর কাজে।
এখন হুয়াওয়ে যদি কোনো দেশের ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করে, চীন ঐ দেশের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি চালাতে পারবে বলে দাবি করছে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো। তারা চাইলে এই ফাইভ-জি নেটওয়ার্কে আদান-প্রদান করা বার্তা পড়তে পারবে, চাইলে নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দিতে পারবে বা সেখানে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারবে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের আগেই অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো হুয়াওয়ের সঙ্গে ব্যবসা না করার জন্য একটা চাপ সৃষ্টি করেছিল। এই দেশগুলোর মধ্যে আছে 'ফাইভ আই'স' বলে পরিচিত একটি গ্রুপ। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া গ্রুপের বাকী চারটি দেশ হচ্ছে যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড। এই পাঁচটি দেশের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের জন্য খুবই ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা আছে। এর বেশিরভাগটাই করা হয় ইলেকট্রনিক উপায়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে এই পাঁচ দেশের কোনো দেশ যদি হুয়াওয়ের নেটওয়ার্ক তাদের গুরুত্বপূর্ণ কোনো ইনফরমেশন সিস্টেমে বসায়, তাহলে সেই দেশের সঙ্গে তারা আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য শেয়ার করতে পারবেন না।
হুয়াওয়ে অবশ্য বারবার জোর দিয়ে বলেছে, তারা কখনোই চীন সরকারের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করবে না। কিন্তু সমালোচকরা একটি চীনা আইনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন যার কারণে কোনো কোম্পানির পক্ষে গোয়েন্দা তথ্য চেয়ে চীনা সরকারের অনুরোধ উপেক্ষা করা প্রায় অসম্ভব হবে।
হুয়াওয়ে আরও বলছে, যদি তাদের যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করা হয় সেটি মার্কিন ভোক্তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করবে। কারণ এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে হুয়াওয়ের বিকল্প হিসেবে তার চেয়ে অনুন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে এবং ফাইভ-জি প্রযুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্র যে এ ধরণের 'প্রযুক্তি গুপ্তচরবৃত্তির' ভয় করছে, তার কারণ হয়তো তারা নিজেরাই এরকম কাজ করেছে বছরের পর বছর। এনএসএ'র সাবেক কন্ট্রাক্টর এডওয়ার্ড স্নোডেন তার ফাঁস করা তথ্যে দেখিয়েছেন কীভাবে মার্কিন নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বড় বড় মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানির নেটওয়ার্ক হ্যাক করে তথ্য চুরি করতো। এর মধ্যে গুগল এবং ইয়াহুর মতো কোম্পানি পর্যন্ত আছে।
কাজেই প্রতিদ্বন্দ্বী একটি দেশের কোম্পানিকে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ যুক্তরাষ্ট্রের আছে।
রোবট এবং অস্ত্র কেলেংকারি
অতিদ্রুত গতির ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কের উদাহরণ দিয়ে জিনিসটা বোঝানো হয়তো কঠিন। কিন্তু হুয়াওয়েকে ঘিরে অন্য কেলেংকারিটি বোঝা অতটা কঠিন নয়। তাদের এক প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে একটি রোবটের হাত চুরির অভিযোগ আনা হয়। তবে এই প্রকৌশলী অভিযোগ করছেন, এটি চুরি ছিল না, দুর্ঘটনাবশত ব্যাপারটি ঘটেছে।
তিনি টি-মোবাইলের ডিজাইন ল্যাবে গিয়েছিলেন। সেখানে একটি রোবটের হাত ব্যবহার করে স্মার্টফোনের স্ক্রীন পরীক্ষা করা হয়। এই যন্ত্রটি দুর্ঘটনাবশত তার ব্যাগের মধ্যে পড়ে যায়। যখন তিনি ল্যাব থেকে বেরিয়ে আসছিলেন, তখন বিষয়টি খেয়াল করেননি।
জার্মান কোম্পানি টি-মোবাইলের সঙ্গে তখন হুয়াওয়ের পার্টনারশীপ ছিল। টি-মোবাইল এই কথা বিশ্বাস করেনি। এরপর দুই কোম্পানির মধ্যে সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়।
নতুন কিছু ইমেল ফাঁস হওয়ার পর এই কেলেংকারি নিয়ে আবার কথাবার্তা শুরু হয়েছে। এসব ইমেলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে এই প্রকৌশলী হয়তো চীনে তার উর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তার নির্দেশে এই কাজ করেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে গত বছর যে কানাডায় হুয়াওয়ের চীফ ফিনান্সিয়াল অফিসার মেং ওয়ানজুকে গ্রেফতার করা হয়, তার একটি কারণ এটি।
ইরানের সঙ্গে গোপন আঁতাত?
মিজ মেং ওয়ানজু তাকে কানাডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়ার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালাচ্ছেন। গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেছেন। ইরানের সঙ্গে কোনো গোপন আঁতাতের কথাও তিনি উড়িয়ে দিচ্ছেন।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছিল যে তেহরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা কীভাবে ফাঁকি দেয়া যায়, সেরকম এক ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তিনিও যোগ দিয়েছিলেন স্কাইকম নামের একটি কোম্পানির মাধ্যমে।
ইরানের সঙ্গে তার ব্যবসায়িক লেনদেনের অনেক কিছুর ব্যাপারে তিনি ব্যাংকগুলোকে এবং মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে মিথ্যে কথা বলেছেন বলেও অভিযোগ আছে।
মিজ মেং হচ্ছেন হুয়াওয়ের প্রতিষ্ঠাতার কন্যা। যদি তাকে বিচারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয় এবং তিনি দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে ৩০ বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে তার।
স্মার্টফোনের ভাঙ্গা স্ক্রীন এবং অঙ্গীকার খেলাপ
ব্লুমবার্গের দেয়া তথ্য অনুসারে, হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে আরও কিছু অভিযোগ তদন্ত করছে যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই। এর একটি হচ্ছে তারা পরীক্ষা করে দেখার নামে ধার নেয়া একটি স্মার্টফোনের স্ক্রিনের নমুনা যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে পাচার করে দিয়েছিল।
মোবাইল ফোনের স্ক্রিন খুব সহজেই ভেঙ্গে যায়। কাজেই এমন একটি স্ক্রিন যদি তৈরি করা যায়, যেটি কোনভাবেই ভাঙ্গবে না, সেটি যেকোন প্রযুক্তি কোম্পানির জন্যই একটি বিরাট আশীর্বাদ হয়ে উঠতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে আখান সেমিকন্ডাক্টার নামের একটি কোম্পানি এরকম একটি কাঁচ তৈরি করে হুয়াওয়েকে দেয়ার প্রস্তাব দেয়। এটি নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা চলছিল। তারা হীরের প্রলেপ দেয়া যে কাঁচের স্ক্রিনটি হুয়াওয়েকে দেয়, সেটি যখন কয়েক মাস পর ফেরত আসে, দেখা গেল সেটি ভাঙ্গা। ব্লুমবার্গের ভাষ্য অনুযায়ী, এটি যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
এফবিআই এটি তদন্ত করছে। যুক্তরাষ্ট্রের আইনে এভাবে এটি দেশের বাইরে নেয়া অবৈধ ছিল। হীরের প্রলেপ দেয়া কোনো জিনিস এভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে নেয়া যায় না, কারণ এ ধরনের জিনিস লেজার অস্ত্রে ব্যবহার করা যায়।
চীনা কোম্পানি হুয়াওয়ে এই অভিযোগও অস্বীকার করছে।
এখানেই গল্পের শেষ নয়
কিন্তু এসব কেলেংকারি, গুগলের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ সত্ত্বেও বিশ্বের প্রযুক্তি জগতে হুয়াওয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানি হিসেবে রয়েই যাবে।
আফ্রিকা এবং এশিয়ার অনেক দেশেই হুয়াওয়ের প্রযুক্তির দাম ইউরোপ এবং আমেরিকার প্রযুক্তির চেয়ে কম। কাজেই এসব দেশে হুয়াওয়ের ব্যবসা বাড়তেই থাকবে।
এমনকি যুক্তরাজ্যে, যারা কীনা যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র, এখনো তীব্র বিতর্ক চলছে হুয়াওয়েকে ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক তৈরি করতে দেয়া উচিত কীনা। সম্প্রতি ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে বরখাস্ত করা হয়েছিল চীনা প্রযুক্তি ব্যবহার নিয়ে এই বিতর্কে।
হুয়াওয়েকে ব্যবসা করতে দেয়া হবে কি হবে না, সেই সিদ্ধান্ত এখনো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। হুয়াওয়েকে ঘিরে আর সব কিছুর মতো, এক্ষেত্রেও কী হবে, তা এখনো অনিশ্চিত। সূত্র : বিবিসি।
No comments