ঝরনা-পাহাড়-নদীতে একদিন by মতিউর রহমান
সুনীল দিগন্তে মন হারায়... |
ভোরবেলায় ঘুম ভাঙতেই জানালায় বাইরে তাকিয়ে বুঝলাম রাঙামাটির
রাস্তায় পৌঁছে গেছি। দু’পাশে পাহাড়ি টিলা জুড়ে ঘন বন। আঁকাবাঁকা পথ মাড়িয়ে
বাস ছুটে চলেছে কাপ্তাইয়ের পথে। কাপ্তাই পর্যন্ত যেতে যেতে এদিক-ওদিক সবুজ
দেখে অনেকদিন পর প্রাণ জুড়িয়ে গেলো।
কাপ্তাই জেটিঘাট পৌঁছে রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলা যাওয়ার নৌকায় চেপে
বসলাম। ছইতোলা নৌকা। দু’পাশে বসার জায়গা আছে। নৌকা চলা শুরু করতেই ছইয়ের
ভেতর বসে থাকা গেলো না! তাই ছইয়ের ওপর চড়ে বসলাম। নদীর দু’পাশ অসাধারণ।
টিলা আর পাহাড়ের সারির মাঝে দিয়ে বয়ে গেছে নদী। একটু পরপর ইঞ্জিনচালিত
নৌকাগুলো পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল।
মাঝে মধ্যে টিলাগুলোর মাথায় ছোট ছোট কাঠের বাড়ি চোখে পড়লো। প্রতিটি বাড়ি
থেকেই নদী পর্যন্ত সোজাসুজি পায়ে হাঁটা পথ। সেখানে নৌকা বাঁধা। নদীর ঘাটে
শিশু-কিশোরদের ছুটোছুটি চোখে পড়লো। ছোটবেলায় পড়ার বইয়ে নদীমাতৃক বাংলাদেশ
নিয়ে যেসব লেখা পড়েছিলাম তা যেন এখানে জীবন্ত।
বিলাইছড়ি ঘাটে পৌঁছে মনে হলো এই নদীপথ আরও দীর্ঘ হলে খারাপ হতো না।
বিলাইছড়ি থেকে হাঁটাপথে মুপ্পোছড়ি ঝরনা যেতে লাগে প্রায় দুই ঘণ্টার মতো।
পাহাড়ি পথ বেয়ে খাড়া মাথায় উঠতে হয়। নামার পন্থাও একই।
দু’পাশে
নাম না জানা নানান প্রজাতির গাছপালা। বুনোফুল তো আছেই। আমরা হেঁটে হাঁপিয়ে
ওঠার পর একটু বিশ্রাম নিতে একটি কূপের পাশে আশ্রয় নিলাম। কয়েকজন আদিবাসীর
সঙ্গে দেখা হলো সেখানে। মধ্যদুপুরের দাবদাহে তৃষ্ণা মেটাতে এখানে থেমেছেন
তারা। কথায় কথায় যা জানালেন তারা তা শুনে মাথা চক্কর দেওয়ার দশা! তারা
বাড়ির পথে রওনা দিয়েছেন সকালে, ঘরে পৌঁছাতে বেজে যাবে রাত প্রায় ১০টা-১১টা
এবং পুরোটা পথ হেঁটেই যেতে হবে তাদের। কোনও যানবাহন চলে না এই দুর্গম পথে।
যেতে যেতে চোখে পড়লো আদিবাসীদের বাঁশ ও কাঠের বাড়ি। বাঁশের চাটাইয়ের ওপর
দোকানের পসরা মেলে বসেছেন তারা। এখানে আড়াই টাকায় মিললো কলা আর ১০ টাকায়
জাম। এসব ফলের স্বাদ ভোলার নয়।
ঝরনা
থেকে পানি নেমে তৈরি হয়েছে পাথুরে খাল। তাতে বসে আদিবাসী শিশু-কিশোররা
খেলাধুলায় মেতেছে। খালের পাশে পাওয়া গেলো সুপেয় পানির আধার। পাথর চুঁইয়ে
এসে জমা হচ্ছে বিশুদ্ধ পানি। ঢাকা ওয়াসার শতভাগ সুপেয় পানি পান করতে ভয়
লাগলেও খোলা আকাশের নিচের ওই পানি গিলতে একটুও সংকোচ হয়নি।
পাথুরে পথ অনেকটা হেঁটে বেশ হয়রান আমরা। ঝরনার কাছাকাছি আসতেই নেমে আসা
পানির খাল হয়ে দাঁড়ালো পথ। পাথুরে খাল এতই পিচ্ছিল যে, একটু ভুল করলেই
হাত-পা ভাঙার আশঙ্কা। অথচ এমন ভয়ানক পথে কয়েকজন আদিবাসী গাছের গুঁড়ি কাঁধে
নিয়ে অনায়াসে হেঁটে যাচ্ছেন। কী অদ্ভুত জীবনীশক্তি তাদের!
এদিকে
পথ যেন শেষ হতেই চাইছে না। গাইডকে যখনই জিজ্ঞেস করছি, আর কতদূর? তার একই
জবাব— ‘আর আধঘণ্টা’। এমনকি মূল ঝরনার বাঁকে পৌঁছে যখন গন্তব্য নিয়ে জানতে
চাইলাম, তখনও তিনি উত্তর দিলেন— ‘আর আধঘণ্টা’। বাঁকঘুরেই ঝরনার দেখা পেয়ে
গাইডের সময়জ্ঞানের বহর দেখে একচোট হেসে নিলাম। তুমুল গরমে ঝরনার দেখা পেয়ে
লোভ সামলানো মুশকিল। খাড়া পাহাড় থেকে নেমে আসছে জলধারা। চারপাশে পাহাড়,
পানির শব্দ আর আমরা ক’জন ছাড়া কিছুই নেই। এবার দৌড়ে গিয়ে ঝরনার শীতল পানির
নিচে দাঁড়িয়ে এতক্ষণের ক্লান্তি দূর করার পালা।
------দরকারি তথ্য----
বিলাইছড়ি যেতে হলে মাঝপথে বিজিবি/সেনাবাহিনী ক্যাম্পে চেক-ইন করতে হয়। সেখানে নাম-ঠিকানা জানানোর পাশাপাশি জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি দিতে হবে। পাসপোর্টের ফটোকপি হলেও চলবে। এরপর তারা ছবি তুলে ছেড়ে দেবে।
বিলাইছড়ি যেতে হলে মাঝপথে বিজিবি/সেনাবাহিনী ক্যাম্পে চেক-ইন করতে হয়। সেখানে নাম-ঠিকানা জানানোর পাশাপাশি জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি দিতে হবে। পাসপোর্টের ফটোকপি হলেও চলবে। এরপর তারা ছবি তুলে ছেড়ে দেবে।
------যেভাবে যাবেন-----
ঢাকা থেকে কাপ্তাই যেতে হবে বাসে। প্রায় ৮ ঘণ্টার ভ্রমণ। হানিফ, শ্যামলী, গ্রিন লাইন, সেন্টমার্টিন পরিবহন প্রতিদিন রাতে রওনা দেয় কাপ্তাইয়ের পথে। কল্যাণপুর বা পান্থপথ কাউন্টার থেকে টিকিট কাটা যায়। নন-এসি বাসে ভাড়া পড়বে ৫৫০ টাকা।
ঢাকা থেকে কাপ্তাই যেতে হবে বাসে। প্রায় ৮ ঘণ্টার ভ্রমণ। হানিফ, শ্যামলী, গ্রিন লাইন, সেন্টমার্টিন পরিবহন প্রতিদিন রাতে রওনা দেয় কাপ্তাইয়ের পথে। কল্যাণপুর বা পান্থপথ কাউন্টার থেকে টিকিট কাটা যায়। নন-এসি বাসে ভাড়া পড়বে ৫৫০ টাকা।
বাস থেকে নেমে যেতে হবে জেটিঘাটে। এটি বাস কাউন্টারের কাছেই। জেটিঘাট
থেকে বিলাইছড়ি দুই ঘণ্টার নদী পথ। নৌকা রিজার্ভ নিতে চাইলে ভাড়া পড়বে ১৫০০
টাকা থেকে ২৫০০ টাকা। স্থানীয়দের সঙ্গে মিলেমিশে গেলে ৬০ টাকা ভাড়া। সকাল
সাড়ে ৮টায় প্রথম নৌকা ছাড়ে। এরপর সকাল সাড়ে ১০টায় আরেকটি রওনা দেয়। মাঝখানে
বিরতি নিয়ে বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে দুই ঘণ্টা পরপর আবারও নৌকা ছেড়ে যায়।
ফেরার পথও একই।
-------কোথায় থাকবেন------
বিলাইছড়িতে রাতে থাকার মতো ভালো হোটেল নেই। যেগুলো আছে ভাড়া খুব কম। দুইজনের রুম ৩০০ টাকায় পাওয়া যাবে। বড় রুম নিতে চাইলে একহাজার অথবা ১২০০ টাকা পড়বে। যদি রাতের আগে ভ্রমণ শেষ হয় তাহলে কাপ্তাই এসে রাতে থাকা ভালো। কাপ্তাই জেটিঘাট থেকে আধঘন্টার দূরত্বে বিজিবি নিয়ন্ত্রিত প্যানোরোমা জুম রেস্তোরাঁর ভেতরে এসি/ নন-এসি সব ধরনের কটেজ মিলবে। ভাড়া পড়বে ১৫০০ টাকা থেকে ৩৫০০ টাকা।
বিলাইছড়িতে রাতে থাকার মতো ভালো হোটেল নেই। যেগুলো আছে ভাড়া খুব কম। দুইজনের রুম ৩০০ টাকায় পাওয়া যাবে। বড় রুম নিতে চাইলে একহাজার অথবা ১২০০ টাকা পড়বে। যদি রাতের আগে ভ্রমণ শেষ হয় তাহলে কাপ্তাই এসে রাতে থাকা ভালো। কাপ্তাই জেটিঘাট থেকে আধঘন্টার দূরত্বে বিজিবি নিয়ন্ত্রিত প্যানোরোমা জুম রেস্তোরাঁর ভেতরে এসি/ নন-এসি সব ধরনের কটেজ মিলবে। ভাড়া পড়বে ১৫০০ টাকা থেকে ৩৫০০ টাকা।
-------কী খাবেন------
বিলাইছড়িতে যাওয়ার পথে পানির তৃষ্ণা পাবে। তাই সঙ্গে বিশুদ্ধ পানি রাখতে হবে। বিলাইছড়ি বাজারে বেশকিছু রেস্তোরাঁ আছে। তবে সকাল ৯টার মধ্যে পরোটা ভাজা বন্ধ করে দেয় সেগুলো, সুতরাং আগেই খেয়ে নেওয়া উচিত। এছাড়া গাইডের সঙ্গে কথা বলে খাবারের ব্যবস্থা করা যায়। আর প্যানোরোমা জুম রেস্তোরাঁয় উঠলে সেখানকার খাবার মিস করা উচিত হবে না!
বিলাইছড়িতে যাওয়ার পথে পানির তৃষ্ণা পাবে। তাই সঙ্গে বিশুদ্ধ পানি রাখতে হবে। বিলাইছড়ি বাজারে বেশকিছু রেস্তোরাঁ আছে। তবে সকাল ৯টার মধ্যে পরোটা ভাজা বন্ধ করে দেয় সেগুলো, সুতরাং আগেই খেয়ে নেওয়া উচিত। এছাড়া গাইডের সঙ্গে কথা বলে খাবারের ব্যবস্থা করা যায়। আর প্যানোরোমা জুম রেস্তোরাঁয় উঠলে সেখানকার খাবার মিস করা উচিত হবে না!
--------যা যা করতে পারেন-------
প্রথম দিন মুপ্পোছড়া ঝরনা দেখবেন। ঝরনার পথে যেতে দরকার হবে গাইড। নৌকা থেকে নামলেই গাইডরা যোগাযোগ করবে। তাদের দিতে হবে ৫০০ টাকার মতো। এরপর ধূপপানি ঝরনা দেখতে চাইলে পুরোদিন লাগবে যাওয়া-আসার জন্য। সেক্ষেত্রে নৌকা ভাড়া পড়বে ২০০০ টাকা থেকে ৪৫০০ টাকা পর্যন্ত। কায়াকিং করতে চাইলে ফেরার দিনে কাপ্তাই ফেরিঘাটে পৌঁছে প্যানোরোমা জুম রেস্তোরাঁয় যাবেন। বিজিবি নিয়ন্ত্রিত এই স্পট একটি লেককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। বসে সময় কাটানোর জন্যে বেশ মনোরম পরিবেশ রয়েছে এতে।
প্রথম দিন মুপ্পোছড়া ঝরনা দেখবেন। ঝরনার পথে যেতে দরকার হবে গাইড। নৌকা থেকে নামলেই গাইডরা যোগাযোগ করবে। তাদের দিতে হবে ৫০০ টাকার মতো। এরপর ধূপপানি ঝরনা দেখতে চাইলে পুরোদিন লাগবে যাওয়া-আসার জন্য। সেক্ষেত্রে নৌকা ভাড়া পড়বে ২০০০ টাকা থেকে ৪৫০০ টাকা পর্যন্ত। কায়াকিং করতে চাইলে ফেরার দিনে কাপ্তাই ফেরিঘাটে পৌঁছে প্যানোরোমা জুম রেস্তোরাঁয় যাবেন। বিজিবি নিয়ন্ত্রিত এই স্পট একটি লেককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। বসে সময় কাটানোর জন্যে বেশ মনোরম পরিবেশ রয়েছে এতে।
কাপ্তাই জেটিঘাট থেকে সিএনজি ভাড়া ২০০ টাকার মতো পড়ে। আর জুম রেস্তোরাঁয়
ঢোকার প্রবেশমূল্য ২০ টাকা। ২০০ টাকায় একটি কায়াক বোট পাওয়া যাবে একঘণ্টার
জন্য। দু’জন বসে কায়াকিং করা যাবে। পাশেই প্রশান্তি পার্ক। সেখানেও ঢুঁ
দিলে মন্দ লাগবে না!
>>>ছবি: লেখক
No comments