‘মানব পাচাররোধে সরকার নির্লিপ্ত’
মানব পাচাররোধে সরকার নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করছে বলে মন্তব্য করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) নেতৃবৃন্দ। তারা মনে করেন, সুশাসনের ঘাটতি, সরকারের অবিবেচনাপূর্ণ নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবতা অস্বীকার করার প্রবণতার কারণে এ সঙ্কটের সৃষ্টি। তাছাড়া দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় ও বৈধভাবে অভিবাসনের সুযোগ না পাওয়ায় অবৈধপথে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। যে কারণে মানব পাচার চক্রের শিকারে পরিণত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এভাবে চলতে থাকলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের সুনাম নষ্ট হবে বলে মনে করছেন সুজন নেতৃবৃন্দ। মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ‘মানব পাচার বন্ধে করণীয়’- শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করে। বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বাংলাদেশ থেকে বহির্বিশ্বে অভিবাসন সামপ্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমে গেছে। একই সময় প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থের পরিমাণও পূর্বের তুলনায় কমে যায়। অবৈধ অভিবাসনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার একটি বড় কারণ হলো ক্রমাগতভাবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা হ্রাস। মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধির একটি বড় উৎস হলো মানসম্মত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ। এছাড়াও বিনিয়োগের স্থবিরতার কারণে গ্রামে অন্য কোন বিকল্প কর্মসংস্থানেরও সুযোগ নেই। তাই জীবন-জীবিকার সন্ধানে মানুষ বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। সরকারিভাবে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীসহ নানান ধরনের কার্যক্রম প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের কাছে যথাযথভাবে না পৌঁছানোও মানব পাচারের অন্যতম একটি কারণ বলেও উল্লেখ করেন তিনি। মানব পাচার বন্ধে করণীয় সম্পর্কে সুজন সম্পাদক বলেন, মানবপাচার বন্ধ করতে হলে সরকারের নীতি-কাঠমোতে কতগুলো মৌলিক পরিবর্তন আনা জরুরি। বিশেষত আমাদের জন্য একটি নতুন সামাজিক চুক্তির দরকার। যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদের একটি অংশ সরাসরি দরিদ্রদের কাছে হস্তান্তরের একটি ব্যবস্থা। একই সঙ্গে দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাও জরুরি। সুজন সভাপতি এম. হাফিজউদ্দিন খান বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশ থেকে মানব পাচার হয়ে আসছে। কিন্তু সরকার আমাদের নাগরিকদের পাচার হওয়া বন্ধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেনি। তাই মানব পাচার বন্ধে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি স্টিনা লুংডেল বলেন, দুই থেকে তিন হাজার ডলার ব্যয় করে এদেশের মানুষ সমুদ্র পথে বিদেশ যাচ্ছে। কিন্তু যারা আদৌ দেশের বাইরে যেতে চায় না তাদেরকেও সাগরে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া গেছে। কারণ তাদের অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ইউএনএইচসিআর-এর তথ্যমতে, ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাসে বঙ্গোপসাগর দিয়ে ২৫ হাজার ব্যক্তি অবৈধভাবে দেশত্যাগ করে। এই সংখ্যা ২০১৩ এবং ২০১৪ এর একই সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এই ২৫ হাজার উদ্বাস্তুর প্রায় ৪০-৬০ শতাংশ মিয়ানমারের। আর বাকি প্রায় সকল যাত্রীই বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা থেকে গিয়েছিল। তিনি আরও বলেন, সমগ্র প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত রয়েছে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার আইন প্রণয়নকারী সংস্থা ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কিছু কর্মকর্তা। এদের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া এতবড় অপকর্ম সম্ভব নয়। এ অপকর্ম তথা মানব পাচার বা অবৈধ অভিবাসন রোধে আমাদেরকে স্ব স্ব অবস্থান থেকে ভূমিকা পালন করতে হবে। কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, বৌদ্ধ মৌলবাদ ও উগ্র বার্মিজ জাতীয়তাবাদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। থাইল্যান্ড একজন সেনাকর্মকর্তাকে বরখাস্ত করেছে মানব পাচারে জড়িত থাকার কারণে। দুঃখজনক হচ্ছে- আমরা বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত একজন কনস্টেবল বরখাস্ত করতে পারিনি। ছোটখাট দালাল গুলি করে মারলে এ সমস্যার সমাধান হবে না। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, দেশে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে এবং বৈধভাবে অভিবাসন কমে যাওয়ায় মানব পাচার তথা অবৈধ অভিবাসন বাড়ছে। সরকারি উদ্যোগে বিদেশ নেয়ার কার্যক্রম ব্যর্থ হয়েছে। আমি মনে করি, সরকার এটি নিয়ে ব্যবসা করতে পারে না। সঠিক তদারকির মাধ্যমে বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে অভিবাসী প্রেরণের কাজ করতে দেয়া উচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অভিবাসী বিশেষজ্ঞ ড. সিআর আবরার বলেন, জি-টুজি প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। গণমাধ্যমের চাপে পড়ে ক্রসফায়ারে কয়েকজন মানব পাচারকারীকে পুলিশ মেরেছে। এতে উচ্চপর্যায়ের মানব পাচারকারীদের ধরতে যে প্রমাণ দরকার ছিল তা নষ্ট হয়ে গেছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লাখ অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা বসবাস করছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও সুজন জাতীয় কমিটির সদস্য মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, মানব পাচার বন্ধে মিয়ানমার, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের যৌথ উদ্যোগ ও সহযোগিতা দরকার। প্রয়োজনে জাতিসংঘকে এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়া পাচারকারী এবং যেসব সরকারি কর্মকর্তা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। বেলা’র নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এদেশের জনগণ সাগর পাড়ি দিচ্ছে। কারণ রাষ্ট্র তাদের মৌলিক অধিকার দিতে ব্যর্থ হয়েছে। পাসপোর্ট ছাড়াই মানুষ শিলং চলে যাচ্ছে। বর্ডার কর্তৃপক্ষ কিছুই জানছে না। সুজন সভাপতি এম. হাফিজউদ্দিন খানের সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য রাখেন নির্বাহী সদস্য ড. হামিদা হোসেন, সহ-সম্পাদক জাকির হোসেন, জাতীয় কমিটির সদস্য সুমাইয়া ইসলাম প্রমুখ।
No comments