হেরে গেলে জানবে প্রস্তুতি পরিপূর্ণ ছিল না by তানজীনা ইয়াসমিন
আমাদের
জাতীয় ক্রিকেট দল এখন অনেক পরিণত। যে কোনো দলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায়
প্রবাসে ভিনদেশিদের মাঝেও উন্নত শিরে খেলা দেখে বিজয়ের হাসি হাসতে পারি!
তবুও জাতীয় দলের উদ্দেশে জাপানের একটি খেলার গল্প বলি। আমরা বাস করি
জাপানের উত্তরে, কিউশ্যুর ফুকুওকায়।
কনিষ্ঠ পুত্রের বাস্কেটবলের গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্ট দেখতে গেলাম নাগাসাকির কাছে। আমাদের শহর থেকে গাড়িতে ঘণ্টা দুয়েক লাগে। ভোর সাতটায় গেলাম, রাত সাড়ে আটটায় ফিরলাম। বাসায় অপেক্ষা করছে স্তূপীকৃত কাজ। এ ছাড়া পরদিন সাপ্তাহিক কর্মদিবসের শুরু। সমস্ত শরীর মোটর নিউরনে আক্রান্তের মতো বোধগম্য নিস্তেজ মনে হচ্ছে।
তবে, গিয়ে এক অভিজ্ঞতাই হলো বটে! জাপানিরা খাটো হয়—এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে-পরে জন্ম নেওয়া প্রজন্মের জন্যই প্রযোজ্য। ৬০ বছরের নিচে সর্বনিম্ন উচ্চতার কোনো নারী ৫ ফুটের নিচে দেখিনি, পুরুষ ৫ ফুট ৫ ইঞ্চির নিচে দেখিনি। আর বাস্কেটবল তো দীর্ঘদেহীদেরই খেলা।
টুর্নামেন্টে গিয়ে দেখি ১৪ বছরের ছেলেও কয়েকটা আছে, ৬ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা। গায়ে অসুরের শক্তি—যেটা এই খেলায় খুবই উপযোগী। স্কুলটার বাস্কেটবল ক্লাব জাপানের জুনিয়র হাইস্কুলের মধ্যে সেরা।
কোচও জাপানের সেরা বাস্কেটবল কোচ।
প্রচণ্ড বদরাগী এক আধবুড়া, ৫৫ বছর বয়সে লাল টকটকে প্যান্ট, চক্রাবক্রা কোট পরে কোর্টের বাইরে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত চিৎকার করতে করতে পুরা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।
কারও একবারের বেশি কোনো ভুল হলেই একেবারে গগনবিদারী চিৎকার করে তাকে বসিয়ে দিয়ে অপেক্ষমাণ খেলোয়াড় একটার মাথায় ঠকাশ করে চাটি মেরে, ওঠ, যা বলে নামিয়ে দিচ্ছে। খেলার মাঝখানেও খেলা থামিয়ে ডেকে নিয়ে সামুরাই ঝাড়ি! ১২ থেকে ১৫ বছরের সব বাচ্চা ক্রমাগত গালির ওপর ঘেমে নেয়ে পর পর তিনটা ম্যাচ খেলল এবং চ্যাম্পিয়ন হলো! এই পরিমাণ চাপ নিয়ে বাচ্চাগুলো বছরের প্রায় ৩৬৫ দিন খেলে যায়। ছুটি নিলে নাকি ফর্ম পরে যাবে।
একেই বলে সাধনা। ওরা জাপানিজ, আমরা বাংলাদেশি বলে কিছু নেই। মানুষ সব দেশে একই রকম। সিস্টেম সবাইকে তার মতো চালিত করে।
এর প্রমাণ আমার ছেলেই। ওর বয়স ১৪ বছর হতে চলেছে, উচ্চতা ৫ ফুট। এলিমেন্টারি স্কুলে ২০১২ সালে যখন ক্লাবে যোগ দিয়েছিল, ভিনদেশি বলে এক বছর ওকে সাইড লাইনে বসিয়ে রেখেছিল। ইউনিফর্ম পর্যন্ত দেয়নি। তা সত্ত্বেও ২০১৩ সালে এলিমেন্টারি লেবেলে আমার ছেলে এই শহরের দ্বিতীয় সেরা খেলোয়াড় হয়েছিল নিরলস পরিশ্রম-সাধনা দিয়ে।
ওর বিদায় অনুষ্ঠানের দিন অনুজ সবাই শপথ নিচ্ছিল তারা ওর মতো হতে চায়। তাদের ধারণাই হয়ে গেছে বাংলাদেশি মানেই অদম্য পরিশ্রমী এক জাতি। সবার প্রশংসা আর মুগ্ধতার দৃষ্টি দেখেই অভ্যস্ত সে ছিল গত ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত।
আর এখন জুনিয়র হাই স্কুলে ওদের মূল দলের সবচেয়ে খাটো ছেলেটাও ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি! জাপানের বিভিন্ন শহরের বাস্কেটবলের সেরারাই এখানে এসেছে। তাই, আমার ছেলে এখন সেকেন্ড গ্রেডে উঠেও মূল দলে কদাচিৎ বদলি খেলোয়াড় হিসেবে ঢুকতে পারছে। এ ছাড়া বাকি সময় অন্য সবার মতো নিয়মিত খেলোয়াড়দের খেদমত করাই ওর কাজ।
আমরা খুব ভালোই বুঝলাম, ও তীব্র অনিচ্ছা নিয়ে খাদেমের কাজগুলি করছে। আরও বুঝলাম সেরা এই টিমে নিয়মিত খেলোয়াড় হতে হলে ওর আসলে আরও কতটা কষ্ট করতে হবে এবং আমাদেরও ওকে কীভাবে complement করতে হবে।
আমাদের জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা বলেন, ফর্ম খারাপ হলেই, বাজে খেললেই টিম থেকে বাদ পড়ার সম্ভাবনা। এসব চাপ নিয়ে ভালো খেলব কীভাবে?
এই শিশুগুলোকে দেখে কি বোঝা যায় ফর্ম ধরে রাখতে কতটা অমানুষিক কষ্ট করতে হয় এবং কোনো মানদণ্ডে দলে নামার উপযোগিতা হারালে কীভাবে মেনে নিয়ে আবারও চেষ্টা চালাতে হয়?
সর্বোপরি এরা ধর্মহীন জাতি। ভাগ্য বলেও কিছুতে বিশ্বাস নেই। হেরে গেলে বলে, প্রস্তুতি পরিপূর্ণ ছিল না, যোগ্য ছিলে না। জিতে গেলে যোগ্য ছিলে, প্রস্তুতি যথাযথ ছিল।
(লেখিকা, প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপান)।
কনিষ্ঠ পুত্রের বাস্কেটবলের গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্ট দেখতে গেলাম নাগাসাকির কাছে। আমাদের শহর থেকে গাড়িতে ঘণ্টা দুয়েক লাগে। ভোর সাতটায় গেলাম, রাত সাড়ে আটটায় ফিরলাম। বাসায় অপেক্ষা করছে স্তূপীকৃত কাজ। এ ছাড়া পরদিন সাপ্তাহিক কর্মদিবসের শুরু। সমস্ত শরীর মোটর নিউরনে আক্রান্তের মতো বোধগম্য নিস্তেজ মনে হচ্ছে।
তবে, গিয়ে এক অভিজ্ঞতাই হলো বটে! জাপানিরা খাটো হয়—এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে-পরে জন্ম নেওয়া প্রজন্মের জন্যই প্রযোজ্য। ৬০ বছরের নিচে সর্বনিম্ন উচ্চতার কোনো নারী ৫ ফুটের নিচে দেখিনি, পুরুষ ৫ ফুট ৫ ইঞ্চির নিচে দেখিনি। আর বাস্কেটবল তো দীর্ঘদেহীদেরই খেলা।
টুর্নামেন্টে গিয়ে দেখি ১৪ বছরের ছেলেও কয়েকটা আছে, ৬ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা। গায়ে অসুরের শক্তি—যেটা এই খেলায় খুবই উপযোগী। স্কুলটার বাস্কেটবল ক্লাব জাপানের জুনিয়র হাইস্কুলের মধ্যে সেরা।
কোচও জাপানের সেরা বাস্কেটবল কোচ।
প্রচণ্ড বদরাগী এক আধবুড়া, ৫৫ বছর বয়সে লাল টকটকে প্যান্ট, চক্রাবক্রা কোট পরে কোর্টের বাইরে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত চিৎকার করতে করতে পুরা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।
কারও একবারের বেশি কোনো ভুল হলেই একেবারে গগনবিদারী চিৎকার করে তাকে বসিয়ে দিয়ে অপেক্ষমাণ খেলোয়াড় একটার মাথায় ঠকাশ করে চাটি মেরে, ওঠ, যা বলে নামিয়ে দিচ্ছে। খেলার মাঝখানেও খেলা থামিয়ে ডেকে নিয়ে সামুরাই ঝাড়ি! ১২ থেকে ১৫ বছরের সব বাচ্চা ক্রমাগত গালির ওপর ঘেমে নেয়ে পর পর তিনটা ম্যাচ খেলল এবং চ্যাম্পিয়ন হলো! এই পরিমাণ চাপ নিয়ে বাচ্চাগুলো বছরের প্রায় ৩৬৫ দিন খেলে যায়। ছুটি নিলে নাকি ফর্ম পরে যাবে।
একেই বলে সাধনা। ওরা জাপানিজ, আমরা বাংলাদেশি বলে কিছু নেই। মানুষ সব দেশে একই রকম। সিস্টেম সবাইকে তার মতো চালিত করে।
এর প্রমাণ আমার ছেলেই। ওর বয়স ১৪ বছর হতে চলেছে, উচ্চতা ৫ ফুট। এলিমেন্টারি স্কুলে ২০১২ সালে যখন ক্লাবে যোগ দিয়েছিল, ভিনদেশি বলে এক বছর ওকে সাইড লাইনে বসিয়ে রেখেছিল। ইউনিফর্ম পর্যন্ত দেয়নি। তা সত্ত্বেও ২০১৩ সালে এলিমেন্টারি লেবেলে আমার ছেলে এই শহরের দ্বিতীয় সেরা খেলোয়াড় হয়েছিল নিরলস পরিশ্রম-সাধনা দিয়ে।
ওর বিদায় অনুষ্ঠানের দিন অনুজ সবাই শপথ নিচ্ছিল তারা ওর মতো হতে চায়। তাদের ধারণাই হয়ে গেছে বাংলাদেশি মানেই অদম্য পরিশ্রমী এক জাতি। সবার প্রশংসা আর মুগ্ধতার দৃষ্টি দেখেই অভ্যস্ত সে ছিল গত ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত।
আর এখন জুনিয়র হাই স্কুলে ওদের মূল দলের সবচেয়ে খাটো ছেলেটাও ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি! জাপানের বিভিন্ন শহরের বাস্কেটবলের সেরারাই এখানে এসেছে। তাই, আমার ছেলে এখন সেকেন্ড গ্রেডে উঠেও মূল দলে কদাচিৎ বদলি খেলোয়াড় হিসেবে ঢুকতে পারছে। এ ছাড়া বাকি সময় অন্য সবার মতো নিয়মিত খেলোয়াড়দের খেদমত করাই ওর কাজ।
আমরা খুব ভালোই বুঝলাম, ও তীব্র অনিচ্ছা নিয়ে খাদেমের কাজগুলি করছে। আরও বুঝলাম সেরা এই টিমে নিয়মিত খেলোয়াড় হতে হলে ওর আসলে আরও কতটা কষ্ট করতে হবে এবং আমাদেরও ওকে কীভাবে complement করতে হবে।
আমাদের জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা বলেন, ফর্ম খারাপ হলেই, বাজে খেললেই টিম থেকে বাদ পড়ার সম্ভাবনা। এসব চাপ নিয়ে ভালো খেলব কীভাবে?
এই শিশুগুলোকে দেখে কি বোঝা যায় ফর্ম ধরে রাখতে কতটা অমানুষিক কষ্ট করতে হয় এবং কোনো মানদণ্ডে দলে নামার উপযোগিতা হারালে কীভাবে মেনে নিয়ে আবারও চেষ্টা চালাতে হয়?
সর্বোপরি এরা ধর্মহীন জাতি। ভাগ্য বলেও কিছুতে বিশ্বাস নেই। হেরে গেলে বলে, প্রস্তুতি পরিপূর্ণ ছিল না, যোগ্য ছিলে না। জিতে গেলে যোগ্য ছিলে, প্রস্তুতি যথাযথ ছিল।
(লেখিকা, প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপান)।
No comments