স্মরণ- আমাদের সঙ্গেই আছেন সরদার স্যার by শান্তনু মজুমদার
সরদার ফজলুল করিম |
আজ
মনীষী সরদার ফজলুল করিমের প্রথম প্রয়াণবার্ষিকী। বিকেলে বাংলা একাডেমি
আয়োজিত প্রয়াণবার্ষিকীর আলোচনা সভায়, ধারণা করি, আমাদের শীর্ষ
বুদ্ধিজীবীদের অনেকে হাজির থাকবেন। তাঁর চিন্তার পথের সহযাত্রীরা, তাঁর
সান্নিধ্যধন্য মানুষেরাও যাবেন নিশ্চয়। বাংলা একাডেমির আয়োজন, আয়োজনটি
ঘিরে কাছের মানুষদের খানিক ব্যস্ততা, আয়োজনের খবর জানতে পারলে হাজির হবেনই
এমন মানুষকে খবর দেওয়া—সবই হয়েছে। কিন্তু তবু আমার একবারও মনে হয় না যে
তিনি আর আমাদের মাঝে নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে আমরা সরদার স্যারের একেবারে শেষের দিকের, সম্ভবত শেষ ব্যাচের ছাত্র। ’৯০ সালে প্রথম বর্ষে যখন তাঁর ছাত্র হই, তখন জানতাম না যে এই ছাত্রত্ব আর কোনো দিন শেষ হবে না। পশ্চিমা রাষ্ট্রচিন্তার ক্লাসে আড়াই হাজার বছরের পুরোনো এক প্রশ্ন সামনে রেখে সত্যিকার অর্থেই আমাদের অনেকের মগজ ধোলাই করে দেন তিনি। মারাত্মক সেই প্রশ্ন—ন্যায় কী? এই প্রশ্ন উত্থাপনকারী হলেন গ্রিসের নগর–রাষ্ট্রগুলোর অধঃপতনে আকুল চিন্তাবিদ প্লেটো। কয়েক বছর পরে, শিক্ষকতায় যুক্ত হওয়ার পরে, স্যারের সঙ্গে বেশি বেশি মেশা শুরুর অনেক পরে, বুঝতে শুরু করি যে প্লেটোর উত্থাপিত প্রশ্নটির উত্তর অনুসন্ধানই স্যারের সারা জীবনের ব্রত। এস্টাবলিশমেন্টের পক্ষের মানুষ অ্যাথেন্সবাসী প্লেটোর পক্ষে সারা জীবন সাফাই গেয়েছেন বাংলার সরদার। অথচ নিজে কোনো দিন কোনো অর্থেই এস্টাবলিশমেন্টের সঙ্গে নেই।
ন্যায় কী? কীভাবে ন্যায় কায়েম হয়? ন্যায় কায়েমের সূত্র কী? ন্যায়কে ভিত্তি ধরে মানুষ কেমন করে মানুষ হয়ে উঠবে? তাঁর মনে হয়েছে, এসব জটিলতার সমাধান আছে সমাজতন্ত্র হয়ে সাম্যবাদে। এ জন্য অবশ্য সরদার স্যারের কোনো তাড়া নেই। তিনি মনে করেন, মানুষের সমাজ গঠিত হতে হাজার বছরও লেগে যেতে পারে; কিন্তু তাতে অস্থির হওয়ার কিছু নেই। স্যারের কথা হচ্ছে, ব্যক্তি হিসেবে সরদার ফজলুল করিম মানুষটি থাকবেন না, কিন্তু মনুষ্য প্রজাতি থেকে যাবে। মানুষের মানুষ হওয়ার সংগ্রামে শরিক হওয়ার গৌরব তাঁকে নির্ভীক করেছে। নির্ভীকতা বলতে সরদার সর্বদা চেঁচানো, ভূতগ্রস্তের মতো বাক্-প্রলাপ, বিপ্লবের সোল এজেন্সি নিয়ে নেওয়া বোঝেন না। তাঁর নির্ভীকতা সৌম্য ও প্রশান্ত। স্কলারশিপে বিদেশে যাওয়া কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চেয়ে নেতারা মনে করলেন যে তাঁকে সাংগঠনিক কাজে বেশি দরকার। সরদার বিনা আক্ষেপে স্কলারশিপ ছাড়েন, মাস্টারি ছেড়ে দেন; পার্টির কাজ করতে থাকেন। মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার কাজ করতে গিয়ে জেল খাটেন ১১ বছর। তাতে কী! এ নিয়ে সরদারের কোনো আক্ষেপ আগে-পরে কখনো দেখা যায় না।
একসময় রাজনীতি থেকে সরে এসে নিবেদিত হন নিবিষ্ট জ্ঞানসাধনায় আর সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতি পর্যবেক্ষণে। সরদার বাঙালিকে বাংলায় পরিচয় করিয়ে দিলেন প্লেটোর রিপাবলিক ও সক্রেটিস-বিষয়ক রচনাবলির সঙ্গে। তিনি অনুবাদ করলেন অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স, রুশোর সোশ্যাল কনট্র্যাক্ট, এঙ্গেলসের অ্যান্টি-ডুরিং-এর মতো যুগান্তকারী গ্রন্থ। অনুবাদগুলোর প্রতিটির ভূমিকায় সরদার নিজেকে উন্মোচন করেন স্বমহিমায়। জ্ঞানচর্চায় প্রাচ্যের জন্য পশ্চিমকে হারাম ঘোষণার নির্বুদ্ধিতা সরদারকে কখনো ভর করেনি। তাই সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল তাঁর কাছে এলিয়েন নন; কাছের মানুষ। রুশো তাঁর প্রাণের সখা। মার্ক্স-এঙ্গেলস তাঁর জীবনদেবতা।
অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত জীবনযাপনের সংগ্রাম, ‘অবুঝ’ এক পুত্রসন্তানের জন্য উৎকণ্ঠা সব সময় ঘিরে ধরে থাকলেও সরদার ফজলুল করিম তাঁর পর্যবেক্ষণগুলো নিয়ে লিখতেই থাকেন, বলতেই থাকেন। আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতি নিয়ে লেখাতে-বলাতে তিনি মানুষের অপার সম্ভাবনার কথা শোনাতেই থাকেন, ভীরুদের সাহস দিতেই থাকেন। এ যুগের তরুণেরা হতাশায় আতঙ্কিত হন। তিনি সতর্ক করেন, ‘ব্যক্তির হতাশা থেকে হতাশার মহামারি হয়।’ ‘হতাশার নিবাস কোথায়?’ তীব্রভাবে জানতে চান সরদার। ইতিহাস–বিস্মৃতি আর ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যান সরদার স্যার। স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থা জিন্দা থাকার বিপদ ও কারণ বোঝাতে থাকেন তিনি। এই বিপদ থেকে পার পাওয়া যে সহজ কর্ম নয়, পারলে তা গণতান্ত্রিক শক্তিকে গুলে খাওয়াতে চান সরদার ফজলুল করিম।
স্বাধীনতার পরে দীর্ঘদিনের ব্যবধানে আবার শিক্ষক হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে; পদ ও পদোন্নতির চিন্তা মাথার বাইরে রেখে। ক্লাসরুমে সরদারে আবিষ্ট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা অনুমেয়ভাবেই অনেক। কিন্তু সরদারে আকৃষ্ট অন্যান্য বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যাও অগুনতি। কেন সবাই পাতলা শরীর, হাফ হাতা জামা পরা, মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরা, লাঠি হাতে লোকটির কাছে ফিরে ফিরে আসে? তিনি প্রজ্ঞাবান, জাতীয়ভাবে পরিচিত এক শীর্ষ বুদ্ধিজীবী। তিনি প্রগতিশীল, তিনি সৎ। আরও অনেক বিশেষণ সরদার ফজলুল করিমের নামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া যায়। কিন্তু আমার বিবেচনায়, সত্যিকার অর্থেই অহম বিসর্জন দিয়ে চলতে পারার গুণের কারণেই অসংখ্য মানুষের মনে পৌঁছে গিয়েছেন তিনি; মগজে আটকে না থেকে।
এটা ঠিক যে সরদার স্যার আর লিখবেন না; বলবেন না। কিন্তু তাঁর সৃষ্টিগুলো আছে, সেগুলো তাঁর অনুসারীদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। শারীরিকভাবে অনুপস্থিত থাকলেও, জীবন ও কর্মের নিদর্শনগুলোর মাধ্যমে নিত্যদিন আমাদের সঙ্গেই থাকবেন সরদার স্যার।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে আমরা সরদার স্যারের একেবারে শেষের দিকের, সম্ভবত শেষ ব্যাচের ছাত্র। ’৯০ সালে প্রথম বর্ষে যখন তাঁর ছাত্র হই, তখন জানতাম না যে এই ছাত্রত্ব আর কোনো দিন শেষ হবে না। পশ্চিমা রাষ্ট্রচিন্তার ক্লাসে আড়াই হাজার বছরের পুরোনো এক প্রশ্ন সামনে রেখে সত্যিকার অর্থেই আমাদের অনেকের মগজ ধোলাই করে দেন তিনি। মারাত্মক সেই প্রশ্ন—ন্যায় কী? এই প্রশ্ন উত্থাপনকারী হলেন গ্রিসের নগর–রাষ্ট্রগুলোর অধঃপতনে আকুল চিন্তাবিদ প্লেটো। কয়েক বছর পরে, শিক্ষকতায় যুক্ত হওয়ার পরে, স্যারের সঙ্গে বেশি বেশি মেশা শুরুর অনেক পরে, বুঝতে শুরু করি যে প্লেটোর উত্থাপিত প্রশ্নটির উত্তর অনুসন্ধানই স্যারের সারা জীবনের ব্রত। এস্টাবলিশমেন্টের পক্ষের মানুষ অ্যাথেন্সবাসী প্লেটোর পক্ষে সারা জীবন সাফাই গেয়েছেন বাংলার সরদার। অথচ নিজে কোনো দিন কোনো অর্থেই এস্টাবলিশমেন্টের সঙ্গে নেই।
ন্যায় কী? কীভাবে ন্যায় কায়েম হয়? ন্যায় কায়েমের সূত্র কী? ন্যায়কে ভিত্তি ধরে মানুষ কেমন করে মানুষ হয়ে উঠবে? তাঁর মনে হয়েছে, এসব জটিলতার সমাধান আছে সমাজতন্ত্র হয়ে সাম্যবাদে। এ জন্য অবশ্য সরদার স্যারের কোনো তাড়া নেই। তিনি মনে করেন, মানুষের সমাজ গঠিত হতে হাজার বছরও লেগে যেতে পারে; কিন্তু তাতে অস্থির হওয়ার কিছু নেই। স্যারের কথা হচ্ছে, ব্যক্তি হিসেবে সরদার ফজলুল করিম মানুষটি থাকবেন না, কিন্তু মনুষ্য প্রজাতি থেকে যাবে। মানুষের মানুষ হওয়ার সংগ্রামে শরিক হওয়ার গৌরব তাঁকে নির্ভীক করেছে। নির্ভীকতা বলতে সরদার সর্বদা চেঁচানো, ভূতগ্রস্তের মতো বাক্-প্রলাপ, বিপ্লবের সোল এজেন্সি নিয়ে নেওয়া বোঝেন না। তাঁর নির্ভীকতা সৌম্য ও প্রশান্ত। স্কলারশিপে বিদেশে যাওয়া কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চেয়ে নেতারা মনে করলেন যে তাঁকে সাংগঠনিক কাজে বেশি দরকার। সরদার বিনা আক্ষেপে স্কলারশিপ ছাড়েন, মাস্টারি ছেড়ে দেন; পার্টির কাজ করতে থাকেন। মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার কাজ করতে গিয়ে জেল খাটেন ১১ বছর। তাতে কী! এ নিয়ে সরদারের কোনো আক্ষেপ আগে-পরে কখনো দেখা যায় না।
একসময় রাজনীতি থেকে সরে এসে নিবেদিত হন নিবিষ্ট জ্ঞানসাধনায় আর সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতি পর্যবেক্ষণে। সরদার বাঙালিকে বাংলায় পরিচয় করিয়ে দিলেন প্লেটোর রিপাবলিক ও সক্রেটিস-বিষয়ক রচনাবলির সঙ্গে। তিনি অনুবাদ করলেন অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স, রুশোর সোশ্যাল কনট্র্যাক্ট, এঙ্গেলসের অ্যান্টি-ডুরিং-এর মতো যুগান্তকারী গ্রন্থ। অনুবাদগুলোর প্রতিটির ভূমিকায় সরদার নিজেকে উন্মোচন করেন স্বমহিমায়। জ্ঞানচর্চায় প্রাচ্যের জন্য পশ্চিমকে হারাম ঘোষণার নির্বুদ্ধিতা সরদারকে কখনো ভর করেনি। তাই সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল তাঁর কাছে এলিয়েন নন; কাছের মানুষ। রুশো তাঁর প্রাণের সখা। মার্ক্স-এঙ্গেলস তাঁর জীবনদেবতা।
অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত জীবনযাপনের সংগ্রাম, ‘অবুঝ’ এক পুত্রসন্তানের জন্য উৎকণ্ঠা সব সময় ঘিরে ধরে থাকলেও সরদার ফজলুল করিম তাঁর পর্যবেক্ষণগুলো নিয়ে লিখতেই থাকেন, বলতেই থাকেন। আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতি নিয়ে লেখাতে-বলাতে তিনি মানুষের অপার সম্ভাবনার কথা শোনাতেই থাকেন, ভীরুদের সাহস দিতেই থাকেন। এ যুগের তরুণেরা হতাশায় আতঙ্কিত হন। তিনি সতর্ক করেন, ‘ব্যক্তির হতাশা থেকে হতাশার মহামারি হয়।’ ‘হতাশার নিবাস কোথায়?’ তীব্রভাবে জানতে চান সরদার। ইতিহাস–বিস্মৃতি আর ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যান সরদার স্যার। স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থা জিন্দা থাকার বিপদ ও কারণ বোঝাতে থাকেন তিনি। এই বিপদ থেকে পার পাওয়া যে সহজ কর্ম নয়, পারলে তা গণতান্ত্রিক শক্তিকে গুলে খাওয়াতে চান সরদার ফজলুল করিম।
স্বাধীনতার পরে দীর্ঘদিনের ব্যবধানে আবার শিক্ষক হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে; পদ ও পদোন্নতির চিন্তা মাথার বাইরে রেখে। ক্লাসরুমে সরদারে আবিষ্ট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা অনুমেয়ভাবেই অনেক। কিন্তু সরদারে আকৃষ্ট অন্যান্য বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যাও অগুনতি। কেন সবাই পাতলা শরীর, হাফ হাতা জামা পরা, মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরা, লাঠি হাতে লোকটির কাছে ফিরে ফিরে আসে? তিনি প্রজ্ঞাবান, জাতীয়ভাবে পরিচিত এক শীর্ষ বুদ্ধিজীবী। তিনি প্রগতিশীল, তিনি সৎ। আরও অনেক বিশেষণ সরদার ফজলুল করিমের নামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া যায়। কিন্তু আমার বিবেচনায়, সত্যিকার অর্থেই অহম বিসর্জন দিয়ে চলতে পারার গুণের কারণেই অসংখ্য মানুষের মনে পৌঁছে গিয়েছেন তিনি; মগজে আটকে না থেকে।
এটা ঠিক যে সরদার স্যার আর লিখবেন না; বলবেন না। কিন্তু তাঁর সৃষ্টিগুলো আছে, সেগুলো তাঁর অনুসারীদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। শারীরিকভাবে অনুপস্থিত থাকলেও, জীবন ও কর্মের নিদর্শনগুলোর মাধ্যমে নিত্যদিন আমাদের সঙ্গেই থাকবেন সরদার স্যার।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।
No comments