আন্তর্জাতিক- 'কোরীয় অঞ্চলে নতুন উত্তেজনা কত দূর যেতে পারে?' by জগলুল আহমেদ চৌধূরী

কোরীয় অঞ্চলে নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে এবং যেভাবে এই পরিস্থিতির উদ্রেক হয়েছে, অনেকেই মনে করছেন, বর্তমানের উত্তাপ অনেক দূর গড়াতে পারে। অনেকে এটাও মনে করছেন, কোরীয় যুদ্ধের পর থেকে দুই কোরিয়ার মধ্যে যতবারই গভীর উত্তেজনার সঞ্চার হয়েছে, বর্তমানের ঘটনাপ্রবাহ সেই তুলনায় অনেকটাই বেশি উত্তপ্ত। সে কারণে বিশ্বব্যাপী এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং কোরীয় অঞ্চলে ভয়াবহ যুদ্ধের আশঙ্কাও বিরাজ করছে। যদি সত্যি শেষ পর্যন্ত বর্তমান উত্তেজনার ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায় এবং সংঘর্ষ পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়, সে ক্ষেত্রে সংঘর্ষ কী রূপ নিতে পারে_সেটা অনুধাবন করা খুব কঠিন নয়।
কেননা, বৃহৎ শক্তিবর্গ এই যুদ্ধে সম্পৃক্ত হয়ে যেতে পারে এই কারণে যে কোরীয় অঞ্চলে তাদের বিভিন্ন ধরনেরই স্বার্থ রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, উত্তর কোরিয়া_যার কারণে বর্তমানের উত্তেজনার সৃষ্টি বলে মনে করা হচ্ছে, আণবিক অস্ত্রে সজ্জিত এবং সে কারণে যেকোনো সংঘর্ষের ভয়াবহতা সহজেই অনুমেয়। যদি দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে উত্তর কোরিয়া সেই বিপজ্জনক অস্ত্র ব্যবহার করে, তাহলে সামগ্রিক পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, বলা কঠিন। তবে এটা বলা যায় যে দক্ষিণ কোরিয়ার ঘনিষ্ঠতম মিত্র বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয়ই বসে থাকবে না এবং মিত্রকে রক্ষার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। অন্যদিকে উত্তরের মিত্র চীনের ভূমিকা কী হতে পারে, সেটা বুঝতে খুব বিশ্লেষণের প্রয়োজন হওয়ার কথা নয়।
কোরীয় উপদ্বীপের সংকট বিশ্বে নতুন কিছু নয়। ১৯৫০-৫৩ সাল থেকে কোরীয় যুদ্ধের পর সেই অঞ্চলে যুদ্ধ বন্ধ হলেও উত্তেজনা বিরাজ করছে কমিউনিস্ট উত্তর ও গণতান্ত্রিক দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে। একটি শান্তিচুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান হয় সত্য, কিন্তু যে কারণগুলো সেই সংকটের সূত্র, সেগুলো নিরসন করা আজও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ফলে কোরীয় উপদ্বীপ পৃথিবীর একটি উত্তেজনাপূর্ণ অঞ্চল হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে। কট্টরপন্থী উত্তর কোরিয়া স্বাভাবিকভাবেই আদর্শগত কারণে কমিউনিস্ট চীন এবং সাবেক সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য ও সমর্থন পেয়েছে। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক দক্ষিণ কোরিয়ার পেছনে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশ। আমেরিকা স্বীয় সৈন্য মোতায়েন রেখেছে দক্ষিণ কোরিয়ায়, যাতে প্রয়োজনে সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে মিত্রকে সাহায্য করা যায়। তবে সাবেক সোভিয়েতের বিলুপ্তির পর চীনই উত্তর কোরিয়ার প্রধান ও একমাত্র শক্তিশালী মিত্র। সোভিয়েতের পরিবর্তে বর্তমানের গণতান্ত্রিক রাশিয়ান ফেডারেশন আর পিয়ংইয়ংয়ের সমর্থক নয়; বরং নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য রাশিয়া উত্তর কোরিয়াকেই দায়ী করেছে।
এবারের পরিস্থিতির সৃষ্টি সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত না হলেও কিছুটা আকস্মিক বৈকি। উত্তর কোরিয়া অনেকটা হঠাৎ করেই যেন দক্ষিণের জলসীমায় প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু করে এবং গোলন্দাজ আক্রমণের মাত্রা অনেককেই আশ্চর্য করে। এতে দক্ষিণ কোরীয় দুই নাবিক নিহত হয় এবং অনেকেই আহত হয়। হয়তো ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সেই তুলনায় বিরাট নয়। কিন্তু এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং সিউল, অর্থাৎ দক্ষিণ কোরিয়া স্বীয় সেনাবাহিনীকে সতর্ক অবস্থায় মোতায়েন করে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে এই ঘটনার কথা অবহিত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র পিয়ংইয়ংয়ের কর্মকাণ্ডের নিন্দা করে এবং স্বীয় মিত্র দক্ষিণকে যেকোনো আক্রমণ থেকে রক্ষা করার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করে। পশ্চিমা প্রতিরক্ষা ব্লক ন্যাটোও উত্তরের নিন্দা এবং দক্ষিণের সমর্থনে এগিয়ে আসে_এটাই প্রত্যাশিত। চীন সব পক্ষকে সংযত থাকতে আহ্বান জানায়; যদিও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে বেইজিংই পিয়ংইয়ংয়ের প্রধান মিত্র।
এই নতুন উত্তেজনার বিবিধ কারণ থাকতে পারে; যদিও কোরীয় অঞ্চলে যেকোনো সময়ই এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কট্টর স্টালিনপন্থী কমিউনিস্ট দেশ উত্তর কোরিয়া সেভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারেনি। পক্ষান্তরে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক অর্জন অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তবে পিয়ংইয়ং সামরিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট শক্তিশালী এবং এই খাতকেই অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে। দেশটি বেশ কয়েকটি পারমাণবিক উদ্ভাবন ঘটিয়েছে এবং ধারণা করা হয় যে তারা এই আণবিক শক্তি এরই মধ্যে অর্জন করেছে। পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন উত্তর কোরিয়া তাই শুধু দক্ষিণ কোরিয়াই নয়, পশ্চিমের অনেক দেশের জন্যই উদ্বেগের কারণ। জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার জন্য বিশেষভাবে পিয়ংইয়ং উৎকণ্ঠার সূত্র। উত্তর কোরিয়া বেশ কয়েক ধরনের শক্তিশালী 'মিসাইল' তৈরিতে সক্ষম হয়েছে এবং বলেছে, প্রয়োজনে সেগুলো 'শত্রুর' বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে। সুতরাং পশ্চিমের দেশগুলো পিয়ংইয়ংয়ের পরিকল্পনা ও কৌশল নিয়ে উদ্বিগ্ন।
পিয়ংইয়ংকে পারমাণবিক ও সামরিক সমৃদ্ধি পরিত্যাগ করানোর জন্য ছয়-জাতি আলোচনায় সম্পৃক্ত করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য, উত্তর কোরিয়া আণবিক ও অন্যান্য উচ্চ পর্যায়ের সামরিক অস্ত্রে নিরুৎসাহিত হলে দেশটিকে আর্থিক ও অন্যান্যভাবে সহায়তা করা হবে। সেই সংলাপে দুই কোরিয়া, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান রয়েছে। শুরুতে সংলাপে কিছুটা অগ্রগতি হলেও বর্তমানে আলোচনা স্থগিত রয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সম্প্রতি এশিয়া সফরের অংশ হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়া সফর করেন এবং সেখানে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে নিরাপত্তাবিষয়ক ইস্যুগুলো একটি বড় আলোচনার বিষয় ছিল। ধারণা করা যেতে পারে যে সিউলে প্রেসিডেন্ট ওবামার সফরের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই হয়তো পিয়ংইয়ং এই ঘটনা ঘটিয়েছে। উদ্দেশ্য, এই মনোভাব ব্যক্ত করা যে উত্তর কোরিয়া ওবামার সফর এবং সেই সময়ে পিয়ংইয়ংয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বক্তব্যে বিচলিত নয়; বরং উত্তর কোরিয়া ওবামার সফরের একটি জবাব এভাবেই দিতে চেয়েছে। উল্লেখ্য, মার্কিন প্রেসিডেন্ট পরবর্তী সময়ে জাপানও সফর করেন এবং সেখানেও পিয়ংইয়ংবিরোধী বক্তব্য দেন।
তবে উত্তর কোরিয়ার এই কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও এটা মনে করার হয়তো ততটা কারণ নেই যে পিয়ংইয়ং বর্তমান সংঘাতকে অনেক দূর নিয়ে যেতে চায়। বড় মিত্র চীন এমন উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কারণে উৎসাহ দেবে বলে মনে হয় না। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যক্ষভাবেই সংকটে সংশ্লিষ্ট হয়ে যেতে পারে। কয়েক মাস আগে একটি দক্ষিণ কোরীয় যুদ্ধজাহাজ নিমজ্জিত করে উত্তর কোরিয়া এবং সিউল ও ওয়াশিংটনের দাবি সত্ত্বেও সেই ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেনি। তাই এবার যদি পিয়ংইয়ং বেশিমাত্রায় বাড়াবাড়ি করে, তাহলে হয়তো প্রতিপক্ষরা সহ্য নাও করতে পারে।
তথাপি উত্তর কোরিয়া অপ্রত্যাশিতভাবে অনেক কিছুই করতে পারে এবং তেমন দৃষ্টান্তও আছে। তাই বর্তমান উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে কিছুই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে পিয়ংইয়ং কিছুদিন পর পর কোনো ঘটনার মধ্য দিয়ে স্বীয় নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিতে চায়। সর্বশেষ উত্তেজনাও এমনি ঘটনা হতে পারে। তবে এর ভয়াবহতা অনেক বেশি।
===================
আলোচনা- 'মানসিক নির্যাতনের প্রতিকার কোথায়' by আশরাফ-উল-আলম  আসুন, ওদের দিকে মমতার হাত বাড়িয়ে দিইঃ গোলটেবিল বৈঠক।এইচআইভি/এইডস : প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সেবা ও মানবাধিকার  আলোচনা- 'আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস'  আলোচনা- 'নেত্রীর অশ্রুপাত, হরতাল এবং অ্যাকশনে বিএনপি' by সঞ্জীব রায়  আলোচনা- 'আরো আলোকিত হোক জনশক্তি রপ্তানি খাত'  আলোচনা- 'কানকুন সম্মেলনে আমাদের প্রত্যাশা' by শিরীন আখতার  আলোচনা- 'জনসংখ্যার বিপদ ও পরিত্রাণের পথ'  শিল্প-অর্থনীতি 'বিনিয়োগ ও মূল্যস্ফীতি:দুর্ভাবনার বিষয়' by ড. আর. এম. দেবনাথ  গল্পসল্প- 'হায়রে নাড়ি ছেঁড়াধন' by শিখা ব্যানার্জী  গল্পসল্প- 'জননী ও জন্মভূমি' by শুভ রহমান  গল্পালোচনা- ''বিভীষণ' বিদায় ও হরতাল সমাচার' by শুভ রহমান  খবর- হরতালের বিরুদ্ধে একজোট, উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা  আলোচনা- 'হজ ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে কিছু কথা' by এয়ার কমোডর (অব.) মুহম্মদ জাকীউল ইসলাম  শিল্প-অর্থনীতি 'কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেতন-কাঠামো' by খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ  স্মরণ- 'মীর শওকত আলী বীর উত্তম : একজন বীরের প্রতিকৃতি' by ড. আশকার ইবনে শাইখ  আন্তর্জাতিক- 'মিয়ানমারে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ' by আহসান হাবীব  রাজনৈতিক আলোচনা- 'বিচিত্র সংকটের আবর্তে একটি বাড়ি' by এবিএম মূসা  ইতিহাস- 'হাজংমাতা শহীদ রাশিমনির স্মৃতিসৌধে' by দীপংকর চন্দ


দৈনিক কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ জগলুল আহমেদ চৌধূরী
সিনিয়র সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.