গল্প- 'দাদার দোকানে শূন্য দশক' by সালাহউদ্দিন

দাদার দোকানে আমাদের যাওয়ার সময়টা নির্দিষ্ট নয়। অথচ আমরা প্রতিদিন প্রায় একই সময় সেই দোকানে গিয়ে উপস্থিত হই। আমাদের হাতে কোনো ঘড়ি থাকে না। কারণ আমাদের জন্য কেবল দিন আর রাত আছে। চব্বিশ ঘণ্টায় এক দিনের শিক্ষা আমাদের জন্য পুরোনো হয়ে পড়ে আছে বাল্যের কোনো এক বইয়ের পাতায়। দাদার দোকানে আমাদের কথা বলার বিষয়বস্তুও আমরা ঠিক করে রাখি না। অথচ মাস শেষে হাতের করে গুণে আমরা কিছুতেই দশ-বারোটার বেশি বিষয় খুঁজে পাই না। আমাদের মাস অবশ্য ৩০ দিনে বাড়ে না।
আমরা কোনো ঘটনা অথবা উপলক্ষকে কেন্দ্র করে মাসের আবর্তন ঘটাই। ফলত ১২ মাসের হিসাব আমাদের খেয়াল থাকে না। আকাশে মেঘ এলে অথবা দাদার দোকানের সামনের কদমগাছটায় ফুল এলে অথবা এর পাশেই ঢাকাইয়া বরইগাছে ফল এলে কিংবা জল-কাদা-কুয়াশা হলে আমাদের ঋতুচক্রের কথা মনে পড়ে। কিন্তু সমস্ত চক্রের কেন্দ্রবিন্দু দাদার দোকান আমাদের পৃথিবীর শেষপ্রান্ত হয়ে ওঠে। এর কারণ, আমাদের যাওয়ার মতো কোনো জায়গা এই ছোট্ট মফস্বল শহরে খুঁজে পাই না।
আমরা কেমন যেন সবকিছুর পিঠপিছন দিয়ে দাঁড়াই। আমরা আমাদের সমসময়কে পেছনে রেখে দাদার দোকানে প্রবেশ করি। সেখানে দাদার দোকানের পাঁচটা টেবিল আর সতেরোটা চেয়ার, ছায়া ছায়া আড়াল, সন্ধ্যা নামলে দাদার এক শ পাওয়ারের বৈদ্যুতিক বাতি, খদ্দেরদের নানা কিসিমের আলাপ আর আমাদের দীর্ঘশ্বাস কিংবা উচ্ছ্বাস, গাম্ভীর্য, স্থৈর্য, বিবমিষা—সব মিলিয়েই আমাদের দিন কাটে। আমরা আসলে একঘরে হয়ে থাকি।
আমাদের দাদা কাঠ কাঠ শরীরের ওপর ভারী চোয়াল আর মুখে সর্বদা একটা বিরক্তি খসখসে চামড়ার আভরণ নিয়ে বসে থাকে। সেই বিরক্তির নিচে কোথাও হয়তো দরদ লুকিয়ে থাকে, নইলে আমাদের অত্যাচার সহ্য করার মতো লোক যে তিনি নন, এটা হলফ করে গোটা কলেজপাড়াই বলতে পারবে। গত পঁয়ত্রিশ বছরে কত ঝড়-বর্ষা এল-গেল, কত হাঙ্গামা, একাত্তর-নব্বই, আমাদের ইতিহাস—সব দাদার দোকানের কড়ি-বরগায় ঝুলকালি হয়ে জমে আছে। সেই ইতিহাসের স্মৃতিরেখা হয়তো দাদার কপালে বিরক্তি হয়ে বসে থাকে, সমকালকে সে দেখে। আমরাও তাই ভাবি, আবারও একটা ইতিহাস হয়তো দাদার মুখ থেকেই নেমে আসবে কোনো এক আটই ফাল্গুনে। আমরা এ রকম কোনো আশায় যে সেখানে বসে থাকি, বিষয়টা এমন নয়। আমরা আসলে সেখানে বসে থাকার একটা অসিলা খুঁজি মাত্র। তাতে দাদাকে মহিমান্বিত না করলে আমাদের উপায় থাকে না, যৌক্তিকতাও থাকে না। আমরা আমাদের ভেতরে নিজেদের চাওয়াগুলোকে পাওয়ার ছলনায় এমন কত কী করি, তা কেবল আমরাই হয়তো জানি। অথবা আমরা আসলে নিয়ম পালন করি কেবল—এই বয়সে এমন অনেকেই একই রকম এমন কিছু করে গেছে। আমরা নেহাতই এক পুরুষানুক্রম, আমাদের দায়িত্ব কেবল ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। তাই আমরা কলেজে আসি না, আসি কলেজ এলাকায়। আমাদের হাতে কখনোই ক্লাসের বইখাতা থাকে না। খাতা না থাকলে কলম থাকাও যে বাহুল্য, এটা আমরা বুঝি। আরও বুঝি যে আমরা যা বুঝি তা আসলে অন্যরা বোঝে না। তারা যে আমাদের বুঝতে পারে না, এটাও তারা বোঝে না। ফলে আমরা কোণঠাসা হয়ে থাকি এবং কলেজের কোনায় দাদার দোকানে বসে থাকি।
মান্দার বা শিরীষের অথবা আমের চেলা কাঠ জ্বেলে, ভোরে বাজারে গিয়ে নিয়ে আসা গাইগরুর দুধ মিশিয়ে, জল আর তাতে সেদ্ধ চা-পাতায় চিনি গুলিয়ে চিনামাটির সাদা কাপে আমাদের জন্য চা তৈরি হয়। মাঝেমধ্যে সকালের লুচি-সবজি বা হালুয়া নাশতা সেরে আমরা দাদার দোকানেই বসে থাকি, দাদার কাচের গ্লাসের ঘোলা পানি পান করি। দিনের মধ্যে কয় কাপ চা আমরা খাই, তার হিসাব কেউ রাখে না, দাদাও না। দাদার দোকানের মেঝে মাটির, বাঁশের চাটাই আর পলিথিনে ঢাকা ছাউনি গলে কখনোই রোদ আসে না, আসে কেবল রোদের রেখা, ক্ষীণ। সেই রোদ খাড়া হলে আমরা বাসায় যাই দুপুরের ভাত খেতে। ভাত খাওয়া শেষে আবারও দাদার দোকান। শেষ রাতের চা দারুণ হতো। তখন গাঢ় লিকার, ঘন দুধ। দাদাও তখন আমাদের সঙ্গে বসে চা খেতেন। যে জীবন দোয়েলের, ফড়িংয়ের, তার গল্প শোনাতেন। আমরা সেই দোকানে বিগত দশক ভাজি; দাদার আর আমাদের শব্দকথায় পুনরুজ্জীবিত হয় অতীত। আমরা কবিতা পড়ি—
কখনো আমার মাকে কোনো গান গাইতে শুনিনি।
সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে
আমাকে কখনো ঘুম পাড়াতেন কি না আজ মনেই পড়ে না।
আমরা পুষ্পবৃক্ষ আর বিহঙ্গ পুরাণ খুঁজি। অথবা আমরা আমাদের সময়কে পড়তে পছন্দ করি। দাদার দোকানে তা-ই আমাদের আড্ডার বিষয় হয়ে ওঠে কখনো কখনো। প্রাচ্য নাটকের সয়ফর আসে একদিন। আমাদের অনেক কথা শুনিয়ে যায় সে—
আমাগো আবার বাঁচন কিয়ের রে দাদি। আমাগো বাঁচন কালনাগিনের দংশন। শ্যাষ জমি বন্ধক দিয়া যে বিয়া করে, তা কিনে আইজল মিয়া। শ্যাষ জমি বন্ধক দিয়া যে বউ ঘরে আনে, তারে মারে সাপে। যে সুড়ঙ্গ খুঁড়ি এই ইন্দুরের নাগাল, তাতে হাপ ঢুইকা পড়ে। এইভাবে ছুবল মারে।
আমাদের চোখের সামনে দাদার দোকানের বাইরের কলেজে যাওয়া সড়ক সাপ হয়ে ওঠে, তার মাথায় ফণা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কলেজটা। দাদার দোকানের শূন্য চালায় আমরা অনর্থক জীবনের ভেলা ভাসাই। তাতে জলের শব্দ জাগে না, পাল হয়তো থাকে কখনো কখনো। আমার সেই পালে স্বপ্ন ভাসাই কি—বুঝতে পারি না। দাদার খ্যাঁচখ্যাঁচে মুখাবয়ব আমাদের দোরে দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা অনেক সময় বের হতে গিয়েও আবার ফিরে আসি। আমাদের কথা বলার ভঙ্গি-বিষয়-পাল্টা জবাব সবই এক হয়ে উঠতে থাকে। আমরা ভাবি, আমরা যমজ হয়ে গেছি। দাদা আমাদের তাই হয়তো কখনোই চিনতে পারেন না। কাকে কী নামে ডাকেন, তা তিনি কখনোই বুঝে উঠতে পারেন না। তিনি কেবল আমাদের হাঁটাচলা আর কথা বলা দেখে বুঝতে পারেন, আমরা এসেছি তাঁর দোকানে। আমাদের কার বাসা কোথায়, বাপ-চাচার কী নাম—এগুলো নিয়ে দাদার আগ্রহ কখনোই ছিল না। অথচ বাইরের মানুষ আমাদের ঠিক ঠিক চেনে। আমাদের ঠিকুজির সব তাদের জানা। আমাদের হাঁড়ির খবর হয়তো তাদের পত্রিকায় ছাপানো হয়। আমরা জানি না। আমাদের ঝোঁক অন্য কোথাও। আমরা অনু হয়ে উঠি—
পরদিন অনু দুপুরের উদ্দেশে নিজেকে অবাক করে নিরুদ্দেশ হলো।
আমদের নিরুদ্দিষ্ট ঠিকানাই হচ্ছে দাদার দোকান। একবার দাদার দোকানের পানির ড্রামে তিন ইঞ্চি গাদ পরিষ্কার করে দিয়েছিলাম আমরা। সেদিন দাদার সে কী রাগ। দোকান বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আমরা যেচে পরিষ্কার করার জন্য নয়, তাঁর দোকানে ময়লা জমে আছে—এই বিষয়টা মেনে নিতে পারছিলেন না দাদা। আরেক দিন কনডেন্স মিল্কে তেলাপোকা ডুবে থাকে। সর্বভূক তেলাপোকার দুধে মাখা শরীরটা আমরা তুলে আনি। সেদিনও দাদা আমাদের খিস্তি ছোড়েন। পরদিন আবার তাঁর একই রকম ভাবগম্ভীর মুখ আমরা দেখি, ভয়ে ভয়ে চা চাই। কিন্তু তিনি আগের মতোই। আগের মতোই কত কত ইতিহাস, জমে থাকা ময়লা নিজের মুখের রেখায় জমিয়ে রাখেন। তেলাপোকার স্বভাবকে আড়াল করে বেঁচে থাকার জীবনে এই দাদা আমাদের অগ্রজ। আমাদের কেন যেন আবু ইব্রাহীমকে মনে পড়ে। বাস্টার্ড আবু ইব্রাহীম। এভরিবডি ইজ ম্যানেজেবল অ্যান্ড এভরিবডি কুড বি পারচেজড, কেবল আবু ইব্রাহীম ছাড়া। আমাদের শিরদাঁড়ায় শিরশিরানি জাগে, আবু ইব্রাহীমের কথা মনে হওয়ার পরদিন থেকেই।
==========================
শিল্পি- 'সফিউদ্দিন আহমেদের সৃষ্টিসমগ্র-অশেষ আলোর আলোর আধার' by সৈয়দ আজিজুল হক  নিবন্ধ- 'সব শিল্পই যাবে প্রকৃতির কাছে। by খান মিজান  গল্পসল্প- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়' by আন্দালিব রাশদী  আলোচনা- 'সেই আমি এই আমি' by আতিকুল হক চৌঁধুরী  ইতিহাস- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়ের হৃদয়সংবেদী ডায়েরি' by দেবেশ রায়  স্মরণ- 'কাউন্ট লিও তলস্তয়ের মৃত্যু-শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি' by বেলাল চৌধুরী  ইতিহাস- 'বাংলায় সিপাহি বিদ্রোহ' by রিদওয়ান আক্রাম  শিল্প-অর্থনীতি 'এখন প্রয়োজন ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের' by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ  রাজনৈতিক আলোচনা- 'গণতন্ত্র : চাইলেই ধরা দেয় না' by এমাজউদ্দীন আহমদ  আন্তর্জাতিক- 'কোরীয় অঞ্চলে নতুন উত্তেজনা কত দূর যেতে পারে?' by জগলুল আহমেদ চৌধূরী  আলোচনা- 'মানসিক নির্যাতনের প্রতিকার কোথায়' by আশরাফ-উল-আলম  আসুন, ওদের দিকে মমতার হাত বাড়িয়ে দিইঃ গোলটেবিল বৈঠক।এইচআইভি/এইডস : প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সেবা ও মানবাধিকার  আলোচনা- 'আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস'  আলোচনা- 'নেত্রীর অশ্রুপাত, হরতাল এবং অ্যাকশনে বিএনপি' by সঞ্জীব রায়  আলোচনা- 'আরো আলোকিত হোক জনশক্তি রপ্তানি খাত'  আলোচনা- 'কানকুন সম্মেলনে আমাদের প্রত্যাশা' by শিরীন আখতার  আলোচনা- 'জনসংখ্যার বিপদ ও পরিত্রাণের পথ'  শিল্প-অর্থনীতি 'বিনিয়োগ ও মূল্যস্ফীতি:দুর্ভাবনার বিষয়' by ড. আর. এম. দেবনাথ


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ সালাহউদ্দিন


এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.