অনুতপ্ত সাকিব বিদায় বেলায় দেশবাসীকে পাশে চাইলেন

কোটাসংষ্কার আন্দোলনে যখন একের পর এক ছাত্র পুলিশের গুলিতে মারা যাচ্ছিলো তখন নীরব ছিলেন সাকিব আল হাসান। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের  সংসদ সদস্য। কিন্তু দেশের অন্যতম সেরা ক্রিকেটারের কাছে কেউ এমন প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা আশা করেননি! ধীরে ধীরে সেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলো গণমানুষ। শেষ পর্যন্ত  সংঘটিত হয় বিল্পব।  সরকারের পতন ঘটে। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সংসদ বিলুপ্ত হয় আর এমপি পদও হারান সাকিব। এরপরই তার বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় এক রিক্সাচালক হত্যার মামলা দায়ের হয়। সেই আন্দোলনের সময় সাকিব ছিলেন দেশের বাইরে।  সেখানেই তার ছুটির ঘণ্টা বাজতে শুরু করে। তবে তাকে জায়গা করে দেয়া হয় পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে। এমনকি খেলেন ভারতের বিপক্ষে টেস্টেও। অবশেষে কানপুরে সাকিব টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর ঘোষণা করেন। সেখানে অবশ্য তিনি দেশে ফিরে আসর ইচ্ছার  কথা জানান। এমনকি নিরাপত্তাও চান। তিনি বলেন দেশের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট খেলে তিনি বিদায় নিতে চান। কিন্তু শুরুতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন তাকে তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারবেনা বিসিবি। পরে  অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুইয়া তার দেশে ফেরা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। তবে অবশ্য বরফ গলতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে অনুতপ্ত হয়ে সাকিব তার সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ক্ষমা চেয়েছেন। আর তার বিদায় বেলাতে দেশবাসীকে পাশে চান বলেও জানান।

তার ফেসবুকে দেয়া সেই বক্তব্য হুবহু তুলে ধরা হলো-
আসসালামু আলাইকুম, আমার দেশের প্রতিটি মানুষের ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধা।
আমার প্রতি আপনাদের দোয়া ও ভালবাসা আমাকে আজকের এই সাকিব আল হাসান হিসেবে বিশ্ব দরবারে সমাদৃত করেছে।
শুরুতেই আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি সে সকল আত্মত্যাগকারী ছাত্রদের, যারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে  শহীদ হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন। তাদের প্রতি এবং তাদের পরিবারের প্রতি আমার অন্তরের অন্তস্তল থেকে শ্রদ্ধা এবং সমবেদনা। যদিও স্বজন হারা একটি পরিবারের ত্যাগকে কোন কিছুর বিনিময়ে পূরণ করা সম্ভব না। সন্তান হারানো কিংবা ভাই হারানোর বেদনা কোন কিছুতেই পূরণযোগ্য নয়।
এই সংকটকালীন সময়টাতে আমার সরব উপস্থিতি না থাকায় আপনারা যারা ব্যথিত হয়েছেন বা কষ্ট পেয়েছেন তাদের অনুভূতির জায়গাটার প্রতি আমার শ্রদ্ধা এবং এজন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
আপনাদের জায়গায় আমি থাকলে হয়তো এভাবে মনঃক্ষুণ্ন  হতাম।
আমি খুবই স্বল্প সময়ের জন্য মাগুরা-১ আসনের সংসদ সদস্য ছিলাম। আমার রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হওয়াটা ছিল মূলত আমার জন্মস্থান অর্থাৎ আমার মাগুরার মানুষের উন্নয়নের জন্য সুযোগ পাওয়া। আপনারা জানেন যে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নির্দিষ্ট কোন দায়িত্ব ছাড়া নিজের এলাকার উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখাটা একটু কঠিন। আর আমার এই এলাকার উন্নয়ন করতে চাওয়া আমাকে সংসদ সদস্য হতে আগ্রহী করে। যাইহোক দিনশেষে আমার পরিচয় আমি একজন বাংলাদেশের ক্রিকেটার। আমি যখন যেখানে যে অবস্থাতেই থেকেছি অন্তর থেকে ক্রিকেটাকেই ধারণ করেছি।
এই ক্রিকেটকে ধারণ করে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের সম্মান অর্জন করার পথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন -আপনারা । আপনাদের ভালোবাসা এবং সমর্থন আমাকে আজকের সাকিব আল হাসান বানিয়েছে। আমি যখন দেশের জন্য ক্রিকেটের মাঠে ব্যাট ধরেছি তখন আমার সাথে ব্যাট ধরেছেন আপনারা সবাই। গ্যালারি থেকে আপনাদের চিৎকার, আপনাদের সমর্থন আমাকে ভালো খেলার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। ক্রিকেট ম্যাচের দিন চায়ের দোকানে টেলিভিশনের সামনে উপচেপড়া ভিড় -আমাকে শক্তি যুগিয়েছে।
আমি জিতলে, আপনারা সবাই জিতেছেন। আমি হেরে গেলে, হেরে গেছেন আপনারা সবাই!
আপনারা জানেন, খুব শীঘ্রই আমি আমার শেষ ম্যাচটি খেলতে যাচ্ছি। আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শুরু থেকে আজকের সাকিব আল হাসান হয়ে ওঠা পর্যন্ত এই পুরো জার্নিটাকে ড্রাইভ করেছেন আপনারা।
এই ক্রিকেটের এই গোটা গল্পটা আপনাদের হাতেই লেখা! তাই আমার শেষ ম্যাচে, এই গল্পের শেষ অধ্যায়ে, আমি আপনাদেরকে পাশে চাই। আমি আপনাদের সবাইকে সাথে নিয়ে বিদায় নিতে চাই। বিদায়বেলায়, সেই মানুষগুলোর হাতে হাত রাখতে চাই, যাদের হাতের তালি আমার ভালো খেলতে বাধ্য করেছে। বিদায়বেলায়, সেই মানুষগুলোর চোখে চোখ রাখতে চাই, আমার ভালো খেলায় যাদের চোখ আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়েছে। আবার আমার খারাপ খেলায় যাদের চোখ ছলছল করেছে।
আমি আশা করি, শুধু আশা না বিশ্বাস করি –এই বিদায় বেলায় আপনারা সবাই আমার সাথে থাকবেন। সবাই সাথে থেকে সেই গল্পের ইতি টানবেন, যে গল্পের নায়ক –আমি নই, আপনারা!

mzamin

No comments

Powered by Blogger.