গণহত্যাসহ নানা অভিযোগে বিএনপি’র ১২৩ মামলা by কিরণ শেখ

ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে ও বিভিন্ন সময়ে ক্রসফায়ারে হত্যা, গায়েবি মামলায় সাজা, কার্যালয়ে অভিযান, লুটপাট, ডাকাতি এবং মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচিতে বাধাসহ নানা অভিযোগে ঢাকাসহ সারা দেশে ১২৩টি মামলা করেছেন বিএনপি’র নেতাকর্মী ও ভুক্তভোগীরা। এরমধ্যে গণহত্যার অভিযোগে ৭টি মামলা করেছে দলটি। ৫ই আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে এসব মামলা করা হয় বলে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় মামলা    তথ্য ও সংরক্ষণ সেল থেকে জানা গেছে। দলটি বলছে, ১৬ বছরে নেতাকর্মীদের ক্রসফায়ারে হত্যা, গুলি করে হত্যা, গায়েবি মামলায় সাজা, কার্যালয়ে অভিযান, লুটপাট, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে থানায় মামলা দায়ের করতে গেলেও তা নেয়া হতো না। বরং উল্টো বাদীদের ভয়ভীতি দেখানো, বাড়ি-ঘরে হয়রানি করা হতো এবং তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হতো। ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হওয়ায় এখন মামলাগুলো বিএনপি’র কেন্দ্রীয় মামলা তথ্য ও সংরক্ষণ সেলের তত্ত্বাবধানে করা হচ্ছে।

বিএনপি’র মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচিতে বাধা দেয়ার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১১৩ জনকে আসামি করে ৫ই অক্টোবর রাজধানীর গুলশান থানায় একটি মামলা হয়েছে। মামলাটি করেন কৃষকদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য মো. শরীফুল ইসলাম। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালের ২৯শে ডিসেম্বর বিএনপি’র মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচিতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া অংশগ্রহণ করতে চাইলে তাকে বাধা দেয়া হয়। পুলিশ সদস্যরা রাস্তায় বালুর ট্রাক দিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন। এই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার, একেএম শহীদুল হকসহ ১১৩ জনকে আসামি করা হয়েছে।

বিএনপি’র মামলা তথ্য ও সংরক্ষণ বিষয়ক কর্মকর্তা সালাহ উদ্দীন মানবজমিনকে বলেন, ঢাকাসহ সারা দেশে মামলা করা হচ্ছে। এসব মামলা বিএনপি’র এবং এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা এবং ভুক্তভোগীরা করছেন। আর এ পর্যন্ত সারা দেশে ১২৩টি মামলা করা হয়েছে।

ওদিকে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে এবং দুই বছর আগে নয়াপল্টনে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পুলিশি অভিযানের নামে লুটপাট ও ডাকাতির অভিযোগে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন ও ডিএমপি’র সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদসহ ৩০ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ১৪ই সেপ্টেম্বর পল্টন মডেল থানায় দুটি অভিযোগ করেছে বিএনপি। দলটির মামলা তথ্য ও সংরক্ষণ বিষয়ক কর্মকর্তা সালাহ উদ্দীন খান অভিযোগ দু’টি দায়ের করেন। একটি মামলার বিবরণে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের ৮ই ডিসেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পুলিশ প্রবেশ করে লুটপাট ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটায়। ডাকাতি করা মালামালের দাম ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং ক্ষতির পরিমাণ তিন লাখ ৫২ হাজার ৫শ’ টাকা। এ মামলায় পুলিশ প্রধানসহ ১৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। অন্য মামলায় বলা হয়, ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে গত ১৬ই জুলাই ডিবি কর্মকর্তা হারুন অর রশীদের নেতৃত্বে ২০/২৫ জন সাদা পোশাকের পুলিশ নয়াপল্টনে বিএনপি অফিসে প্রবেশ করে এবং বাইরে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা অস্ত্র-গোলাবারুদ, বাঁশের লাঠিসোটা, রড, পিস্তল নিয়ে মহড়া দেয়। তারা কেন্দ্রীয় কার্যালয় তছনছ করে এবং অবৈধ অস্ত্র রেখে দেয় ভেতরে। তারা দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীসহ মহানগর নেতৃবৃন্দকে আসামি করে মিথ্যা মামলা করে। এ মামলায় হারুন অর রশীদ ছাড়াও ডিএমপি’র ১৬ জন কর্মকর্তার নাম দেয়া হয়েছে।

যুবদল নেতা মিজানুর রহমানকে অপহরণ করে হত্যার অভিযোগে ১৩ই সেপ্টেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শিবগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়েছে। মামলাটি করেন মিজানুরের বাবা আলহাজ আইনাল হক। মামলায় বলা হয়েছে, মিজানুর রহমান ইউনিয়ন যুবদলের সদস্য ছিলেন। ২০১৬ সালের ১৭ই আগস্ট আওয়ামী লীগ নেতারা পুলিশসহ বেআইনিভাবে দলবল নিয়ে তার বাড়িতে অনধিকার প্রবেশ করেন। তাকে জোরপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিলে বাধা দেয়া হয়। কিন্তু বাধাকে উপেক্ষা করে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ মারধর করে জোরপূর্বক মিজানুর রহমানকে মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ১৮ই সেপ্টেম্বর সকালে গ্রামের লোকজন থানায় গিয়ে মিজানুর রহমান কোথায় আছে জানতে চাইলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রমজান আলী প্রকাশ করে যে, তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহবুব আলম খান পিপিএম রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি এম খুরশীদ হোসেনের অফিসে নিয়ে গিয়েছেন। বলা হয়, ২০ লাখ ঢাকা চাঁদা দিলে মিজানুর রহমানকে ফেরত দিবে। এতে আরও বলা হয়, টাকা না দিলে তাকে হত্যা করে লাশও গুম করে ফেলবে। কিন্তু মিজানুরকে হত্যা করে গোপন রাখা হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া মিজানুরের ভাই রেজাউল এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছে বলেও উল্লেখ রয়েছে। এ মামলায় আওয়ামী লীগ ও পুলিশের কর্মকর্তাসহ অজ্ঞাতনামাদের নাম দেয়া হয়েছে।

এদিকে বিএনপি নেতা কুদরত আলীকে হত্যার অভিযোগে ২রা অক্টোবর কুষ্টিয়া জেলা দৌলতপুর থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। মামলাটি করেন মো. ফেরদৌস। এজাহারে বলা হয়, কুদরত আলীকে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা ও কিছু সুবিধাভোগী পুলিশ মিথ্যা মামলায় আটক ও হত্যা করার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ২০২০ সালের ২৩শে জুলাই রাতে তারা বাড়িতে আসে এবং দরজার প্রাচীর টপকে অবৈধভাবে প্রবেশ করেন। তাকে বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ২৫শে জুলাই তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তার বুকের ডান দিকে ও বামদিকে দু’টি গুলির চিহ্ন, দুই হাতে, পিঠে, মুখে ও পায়ে আঘাতের চিহ্ন ছিল বলেও উল্লেখ রয়েছে। এ মামলায় পুলিশ কর্মকর্তার নাম দেয়া হয়েছে।

বিএনপি’র আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল মানবজমিনকে বলেন, আগে মামলা করার জন্য চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ফ্যাসিস্ট রেজিম যখন ক্ষমতায় থাকে এবং রক্ষক ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তখনকার সময়ের প্রেক্ষাপটে আমরা বহুবার আদালতে এবং থানায় গিয়েছি। আমাদের মামলা করতে দেয়া হয়নি। আদালতে গিয়েছিলাম, সেখান থেকেও আমাদের মামলা খারিজ করা হয়েছে। আমরা মনে করি, এদেশে এখন আইনের শাসন কায়েম হয়েছে কিংবা হচ্ছে। যেকারণে শুধুমাত্র বিএনপি না যেকোনো রাজনৈতিক দলের আইনি আশ্রয়ের অধিকার আছে। যেকোনো নাগরিকের আইনি লাভের অধিকার আছে। সেজন্য এখন আমরা আইনের আশ্রয় নেয়ার জন্য শরণাপন্ন হচ্ছি। সেটা আদালতেও যাওয়া হচ্ছে এবং থানায়ও যাওয়া হচ্ছে। বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয় বহুবার তছনছ ও ভাঙা হয়েছে। যেসব পুলিশ এসব করেছিল তাদের বিরুদ্ধে তখন আমরা আইনগত পদক্ষেপ নিতে পারি নাই। এখন আমরা আইনের আশ্রয় নিচ্ছি। যেন তাদের আইনের আওতায় আনা হয়।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.