শাবি’র ক্যাম্পাসে বেপরোয়া ছিল ছাত্রলীগের অমিত by ওয়েছ খছরু
১৭ই জুলাইয়ের দুপুর পর্যন্ত শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের অবস্থান ছিল। তখনো কোটাবিরোধী শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের কর্মীরা পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করেন। পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা ছাড়াও বিকাল ৩ টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়। এ ঘোষণার পর ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তুঙ্গে। এই অবস্থায় ছাত্রলীগের কর্মীরা গোপনে ছাড়েন বিভিন্ন হল। ছাত্রলীগ হল ছাড়ার পর পুরো ক্যাম্পাস সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ক্যাম্পাসে আতঙ্কের নাম শাহ্পরাণ হল। ওই হল থেকেই ছাত্রলীগের কর্মীরা তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতো। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ও হল প্রশাসনের নির্দেশ না মেনেই শাহ্পরাণ হলে ঢুকে পড়ে। অবশ্য পরে হলের প্রভোস্ট সহ অন্যরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের হলে ঢুকতে বাধ্য হন। হলের সি- ব্লকের ৪২৩ নম্বর কক্ষ। এই কক্ষেই থাকতেন শাবি ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও কুখ্যাত অস্ত্রবাজ অমিত শাহ। ওইদিন হলের ভেতরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সিলেটের সাংবাদিকরাও ঢুকেছিলেন। অভিযানের দিনের স্মৃতিচারণ করে সাংবাদিকরা জানিয়েছেন- অমিত শাহর রুম টার্গেটে ছিল শিক্ষার্থীদের। যখন ওই রুমে তল্লাশি চালানো হচ্ছিল তখন একটি কাঠের র্যাক থেকে দু’টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে একটি ছিল শর্টগান ও অপরটি কাটা রাইফেল। এছাড়া ওই রুমে গাঁজা ও প্রচুর মদের বোতল পাওয়া যায়। অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনার পর ছাত্রলীগের অমিত শাহর নামটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন- মূলত শাহ্পরাণ হলের অমিত শাহর নিয়ন্ত্রণে থাকা রুমটি ছিল অস্ত্রাগার। ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব অস্ত্র ব্যবহার করা হতো তার বেশির ভাগই অমিত শাহর রুমের ভেতরে পাওয়া যায়। তারা জানিয়েছেন; অমিত শাহ ছিল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী। তার ভয়ে শাহ্পরাণ হলের সবাই তটস্থ থাকতেন। এমনকি হলের প্রভোস্ট সহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা তার ভয়ে থাকতেন। ২০১৮-১৯ সেশনের পরিসংখ্যান ব্যাচের শিক্ষার্থী। মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র। বিতর্কিত ঘটনার কারণে দীর্ঘদিন শাবিতে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি দেয়া হয়নি। কমিটি না থাকলেও গ্রুপিং রাজনীতির কারণে ক্যাম্পাসে সবসময়ই চাঙ্গা ছিল রাজনীতি। এ কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীরা হলে অবস্থান করতে পারেননি। যারা ছাত্রলীগে নাম লেখাতেন তারাই কেবল হলে থাকতেন। শাহ্পরাণ হলে যেসব সাধারণ শিক্ষার্থী বসবাস করতেন তাদেরও বাধ্য হয়ে ছাত্রলীগে নাম লেখাতে হতো। এসব শিক্ষার্থীরা পরবর্তীতে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন- এমন কোনো অপকর্ম নেই যে, হলের ভেতরে অমিত শাহ ও তার সহযোগীরা করেনি। হলের ডাইনিং পুরোটাই ছিল তাদের দখলে। আর রাতে বসতো মদ ও গাঁজার আসর। কখনো কখনো বহিরাগতরা গিয়ে তাদের এই আসরে যোগ দিতেন। এ সব বিষয় নিয়ে বেনামি অনেক অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে দেয়া হলেও সাবেক ভিসি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন এতে কর্ণপাত করেননি। ৪২৩ নম্বর কক্ষটি টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করা হতো। কয়েকজন শিক্ষার্থীকে এই কক্ষে নিয়ে পেটানোরও অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে ছাত্রলীগ হল ছাড়ার পরপরই সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিজেদের উদ্যোগে হলের ভেতরে অভিযান চালিয়েছেন। গত দু’বছর শাবি ক্যাম্পাসে ৩০-৩৫টি মণ্ডপে সরস্বতী পূজার আয়োজন করা হয়। আর এই আয়োজনে শিক্ষার্থীদের পক্ষে অমিতকে কমিটিতে রাখতো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আর পূজা আয়োজনের নামে অমিত প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। অস্ত্র উদ্ধারের পর শাবি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসাদুল্লাহ আল গালিব উদ্ধারকৃত অস্ত্রের ফিরিস্তি তুলে ধরে বলেছিলেন- দেড় শতাধিক মদের বোতল, ১টি শর্টগান, ১টি রিভলবার, ৩টি চেইন, ১শ’ স্টিলের পাইপ, ১০টি রামদা, ১২টি চাকু, হাতুড়ি ৩টা ও কিছু গাঁজা পেয়েছি। শুধু শাহ্পরাণ হলের বিভিন্ন কক্ষ থেকে এসব আমরা জব্দ করেছি। এর মধ্যে অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে অমিত শাহর রুম থেকে। এদিকে- শাহ্পরাণ হলের সাবেক প্রভোস্ট কৌশিক সাহার কাছে এসব অস্ত্র জমা দেয়া হয়েছিল। ৫ই আগস্ট পর্যন্ত এসব অস্ত্র পুলিশে জমা না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের হেফাজতে রেখেছিলেন। প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর এসব অস্ত্র থানায় জমা দেয়া হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন প্রভোস্ট কৌশিক সাহা। সিলেট নগরে ছাত্রলীগের নাদেল গ্রুপের কর্মী ছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি নাঈম হাসান। আর নাঈমের কর্মী ছিলেন অমিত শাহ। ফলে ক্যাম্পাসের বাইরেও ছাত্রলীগের শক্তি প্রদর্শনে অমিতের ভূমিকা ছিল সক্রিয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় নগরের মদিনা মার্কেট, আখালিয়া সহ কয়েকটি এলাকায় ছাত্রলীগের কর্মীদের সঙ্গে অমিতও অস্ত্রবাজিতে সক্রিয় ছিল। প্রকাশ্য অস্ত্র নিয়ে ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করার কারণে পালাতে গিয়ে পানিতে পড়ে মারা গিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুদ্র সেন। এদিকে প্রেক্ষাপট পরির্তনের পর কুখ্যাত অমিত শাহ সিলেট থেকে পালিয়ে চলে গিয়েছিল নিজ এলাকা ময়মনসিংহে। সেখান থেকে মঙ্গলবার সকালে র্যাব তাকে আটক করেছে। সঙ্গে আটক হয়েছে শাবি ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আশিকুর রহমানও।
No comments