গোয়েন্দা পরিচয়ে তুলে নেয়ার ৩ মাসেও খোঁজ মেলেনি শাকিলের by ফাহিমা আক্তার সুমি
শাকিলের বোন পিকিং মানবজমিনকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন ১৩ই জুলাই ঘটনাটি ঘটে। যখন ওরা শাকিলকে নিয়ে যায় তখন ওই ব্যক্তিদের পা পর্যন্ত ধরেছি ছেড়ে দেয়ার জন্য। মো. জয় নামের ওর এক বন্ধু ডেকে নিয়ে যায় সে মামলার ২ নম্বর আসামি। মো. সুরুজ মিয়া নামে মামলার ১ নম্বর আসামি এই ঘটনার নেতৃত্বে ছিলেন। সে তার নাম গোপন করে ফিরোজ পরিচয় দিয়েছিলেন এবং নিজেকে গোয়েন্দা সংস্থার লোক পরিচয় দেন। সে আসলে গোয়েন্দা সংস্থার লোক কিনা সেটাও আমরা জানি না। তুলে নেয়ার সময় ফিরোজ পরিচয়দানকারী ব্যক্তির সঙ্গে আরও চারজন ছিল। পরে শাকিলকে একটা অটোর মধ্যে তুলে অজানাস্থানে নিয়ে যায়। শাকিল বিএনপিপন্থি ছিল। এই সুবাধে অনেকের সঙ্গে পরিচয় ছিল। যে ছেলেগুলো শাকিলকে ডেকে নিয়ে যায় তারাও একসঙ্গে রাজনীতি করে। আমাদের জন্মই ঢাকায়। ছোট থেকে এই ঢাকায় বড় হয়েছি। শুরু থেকেই ভাষানটেকে থাকি। বাবা চায়ের দোকান দেয়। আমরা তিন ভাইবোন। ভাইয়ের মধ্যে শাকিল ছিল বড়। ছোট ভাই অটোগাড়ি চালায়। শাকিল ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে কাজ করতো। ১৩ই জুলাই রাত সাড়ে দশটা থেকে সে নিখোঁজ। আমার ধারণা রাজনৈতিকভাবে আমার ভাইয়ের সঙ্গে এই ঘটনাটি ঘটিয়েছে। তিনি বলেন, সজীব নামে স্বেচ্ছাসেবক দলের এক নেতা রয়েছে; তার লোকেরা এসে আমার বাবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে। স্থানীয় নেতাকর্মীদের দিয়ে হুমকি দিচ্ছে। যদি বেশি বাড়াবাড়ি করি, তাহলে রাস্তা থেকে তুলে নিখোঁজ করে ফেলবে। শাকিল বেঁচে আছে, নাকি নেই- এ বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। আজ তিন মাস ধরে আমরা কাশিমপুর, ময়মনসিংহ, ডিবি, সিআইডি, র্যাবসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরছি কিন্তু আমার ভাইয়ের কোনো সন্ধান পাচ্ছি না। সব জায়গায় ছবি দিয়ে এসেছি, তারা সবাই বলছে কোনো খোঁজ পেলে জানাবে কিন্তু এখনো কোনো খবর পাচ্ছি না। শাকিলকে যখন থেকে তুলে নিয়েছে সেদিন থেকেই ওর মোবাইল বন্ধ। এখন পর্যন্ত কোনো আসামিকেও ধরা হয়নি। মামলা থেকে জয়ের নাম ও মামলা তুলে নেয়ারও হুমকি দেয়া হচ্ছে আমাদের।
শাকিলের স্ত্রী জবা বলেন, ওইদিন রাতে আমি গার্মেন্টস থেকে বাসায় এসেছি। পরপর শাকিলও বাসায় আসে। পরে রাত আটটায় বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। এই যে বের হয়েছে আর ফিরে আসেনি। আমি রান্না করে অনেক রাত পর্যন্ত বসে ছিলাম। রাতে তার মোবাইলে কল দিলে বিজি বলে। রাত সাড়ে দশটায় আবার কল দেই তখন ধরে কেটে দেয়। কিছুক্ষণ পরে শাকিলের বন্ধু অনিক এসে বলে তাকে ধরে নিয়ে গেছে গোয়েন্দা পরিচয়ে কয়েকজন ব্যক্তি। এটি শোনার পরে রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত আমরা থানায় থানায় খুঁজেছি- কোথাও শাকিলকে পাইনি। তিনি বলেন, শাকিল যার হাত ধরে রাজনীতির জগতে গেছে তার নাম শফিক। তাকে আমি প্রথম দিনেই শাকিলকে তুলে নেয়ার বিষয়টি জানাই। সে খোঁজ নেয়ার কথা জানায়। এক সপ্তাহ পরে শফিক ভাই বলে, ‘চিন্তা করিও না শাকিল একটি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে আছে।’ পরের দিন শফিক আমাকে বলে, ‘তোমার স্বামী তো আছে; এখন তাকে বের করতে পাঁচ লাখ টাকা লাগবে।’ পরে আমরা বলেছি, এত টাকা কোথায় পাবো? এরপর থেকে সে আমাদের আর কোনো খবর জানায় না। ১৩-১৪ বছর ধরে শফিকের সঙ্গে শাকিলের সম্পর্ক। একটা টিনশেডের বাসায় এক রুম নিয়ে আমার শ্বশুর, আমি আর শাকিল থাকতাম। শাকিলের আয়ে সংসার চলতো। আমি গার্মেন্টসে কাজ করতাম। শাকিলকে তুলে নেয়ার পর চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। এখন পর্যন্ত কোনো আসামি ধরেনি পুলিশ। শাকিল কোথায় আছে এখনো জানি না। আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দিক আর কোনো চাওয়া নেই আমাদের।
এদিকে শাকিলকে তুলে নেয়ার একটি সিসিটিভি ফুটেজ রয়েছে মানবজমিনের হাতে। ওই সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, একটি বাইকে করে শাকিলের বন্ধু অনিককে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেই বাইকটি চালাচ্ছিলেন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা পরিচয়দানকারী ফিরোজ। তার পেছনে একটি অটোতে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল শাকিলকে। তবে কিছুদূর এসে অনিককে মোটরসাইকেল থেকে নামিয়ে দেয়। এ ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে অনিক মানবজমিনকে বলেন, গোয়েন্দা সদস্যের পরিচয় দিয়ে শাকিলকে একটি অটোতে তুলে নিয়ে যায়। এসময় পাঁচজন ব্যক্তি ছিলেন। ফিরোজ নামে ব্যক্তি আমাকে মোটরসাইকেলে মিরপুর-১৪ নম্বরে নামিয়ে দেয়। তারা কেন নিয়েছে, কোথায় নিয়েছে- এ বিষয়ে কিছু বলেনি। উল্টো আমাকেও নিয়ে যাওয়ার ভয় দেখিয়েছিল। তখন আমি বলেছি, শাকিলকে যখন নিচ্ছেন তখন আমাকেও নিয়ে যান। শাকিলের বাসার সঙ্গে আমার বাসা। সেদিন রাতে এলাকায় আমার সঙ্গে দেখা হয় শাকিলের। তখন আমাকে বলে, ভাই আপনাকে নিয়ে আমি একটু বটতলায় যাবো। পরে শাকিল বলে, আমাকে জয় নামের এক বন্ধু ফোন দিয়ে যেতে বলেছে। যখন আমাদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করে তখন তাদের পরিচয় জানতে চাইলে গোয়েন্দা সংস্থার লোক বলে জানায়। তখন তাদের কার্ড দেখতে চাইলে সেটি দেখাতে রাজি হননি। শাকিলের হাতে হাতকড়াও পরিয়েছিলেন তারা। সে সময় শাকিল পা ধরে কান্নাকাটি করেছে তবুও ছাড়েনি। মিরপুর-১৩ নম্বর কাফরুল থানাধীন রাকিন সিটি থেকে তুলে নিয়ে যায়। আমরা কাফরুল থানা পুলিশের কাছে গিয়ে ঘটনাটি খুলে বলি। থানার সিসিটিভি ফুটেজ থেকে আমি ফিরোজকে শনাক্ত করি। তিনি বলেন, এখনো শাকিলের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। সব সময় আমাকে আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হচ্ছে। এভাবে যখন আমার বন্ধুকে তুলে নিয়ে গেছে তখন তো আমাকেও আবার তুলে নিতে পারে।
এ ঘটনায় ২৫শে সেপ্টেম্বর কাফরুল থানায় একটি মামলা করেন নিখোঁজ শাকিলের বাবা আঙ্গুর মিয়া। মামলার এজাহারে বলেন, গত ১১ই জুলাই আনুমানিক দুপুর ২টার সময় ভাষানটেক থানাধীন ভাষানটেক ৩ নং মোড়ে শাহজাহানের ছেলে সুমন (১৭)-এর সঙ্গে গোয়েন্দা পরিচয়দানকারী মো. সুরুজ মিয়া ও তার সঙ্গে থাকা অজ্ঞাতনামা একজনের রাস্তায় অটোরিকশা রাখাকে কেন্দ্র করে কথাকাটাকাটি হয়। এসময় আমার ছেলে মো. শাকিল (২৬) ঘটনাস্থলে গিয়ে সুমনের পক্ষ নিলে সুরুজ মিয়া ও সঙ্গে থাকা অজ্ঞাত ব্যক্তির সঙ্গে আমার ছেলে শাকিল ও সুমনের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। তখন স্থানীয় লোকজন সেখানে উপস্থিত হলে তারা নিজেদের গোয়েন্দা সদস্য পরিচয় দিয়ে শাহজাহানের ভাগ্নে কাজীর কাছে মোবাইল নাম্বার ও তার নাম ফিরোজ পরিচয় দিয়ে চলে যায়। যাওয়ার সময় বলে যায় যে, সন্ধ্যায় তারা আসলে সৃষ্ট বিষয় নিয়ে আপস মীমাংসা করা হবে। পরবর্তীতে সন্ধ্যায় তারা আসলে শাহজাহান তার ছেলের সঙ্গে সুরুজ মিয়া ও তার সঙ্গে থাকা অজ্ঞাত ব্যক্তির মীমাংসা করে দেয়। মীমাংসার সময় তারা আমার ছেলে শাকিলকে সেখানে ডাকে নাই। পরবর্তীতে গত ১৩ই জুলাই রাত আনুমানিক সাড়ে নয়টার সময় মো. জয় আমার ছেলেকে ফোন করে কাফরুল থানাধীন মিরপুর-১৩ বটতলায় যেতে বলে। তখন শাকিল তার বন্ধু অনিক জয়ের কাছে যায়। সেখান থেকে তারা রিকশায় করে রাত আনুমানিক ১০টা ১৫ মিনিটে কাফরুল থানাধীন মিরপুর সেকশন-১৫ (ব্লক ডি), রূপসী হাউজিংয়ের উত্তর-পূর্ব পাশের শেষ মাথায় খাল পাড়ে গেলে সুরুজ মিয়ার নেতৃত্বে গোয়েন্দা সংস্থার লোক পরিচয়দানকারী আরও চার জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি আমার ছেলেকে অটোরিকশায় জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যায়। সুরুজ মিয়া তার মোটরসাইকেলে অনিককে নিয়ে মিরপুর-১৪ নম্বর মোড়ে আসে এবং অনিককে দেয়। এ সময় অনিককে বলে, ‘তুই যা, ওকে যেখানে পাঠানোর পাঠাইয়া দিছি।’ পরে অনিক শাকিলের স্ত্রীকে ঘটনাটি জানায়। পরবর্তীতে আমরা বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করে আমার ছেলে শাকিলের কোনো সন্ধান না পেয়ে কাফরুল থানায় ১৭ই জুলাই জিডি করি। যার নং-১৩৪২। এজাহারে তিনি আরও উল্লেখ করেন, এ ঘটনার পর ৩ নম্বর আসামি শফিক (৩৫) আমার কাছে বলে, তাকে ৫ লাখ টাকা দিলে আমার ছেলে শাকিলকে ফেরত এনে দিবে। ৪ নম্বর আসামি বাবুল (৪০) ও ৫ নম্বর আসামি মো. আবুল হোসেন (৫০) স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে ঘটনার বেশ কিছুদিন আগে শাকিলকে নিখোঁজ করার হুমকি দিয়েছিলেন। বিএনপি’র পোস্টার লাগানোকে কেন্দ্র করে তাদের সঙ্গে আমার ছেলের ঝগড়া হয়। এলাকায় জনশ্রুতি ছিল যে, ৪নং ও ৫নং আসামি বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে হয়রানি করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে ধরিয়ে দিতো। তারা পরস্পরের যোগসাজশে পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে শাকিলকে অপহরণ করে অজ্ঞাতস্থানে আটকে রেখেছে।
এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর আবু হানিফ মানবজমিনকে বলেন, ঘটনাটির বিষয়ে আমরা প্রাথমিকভাবে গোয়েন্দা পরিচয়দানকারী ফিরোজ (সুরুজ মিয়া) নামের ওই ব্যক্তির তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। আমাদের পক্ষ থেকে তাকে চিঠির মাধ্যমে তলব করা হয়েছে। এখনো পর্যন্ত সেই চিঠির কোনো জবাব আমাদের কাছে আসেনি। আমরা শাকিলের নিখোঁজের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছি। এই মামলায় এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। তদন্ত চলমান রয়েছে।
No comments