মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাক্ষী দাউদকান্দি
ইলিয়টগঞ্জ,
আমদপুর, রায়পুর, গোয়ালমারীসহ দাউদকান্দি উপজেলায় রয়েছে একাত্তরের
স্মৃতিবিজড়িত অনেক স্থান। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এসব স্থানও অনেক গুরুত্ব।
ঘুরে এসে লিখেছেন-গাজী মুনছুর আজিজ প্লাবনভূমিখ্যাত কুমিল্লার দাউদকান্দিতে
একাত্তরে একাধিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ঢাকা-চট্টগ্রামের মহাসড়কের পাশ ঘেঁষা এ
অঞ্চলেও ছড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতি। সেসব স্মৃতিবিজড়িত স্থান
দেখতেই এক সকালে হাজির হই দাউদকান্দি। স্থানীয় কৃষিসংগঠক মতিন সৈকত,
সংস্কৃতিকর্মী লিটন সরকার বাদল ও এসএম মিজান ছিলেন এখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের
সঙ্গে পরিচয়ের মাধ্যম। আলাপের শুরুটা হয় দাউদকান্দি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা
সংসদের সাবেক কমান্ডার আবদুল কুদ্দুস সরকারকে দিয়ে। উপজেলার বাজারে
মুক্তিযোদ্ধা সংসদে বসে তার সঙ্গে কথা হয়। আবদুল কুদ্দুস সরকার বলেন,
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প ও নির্যাতন কেন্দ্র
ছিল দাউদকান্দি আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় এবং দাউদকান্দি ডাকবাংলোতে। এ ক্যাম্প ও
নির্যাতন কেন্দ্র ধ্বংস করতে আমরা ৯ ডিসেম্বর সকাল থেকে ক্যাম্পের তিনপাশ
ঘিরে ফেলি, কারণ, বাকি পাশে মেঘনা-গোমতী নদী। তারপর শুরু হয় আক্রমণ-পাল্টা
আক্রমণ। তখন পাকিস্তানি সেনারা প্রাণে বাঁচতে চারটি লঞ্চে করে নদী দিয়ে
পালিয়ে যায়। এভাবে ৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যার আগে শত্রুম্ক্তু হয় দাউদকান্দি। এ
যুদ্ধে যোগ দেন দাউদকান্দির দক্ষিণ এলাকার নজরুল ইসলাম কোম্পানির
মুক্তিযোদ্ধা, উত্তর এলাকার কাউসার কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধা, উত্তর-পূর্ব
এলাকার আবদুল মতিন কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এলাকার শফিক
কমান্ডারের মুক্তিযোদ্ধার দল। আমি ছিলাম নজরুল কোম্পানির দলে। এ কোম্পানিতে
মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন ৯০ থেকে ১০০ জন। অন্য দলগুলোতেও প্রায় এমন সংখ্যক
মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। নজরুল ইসলাম কোম্পানির এলাকা ছিল গোয়ালমারী, কাউসার
কোম্পানির এলাকা ছিল দাউদকান্দি উত্তর, আবদুল মতিনের এলাকা ছিল গৌরীপুর এবং
শফিক কমান্ডারের এলাকা ছিল বড়কোটা। আবদুল কুদ্দুস সরকার জানান, দাউদকান্দি
মুক্ত হওয়ার আগে ২০ নভেম্বর গোয়ালমারীতে একটি যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধেও তিনিসহ
অংশ নেন ওয়াদুদ, শফিক, নজরুল কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা। তার কথা শুনে আমরা
অটো রিকশায় গ্রামের মেঠোপথ ধরে আসি গোয়ালমারী বাজারে। গোয়ালমারীর এ যুদ্ধে
অংশ নেন দাউদকান্দি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বর্তমান কমান্ডার মো.
খোরশেদ আলম। তিনি বলেন, ইনসান পাগলি নামে ২৪ বা ২৫ বছর বয়সী এক নারী
গোয়ালমারী বাজারে ঘুরে বেড়াতেন। তিনি কিভাবে যেন আগাম খবর পেলেন পাকিস্তানি
সেনারা গোয়ালমারীতে আসছে। তখন তিনি চিৎকার করে ঘুরে ঘুরে পাকিস্তানিদের
আসার খবর পুরো এলাকায় জানিয়ে দেন। তার এ চিৎকার শুনেই আমরা নিরাপদে অবস্থান
নিই। সেদিন ইনসান পাগলি যদি চিৎকার করে পাকিস্তানিদের আসার খবর না দিতেন
তাহলে হয়তো আমরা সব মুক্তিযোদ্ধাই মারা যেতাম পাকিস্তানিদের হাতে। তবে
পাকিস্তানিরা আমাদের না মারতে পারলেও ইনসান পাগলিকে গুলি করে মেরেছে। তার
লাশ পড়ে ছিল গোয়ালমারী বাজারের পাশে। পরে তাকে সেখানেই কবর দেন স্থানীয়রা।
খোরশেদ আলম গোয়ালমারী বাজারের পাশে ঘাসে ঢাকা একটি স্থান দেখিয়ে বললেন,
‘এটাই ইনসান পাগলির কবর’। অবশ্য দেখে বোঝার উপায় নেই এটা একটি কবর বা বিশেষ
কারও কবর। গোয়ালমারীর এ যুদ্ধে শহীদদের উদ্দেশ্যে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের
কাজ শুরু হয়েছে। স্থানীয় খালেকুজ্জামান এ স্মৃতিস্তম্ভের জন্য দুই শতক জমি
দান করেছেন। গোয়ালমারী বাজার থেকে আসি জিংলাতলী ইউনিয়নের রায়পুর
বাসস্ট্যান্ড। এখানকার রায়পুর খালের কাঠের সেতুতে ১২ জনকে দাঁড় করিয়ে গুলি
করে হত্যা করে পাকিস্তানিরা। এ হত্যাযজ্ঞ নিজের চোখে দেখেছেন রায়পুরের
চৌধুরী বাড়ির মো. ওমর ফারুক সিকদার। তার সঙ্গে কথা বলি রায়পুর
বাসস্ট্যান্ডের বাজারে। তার বাড়ি থেকে রায়পুর খালের সেতুটি প্রায় ২০০ মিটার
দূরে। তিনি তখন ২১ বছরের তরুণ। সবে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। তিনি বলেন,
দাউদকান্দি উপজেলা সদরে পাকিস্তানিদের ক্যাম্প ছিল। সেই ক্যাম্প থেকে ২৫
থেকে ৩০ জনের একটি সশস্ত্র দল রায়পুর গ্রাসে আসে মুক্তিদ্ধোর খোঁজে।
পাকিস্তানিরা গ্রামে প্রবেশ করলে এ ১২ শহীদ পালিয়ে বাঁচতে চান, কিন্তু
রায়পুর খালের কাঠের সেতু পার হওয়ার আগেই পাকিস্তানিরা তাদের ধরে ফেলে এবং
হত্যা করে। পাকিস্তানিরা ভেবেছে রায়পুরে মুক্তিযোদ্ধারা লুকিয়ে আছেন, তাই
তারা গ্রামে হামলা করে। রায়পুর কৈলাশ চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়েও পাকিস্তানিদের
ক্যাম্প ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা গাছের আড়ালে পালিয়ে থাকতে পারেন এ ভয়ে
পাকিস্তানিরা গ্রামের সব বড় গাছ, ঝোপ-ঝাড় কেটে ফেলে। রায়পুর খাল কালাডুমুর
নদীর ছোট্ট একটি শাখা। এ খাল পার হয়ে একটু এগুলেই কালাডুমুর নদী।
নদীর ওপার
গেলেই নিরাপদ। সেজন্য রায়পুর গ্রামে পাকিস্তানিরা প্রবেশ করলে গ্রামবাসী
দৌড়ে রায়পুর খাল পার হয়ে কালাডুমুর নদী সাঁতরে ওপার চলে যেতেন। এ
হত্যাযজ্ঞের প্রায় আড়াই মাস পরে আরও ৭/৮ জনের সঙ্গে ওমর ফারুক সিকদার
ভারতের পালাটনা যান মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে। তিন মাস প্রশিক্ষণ শেষে
তিনি গ্রামে ফিরে মামাবাড়ি আসেন। এখানে যারা শহীদ হয়েছেন তারা হলেন- পান্ডব
চন্দ্র দেবনাথ, সুধীর বণিক, শীতল সরকার, শরৎ সরকার, উমেশ সরকার (আড়াই
মেম্বরী), ফেলন সরকার, পান্ডব সাহা, বিদেশিনী সাহা, কামিনী বালা দেবনাথ,
নকুল দেবনাথ, রঞ্জিত সরকার ও অনাথ বন্ধু দেবনাথ। রায়পুর থেকে এবার আসি
আদমপুর গ্রামে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যরা এখানে দুজনকে
গুলি করে হত্যা করে। একই সঙ্গে তারা গ্রামের ৫টি বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। দুই
শহীদ হলেন- নূরু মিয়া ও অনুকুল। নূরু মিয়ার বয়স প্রায় ৩৫, আর অনুকুলের বয়স
প্রায় ৫০ বছর। এ হত্যাযজ্ঞ দেখেন নূরু মিয়ার ভগ্নিপতি প্রায় ৯০ বছরের কালা
মিয়া। তার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, খুব সম্ভবত বৈশাখের ১০ তারিখ সোমবার।
গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা আছেন এ খবর পেয়ে বেলা ১১টার দিকে ২০ থেকে ২৫ জন
পাকিস্তানি সৈন্য গ্রামে প্রবেশ করে। তাদের খবর পেয়ে আমরা ভয়ে কালাডুমুর
নদী সাঁতরে পার হয়ে কলিযোগ গ্রামে চলে যাই। আদপুর গ্রাম ঘুরে আসি ইলিয়টগঞ্জ
বাজারে। একাত্তরের ৫ ডিসেম্বর কনকনে শীত আর গভীর রাতে এখানে পাকিস্তানি
সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে শহীদ হন পিপুইয়া গ্রামের আবদুল মমিন।
আহত হন রানীপুরের মোহাম্মদ শাহজাহান। এছাড়া মিত্রবাহিনীর তিন সদস্য শহীদ
হন। অন্যদিকে শত্রুদের ১১ জন মারা যায় ও আত্মসমর্পণ করে সাতজন। বাকিরা
পালিয়ে যায়। ৫ ডিসেম্বর রাতে যুদ্ধ শুরু হয়ে চলে ৬ ডিসেম্বর ভোর পর্যন্ত।
আর এ যুদ্ধের মাধ্যমে শত্রুমুক্ত হয় ইলিয়টগঞ্জ অঞ্চল। এ যুদ্ধের গ্রুপ
কমান্ডার চান্দিনার সুহিলপুর গ্রামের মো. আলী আকবর দর্জি বলেন, ৪৫ জন
মুক্তিযোদ্ধা অংশ নিই এ যুদ্ধে। আবদুল মমিন ছিলেন আমাদের কমান্ডার। সহকারী
কমান্ডার ছিলেন আমার ভাই মো. আমির হোসেন দর্জি। ইলিয়টগঞ্জ রাজেন্দ্র
বিশ্বনাথ উচ্চবিদ্যালয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ঘাঁটি ছিল। আমরা ১১ বার অভিযান
চালিয়ে অবশেষে শেষবার সফল হই। মমিনের দাফন করা হয় তার গ্রামের বাড়ি
পিপুইয়াতে। ইলিয়টগঞ্জ থেকে অটোরিকশায় আমরা আসি পিপুইয়া গ্রামে শহীদ মমিনের
সমাধিস্থলে। সমাধিটির চারপাশের দেয়ালে সম্প্রতি সাদা রঙ দেয়া হয়েছে। তবে
স্থায়ীভাবে কোনো স্মৃতিফলক নেই। সমাধির সামনে ছোট্ট একটি সাইনবোর্ড দেয়া
আছে। সে সাইনবোর্ডে শহীদ মমিনের শহীদ দিবসের তারিখ ভুল লেখা রয়েছে।
ছবি : লেখক
ছবি : লেখক
No comments