ষোড়শ সংশোধনী- বিচার বিভাগের পায়ে বেড়ি পরানো? by মাহ্ফুজ আনাম
পাঠকদের কি ১৯৫০-এর দশকে সিয়ামের (আজকের
থাইল্যান্ড) রাজা চুলালোংকমের ওপর নির্মিত চমৎকার ছবি দ্য কিং অ্যান্ড
আইয়ের কথা মনে আছে? এ ছবিতে রাজা যখন দেখলেন তাঁর সন্তানদের জন্য যে ইংরেজ
গভর্নেস রেখেছিলেন, তিনি তাঁর চেয়ে লম্বা, তখন রাজা গভর্নেসকে বলেন, তাঁর
সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি যেন সব সময় হাঁটুর ওপর বসে থাকেন।
বাংলাদেশে আমরা দেখছি, প্রধানমন্ত্রীর ওপর কোনো মাথা নেই। না, শুধু ক্ষমতার দিক থেকে নয়, খ্যাতির দিক থেকেও (অধ্যাপক ইউনূসের কথা স্মরণ করুন)। এসব আমরা দেখে আসছি, সেটা আমাদের গা-সহাও হয়ে গেছে। কিন্তু গত বুধবার থেকে আমাদের পরিষ্কারভাবে বলা হলো, প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে বড় কোনো প্রতিষ্ঠানও থাকতে পারে না।
সেদিন আমাদের সংবিধানে সর্বসম্মতভাবে পাস হলো যে সংসদই এখন থেকে বিচারপতিদের অভিশংসন করবে (এটা একটা অসাধারণ আইনই বটে, কারণ একজন সাংসদও এর অন্যথা ভাবেননি। ফলে আমাদের মাননীয় সংসদে গণতন্ত্রের কেমন চর্চা হয়, সেটাও বোঝা গেল)।
‘সংসদের ক্ষমতায়ন’ বলতে প্রকৃতই কী বোঝায়, তা নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টির কোনো সুযোগ নেই।
আমাদের দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার আছে। এই ব্যবস্থায় এর সব সদস্যই সমান আর তার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ‘সব সমানদের মধ্যে প্রথম’ হওয়ার কথা। শেখ হাসিনার প্রতি সুবিচার করলে বলতে হবে, এটা কখনোই আমাদের দেশে ছিল না। ১৯৯১ সালে আমরা সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায় ফিরে গেলেও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার চৌহদ্দি নির্ধারণ করতে গিয়ে আমরা এই ‘প্রথম’টা শুধু রেখে দিয়েছি, আর ‘সমানদের মধ্যে’ ব্যাপারটা ঝেড়ে ফেলে দিয়েছি। ফলে সংসদ কখনোই একটি স্বাধীন সত্তা ছিল না, সব সময়ই তা রাবার স্ট্যাম্পের মতো কাজ করেছে৷ যার ভূমিকা ছিল শুধু নেতার ইচ্ছার ‘বৈধতা’ দেওয়া, ‘অনুমোদন’ শব্দটা ব্যবহার করার কথা ভাববেনও না। সেখানে কোনো বিতর্ক, আলোচনা করার অবকাশ ছিল না, আর নেতার ইচ্ছা চ্যালেঞ্জ করার কথা তো ‘অচিন্তনীয়’—যেখান থেকে সবচেয়ে ভালো ‘সম্মিলিত সিদ্ধান্তে’ সবচেয়ে ভালো নীতিটা গ্রহণ করা যায়। কী দুঃসাহস, ‘নেতার সিদ্ধান্ত’ বাদ দিয়ে ‘সম্মিলিত সিদ্ধান্ত’!
দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের সংসদে কখনো গঠনমূলক বিতর্ক হয়নি৷ যা হয়েছে, তা মূলত সরকারের তীব্র সমালোচনা ও গোলমাল সৃষ্টি করা, ওয়াকআউট, সংবাদ সম্মেলন ও রাজপথের কর্মসূচি। এসব কারণেই আমাদের সংসদ জীবন্ত (মূলত একটানা সংসদ বর্জনের কারণেই তা সরগরম থেকেছে, এটা ছিল মারাত্মক ভুল) থেকেছে, কোনো গঠনমূলক কারণে নয়। হ্যঁা, একটা নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত বর্জন জনমত গঠনে সহায়ক হয়, কিন্তু ধারাবাহিক বর্জনের কারণে সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছে।
বর্তমান সংসদে এসবের কোনো বালাই নেই। যে সংসদের বিরোধী দল থেকেও মন্ত্রী আছেন (দুনিয়াতে এটাই একমাত্র নজির), সেখানে ‘সরকারদলীয় ও বিরোধীদলীয়’ আসনের মধ্যে কোনো ভেদরেখা থাকে না। এটা একটা প্রহসন, সংসদের জীবনীশক্তিও এর মধ্য দিয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়।
ফলে ‘রাজার মাথার’ ওপর শুধু স্বাধীন বিচার বিভাগের মাথাই থাকতে পারত, কিন্তু এখন সেই বিচার বিভাগকেও সর্বক্ষমতাময় নির্বাহী বিভাগের কাছে মাথা নত করতে হবে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন এই ষোড়শ সংশোধনী আর কেনই বা সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকতে হবে। এমন কী হলো যে সংসদের হাতে এমন ক্ষমতা দরকার, যাতে তারা এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে। আমাদের সর্বোচ্চ বিচারালয় কি এতই অদক্ষ, অপরিপক্ব, নীতিবিবর্জিত, আস্থাহীন বা নিজের ওপর লাগাম টানতে অক্ষম হয়ে পড়েছেন যে সংসদের মতো ‘বাইরের’ একটি প্রতিষ্ঠানকে বিচার বিভাগের ‘আত্মমর্যাদা’ ফিরিয়ে আনতে হস্তক্ষেপ করতে হবে?
আমাদের সন্দেহ, এই সংশোধনীর উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। সেটা হলে বিচার বিভাগের ‘রাজনৈতিকীকরণ’ ঘটবে এবং সেটা আর স্বাধীন থাকবে না। তখন আর আদালত থাকবে না, সেটা হয়ে যাবে ‘ক্যাঙারু আদালত’? তখন সভ্য জগতে ‘জঙ্গলের রাজত্ব’ সৃষ্টি হবে, যদিও আমরা এখন পর্যন্ত নিজেদের সেই সভ্য জগতের অধিবাসী হিসেবে দাবি করি।
আরও একবার সংবিধানে একটি মৌলিক পরিবর্তন এল তেমন কোনো আলাপ-আলোচনা ছাড়াই। এমনকি পঞ্চদশ সংশোধনীর সময় এর ছলচাতুরী নিয়ে যে আলাপ-আলোচনা হয়েছিল, সেটাও এবার হয়নি। এই ষোড়শ সংশোধনী একটি মৌলিক পরিবর্তন, কারণ এর মাধ্যমে ‘রাষ্ট্রের একটি অঙ্গ’ আরেকটি অঙ্গের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। মানে বিচার বিভাগ চলে যাবে আইন বিভাগের অধীনে, যেটা আবার এখন পুরোপুরি নির্বাহী বিভাগের অধীনে। ফলে বিচার বিভাগকে আইন বিভাগের অধীনে নিয়ে আসার নামে আসলে এটাকে নির্বাহী বিভাগের অধীনে নিয়ে আসা হলো। ষোড়শ সংশোধনী পাস করার ধরনটাই এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
এ সংশোধনীর পক্ষে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে যে এর মাধ্যমে ১৯৭২-এর সংবিধানে ফেরত যাওয়া হলো। এটা কি কোনো যুক্তি হতে পারে? বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বয়স এখন ৪৩ বছর, এই সময়ে আমরা অনেক কিছু শিখেছি। ১৯৭২-এর সংবিধানের সবকিছুই পূতপবিত্র, ব্যাপারটা তো এমন নয়। যেমন ২০১১ সালে আমাদের সংবিধানে একটি বিধান যুক্ত করে সামরিক আইন জারি দেশদ্রোহের শামিল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, যার জন্য যেকোনো সময় শাস্তি প্রদান করা যাবে। ১/১১-এর পরিপ্রেক্ষিতে এটা ঠিকই আছে বলে আমরা মনে করি। কিন্তু এ বিধানটি ১৯৭২-এর সংবিধানে ছিল না। কথা হচ্ছে, ১৯৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার নামে কি এই প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনটিও কি আমরা বাদ দেব?
আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন প্রস্তাবনাসহ প্রায় ৫০টি অনুচ্ছেদ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে এগুলো কোনো ভবিষ্যৎ সংসদই সংশোধন করতে পারবে না। এটা গণতন্ত্রের নীতির সঙ্গে একেবারেই যায় না। আমরা যদি বিশ্বাস করি যে ‘জনগণই সব ক্ষমতার উৎস’, তাহলে একটি সংসদ (নবম সংসদ) কীভাবে ভবিষ্যতের ভোটার ও সংসদের কাছে প্রয়োজনীয় বোধ হয়, এমন আইন প্রণয়ন থেকে বিরত রাখতে পারে? আশা করি, আমরা জনগণের ক্ষমতায় বিশ্বাস করি।
এসব অনুচ্ছেদের ‘সংশোধন অযোগ্যতার’ বিধান আসলে অন্য সব সংসদের চেয়ে নবম সংসদই শ্রেয়তর, এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে প্রণয়ন করা হয়েছে। আমরা আসলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আদেশ দিচ্ছি, যেটা করার কোনো আইনি ও নৈতিক অধিকার আমাদের নেই। এটা অসংগত, ১৯৭২-এর সংবিধান থেকে মৌলিক ‘বিচ্যুতি’। ফলে ১৯৭২-এর সংবিধানের প্রতি এই দরদ আসলে একটা প্রহসন, ‘রাজার’ মাথার ওপর যে একটা মাথা ছিল, সেটা কেটে ফেলার লক্ষ্যে বারবার এর দোহাই দেওয়া হচ্ছে।
অন্যান্য দেশেও এ বিধান আছে বলে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, সেটাও আসলে অন্য যুক্তিগুলোর মতো খোঁড়া। আমাদের সংসদের নির্বাচিত সাংসদেরা (১৫৩ জন অনির্বাচিত সাংসদের কথা নাহয় ছেড়েই দিলাম) কি অন্য দেশের সংসদের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারেন? ওসব দেশের সংসদ কি অকারণ বর্জনের মধ্য দিয়ে পঙ্গু হয়ে পড়েছে? সেসব দেশে কি আমাদের সংসদের মতো সরকারি ও বিরোধী নেতাদের নামে কুৎসা রটনা করা হয়? সেসব দেশের সাংসদদের শুধু অর্থ বিলে সরকারের পক্ষে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্দেশনা থাকে। কিন্তু সেখানকার সাংসদেরা কি সব ক্ষেত্রে নিজ দলের পক্ষে ভোট দিতে বাধ্য, মানে ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ কি সেসব দেশে আছে? কোনো দেশের সংসদে ‘পয়েন্ট অব অর্ডার’ বা ‘বাজেট আলোচনায়’ অন্য দলের সদস্যদের গালি দেওয়া হয়? প্রায় সব দেশেই সংসদীয় রেওয়াজ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। আর আমরা কি পারস্পরিক গালাগাল দেওয়া ছাড়া আর কোনো প্রথা তৈরি করতে পেরেছি? কোন দেশের সংসদে অর্ধেকের বেশি সাংসদ বিনা নির্বাচনে নির্বাচিত হন?
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আমাদের সংসদে একজন সদস্য তাঁর দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারেন না। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল কোনো বিচারপতিকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নিলে সেটা বাস্তবায়িত হবেই, এর অন্যথা হওয়ার সুযোগ নেই। আর দলগুলোর ভেতরে কী হয়, আমরা তা জানি৷ ফলে কখন ও কেন এ রকম সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, তাও আমরা বুঝি।
ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে, এর মাধ্যমে শুধু এটাই নিশ্চিত হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য আত্মঘাতী হবে। এরূপ অবস্থা থেকে বাঁচতে হলে একটি পৃথক আইন করে তার আওতায় এই সংশোধনী কার্যকর করতে হবে। আইনবিদদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করে এই আইন প্রণয়ন করতে হবে, যাতে কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তার স্বচ্ছ ও সঠিক তদন্ত হয়৷ এ ক্ষেত্রে উচ্চ বিচারালয়কে যুক্ত করা যেতে পারে—ভারত, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অন্যান্য দেশে যা করা হয়েছে।
এই লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে, নির্বাহী বিভাগ ও সংসদকে প্রাসঙ্গিক আইন প্রণয়নে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার তাগাদা দেওয়া।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
মাহ্ফুজ আনাম: সম্পাদক, ডেইলি স্টার।
No comments