বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান সাড়া পাবে কি? by আলী ইদরিস
গত ১৭ই সেপ্টেম্বর ঢাকায় বিনিয়োগ বোর্ড আয়োজিত দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণে এক আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ‘আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী ফোরাম ২০১৪’ শীর্ষক সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উন্মুক্ত বাজার, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ, দক্ষ জনশক্তি ও কৌশলগত অবস্থানের সুবিধা নিতে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের ব্যবসা সম্প্রসারণের আহ্বান জানান। সম্মেলনে ২১টি দেশের ২৭৩ জন প্রতিনিধির অংশগ্রহণে চারটি কর্ম অধিবেশন ও আলোচনায় সরকারের মন্ত্রী, আমলা, এফবিসিসিআই ও অন্যান্য বণিক এবং ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিনিধি ও দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন সম্ভাবনা ও সমস্যার বিষয় তুলে ধরেন। বিনিয়োগের সম্ভাবনার দিকগুলো যেমন বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও গত ৫ বছরে এ দেশের গড়ে ৬.২ হারে জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন, কৃষি, হাল্কা প্রকৌশল, অবকাঠামো খাতসহ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে রপ্তানিজাত বিভিন্ন শিল্পে বিনিয়োগের সম্ভাবনা তুলে ধরা হয়। আরও বলা হয় বিশ্বেও ৩৮টি দেশে বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা পেয়ে থাকে যা দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা কাজে লাগাতে পারেন। কৃষিখাতে বিভিন্ন খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ছাড়াও জাহাজ নির্মাণ, খেলনা, জ্ব্বলানি, বিদ্যুৎ ও স্বাস্থ্য সেবা খাতে লাভজনক বিনিয়োগের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরা হয়। বিনিয়োগ বোর্ড কর্তৃক আন্তর্জাতিক মানের ও বৃহৎ পরিসরের এমন একটি সম্মেলন আয়োজন করা প্রশংসার দাবি রাখে। বিনিয়োগের অপার সম্ভাবনার বিপরীতে কিছু কিছু প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে যা দূর না করলে অত সহজে আমাদের লক্ষ পূরণ না-ও হতে পারে। যেমন: ভূমির সহজলভ্যতা আগের মতো নেই, প্রতি বছর লোকসংখ্যা বাড়ছে কিন্তু কৃষিযোগ্য ভূমি প্রায় ১% কমছে, দামও বাড়ছে। তাই এখন রপ্তানিমুখী শিল্প ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য সরকারকে সারা দেশে প্রয়োজনীয় সুবিধাসহ অর্থনৈতিক জোন সৃষ্টি করে বহুতল বিশিষ্ট অবকাঠামো তৈরি করে দিতে হবে। আমাদের কৃষিজমিকে বাঁচাতে হবে। দ্বিতীয়ত, দেশে জনবলের অভাব না থাকলেও নিঃসন্দেহে দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে। এ অদক্ষ জনশক্তিই দক্ষদের সঙ্গে দেশের বাইরে কাজ করে হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। অদক্ষ জনশক্তিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তুললে এরাই বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণ হয়ে উঠবে। বর্তমান গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহের পরিমাণ দিয়ে নতুন শিল্পকারখানা চালানো অথবা ব্যবসা সম্প্রসারণ করা কঠিন হবে, তাই জা্বলানির প্রাপ্যতাও নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আরও একটি বিষয় পর্যবেক্ষণ করেন, সেটা হলো স্থানীয় উদ্যোক্তারা ব্যবসাতে নতুন বিনিয়োগ করছেন কিনা। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পূর্ব সময়ে এবং নির্বাচন-উত্তরকালে ব্যাংকগুলোতে অলস পড়ে আছে প্রায় ১০০,০০০ কোটি টাকা যা থেকে বোঝা যায় যে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। নতুন বিনিয়োগ হলো অর্থনীতির প্রাণ। বিনিয়োগ না হওয়ার অর্থ হচ্ছে উৎপাদনে, কর্মসংস্থানে, জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জনে স্থিতাবস্থা বা স্থবিরতা বিরাজ করা। এ স্থবিরতা ব্যাংকিং কর্মকাণ্ডকেও স্থবির করে ফেলে, ব্যাংকে অলস টাকার পাহাড় গড়ে ওঠে। রাজনৈতিক অস্থিরতায়, বিশেষ করে ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬২ দিন হরতাল অবরোধে অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছিল তা ব্যাংকিং সেক্টরকেও দুর্বল করে দিয়েছিল। এফবিসিসিআই-এর এক প্রতিবেদন মতে তৈরী পোশাক, চামড়া, পোলট্রি, হিমায়িত খাদ্য, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, পরিবহন ইত্যাদি খাতে হরতাল-অবরোধে প্রায় ২০,০০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছিল, আবাসন খাতে ৫০% ছাড় দিয়েও ক্রেতা মিলছে না, এসব খাতের মোট খেলাপি ঋণ প্রায় ৩০,০০০ কোটি টাকা। এফবিসিসিআই বলেছে, ২০১৩ সালে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১,০০,০০০ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিপিডির প্রতিবেদন মোতাবেক গত সাড়ে চার বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহে প্রায় ৫,০০০ কোটি টাকার সুদ মওকুফ ও ১১,০০০ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এর আগে ৭ বছরে সুদ মওকুফ করা হয়েছিল মাত্র ৩,৬৪৫ কোটি টাকার। গত জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫১,৩৪৪ কোটি টাকা যা মোট ঋণের প্রায় ৩৩%। এ ভয়াবহ পরিস্থিতি ব্যাংক খাতের জন্য অশনি সংকেত। খেলাপি ঋণের এ বিপজ্জনক পরিমান ব্যাংকের মূলধনকে খেয়ে ফেলেছে। গত অর্থবছরের বাজেটে সরকার ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি মেটাতে জনগণের করের টাকা থেকে ৪,২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল কিন্তু ঋণ আদায়ের কোন উন্নতি হয়নি। আরও আছে খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন ঘাটতি। সোনালী, জনতা, অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৯,৬৪৫ কোটি টাকা, প্রভিশন ঘাটতি ৭,৪৯৪ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংক দু’দিকেই সবচেয়ে এগিয়ে আছে। হল-মার্ক, ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ ইত্যাদি গ্রুপের কেলেঙ্কারির পর অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ২,১৭,৯৯২ কোটি ঋণের বিপরীতে ৪,৬৮০ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করা হয়েছে। এ নাজুক পরিস্থিতিতে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার উদ্দেশ্যে ২০১৩ সালের রাজনৈতিক সহিংসতায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি হযেছে এ অজুহাত দেখিয়ে নতুন, পুরাতন খেলাপি ঋণ কোন রকম ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই পুনঃতফসিল করা হয়েছিল। যে সমস্ত ঋণ অতীতে একাধিকবার পুনঃতফসিল করা হয়েছে তা পুনরায় বিবেচনার অবকাশ নেই, তা সত্ত্বেও এ সমস্ত ঋণ পুনঃতফসিল করায় সেগুলো আবার খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে নতুন কোন স্থানীয় উদ্যোক্তা বিনিয়োগে এগিয়ে আসছেন না। ব্যাংকে আমানত বাড়ছে, ঋণ বিতরণ বাড়ছে না। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এ অচলাবস্থা দেখে উৎসাহিত হবেন না। এ অবস্থার উন্নতির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দক্ষ নীতিমালা এবং নজরদারি যেমন আরও বাড়াতে হবে, তেমনি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়নের জন্য ৫ই নির্বাচনের দোষত্রুটি, অসম্পূর্ণতা দূর করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সুসম্পর্ক আনয়ন করতে হবে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্যই স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসছে না, এবং স্থানীয় উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগ না করলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা উৎসাহ না-ও পেতে পারে।
No comments