আসুন, বেশি করে কথা বলি! by কে এম জাকারিয়া
‘জ্ঞানী লোকেরা কথা বলেন কারণ তাঁদের বলার কিছু আছে আর বোকারা কথা বলেন কারণ তাঁদের কিছু বলতে হবে।’ বলে গেছেন দার্শনিক প্লেটো। মানে, জ্ঞানী ও বোকাভেদে কথার মানে ভেদ হতে পারে কিন্তু কথা বলা থেকে কেউই বিরত থাকে না। মানুষের কথা বলার এই যে বিকট ইচ্ছা, তার ওপর ভর করে ভালোই ব্যবসা করে যাচ্ছে মুঠোফোন কোম্পানিগুলো। তারা কথা মাপে, তবে কথার ‘কোয়ালি’ (মান) নয়, ‘কোয়ান্টি’ (পরিমাণ)। জ্ঞানী বা আমাদের মতো বোকা সবই মিলেমিশে এখানে একাকার। কারণ, ‘কিছু বলার থাকলে’ বলা বা ‘কিছু বলতে হবে’ বলে বলা— যা-ই হোক না কেন, সবাইকেই পয়সা গুনতে হয় ‘টকটাইম’ ধরে। এরপরও কথা বলে পয়সা খরচ করতে কারও যেন কসুর নেই। এমন সুযোগ সরকার নেবে না কেন? যত খুশি কথা বলো, কিন্তু সরকারকেও ট্যাক্স দাও। যত কথা, তত ট্যাক্স!
সরকার দেশের উন্নয়ন করতে চায় আর এর জন্য দরকার যথেষ্ট অর্থকড়ি। অনেক ভেবেচিন্তে সরকার তার আয়-রোজগার বাড়ানোর একটি পথ খুঁজে পেয়েছে; মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর সারচার্জ। এটা আদায় হবে ‘উন্নয়ন সারচার্জ’ নামে। ১০০ টাকার কথা বললে এক টাকা সরকারকে দিতে হবে, খুবই সামান্য। যে বা যিনি কথা বলে ১০০ টাকা খরচ করতে পারবেন, তিনি এ জন্য এক টাকা বাড়তিও দিতে পারবেন। খুব চেপে হিসাব করে দেখা গেছে, এতে বছরে সরকারের বাড়তি আয় হতে পারে প্রায় ১৪০ কোটি টাকা। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে খরচ হবে এই টাকা।
উন্নয়ন চাইলে ও সরকারের উন্নয়নকাজে সহায়তা করতে চাইলে মুঠোফোনে বেশি কথা বলা এখন একটি পথ হতে পারে। যত বেশি ফোনে কথা বলা, ততই সরকারকে সহায়তা করা। মুঠোফোনে কথা বলার খরচ বেড়ে যাচ্ছে এই ভয় না পেয়ে মোবাইল কোম্পানিগুলোর বরং উচিত এই ‘দেশপ্রেম’ থিমকে কাজে লাগিয়ে নতুন বিজ্ঞাপন ও প্রচারণায় নেমে পড়া। তবে বিপদ হচ্ছে, যতই কম হোক এই সারচার্জ অনেকের মধ্যে মানসিক যন্ত্রণার সৃষ্টি করতে পারে। কেউ হয়তো ভাবতে পারেন, দেশ কোথায় গেল, কথা বলতে গেলেও ট্যাক্স গুনতে হবে!
প্লেটোর তত্ত্ব অনুযায়ী, জ্ঞানী বা বোকা কথা বলায় কেউ কম যান না। এর মধ্যে আমরা আবার তর্ক-বিতর্ক-কথাবার্তা পছন্দ করা জাতি। অমর্ত্য সেন তো ভারতীয়দের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও পরিচিতিসংক্রান্ত প্রবন্ধমালার বইয়ের শিরোনামই দিয়েছেন তর্কপ্রিয় ভারতীয়। অমর্ত্য সেন ভারতীয় বটে, তবে বাঙালিও। লিখেছেন ‘আমরা কথা বলতে ভালোবাসি।’ আমরা বাংলাদেশের লোকজনও কী কম যাই! কোনো বিষয়ে মত দেওয়া, প্রশ্ন তোলা ও তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়তে আমাদের জুড়ি নেই। কারও মনে এই বেয়াড়া প্রশ্ন উঠতেই পারে; কথা বলার জন্য সারচার্জ নাহয় দিলাম, কিন্তু এই টাকার পুরোটা উন্নয়নের কাজে লাগবে তো? দুর্নীতির নানা খবরের শিরোনামগুলো ভেসে উঠবে কারও কারও মনে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থা মনে পড়ে যাবে অনেকের। এই টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়ে যেতে পারে—এমন ভয়ও ঢুকবে কারও কারও মনে! এমন ভাবনাগুলো ঠেকানোর কোনো পথ নেই। ‘ভাবনার’ ওপর তো আর সারচার্জ বসানো যাবে না!
কথা বলার জন্য এই যে সারচার্জ গুনতে হবে জনগণকে, সেই টাকা অবশ্য সরাসরি আদায় করবে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। মোবাইল ফোন অপারেটররা গ্রাহকদের কাছ থেকে বিলের সঙ্গে কথা বলার সারচার্জ আদায় করে তা এনবিআরের কোষাগারে জমা দেবে। সরকার আয় বাড়ানোর এই যে একটি নতুন খাত খুঁজে পেয়েছে, তা খুবই সম্ভাবনাময়। আমরা এত বেশি কথা বলি যে সব ধরনের কথা বলার ওপর সারচার্জ আরোপ ও আদায় করতে পারলে সম্ভবত আমাদের আর বিদেশি সাহায্য বা বিশ্বব্যাংক ধরনের কারও ওপর কখনোই নির্ভর করতে হবে না।
তবে শুরুতে সব ধরনের কথা বলার ওপর ‘সারচার্জ’ আরোপ করা না গেলেও আপাতত আরও কিছু ক্ষেত্রে তা সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। টিভি ‘টক শো’গুলো নিয়ে সরকারের বিরক্তি-অস্বস্তির শেষ নেই। এই টক শোগুলোতে কথা বলার ওপর ‘উন্নয়ন সারচার্জ’ আরোপ করলে কেমন হয়! টিভি টক শোতে কত মিনিট কথা বললে কত সারচার্জ দিতে হবে, তা সরকার বা এনবিআর ঠিক করে দিতে পারে। টিভি কর্তৃপক্ষ মাসের শেষে বক্তাদের সম্মানী থেকে সেই পরিমাণ টাকা কেটে এনবিআরের কোষাগারে জামা দেবে। এনবিআরের তেমন কিছুই করতে হবে না, লোকবল বাড়ানোরও দরকার পড়বে না। সরকার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখতে পারে।
তবে এই সারচার্জ শুধু সরকারবিরোধী বা ভিন্নমতের টক শো বক্তাদের ওপর কার্যকর করলেই ভালো (সরকারবিরোধী টক শো বক্তারা এতে খুব নাখোশ হবেন বলে মনে হয় না। ‘সারচার্জ’ দিয়ে হলেও যদি সরকারের বিরুদ্ধে বেশি কথা বলার সুযোগ পাওয়া যায়, ক্ষতি কী!)। সরকারের বিরুদ্ধে যত বেশি কথা বলতে চাও বলো, সমালোচনা করতে চাইলে করো, কিন্তু সারচার্জ দাও! এতে গণতন্ত্রের প্রতি সরকারের শ্রদ্ধা-ভক্তির বিষয়টি যেমন নিশ্চিত হবে, আবার কিছু আয়ও হবে! এটা দিয়ে শুরু হোক, পরে নাহয় আওতা আরও বাড়ানো যাবে। সামনের কোনো সন ঠিক করে সরকার ‘গোল’ নির্ধারণ করতে পারে, যখন সব ধরনের কথা বলার ওপর সারচার্জ বসানো যাবে!
জ্ঞানী বা বোকা কেউই যেহেতু কথা না বলে থাকতে পারে না, তাই আসুন, আমরা সবাই বেশি করে কথা বলি, সারচার্জ দিই ও সরকারের উন্নয়নকাজে সহায়তা করি!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
সরকার দেশের উন্নয়ন করতে চায় আর এর জন্য দরকার যথেষ্ট অর্থকড়ি। অনেক ভেবেচিন্তে সরকার তার আয়-রোজগার বাড়ানোর একটি পথ খুঁজে পেয়েছে; মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর সারচার্জ। এটা আদায় হবে ‘উন্নয়ন সারচার্জ’ নামে। ১০০ টাকার কথা বললে এক টাকা সরকারকে দিতে হবে, খুবই সামান্য। যে বা যিনি কথা বলে ১০০ টাকা খরচ করতে পারবেন, তিনি এ জন্য এক টাকা বাড়তিও দিতে পারবেন। খুব চেপে হিসাব করে দেখা গেছে, এতে বছরে সরকারের বাড়তি আয় হতে পারে প্রায় ১৪০ কোটি টাকা। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে খরচ হবে এই টাকা।
উন্নয়ন চাইলে ও সরকারের উন্নয়নকাজে সহায়তা করতে চাইলে মুঠোফোনে বেশি কথা বলা এখন একটি পথ হতে পারে। যত বেশি ফোনে কথা বলা, ততই সরকারকে সহায়তা করা। মুঠোফোনে কথা বলার খরচ বেড়ে যাচ্ছে এই ভয় না পেয়ে মোবাইল কোম্পানিগুলোর বরং উচিত এই ‘দেশপ্রেম’ থিমকে কাজে লাগিয়ে নতুন বিজ্ঞাপন ও প্রচারণায় নেমে পড়া। তবে বিপদ হচ্ছে, যতই কম হোক এই সারচার্জ অনেকের মধ্যে মানসিক যন্ত্রণার সৃষ্টি করতে পারে। কেউ হয়তো ভাবতে পারেন, দেশ কোথায় গেল, কথা বলতে গেলেও ট্যাক্স গুনতে হবে!
প্লেটোর তত্ত্ব অনুযায়ী, জ্ঞানী বা বোকা কথা বলায় কেউ কম যান না। এর মধ্যে আমরা আবার তর্ক-বিতর্ক-কথাবার্তা পছন্দ করা জাতি। অমর্ত্য সেন তো ভারতীয়দের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও পরিচিতিসংক্রান্ত প্রবন্ধমালার বইয়ের শিরোনামই দিয়েছেন তর্কপ্রিয় ভারতীয়। অমর্ত্য সেন ভারতীয় বটে, তবে বাঙালিও। লিখেছেন ‘আমরা কথা বলতে ভালোবাসি।’ আমরা বাংলাদেশের লোকজনও কী কম যাই! কোনো বিষয়ে মত দেওয়া, প্রশ্ন তোলা ও তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়তে আমাদের জুড়ি নেই। কারও মনে এই বেয়াড়া প্রশ্ন উঠতেই পারে; কথা বলার জন্য সারচার্জ নাহয় দিলাম, কিন্তু এই টাকার পুরোটা উন্নয়নের কাজে লাগবে তো? দুর্নীতির নানা খবরের শিরোনামগুলো ভেসে উঠবে কারও কারও মনে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থা মনে পড়ে যাবে অনেকের। এই টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়ে যেতে পারে—এমন ভয়ও ঢুকবে কারও কারও মনে! এমন ভাবনাগুলো ঠেকানোর কোনো পথ নেই। ‘ভাবনার’ ওপর তো আর সারচার্জ বসানো যাবে না!
কথা বলার জন্য এই যে সারচার্জ গুনতে হবে জনগণকে, সেই টাকা অবশ্য সরাসরি আদায় করবে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। মোবাইল ফোন অপারেটররা গ্রাহকদের কাছ থেকে বিলের সঙ্গে কথা বলার সারচার্জ আদায় করে তা এনবিআরের কোষাগারে জমা দেবে। সরকার আয় বাড়ানোর এই যে একটি নতুন খাত খুঁজে পেয়েছে, তা খুবই সম্ভাবনাময়। আমরা এত বেশি কথা বলি যে সব ধরনের কথা বলার ওপর সারচার্জ আরোপ ও আদায় করতে পারলে সম্ভবত আমাদের আর বিদেশি সাহায্য বা বিশ্বব্যাংক ধরনের কারও ওপর কখনোই নির্ভর করতে হবে না।
তবে শুরুতে সব ধরনের কথা বলার ওপর ‘সারচার্জ’ আরোপ করা না গেলেও আপাতত আরও কিছু ক্ষেত্রে তা সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। টিভি ‘টক শো’গুলো নিয়ে সরকারের বিরক্তি-অস্বস্তির শেষ নেই। এই টক শোগুলোতে কথা বলার ওপর ‘উন্নয়ন সারচার্জ’ আরোপ করলে কেমন হয়! টিভি টক শোতে কত মিনিট কথা বললে কত সারচার্জ দিতে হবে, তা সরকার বা এনবিআর ঠিক করে দিতে পারে। টিভি কর্তৃপক্ষ মাসের শেষে বক্তাদের সম্মানী থেকে সেই পরিমাণ টাকা কেটে এনবিআরের কোষাগারে জামা দেবে। এনবিআরের তেমন কিছুই করতে হবে না, লোকবল বাড়ানোরও দরকার পড়বে না। সরকার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখতে পারে।
তবে এই সারচার্জ শুধু সরকারবিরোধী বা ভিন্নমতের টক শো বক্তাদের ওপর কার্যকর করলেই ভালো (সরকারবিরোধী টক শো বক্তারা এতে খুব নাখোশ হবেন বলে মনে হয় না। ‘সারচার্জ’ দিয়ে হলেও যদি সরকারের বিরুদ্ধে বেশি কথা বলার সুযোগ পাওয়া যায়, ক্ষতি কী!)। সরকারের বিরুদ্ধে যত বেশি কথা বলতে চাও বলো, সমালোচনা করতে চাইলে করো, কিন্তু সারচার্জ দাও! এতে গণতন্ত্রের প্রতি সরকারের শ্রদ্ধা-ভক্তির বিষয়টি যেমন নিশ্চিত হবে, আবার কিছু আয়ও হবে! এটা দিয়ে শুরু হোক, পরে নাহয় আওতা আরও বাড়ানো যাবে। সামনের কোনো সন ঠিক করে সরকার ‘গোল’ নির্ধারণ করতে পারে, যখন সব ধরনের কথা বলার ওপর সারচার্জ বসানো যাবে!
জ্ঞানী বা বোকা কেউই যেহেতু কথা না বলে থাকতে পারে না, তাই আসুন, আমরা সবাই বেশি করে কথা বলি, সারচার্জ দিই ও সরকারের উন্নয়নকাজে সহায়তা করি!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
No comments