বন্ধ হয়ে যাচ্ছে গার্মেন্টের দরজা by হাফিজ উদ্দিন
খুব
অল্প সময়ের ব্যবধানে দেশের পোশাক খাতের অন্যতম এলাকা হিসেবে পরিণত হয়
সাভার। তবে শ্রমিক আন্দোলন, কারখানা ভাঙচুর, শ্রমিক নির্যাতন ও রাজনীতিক
অস্থিরতাসহ বিভিন্ন কারণে একের পর এক পোশাক কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছে মালিক
পক্ষ। বছর জুড়েই বিভিন্ন ইস্যুতে অব্যাহত শ্রমিক আন্দোলনের কারণে গত দেড়
বছরে এ এলাকার ছোট ও মাঝারি ধরনের শতাধিক কারখানা বন্ধ হলেও কিছুদিন পর
অনেকেই আবার নতুন করে শুরু করেছে উৎপাদন। তবে বেশ কয়েকটি কারখানা কর্তৃপক্ষ
তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। ফলে কারখানা বন্ধের কারণে বেকার হয়ে পড়েছে
কয়েক হাজার শ্রমিক। অনেকেই গ্রামে ফিরে গেছে। শিল্প পুলিশ ও এলাকাবাসী
সূত্রে জানা গেছে, সাভার ও আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল এলাকায় ৭ শতাধিকেরও বেশি
পোশাক কারখানায় কয়েক লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ করেন। এদের মধ্যে গত দেড় বছরে
শ্রমিক আন্দোলন, কারখানা ভাঙচুর ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে উৎপাদন বন্ধ
হয়ে যাওয়া ও ঠিকমত অর্ডার সরবরাহ করতে না পারায় আশুলিয়ার জিরানী এলাকার
লিবার্টি ফ্যাশন লিমিটেড, ভলিভদ্র এলাকার ইন্ট্রাকো সোয়েটার, নয়ারহাট
এলাকার নুরজাহান এ্যাপারেলস লিমিটেডসহ সাভার ও আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের
২০/২৫টি পোশাক কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। আশুলিয়ার ভলিভদ্র এলাকার
ইন্ট্রাকো সোয়েটার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সফিউল আলম বলেন,
তাদের কারখানায় প্রায় ৮শ’ শ্রমিক কাজ করতো। বিরোধী দলের ডাকা হরতাল,
অবরোধের সময় বিদেশী বায়ারদের কারখানায় আসতে অনেক অসুবিধায় পড়তে হয়। এছাড়াও
এদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেক বিদেশী বায়ার বিনিয়োগ করতে অনীহা
প্রকাশ শুরু করেন। ফলে কারখানায় ক্রমশই অর্ডার কমতে থাকে। যার কারণে আর্থিক
সঙ্কটের মধ্যে পড়তে হয়। শ্রমিকদের বেতন ঠিকমতো প্রদান করতে না পারায় তারাও
আন্দোলন শুরু করেন। একপর্যায়ে গত বছরের ডিসেম্বর মাসের দিকে কারখানাটি
বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন তিনি। জিরানী এলাকার লিবার্টি ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা
পরিচালক বলেন, তার কারখানায় প্রায় দুই হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। রানা
প্লাজার ঘটনার পর থেকে তার কারখানাটি ঝুঁকিপূর্ণের মিথ্যা অভিযোগ এনে বন্ধ
করে দিতে বাধ্য করা হয়। একপর্যায়ে তিনিও কারখানাটি বন্ধ করে দিয়ে ব্যবসা
গুটিয়ে ফেলেন। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিদেশী বায়ারদের অর্ডার কমতে শুরু
করে। এতে বিভিন্ন কারখানা আর্থিক সঙ্কটের মুখে পড়ে সময় মতো শ্রমিকদের বেতন
প্রদানেও ব্যর্থ হয়। এছাড়াও ঠিক সময়ে মালামাল রপ্তানি করতে না পারায় অনেক
ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় তাদের। একপর্যায়ে শ্রমিক অসন্তোষের মুখে কারখানা
বন্ধ করে দিয়েছেন বলে জানালেন নুরজাহান এ্যাপারেলসের মালিক সফিউল আলম।
অপরদিকে নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণার পর থেকেই শ্রমিকদের বাড়তি মজুরি দিতে না
পারায় সাভারের হেমায়েতপুর এলাকার এ এইচ ড্রেসেস, দস্তগীর অ্যাপারেলস, পৌর
এলাকার আড়াপাড়া মহল্লার ফেয়ার নিটিং লিমিটেড, জামগড়া এলাকার জামী ফ্যাশনসহ
সাভার ও আশুলিয়ার আরও বেশ কয়েকটি ছোট ছোট পোশাক কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে
কর্তৃপক্ষ। বন্ধ হয়ে যাওয়া এসব কারখানাগুলোর মধ্যে অধিকাংশই বড় কারখানার
ওপর নির্ভরশীল ছিল। তাদের কাছ থেকে সাব-কন্ট্রাক কাজের ওপর ভিত্তি করেই
তাদের প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা হতো। পোশাক কারখানা শ্রমিকদের ন্যূনতম
মজুরির দাবিতে সৃষ্ট লাগাতার আন্দোলনের কারণে ছোট কারখানাগুলো তাদের উৎপাদন
সময় মতো শেষ করতে পারেনি। এতে তারা বিশেষ ক্ষতির মুখে পড়ে যায়। এছাড়াও ছোট
কারখানাগুলো বড় কারখানার ওপর নির্ভরশীল থাকায় নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণার পর
থেকেই ওইসব বড় কারখানাগুলো শ্রমিকদের অতিরিক্ত মজুরি গুনতে ভিন্ন কৌশল
অবলম্বন করেন। তারা ছোট কারখানায় সাব-কন্ট্রাকে কাজ না দিয়ে নিজেদের
কারখানায় শ্রমিকদের বাড়তি প্রেসার দিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করাতে শুরু করেন। এ
সময় কাজ না পাওয়ার কারণে অনেক কারখানা মালিক মূলধন হারিয়ে ব্যবসা বন্ধ করে
দিতে বাধ্য হন। এরপর পোশাক কারখানা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ হওয়ার
পর অনেক কারখানা মালিক শ্রমিকদের বেতন ভাতা পরিশোধ করতে বিপাকে পড়ে যান।
তখন তারা উৎপাদন খরচ কমাতে শ্রমিক ছাঁটাই শুরু করেন। তাতে আবার দেখা দেয়
বিপত্তি। শ্রমিক ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে শ্রমিকরা আবারও আন্দোলন করতে পথে
নামেন। এমন পরিস্থিতিতে সাভার ও আশুলিয়ার ছোট ছোট কারখানা মালিক রাতারাতি
কারখানা বন্ধ করে নোটিশ ঝুলিয়ে দেয়। সাভারের আড়াপাড়া এলাকার ফেয়ার নিটিং
লিমিটেড কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আর এইচ হাশেমি বলেন, তার কারখানায়
৫শ’ শ্রমিক কাজ করতেন। তাদের কারখানা ছোট হওয়ায় বিদেশী বায়াররা কাজ দিতে
অনীহা প্রকাশ করতো। আর এ কারণেই বড় কারখানার ওপর তাদের নির্ভরশীল হয়ে পড়তে
হয়। তবে নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণার পর থেকেই শ্রমিকদের অতিরিক্ত মজুরির টাকা
পুষিয়ে নিতে কারখানার মালিকরা ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন। মালিকরা তাদের কাজ
ছোট কারখানায় না দিয়ে শ্রমিকদের ওপর বাড়তি প্রেসার দিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করে
দিয়েছেন। আর এ কারণেই কাজ না পেয়ে তার কারখানায় বেশ কয়েক মাসের গ্যাস ও
বিদুৎ বিল বকেয়া পড়ে যায়। এছাড়াও শ্রমিকদের বেতন বকেয়া থাকায় তারা কাজ বন্ধ
করে দেয়। একপর্যায়ে তিনি কারখানাটি বন্ধ করার ঘোষণা দেন। এছাড়া সম্প্রতি
বন্ধ হয়ে যাওয়া একাধিক কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বড়
পোশাক কারখানাগুলো বেশীরভাগ সময়ই তাদের অতিরিক্ত উৎপাদনের জন্য ছোট
কারখানার ওপর নির্ভরশীল থাকেন। তবে নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণার পর থেকেই ওইসব
বড় কারখানার মালিকপক্ষ তাদের কাজ ছোট কারখানায় না দিয়ে নিজের কারখানাতেই
উৎপাদনের চেষ্টা করেন। এর ফলে ছোট কারখানাগুলো কাজের অর্ডার স্বল্পতার
কারণে আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে পড়েন। একপর্যায়ে তারা কারখানা বন্ধ করে দেয়া
ছাড়া কোন উপায় থাকে না। গামের্ন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রেন সাধারণ
সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু বলেন, সাভার আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে গত দেড় বছরে
২০/২৫টি পোশাক কারখানা বিভিন্ন জটিলতায় মালিকপক্ষ স্থায়ীভাবে বন্ধ করে
দিয়েছেন।
No comments