তাজউদ্দীনের প্রাপ্য স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য কেন? by মইনুল ইসলাম
১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসে প্রতিবছর
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর
প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণের মাধ্যমে এই ঐতিহাসিক দিনটির স্মরণ-উৎসবের
সূচনা করে থাকেন, এবারও করেছেন। কিন্তু ঢাকার বনানী কবরস্থানে শায়িত জাতীয়
চার নেতার মধ্যে তিনজনের (সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ক্যাপ্টেন
মনসুর আলী) সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের তাগিদ বোধ করেননি, এই দায়িত্ব পালন
করে থাকেন আওয়ামী লীগের অন্য নেতা-নেত্রী। একইভাবে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের
প্রতিবছরের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার দায়িত্বটাও বর্তাচ্ছে আওয়ামী লীগের
অন্যান্য নেতার ওপর, প্রধানমন্ত্রী বরাবরের মতো এবারও মুজিবনগরে অনুপস্থিত।
মুজিবনগর দিবসে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলোর সভা-সেমিনারগুলোতেও একটা অলিখিত নিয়ম দাঁড়িয়ে গেছে যে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন এবং নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারি তাজউদ্দীনের অতুলনীয় ঐতিহাসিক ভূমিকা এবং অনন্য নেতৃত্বের বিষয়ে প্রশংসাসূচক বক্তব্য দেওয়া একটা ‘ট্যাবু’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের প্রথম কাতারের নেতারাও খুবই সাবধানি, পাছে শীর্ষ নেতৃত্ব অসন্তুষ্ট হন। পুরো বিষয়টিও আমার কাছে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন বলে মনে করি। প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধের মূল কান্ডারি তাজউদ্দীনকে তাঁর প্রাপ্য স্বীকৃতি দিতে শীর্ষ নেতৃত্ব কার্পণ্য করছেন বলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এ ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করছেন না।
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম তাজউদ্দীনের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে মুজিবনগর সরকারের অন্যতম রূপকার ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মূল মুসাবিদাকারীও। বলার অপেক্ষা রাখে না যে তিনিও স্বীকৃতি ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত। এটাও জাতীয় জীবনের বড় লজ্জা বৈকি! মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পার করছি আমরা, আর কত দিন এ ধরনের ইতিহাস খণ্ডিতকরণের সংস্কৃতি মেনে নিতে হচ্ছে এ জাতিকে?
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ১৯৭১ সালের ২৫ ও ২৬ মার্চের রাতের ঘটনাবলির ধারাবাহিকতায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যেভাবে শুরু হয়েছিল, তার সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে মুজিবনগর দিবসের প্রতি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের ভালোবাসার ঘাটতি। অথচ আমার বিবেচনায়, ওই পর্যায়ে তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর-উল ইসলাম যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন, তার জন্য তাঁদের কাছে জাতির চিরকৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
এই বিবেচনার সপক্ষে আমি আমার যুক্তি তুলে ধরছি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় যখন ইয়াহিয়া খান গোপনে ঢাকা ত্যাগ করলেন, তখনই সারা দেশের মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে পাকিস্তানি ঘাতক বাহিনী বাঙালি জাতির ওপর সশস্ত্র আঘাত হানতে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বেরও এ ব্যাপারে প্রস্তুতি ও পূর্বপরিকল্পনা ছিল। এই পরিকল্পনা মোতাবেক বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার কথা ছিল আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে; বঙ্গবন্ধু এ ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছিলেন। ২৫ মার্চের ভয়াল রাতে আক্রমণের জন্য সেনাবাহিনী ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে রওনা হওয়ার খবর পেয়েই তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর বাসায় গেলেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যেতে, পুরান ঢাকার একটি বাসাও ঠিক করে রাখা হয়েছিল আত্মগোপনের জন্য। কিন্তু ইতিহাসের ওই যুগসন্ধিক্ষণে শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্তে বঙ্গবন্ধু কোথাও যেতে রাজি হলেন না। তাজউদ্দীনের আকুতি বিফলে গেল। বঙ্গবন্ধুর এক কথা, ‘তোমরা যা করার করো, আমি কোথাও যাব না।’
পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তাজউদ্দীন একটি স্বাধীনতার ঘোষণাও লিখে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং টেপরেকর্ডারও নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু টেপে বিবৃতি দিতে বা স্বাধীনতার ঘোষণায় স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানালেন। বঙ্গবন্ধুর মন্তব্য, ‘এটা আমার বিরুদ্ধে দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের জন্য বিচার করতে পারবে।’ (সূত্র: শারমিন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ: নেতা ও পিতা, ঐতিহ্য, এপ্রিল ২০১৪)
তাজউদ্দীনকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিলেও স্বাধীনতা ঘোষণার বিকল্প ব্যবস্থা ছিল বঙ্গবন্ধুর, এটা এখন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। তিনি স্বেচ্ছায় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার সিদ্ধান্ত যেমন নিয়েছিলেন সুচিন্তিতভাবে, তেমনি আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের অগোচরে ওয়্যারলেস ও অন্যান্য মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটিও জাতিকে জানানোর ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করেছিলেন। শারমিন আহমদের বইয়ে ইঞ্জিনিয়ার নুরুল হকের একটি টেলিফোন কল রিসিভ করার প্রসঙ্গ বর্ণিত হয়েছে, যে কলটি ২৫ মার্চ মধ্যরাতের অব্যবহিত পর রিসিভ করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী গোলাম মোরশেদ। নুরুল হক গোলাম মোরশেদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘মেসেজটি পাঠানো হয়ে গেছে। এখন মেশিনটি কী করব?’ তখন গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে। হয়তো তাই বঙ্গবন্ধু টেলিফোন কল রিসিভ না করেই গোলাম মোরশেদের মাধ্যমে জবাব দিয়েছিলেন, ‘মেশিনটি ভেঙে ফেলে পালিয়ে যেতে বলো।’
গোলাম মোরশেদের এই কাহিনির সমর্থন মিলছে ইঞ্জিনিয়ার নুরুল হককে ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ওই ওয়্যারলেস মেসেজ পাঠানোর অপরাধে বাসা থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করার ঘটনায়। এই কাহিনির একমাত্র সাক্ষী হাজি গোলাম মোরশেদ আজও বেঁচে আছেন। তাঁর সঙ্গে দেখা হলো গত ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে শারমিন আহমদের বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে। তিনি সংক্ষিপ্ত ভাষণে ওই ঘটনার সত্যতা স্বীকার করলেন। তাঁর এই কাহিনি ২৬ মার্চ রাতের বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার অকাট্য প্রমাণ, যা ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’-এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ওই মেসেজই হয়তো চট্টগ্রামের ওয়্যারলেস অফিস থেকে মিসেস নুরুন্নাহার জহুরকে ফোনে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল, যেটা সাইক্লোস্টাইল করে ২৬ মার্চ ভোর থেকে চট্টগ্রামে প্রচার করা হয়েছিল! ২৬ মার্চ সকালে একটি ঘোড়ার গাড়িতে করে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারকারীদের হাত থেকে আমিও ওই লিফলেট পেয়েছিলাম চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায়।
অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধুকে আত্মগোপনে যেতে কিংবা স্বাধীনতা ঘোষণায় রাজি করাতে না পেরে বিক্ষুব্ধচিত্তে নিজের বাসায় ফিরে যান তাজউদ্দীন। এরপর কীভাবে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম তাঁকে বাসা থেকে নিজের গাড়িতে তুলে নিয়ে লালমাটিয়ার এক বাড়িতে গিয়ে আত্মগোপন করেছিলেন এবং ২৭ মার্চ কারফিউ প্রত্যাহারের পর জীবন বাজি রেখে তিন দিন তিন রাতের কঠিন ও বিপৎসংকুল যাত্রা পার হয়ে ৩০ মার্চ কুষ্টিয়ার জীবননগর সীমান্তের টুঙ্গি নামের জায়গার একটি কালভার্টের ওপর পৌঁছে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ও মাহবুবউদ্দিন আহমদকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) কর্মকর্তাদের কাছে আলোচনার জন্য পাঠিয়েছিলেন, তার মনমুগ্ধ বর্ণনা তাজউদ্দীন-কন্যা শারমিন আহমদের বইটির ১০৬ থেকে ১১০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা আছে।
তাজউদ্দীন ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর এক সাক্ষাৎকারে জাতিকে জানিয়েছিলেন যে টুঙ্গির ওই কালভার্টের ওপর অপেক্ষা করার সময়েই তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে একটা স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করবেন এবং তার জন্য ভারতের সাহায্য কামনা করবেন।
সফল আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কিছুক্ষণের মধ্যেই তাজউদ্দীন ও ব্যারিস্টার আমীরকে বিএসএফের একটি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং খবর পেয়ে সেখানে ছুটে আসেন বিএসএফের পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক প্রধান গোলোক মজুমদার। তাঁর মাধ্যমে বিএসএফের মহাপরিচালক এ এফ এম রুস্তমজি খবর পেয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দীন ও আমীরকে সাক্ষাৎদানে সম্মত হওয়ায় তাঁদের নয়াদিল্লি নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এয়ারপোর্টে তাঁদের জামাকাপড়ের মলিন ও জীর্ণদশা দেখে রুস্তমজি তাঁদের জন্য কিছু জামাকাপড় কিনেও দিয়েছিলেন।
দিল্লি পৌঁছার পর ৩ এপ্রিল ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীনের সাক্ষাৎ ও আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। দিল্লিতে এরই মধ্যে গিয়ে পৌঁছান বাংলাদেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান ও আনিসুর রহমান। তাঁরাও আলোচনায় শরিক হন। একাধিক আলোচনা-বৈঠকের পর ১০ এপ্রিল তাজউদ্দীন এক বেতার ভাষণে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা প্রদান করেন, যাতে মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু কর্তৃক গঠিত হাইকমান্ডের সদস্যদের মন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। স্বাধীনতা ঘোষণার ওই ভাষণের মুসাবিদা করেছিলেন তাজউদ্দীন, আমীর-উল ইসলাম ও রেহমান সোবহান। ভাষণ প্রদানের পর তাজউদ্দীন ও আমীর কলকাতায় ফিরে এসে অন্য নেতাদের খুঁজতে শুরু করেন। প্রথমে তাঁদের দেখা হয় মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানের সঙ্গে; তাঁরা দুজনেই সানন্দে তাঁদের সম্মতি প্রদান করেন। পরে খবর পাওয়া যায় যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ময়মনসিংহ সীমান্তে আছেন। তাঁর কাছে ছুটে যান তাজউদ্দীন, তিনিও সম্মতি দেন। পরে আগরতলায় খোন্দকার মোশতাকের আপত্তির মুখে পড়েন তাজউদ্দীন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেওয়ার শর্তে তাঁর সঙ্গে রফা হয়। আরও তীব্র বাধা এসেছিল শেখ মনিসহ যুব ও ছাত্রনেতাদের কাছ থেকে, যাঁরা তাঁদের নেতৃত্বে বিপ্লবী কাউন্সিল করার ম্যান্ডেট বঙ্গবন্ধু তাঁদের দিয়েছিলেন বলে দাবি তুলে ঘোষিত সরকারের শপথ অনুষ্ঠানকে প্রায় ভন্ডুলই করে দিয়েছিলেন। তীব্র বাগিবতণ্ডার পর তাঁদের নিরস্ত করা গিয়েছিল।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই রচিত হয়েছিল ১৭ এপ্রিলের মুজিবনগর দিবসের ইতিহাস। এই ইতিহাসের মূল স্রষ্টাকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দিতে অপারগতা কি অযৌক্তিক নয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী? এটা খুবই বেদনাদায়ক যে কোনো অজানা কারণে বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় একবারও মুজিবনগরে যাননি, এমনকি তাজউদ্দীনের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের ঘটনাবলি বা মুজিবনগর সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে কিছু জানতে চাননি।
কিন্তু এখন তো বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে মুজিবনগরের স্মৃতি রক্ষার্থে দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য ও স্মৃতিসৌধগুলো গড়ে তোলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারিকে যথাযথ স্বীকৃতি দিয়ে অভিমানাহত স্বজনদের কাছে টেনে নেওয়ার এটাই তো প্রকৃষ্ট সময়। তিনি কি সাড়া দেবেন?
মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।
No comments