শাপলা চত্বরে অভিযানের এক বছর- থিতিয়ে পড়েছে হেফাজত by সেলিম জাহিদ
দেশ কাঁপিয়ে উত্থান, ৫ মে ঢাকা অবরোধ, দিনব্যাপী সহিংসতা, শাপলা চত্বরে অবস্থান, গভীর রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ছত্রভঙ্গ। এরপর এক বছরের মাথায় থিতিয়ে পড়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। উপরন্তু, শীর্ষ নেতৃত্বের কারও কারও বিরুদ্ধে সরকারের কাছ থেকে বৈষয়িক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগকে কেন্দ্র করে এখন হেফাজতের অভ্যন্তরে ক্ষোভ-হতাশা ও সন্দেহ-অবিশ্বাস প্রকট হয়ে উঠেছে। সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁদের বেশির ভাগ নেতাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, হেফাজতের শীর্ষ নেতৃত্ব সরকারের কবজায় চলে গেছেন। আওয়ামী লীগ, সরকার ও ছাত্রলীগকে হেফাজতের বন্ধু বলে গত ১১ এপ্রিল হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফীর বক্তৃতার পর এ বিশ্বাস আরও জোরালো হয়। এখন অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে যে গত বছরের ৫ মে 'ঢাকা অবরোধ' কর্মসূচিতে হতাহতদের স্মরণে এ দিনটিতে আজ কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো কর্মসূচি দিতে পারেনি হেফাজত।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ সৃষ্টির পর কথিত নাস্তিকদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হঠাৎ জেগে ওঠে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক এই অরাজনৈতিক সংগঠনটি। ৬ এপ্রিল ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দেশ-বিদেশে হইচই ফেলে দিয়েছিল। এরপর ৫ মের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি তখন ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের চরম উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছিল। নানা বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে সারা দেশ থেকে মাদ্রাসার লাখ লাখ ছাত্র-শিক্ষক রাজধানী ঢাকার চারপাশের প্রবেশপথগুলো অবরোধ করেন। একপর্যায়ে তাঁরা মতিঝিলের শাপলা চত্বরে গিয়ে অবস্থান নেন। দিনভর রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে চলে সহিংসতা, সম্পদের ক্ষতি ও প্রাণহানী। এরপর মধ্যরাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে শাপলা চত্বর থেকে সরিয়ে দেয় হেফাজতকে। নিহতদের তালিকা প্রকাশ করেনি: সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ওই রাতের অভিযানে কোনো প্রাণহানি হয়নি। আর হেফাজতের আমির ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ফিরে ৭ মে এক বিবৃতিতে দাবি করেছিলেন, ওই অভিযানের সময় আড়াই থেকে তিন হাজার লোক মারা গেছেন।
পরে হেফাজতের নেতারা জানিয়েছিলেন, তাঁরা হতাহতদের তালিকা করছেন, সেটা যথাসময়ে প্রকাশ করা হবে। হেফাজতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী গত বছরের ৪ জুন এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, প্রশাসনের চাপ ও হয়রানির কারণে তাঁরা ঠিকমতো তথ্য সংগ্রহ করতে পারছেন না। তখন পর্যন্ত ৭৩ জন নিহত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পেরেছিলেন বলে তিনি দাবি করেন। এগারো মাস পর গত শনিবার রাতে ওই তালিকা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে আজিজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, নিহত ও নিখোঁজদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এর সংখ্যা কত জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'শুনলে গা শিউরে উঠবে।' তালিকাটি চাইলে তিনি বলেন, এটি প্রকাশে এখনো হুজুরের (আমির আহমদ শফী) অনুমতি নেই। হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ও ঢাকা মহানগর কমিটির আহ্বায়ক নূর হোসাইন কাসেমী প্রথম আলোকে বলেন, 'কেন্দ্রীয়ভাবে দায়িত্বপ্রাপ্তরা শাপলা চত্বরে শাহাদাতবরণকারী ভাইদের সঠিক তালিকা সংগ্রহের কাজ অনেকটা গুছিয়ে এনেছেন। ইনশাল্লাহ কেন্দ্রীয়ভাবেই তা দেশবাসীর সামনে প্রকাশ করা হবে।'
সরকারি লোকদের যাতায়াত: শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতকে সরিয়ে দেওয়ার পর জুন ও জুলাই মাসে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মাঠপর্যায়ে সক্রিয় ছিল হেফাজত। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীর পরাজয়ের জন্য হেফাজত একটা কারণ হিসেবে আলোচনায় এসেছিল। ফলে হেফাজত আবার সরকারের শীর্ষ মহলের উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে ওঠে। অবশ্য ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনের আগেই হেফাজতকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় সরকার। সংগঠনের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় গিয়ে শাহ আহমদ শফীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এর পর থেকে হেফাজতের আন্দোলনমুখী তৎপরতা থিতিয়ে আসে। একই সঙ্গে হেফাজতের আমিরের কাছে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের যাতায়াত বাড়ে। এ সময় সরকারের কাছ থেকে বৈষয়িক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগও ওঠে। ফলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতি অন্যদের সন্দেহ-অবিশ্বাস বাড়তে থাকে। এর মধ্যে গত ১০ এপ্রিল সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী, ২২ এপ্রিল চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, এর আগে ১৭ মার্চ একটি গোয়েন্দা সংস্থার দুজন পদস্থ কর্মকর্তা হাটহাজারী মাদ্রাসায় গিয়ে হেফাজতের আমিরের সঙ্গে দেখা করেন। প্রায় সব বৈঠকেই আমিরের ছেলে আনাস মাদানী উপস্থিত ছিলেন।
কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা জানান, শুরুর দিকে হেফাজতের আমির সরকারের মন্ত্রী, সাংসদ, সরকারি কোনো সংস্থার লোকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ দিতে রাজি হতেন না। একদম এড়াতে না পারলে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের ডেকে আনতেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের কেউ দেখা করতে এলে ছেলে আনাস ছাড়া অন্য কাউকে রাখা হয় না। অবশ্য হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির নূর হোসাইন কাসেমী দাবি করেন, 'হেফাজতের ইমানি আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রশ্নবিদ্ধ করার দুরভিসন্ধি নিয়ে অনেকে সরকারের সঙ্গে আঁতাত কিংবা অর্থ-সহায়তা গ্রহণের কাল্পনিক ও ভিত্তিহীন তথ্য প্রচার করছে।' বিবৃতিনির্ভর তৎপরতা: সংগঠনের নেতারা জানান, গত ডিসেম্বর মাসের আগ পর্যন্ত হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে সারা দেশের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ের অন্তত অর্ধশত আলেম উপস্থিত থাকতেন। বর্তমানে কেবল হাটহাজারী মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষকসহ বৈঠকে উপস্থিতির সংখ্যা ৮-১০ জনে নেমে এসেছে। এ অবস্থায় হেফাজত এখন অনেকটা 'বিবৃতিনির্ভর' সংগঠনে পরিণত হয়েছে। হিসাব কষে দেখা গেছে, গত এক বছরে হেফাজতের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে ৭৫টির মতো বিবৃতি বা বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। এমনকি বৈঠক না করেও শীর্ষস্থানীয় আলেমদের অংশগ্রহণে সভা হয়েছে দাবি করে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়েছে বলে একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সর্বশেষ গত ৩০ এপ্রিল আহমদ শফীর সভাপতিত্বে হাটহাজারী মাদ্রাসায় হেফাজতের জরুরি সভা হয়েছে বলে সংগঠনের প্রচার সম্পাদক আনাস মাদানীর নামে একটি বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়। তাতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে হেফাজতের আমির ও তাঁর ছেলে আনাসের আর্থিক ও সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ জানানো হয়। 'হেফাজতে ইসলাম সরকারের সাথে আঁতাত বা অর্থনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করেনি' শিরোনামে ওই বিজ্ঞপ্তিতে ২৩ জনের উপস্থিতির কথা উল্লেখ করা হয়। তাঁদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীসহ কয়েকজনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা বলেন, এ ধরনের কোনো সভার কথা তাঁরা জানেন না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আনাস মাদানী গতকাল প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীসহ ওই সভায় যাঁরা আসতে পারেননি, তাঁদের সম্মতি নিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে নাম দেওয়া হয়েছে।
কর্মসূচি নিয়ে দ্বিধাবিভক্তি: কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা জানান, ৫ মে শাপলা চত্বরে হতাহতদের স্মরণে আজ সোমবার সারা দেশে 'দোয়া' কর্মসূচি দেওয়ার প্রস্তাব আসে। এ নিয়ে ২৯ এপ্রিল সকালে হেফাজতের আমিরের সঙ্গে কথা বলেন মহাসচিব মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরীসহ ছয়জনের একটি প্রতিনিধিদল। কিন্তু আমির কর্মসূচি দিতে রাজি হননি। এই অবস্থায় সংগঠনের কিছু নেতা আল-আমানাহ ফাউন্ডেশনের নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে হাটহাজারীর পার্বতী হাইস্কুল মাঠে আজ সোমবার সমাবেশ ডেকেছেন। হেফাজতের ঢাকা মহানগর কমিটিতে বারিধারা ও লালবাগ মাদ্রাসাকেন্দ্রিক দুটি ধারার সৃষ্টি হয়েছে। রাজধানীর বারিধারার জামিয়া মাদানিয়া মাদ্রাসার প্রধান নূর হোসাইন কাসেমী হেফাজতের মহানগর কমিটির আহ্বায়ক। তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামেরও জ্যেষ্ঠ নেতা। আর জুনাইদ আল হাবীব হেফাজতের মহানগর কমিটির সদস্যসচিব, তিনি সম্প্রতি ইসলামী ঐক্যজোট থেকে জমিয়তে যোগ দিয়েছেন। অন্যদিকে হেফাজতের কেন্দ্রীয় ও মহানগর কমিটির নেতাদের বড় অংশ ইসলামী ঐক্যজোটের, তাঁরা লালবাগ মাদ্রাসাকেন্দ্রিক।
উভয় পক্ষ আজ পৃথক কর্মসূচি দিয়েছে। এর মধ্যে বারিধারা মাদ্রাসায় হেফাজতের ব্যানারে আজ '৫ ও ৬ মে শাপলা চত্বরসহ সারা দেশে শাহাদাত বরণকারীদের' স্মরণে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের কর্মসূচি দেয় একাংশ। আরেক অংশ খেলাফত আন্দোলনের ব্যানারে আজ কামরাঙ্গীরচর মাদ্রাসায় জমায়েত হয়ে শাপলা চত্বরের উদ্দেশে 'কালেমা ও জাতীয় পতাকা' মিছিলের কর্মসূচি দিয়েছে। এ ছাড়া শাপলা চত্বরে 'শহীদদের' স্মরণে কাল মঙ্গলবার ইসলামী ঐক্যজোট ও খেলাফত মজলিসের দুই অংশসহ আরও কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দল যৌথভাবে লালবাগ মাদ্রাসায় দোয়া ও আলোচনার আয়োজন করেছে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ সৃষ্টির পর কথিত নাস্তিকদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হঠাৎ জেগে ওঠে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক এই অরাজনৈতিক সংগঠনটি। ৬ এপ্রিল ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দেশ-বিদেশে হইচই ফেলে দিয়েছিল। এরপর ৫ মের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি তখন ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের চরম উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছিল। নানা বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে সারা দেশ থেকে মাদ্রাসার লাখ লাখ ছাত্র-শিক্ষক রাজধানী ঢাকার চারপাশের প্রবেশপথগুলো অবরোধ করেন। একপর্যায়ে তাঁরা মতিঝিলের শাপলা চত্বরে গিয়ে অবস্থান নেন। দিনভর রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে চলে সহিংসতা, সম্পদের ক্ষতি ও প্রাণহানী। এরপর মধ্যরাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে শাপলা চত্বর থেকে সরিয়ে দেয় হেফাজতকে। নিহতদের তালিকা প্রকাশ করেনি: সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ওই রাতের অভিযানে কোনো প্রাণহানি হয়নি। আর হেফাজতের আমির ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ফিরে ৭ মে এক বিবৃতিতে দাবি করেছিলেন, ওই অভিযানের সময় আড়াই থেকে তিন হাজার লোক মারা গেছেন।
পরে হেফাজতের নেতারা জানিয়েছিলেন, তাঁরা হতাহতদের তালিকা করছেন, সেটা যথাসময়ে প্রকাশ করা হবে। হেফাজতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী গত বছরের ৪ জুন এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, প্রশাসনের চাপ ও হয়রানির কারণে তাঁরা ঠিকমতো তথ্য সংগ্রহ করতে পারছেন না। তখন পর্যন্ত ৭৩ জন নিহত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পেরেছিলেন বলে তিনি দাবি করেন। এগারো মাস পর গত শনিবার রাতে ওই তালিকা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে আজিজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, নিহত ও নিখোঁজদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এর সংখ্যা কত জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'শুনলে গা শিউরে উঠবে।' তালিকাটি চাইলে তিনি বলেন, এটি প্রকাশে এখনো হুজুরের (আমির আহমদ শফী) অনুমতি নেই। হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ও ঢাকা মহানগর কমিটির আহ্বায়ক নূর হোসাইন কাসেমী প্রথম আলোকে বলেন, 'কেন্দ্রীয়ভাবে দায়িত্বপ্রাপ্তরা শাপলা চত্বরে শাহাদাতবরণকারী ভাইদের সঠিক তালিকা সংগ্রহের কাজ অনেকটা গুছিয়ে এনেছেন। ইনশাল্লাহ কেন্দ্রীয়ভাবেই তা দেশবাসীর সামনে প্রকাশ করা হবে।'
সরকারি লোকদের যাতায়াত: শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতকে সরিয়ে দেওয়ার পর জুন ও জুলাই মাসে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মাঠপর্যায়ে সক্রিয় ছিল হেফাজত। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীর পরাজয়ের জন্য হেফাজত একটা কারণ হিসেবে আলোচনায় এসেছিল। ফলে হেফাজত আবার সরকারের শীর্ষ মহলের উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে ওঠে। অবশ্য ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনের আগেই হেফাজতকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় সরকার। সংগঠনের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় গিয়ে শাহ আহমদ শফীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এর পর থেকে হেফাজতের আন্দোলনমুখী তৎপরতা থিতিয়ে আসে। একই সঙ্গে হেফাজতের আমিরের কাছে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের যাতায়াত বাড়ে। এ সময় সরকারের কাছ থেকে বৈষয়িক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগও ওঠে। ফলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতি অন্যদের সন্দেহ-অবিশ্বাস বাড়তে থাকে। এর মধ্যে গত ১০ এপ্রিল সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী, ২২ এপ্রিল চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, এর আগে ১৭ মার্চ একটি গোয়েন্দা সংস্থার দুজন পদস্থ কর্মকর্তা হাটহাজারী মাদ্রাসায় গিয়ে হেফাজতের আমিরের সঙ্গে দেখা করেন। প্রায় সব বৈঠকেই আমিরের ছেলে আনাস মাদানী উপস্থিত ছিলেন।
কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা জানান, শুরুর দিকে হেফাজতের আমির সরকারের মন্ত্রী, সাংসদ, সরকারি কোনো সংস্থার লোকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ দিতে রাজি হতেন না। একদম এড়াতে না পারলে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের ডেকে আনতেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের কেউ দেখা করতে এলে ছেলে আনাস ছাড়া অন্য কাউকে রাখা হয় না। অবশ্য হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির নূর হোসাইন কাসেমী দাবি করেন, 'হেফাজতের ইমানি আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রশ্নবিদ্ধ করার দুরভিসন্ধি নিয়ে অনেকে সরকারের সঙ্গে আঁতাত কিংবা অর্থ-সহায়তা গ্রহণের কাল্পনিক ও ভিত্তিহীন তথ্য প্রচার করছে।' বিবৃতিনির্ভর তৎপরতা: সংগঠনের নেতারা জানান, গত ডিসেম্বর মাসের আগ পর্যন্ত হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে সারা দেশের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ের অন্তত অর্ধশত আলেম উপস্থিত থাকতেন। বর্তমানে কেবল হাটহাজারী মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষকসহ বৈঠকে উপস্থিতির সংখ্যা ৮-১০ জনে নেমে এসেছে। এ অবস্থায় হেফাজত এখন অনেকটা 'বিবৃতিনির্ভর' সংগঠনে পরিণত হয়েছে। হিসাব কষে দেখা গেছে, গত এক বছরে হেফাজতের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে ৭৫টির মতো বিবৃতি বা বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। এমনকি বৈঠক না করেও শীর্ষস্থানীয় আলেমদের অংশগ্রহণে সভা হয়েছে দাবি করে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়েছে বলে একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সর্বশেষ গত ৩০ এপ্রিল আহমদ শফীর সভাপতিত্বে হাটহাজারী মাদ্রাসায় হেফাজতের জরুরি সভা হয়েছে বলে সংগঠনের প্রচার সম্পাদক আনাস মাদানীর নামে একটি বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়। তাতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে হেফাজতের আমির ও তাঁর ছেলে আনাসের আর্থিক ও সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ জানানো হয়। 'হেফাজতে ইসলাম সরকারের সাথে আঁতাত বা অর্থনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করেনি' শিরোনামে ওই বিজ্ঞপ্তিতে ২৩ জনের উপস্থিতির কথা উল্লেখ করা হয়। তাঁদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীসহ কয়েকজনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা বলেন, এ ধরনের কোনো সভার কথা তাঁরা জানেন না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আনাস মাদানী গতকাল প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীসহ ওই সভায় যাঁরা আসতে পারেননি, তাঁদের সম্মতি নিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে নাম দেওয়া হয়েছে।
কর্মসূচি নিয়ে দ্বিধাবিভক্তি: কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা জানান, ৫ মে শাপলা চত্বরে হতাহতদের স্মরণে আজ সোমবার সারা দেশে 'দোয়া' কর্মসূচি দেওয়ার প্রস্তাব আসে। এ নিয়ে ২৯ এপ্রিল সকালে হেফাজতের আমিরের সঙ্গে কথা বলেন মহাসচিব মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরীসহ ছয়জনের একটি প্রতিনিধিদল। কিন্তু আমির কর্মসূচি দিতে রাজি হননি। এই অবস্থায় সংগঠনের কিছু নেতা আল-আমানাহ ফাউন্ডেশনের নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে হাটহাজারীর পার্বতী হাইস্কুল মাঠে আজ সোমবার সমাবেশ ডেকেছেন। হেফাজতের ঢাকা মহানগর কমিটিতে বারিধারা ও লালবাগ মাদ্রাসাকেন্দ্রিক দুটি ধারার সৃষ্টি হয়েছে। রাজধানীর বারিধারার জামিয়া মাদানিয়া মাদ্রাসার প্রধান নূর হোসাইন কাসেমী হেফাজতের মহানগর কমিটির আহ্বায়ক। তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামেরও জ্যেষ্ঠ নেতা। আর জুনাইদ আল হাবীব হেফাজতের মহানগর কমিটির সদস্যসচিব, তিনি সম্প্রতি ইসলামী ঐক্যজোট থেকে জমিয়তে যোগ দিয়েছেন। অন্যদিকে হেফাজতের কেন্দ্রীয় ও মহানগর কমিটির নেতাদের বড় অংশ ইসলামী ঐক্যজোটের, তাঁরা লালবাগ মাদ্রাসাকেন্দ্রিক।
উভয় পক্ষ আজ পৃথক কর্মসূচি দিয়েছে। এর মধ্যে বারিধারা মাদ্রাসায় হেফাজতের ব্যানারে আজ '৫ ও ৬ মে শাপলা চত্বরসহ সারা দেশে শাহাদাত বরণকারীদের' স্মরণে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের কর্মসূচি দেয় একাংশ। আরেক অংশ খেলাফত আন্দোলনের ব্যানারে আজ কামরাঙ্গীরচর মাদ্রাসায় জমায়েত হয়ে শাপলা চত্বরের উদ্দেশে 'কালেমা ও জাতীয় পতাকা' মিছিলের কর্মসূচি দিয়েছে। এ ছাড়া শাপলা চত্বরে 'শহীদদের' স্মরণে কাল মঙ্গলবার ইসলামী ঐক্যজোট ও খেলাফত মজলিসের দুই অংশসহ আরও কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দল যৌথভাবে লালবাগ মাদ্রাসায় দোয়া ও আলোচনার আয়োজন করেছে।
No comments