জবাবদিহির জন্য দাঁড়াতে হবে

সমাজে প্রত্যেক মানুষ তার কর্মফলের জন্য নিজেই দায়ী। পার্থিব জীবন শেষে আল্লাহর কাছে প্রত্যেককে নিজ নিজ কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। কোনো লোকের দুর্নীতি, অপকর্ম বা পাপে অন্য কেউ বা তার আত্মীয়স্বজন বা বংশ দায়ী হবে না। মানুষকে নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য অত্যন্ত সুষ্ঠু ও স্বচ্ছতার সঙ্গে যথাযথভাবে পালন করতে হবে। বিভিন্ন কাজকর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের প্রকাশের উপযুক্ত তত্ত্ব-তথ্য, আয়-ব্যয়, হিসাব-নিকাশ ও লেনদেনকে সুস্পষ্টভাবে জানার জন্য উন্মুুক্ত করাই হলো স্বচ্ছতা। আর প্রত্যেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি নিজ নিজ অধীন ব্যক্তিদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হওয়াই জবাবদিহি। ইসলামে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি ইহকালীন ও পারলৌকিক উভয় জগতেই লক্ষ করা যায়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘অনন্তর যে ব্যক্তি স্বীয় প্রতিপালকের সামনে দণ্ডায়মান হওয়াকে (জবাবদিহি) ভয় করে এবং প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখে, জান্নাতই হবে তার আবাস।’ (সূরা নাজিআত, আয়াত: ৪০) প্রশাসনে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের যে ক্ষমতা বা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তা পালন করার সন্তোষজনক কৈফিয়ত প্রদানকে জবাবদিহি বোঝায়। শাসক বা নেতাকে যেমন অধীনস্থ প্রজা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে, তেমনি আপামর জনসাধারণকেও তাদের কর্তব্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই রক্ষক এবং তোমাদের প্রত্যেকেই স্বীয় অধীনস্থ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।
সুতরাং শাসনকর্তা যিনি জনগণের রক্ষক, তিনি স্বীয় অধীনস্থ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন আর প্রত্যেক পুরুষ স্বীয় পরিবারের লোকদের রক্ষক এবং তিনি নিজের অধীনস্থ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। আর প্রত্যেক নারী স্বীয় স্বামীর পরিবারের লোক ও তাঁর সন্তানদের দায়িত্বশীল এবং তিনি তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। কোনো লোকের চাকর স্বীয় মনিবের সম্পদের রক্ষক এবং সে তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম) জবাবদিহির সীমাবদ্ধতার ফলে একদিকে যেমন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, নিরপেক্ষতার অভাব, অন্তর্দ্বন্দ্ব ও হতাশা ব্যাপকভাবে বিদ্যমান; অপর দিকে স্বেচ্ছাচারিতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম, অদক্ষতা, তোষামোদ, কাজে দীর্ঘসূত্রতার পাশাপাশি নিয়মশৃঙ্খলা ও সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। একজন সাধারণ মানুষ যেমন তার দায়দায়িত্বের জন্য পরকালে জিজ্ঞাসিত হবে, ঠিক তেমনি একজন ধর্মপ্রাণ বান্দাও তার নির্ধারিত কাজের জন্য জিজ্ঞাসিত হবে। পরিবারের রক্ষক ও অভিভাবক পুরুষকে যেমন তার পরিবার-পরিজন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে, তেমনি সংসারের কর্ত্রী স্ত্রীকেও তার স্বামীর ঘর-সংসার ও সন্তানসন্ততিদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। কোনো লোকের চাকর বা শ্রমিককে তার কর্তব্য তথা মালিকের বা সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে প্রত্যেকেই তার অধীনস্থ ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি দায়িত্বশীল রয়েছে এবং সবাই ভালোমন্দ কাজের জন্য দায়বদ্ধ হবে। তাই সমানভাবে বিচারের জন্য তাদের স্বীয় অধীনস্থ ব্যক্তিদের সম্পর্কে কিয়ামতের দিন অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।
পরকালে আল্লাহর পক্ষ থেকে সম্মান ও মর্যাদা প্রাপ্তির লক্ষ্যে প্রত্যেকের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে আত্মসচেতন, কর্তব্যপরায়ণ ও কর্মতৎপর হতে হবে। নিজেকে অর্পিত দায়িত্ব পালনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জন্য প্রস্তুত করে তুলতে হবে। দৈনন্দিন জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ও জাতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির মনে ইমানি চেতনায় মানসিক দৃঢ়তা, সাহসিকতা ও আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলে। স্বচ্ছতার ফলে অধীনস্থ ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে যথেষ্ট সম্মান পাওয়া যায়। মানবজীবন জবাবদিহির একটি নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা। এটি ইহকাল ও পরকালে কল্যাণ বয়ে আনে। এ জন্য সততা, ন্যায়নিষ্ঠা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, নিরপেক্ষতার সঙ্গে সবাইকে সমাজজীবনে যথাযথভাবে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হবে। সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টির লক্ষ্যে স্বচ্ছতা অবশ্যই একটি উত্তম প্রক্রিয়া। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকলে সর্বমহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের গ্রহণযোগ্যতা ও ভাবমূর্তি বেড়ে যায়। তাই জাতীয় জীবনে প্রত্যেক মানুষকে লোভ-লালসা ও ভোগ-বিলাসিতার মাধ্যমে নয়, বরং ন্যায়নিষ্ঠা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা খুবই প্রয়োজন। চাকরি, ব্যবসা বা কর্মক্ষেত্রে কাজের জন্য কোনো একজনের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। দেশের জনগণ প্রশাসনে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের ওপর যে গুরুদায়িত্ব ও কর্তব্য অর্পণ করেছে, তা যথাযথভাবে পালন করা সবার অবশ্যকর্তব্য। দায়বদ্ধতা বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটি অনন্য কৌশল জবাবদিহি। দক্ষ ও উন্নত নৈতিকতাসম্পন্ন প্রশাসনের জন্য জবাবদিহির বিকল্প নেই। একজন সফল আদর্শ নেতা ও জাতি গঠনকারী হিসেবে সরকারের দায়িত্ব ও জবাবদিহি সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘যাকে আল্লাহ তাআলা প্রজা সাধারণের ওপর শাসক বানিয়েছেন, সে যদি তাদের পূর্ণভাবে কল্যাণ কামনা না করে, তবে সে জান্নাতের সুবাসও পাবে না।’ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে দুর্নীতি প্রতিরোধে জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আচরণ ও শৃঙ্খলাবিধির প্রয়োগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণের আবশ্যকতা রয়েছে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.