অসময়েই চলে গেলেন কিংবদন্তি মূসা by ড. এম. আনিছুর রহমান
সত্যনিষ্ঠ ও সাহসী সাংবাদিকতার পথিকৃত এবিএম মূসা (৮৩) ওরফে মূসা ভাই আমাদের রেখে আজ চলে গেলেন এক অজানার দেশে (ইন্না লিল্লাহে ..........ইলাইহে রাজিউন)। গত মঙ্গলবার চিকিৎসকদের 'হিজ কন্ডিশন ইজ ভেরি ক্রিটিক্যাল' বক্তব্যেই অনেকটা আঁচ করতে পারছিলাম, তিনি ওই অজানার দেশের পথিক হয়ে গেছেন। এরপরও আশা করেছিলাম মূসা ভাই আবারও আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন, ভাঙ্গা গলায় টেলিভিশনের পর্দায় সত্য তীক্ষ্ণ কথাগুলো বলবেন। কিন্তু সেটা আর হলো না।
বলা যায়, জাতির বড় অসময়েই চলে গেলেন এই বরেণ্য সাংবাদিক। আমরা হারালাম জাতির এক মহান বিবেককে। আর সব দলমতের সাংবাদিক সমাজ হারালো তাদের অভিভাবককে। ফলে কিংবদন্তি সাংবাদিককে হারিয়ে গোটা জাতি আজ শোকাহত।
এবিএম মূসা সবচেয়ে বেশি অসাধারণ ছিলেন তার সততায়। পেশাদার সাংবাদিক হলেও কখনোই তিনি পেশাদারিত্বের অযুহাতে নিজের আদর্শ ও নৈতিকতা থেকে বিচ্যুত হননি। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অবিচল থাকার কথা অকপটেই স্বীকার করে গেছেন। এরপরও তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের কঠোর সমালোচক ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে সরকারের কঠোর সমালোচনা করায় শাসক দলের নেতানেত্রীরা তাকে স্বাধীনতা বিরোধী বলেও আখ্যায়িত করেন। এ জন্য আওয়ামী লীগের অনেক নেতার, এমন কী খোদ বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকেও কটু কথা শুনতে হয়েছে তাকে।
বাংলাদেশের কিছু সম্পাদক-সাংবাদিক নিজেদের আদর্শিক অসততা স্খলনের জন্য বলেন, পেশাদারিত্বের কারণে তিনি নিজে যা বিশ্বাস করেন না, সেটা লিখতে বা বলতে বাধ্য হয়েছেন। এবিএম মূসা এই আচরণের বিরোধী ছিলেন। তিনি নিজে যা বিশ্বাস করতেন সেটা তিনি গোপন করতেন না। নির্দ্বিধায় বলতেন ও লিখতেন।
জাতির সঙ্কটময় মুহূর্তে যে গুটিকয়েক ব্যক্তি সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। ১১ জানুয়ারি ২০০৭ বা ওয়ান-ইলেভেনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অসাংবিধানিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। তিনি মনে প্রাণে সামরিক শাসনের ঘোর বিরোধী ছিলেন। প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে সামরিক শাসকদের সহযোগিতাকারী তথাকথিত মাইনাস টু ফর্মুলার উদগাতা ও সমর্থক সম্পাদক-সাংবাদিকদের সঙ্গে এবিএম মূসার বড় পার্থক্যটা ছিল এখানেই। সেই সময়ে সেনাবাহিনীর বন্দুকের নলের ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে প্রতিনিয়ত টেলিভিশনের টকশোতে যেতেন এবং গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলতেন।
এভাবে মূসা ভাই অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত রাতের পর রাত জেগে বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশনের টকশো ও সংবাদ বিশ্লেষণ অনুষ্ঠানে গিয়ে একজন নির্ভিক দেশপ্রেমিক হিসেবে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে কথা বলে গেছেন।
বলা যায়, এখনো বাংলাদেশে যেটুকু গণতন্ত্রের নামগন্ধ টিকে আছে তার পেছনে এবিএম মূসার কর্মতৎপরতার সাহসী অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
তাঁর জীবদ্দশায় সরকারের ত্রুটি বিচ্যুতি হলে তা ধরিয়ে দিতেন বরেণ্য সাংবাদিক এবিএম মূসা। কোনো ভুল হলে নিজ দৃষ্টিভঙ্গী থেকে তার সমালোচনা করতেন। সংশোধনের পথও দেখানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সরকার সেটা কীভাবে নিতো সেদিকে তাঁর কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না। অবিরাম তিনি গণমানুষের পক্ষেই কথা বলে যেতেন।
ল্যাবএইড হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. বরেণ চক্রবর্তীর ভাষ্যমতে, এবিএম মূসা দীর্ঘদিন থেকেই অসুস্থ ছিলেন। সোমবার মধ্যরাত থেকে তাকে ডেঞ্জার পয়েন্টে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়।
এ চিকিৎসক আরও জানান, বছর দুয়েক আগেও তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার প্রয়োজন পড়েছিল। কিন্তু সে অবস্থা থেকে তাকে ফেরানো সম্ভব হয়েছিল। এবারের অবস্থাটা আগের মতো ছিল না। আরও একটু জটিল। সোমবার রাত আড়াইটার দিকে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয় এবিএম মূসাকে। কোনোভাবেই তার শরীরে রক্ত স্বাভাবিক কাজ করছিল না। বারবার রক্ত দিলেও তার দেহে রক্তকণিকা ভেঙে যাচ্ছিল।এ রোগের নাম মাইলো ডিসপ্লাস্টিক সিনড্রোম- যা ব্লাড ক্যান্সারের মতোই।
ল্যাবএইড হাসপাতালে সিসিইউতে সার্বক্ষণিকভাবে এবিএম মূসার তদারককারী অপর কনসালট্যান্ট হাবিবুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, এবিএম মূসার হার্টের পাম্পিং মঙ্গলবার পর্যন্ত মাত্র ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। ৬০ শতাংশ হলে আশঙ্কা কম থাকতো।এরপরও পাম্পিং থেমে থেমে হচ্ছিল। কিডনিও ড্যামেজ ছিল। ফুসফুসেও জীবাণু সংক্রমণ (ইনফেকশন) ছিল।
চিকিৎসক হাবিবুর সাংবাদিকদের আরও জানান, এর আগে মূসার হার্টে বাইপাস হয় এবং পেসমেকারও বসানোর প্রয়োজন পড়ে। সব মিলিয়ে জটিলতা বেড়ে গিয়েছিল। তিনি অনেকটা মনের জোরে চলছিলেন। তবে চলমান এই সিনড্রোমের কারণে গত ছয় মাস ধরে মূসার অবস্থার অবনতি হতেই থাকে।
এবিএম মূসার ছেলে ডা. নাসিম মূসা জানান, জানুয়ারি থেকেই তার বাবার শরীরটা খারাপ হতে শুরু করে। গত শনিবার তার ফুসফুস ও হার্টে ত্রুটি দেখা দেয়। পরে সোমবার রাতে অবস্থা বেশি খারাপ হওয়ায় ল্যাবএইডে ভর্তি করা হয়। এবিএম মূসার মেয়ে পারভীন সুলতানা ঝুমা জানান, তার মাও (মূসার স্ত্রী সেতারা মূসা) শারীরিকভাবে খুবই অসুস্থ। তিনি প্যারালাইজড হয়ে আছেন।
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এবিএম মূসা
বর্ষীয়ান সাংবাদিক এবিএম মূসা ১৯৩১ সালে ফেনী জেলার ধর্মপুর গ্রামে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দীর্ঘ ৬৪ বছর ধরে সাংবাদিকতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। ১৯৫০ সালে দৈনিক ইনসাফ দিয়ে তার সাংবাদিকতা শুরু। ওই বছর তিনি ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভারে যোগ দেন। পাকিস্তান অবজারভারে রিপোর্টার, স্পোর্টস রিপোর্টার, বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার অবজারভার বন্ধ করে দিলে তিনি সংবাদ-এ যোগ দেন। ১৯৫৪ সালে তিনি অবজারভারে ফিরে আসেন। '৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিবিসি, সানডে টাইমস প্রভৃতি পত্রিকার সংবাদদাতা হিসেবে রণাঙ্গন থেকে সংবাদ পাঠাতেন।
বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবিএম মূসা। তিনি ১৯৮১ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক এবং ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার মহাব্যবস্থাপক ও প্রধান সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৪ সালে তিনি দৈনিক যুগান্তর-এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
এবিএম মূসা জাতীয় প্রেসক্লাবে চারবার সভাপতি ও তিনবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এবিএম মূসা একুশে পদক ও দেশি-বিদেশি নানা পুরস্কারে ভূষিত।
তাঁর অনন্য কর্ম ও সত্যনিষ্ঠ লেখনী-ভাষ্য দলমত নির্বিশেষে সবার হৃদয়ে স্থান করে গেছেন। দেশের আপদকালীন সময়ে তাঁর সত্যনিষ্ঠ বক্তব্য ও ভুমিকা সবার কাছে প্রসংশনীয়। তিনি 'মুজিব ভাই' বলে একটি বইও রচনা করেন। দেশ ও জাতির গর্ব বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অধিকারী এবিএম মূসার চিকিৎসার বিষয়ে আমরা কী দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পেরেছি? আমাদের দেশের সরকার কী তাঁর কর্মের প্রতি ন্যুনতম সৌজন্যবোধ দেখাতে পেরেছে? এবিএম মূসা ভাই'র বিভিন্ন সময়ের সত্যনিষ্ঠ বক্তব্য-ভাষ্যে অসন্তুষ্ট হয়ে থাকলেও দেশ-জাতির স্বার্থের কথা বিচেনায় নিয়ে সব কিছু ভুলে গিয়ে আমাদের উচিত ছিল তাঁর উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করা। কিন্তু সংকীর্ণতার কারণে আমরা সেটা করতে পারিনি। এ জন্য ব্যক্তিগতভাবে আমি মরহুম মূসা ভাইয়ের পরিবারের কাছে লজ্জিত। মরহুম এবিএম মূসা ভাইয়ের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। আল্লাহ পাক তাঁকে সর্বোচ্চ পুরুস্কার দান করুন। সেই সঙ্গে মরহুমের শোক-সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের সহমর্মিতা প্রকাশ করছি- আল্লাহ পাক তাদের এই শোক সইবার শক্তি দান করুন। সবশেষে মরহুম এবিএম মূসার অসুস্থ স্ত্রীর আশু রোগ মুক্তি কামনা করছি।
মূসা ভাই আমাদের মাফ করবেন। আমরা অকৃতজ্ঞ জাতি। আমরা আপনার কর্মের যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারিনি। আপনার কর্মের ঋণ কোন দিনও শোধ করবার নয়।
ড. এম. আনিছুর রহমান: গবেষক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, sarderanis@gmail.com
বলা যায়, জাতির বড় অসময়েই চলে গেলেন এই বরেণ্য সাংবাদিক। আমরা হারালাম জাতির এক মহান বিবেককে। আর সব দলমতের সাংবাদিক সমাজ হারালো তাদের অভিভাবককে। ফলে কিংবদন্তি সাংবাদিককে হারিয়ে গোটা জাতি আজ শোকাহত।
এবিএম মূসা সবচেয়ে বেশি অসাধারণ ছিলেন তার সততায়। পেশাদার সাংবাদিক হলেও কখনোই তিনি পেশাদারিত্বের অযুহাতে নিজের আদর্শ ও নৈতিকতা থেকে বিচ্যুত হননি। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অবিচল থাকার কথা অকপটেই স্বীকার করে গেছেন। এরপরও তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের কঠোর সমালোচক ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে সরকারের কঠোর সমালোচনা করায় শাসক দলের নেতানেত্রীরা তাকে স্বাধীনতা বিরোধী বলেও আখ্যায়িত করেন। এ জন্য আওয়ামী লীগের অনেক নেতার, এমন কী খোদ বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকেও কটু কথা শুনতে হয়েছে তাকে।
বাংলাদেশের কিছু সম্পাদক-সাংবাদিক নিজেদের আদর্শিক অসততা স্খলনের জন্য বলেন, পেশাদারিত্বের কারণে তিনি নিজে যা বিশ্বাস করেন না, সেটা লিখতে বা বলতে বাধ্য হয়েছেন। এবিএম মূসা এই আচরণের বিরোধী ছিলেন। তিনি নিজে যা বিশ্বাস করতেন সেটা তিনি গোপন করতেন না। নির্দ্বিধায় বলতেন ও লিখতেন।
জাতির সঙ্কটময় মুহূর্তে যে গুটিকয়েক ব্যক্তি সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। ১১ জানুয়ারি ২০০৭ বা ওয়ান-ইলেভেনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অসাংবিধানিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। তিনি মনে প্রাণে সামরিক শাসনের ঘোর বিরোধী ছিলেন। প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে সামরিক শাসকদের সহযোগিতাকারী তথাকথিত মাইনাস টু ফর্মুলার উদগাতা ও সমর্থক সম্পাদক-সাংবাদিকদের সঙ্গে এবিএম মূসার বড় পার্থক্যটা ছিল এখানেই। সেই সময়ে সেনাবাহিনীর বন্দুকের নলের ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে প্রতিনিয়ত টেলিভিশনের টকশোতে যেতেন এবং গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলতেন।
এভাবে মূসা ভাই অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত রাতের পর রাত জেগে বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশনের টকশো ও সংবাদ বিশ্লেষণ অনুষ্ঠানে গিয়ে একজন নির্ভিক দেশপ্রেমিক হিসেবে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে কথা বলে গেছেন।
বলা যায়, এখনো বাংলাদেশে যেটুকু গণতন্ত্রের নামগন্ধ টিকে আছে তার পেছনে এবিএম মূসার কর্মতৎপরতার সাহসী অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
তাঁর জীবদ্দশায় সরকারের ত্রুটি বিচ্যুতি হলে তা ধরিয়ে দিতেন বরেণ্য সাংবাদিক এবিএম মূসা। কোনো ভুল হলে নিজ দৃষ্টিভঙ্গী থেকে তার সমালোচনা করতেন। সংশোধনের পথও দেখানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সরকার সেটা কীভাবে নিতো সেদিকে তাঁর কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না। অবিরাম তিনি গণমানুষের পক্ষেই কথা বলে যেতেন।
ল্যাবএইড হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. বরেণ চক্রবর্তীর ভাষ্যমতে, এবিএম মূসা দীর্ঘদিন থেকেই অসুস্থ ছিলেন। সোমবার মধ্যরাত থেকে তাকে ডেঞ্জার পয়েন্টে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়।
এ চিকিৎসক আরও জানান, বছর দুয়েক আগেও তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার প্রয়োজন পড়েছিল। কিন্তু সে অবস্থা থেকে তাকে ফেরানো সম্ভব হয়েছিল। এবারের অবস্থাটা আগের মতো ছিল না। আরও একটু জটিল। সোমবার রাত আড়াইটার দিকে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয় এবিএম মূসাকে। কোনোভাবেই তার শরীরে রক্ত স্বাভাবিক কাজ করছিল না। বারবার রক্ত দিলেও তার দেহে রক্তকণিকা ভেঙে যাচ্ছিল।এ রোগের নাম মাইলো ডিসপ্লাস্টিক সিনড্রোম- যা ব্লাড ক্যান্সারের মতোই।
ল্যাবএইড হাসপাতালে সিসিইউতে সার্বক্ষণিকভাবে এবিএম মূসার তদারককারী অপর কনসালট্যান্ট হাবিবুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, এবিএম মূসার হার্টের পাম্পিং মঙ্গলবার পর্যন্ত মাত্র ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। ৬০ শতাংশ হলে আশঙ্কা কম থাকতো।এরপরও পাম্পিং থেমে থেমে হচ্ছিল। কিডনিও ড্যামেজ ছিল। ফুসফুসেও জীবাণু সংক্রমণ (ইনফেকশন) ছিল।
চিকিৎসক হাবিবুর সাংবাদিকদের আরও জানান, এর আগে মূসার হার্টে বাইপাস হয় এবং পেসমেকারও বসানোর প্রয়োজন পড়ে। সব মিলিয়ে জটিলতা বেড়ে গিয়েছিল। তিনি অনেকটা মনের জোরে চলছিলেন। তবে চলমান এই সিনড্রোমের কারণে গত ছয় মাস ধরে মূসার অবস্থার অবনতি হতেই থাকে।
এবিএম মূসার ছেলে ডা. নাসিম মূসা জানান, জানুয়ারি থেকেই তার বাবার শরীরটা খারাপ হতে শুরু করে। গত শনিবার তার ফুসফুস ও হার্টে ত্রুটি দেখা দেয়। পরে সোমবার রাতে অবস্থা বেশি খারাপ হওয়ায় ল্যাবএইডে ভর্তি করা হয়। এবিএম মূসার মেয়ে পারভীন সুলতানা ঝুমা জানান, তার মাও (মূসার স্ত্রী সেতারা মূসা) শারীরিকভাবে খুবই অসুস্থ। তিনি প্যারালাইজড হয়ে আছেন।
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এবিএম মূসা
বর্ষীয়ান সাংবাদিক এবিএম মূসা ১৯৩১ সালে ফেনী জেলার ধর্মপুর গ্রামে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দীর্ঘ ৬৪ বছর ধরে সাংবাদিকতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। ১৯৫০ সালে দৈনিক ইনসাফ দিয়ে তার সাংবাদিকতা শুরু। ওই বছর তিনি ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভারে যোগ দেন। পাকিস্তান অবজারভারে রিপোর্টার, স্পোর্টস রিপোর্টার, বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার অবজারভার বন্ধ করে দিলে তিনি সংবাদ-এ যোগ দেন। ১৯৫৪ সালে তিনি অবজারভারে ফিরে আসেন। '৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিবিসি, সানডে টাইমস প্রভৃতি পত্রিকার সংবাদদাতা হিসেবে রণাঙ্গন থেকে সংবাদ পাঠাতেন।
বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবিএম মূসা। তিনি ১৯৮১ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক এবং ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার মহাব্যবস্থাপক ও প্রধান সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৪ সালে তিনি দৈনিক যুগান্তর-এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
এবিএম মূসা জাতীয় প্রেসক্লাবে চারবার সভাপতি ও তিনবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এবিএম মূসা একুশে পদক ও দেশি-বিদেশি নানা পুরস্কারে ভূষিত।
তাঁর অনন্য কর্ম ও সত্যনিষ্ঠ লেখনী-ভাষ্য দলমত নির্বিশেষে সবার হৃদয়ে স্থান করে গেছেন। দেশের আপদকালীন সময়ে তাঁর সত্যনিষ্ঠ বক্তব্য ও ভুমিকা সবার কাছে প্রসংশনীয়। তিনি 'মুজিব ভাই' বলে একটি বইও রচনা করেন। দেশ ও জাতির গর্ব বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অধিকারী এবিএম মূসার চিকিৎসার বিষয়ে আমরা কী দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পেরেছি? আমাদের দেশের সরকার কী তাঁর কর্মের প্রতি ন্যুনতম সৌজন্যবোধ দেখাতে পেরেছে? এবিএম মূসা ভাই'র বিভিন্ন সময়ের সত্যনিষ্ঠ বক্তব্য-ভাষ্যে অসন্তুষ্ট হয়ে থাকলেও দেশ-জাতির স্বার্থের কথা বিচেনায় নিয়ে সব কিছু ভুলে গিয়ে আমাদের উচিত ছিল তাঁর উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করা। কিন্তু সংকীর্ণতার কারণে আমরা সেটা করতে পারিনি। এ জন্য ব্যক্তিগতভাবে আমি মরহুম মূসা ভাইয়ের পরিবারের কাছে লজ্জিত। মরহুম এবিএম মূসা ভাইয়ের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। আল্লাহ পাক তাঁকে সর্বোচ্চ পুরুস্কার দান করুন। সেই সঙ্গে মরহুমের শোক-সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের সহমর্মিতা প্রকাশ করছি- আল্লাহ পাক তাদের এই শোক সইবার শক্তি দান করুন। সবশেষে মরহুম এবিএম মূসার অসুস্থ স্ত্রীর আশু রোগ মুক্তি কামনা করছি।
মূসা ভাই আমাদের মাফ করবেন। আমরা অকৃতজ্ঞ জাতি। আমরা আপনার কর্মের যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারিনি। আপনার কর্মের ঋণ কোন দিনও শোধ করবার নয়।
ড. এম. আনিছুর রহমান: গবেষক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, sarderanis@gmail.com
No comments