প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ছাত্র-জনতার অদম্য সংকল্প ও প্রত্যয় স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি দিয়েছে। তাদের সম্মিলিত সংকল্পের মধ্যেই আমাদের দেশের ভবিষ্যত নিহিত, যা এ দেশটিকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের মাঝে একটি দায়িত্বশীল জাতির মর্যাদায় উন্নীত করবে। স্থানীয় সময় শুক্রবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দেয়া ভাষণে এসব কথা বলেন তিনি। ড. ইউনূস বলেন, এই জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে, তার প্রেক্ষিতেই আজ আমি বিশ্বসম্প্রদায়ের এ মহান সংসদে উপস্থিত হতে পেরেছি। আমাদের গণমানুষের, বিশেষ করে তরুণসমাজের, অফুরান শক্তি আমাদের বিদ্যমান রাষ্ট্র কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল রূপান্তরের এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। আমাদের ছাত্র ও যুবসমাজের আন্দোলন প্রথমদিকে মূলত ছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। পর্যায়ক্রমে তা গণআন্দোলনে রূপ নেয়। এরপর সারা পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে দেখেছে কীভাবে সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ একনায়কতন্ত্র, নিপীড়ন, বৈষম্য, অবিচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজপথ এবং সামাজিক-যোগাযোগ মাধ্যমে দৃঢ়ভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিল। তিনি বলেন, উদারনীতি, বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর মানুষের গভীর বিশ্বাস থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়। ১৯৭১ সালে যে মূল্যবোধকে বুকে ধারণ করে আমাদের গণমানুষ যুদ্ধ করেছিল, সেই মূল্যবোধকে বহু বছর পরে আমাদের ‘জেনারেশন জি’ নতুনভাবে দেখতে শিখিয়েছে। বাংলাদেশের এই ‘মুনসুন অভ্যুত্থান’ আগামীতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষকে মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়াতে প্রেরণা জোগাবে। অধিবেশনে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দেয়া বক্তব্যে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার ত্যাগের কথা তুলে ধরার পাশাপাশি মুক্তি ও গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে বিশ্বসম্প্রদায়কে নতুন বাংলাদেশের সঙ্গে নতুনভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানান। পতিত শেখ হাসিনা সরকার রাষ্ট্রের মূল প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্মম দলীয়করণের আবর্তে বন্দি করেছেন উল্লেখ করে অতীতের ভুল সংশোধন করে প্রতিযোগিতামূলক ও শক্তিশালী অর্থনীতি এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলাই তার সরকারের মূল লক্ষ্য বলে জানান। বলেন, আমরা মানুষের মৌলিক অধিকারকে সমুন্নত ও সুরক্ষিত রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। রাষ্ট্রব্যবস্থার সকল পর্যায়ে সুশাসন ফিরিয়ে আনাই আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য। টেকসই সংস্কারের মাধ্যমে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাজ করে যাচ্ছে। এ সময় রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধে নিয়েও কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, রাজনৈতিক মুক্তি এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক জাগরণ ব্যতীত শান্তি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতে সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়। বক্তব্যের শুরুতে ড. ইউনূস অধিবেশনের সভাপতিকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের পাশাপাশি জাতিসংঘের ম্যান্ডেটকে সমুন্নত রাখা এবং বৈশ্বিক সংকটসমূহ নিরসনে মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরাঁর দৃঢ়প্রত্যয় ও সাফল্যমণ্ডিত নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। সম্মেলনে যে ‘ভবিষ্যতের জন্য চুক্তি’ এবং ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ঘোষণাপত্র’ সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে তা এজেন্ডা ২০৩০ পরবর্তী বৈশ্বিক উন্নয়ন কর্মপন্থা নির্ধারণে বিশেষ সহায়ক হবে বলে তিনি মনে করেন। জুলাই-আগস্টের আন্দোলন নিয়ে প্রফেসর ইউনূস বলেন, এই গণআন্দোলন রাজনৈতিক অধিকার ও উন্নয়নের সুবিধাবঞ্চিত বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। বাংলাদেশের মানুষ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশীদারিত্ব চেয়েছিল। আমাদের জনগণ একটি ন্যায্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে, যার জন্য আমাদের নতুন প্রজন্ম জীবন উৎসর্গ করেছিল। আমাদের এই তরুণরা যে প্রজ্ঞা, সাহস ও প্রত্যয় দেখিয়েছে তা আমাদের অভিভূত করেছে। জনগণের এই আন্দোলনে আমাদের জানা মতে, প্রায় আটশত-এরও বেশি জীবন আমরা হারিয়েছি স্বৈরাচারী শক্তির হাতে। এ সময় বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে বিশ্বসম্প্রদায়কে নতুন বাংলাদেশের সঙ্গে নতুনভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা। বলেন, যে রাষ্ট্রকাঠামো দুঃসহ হয়ে গেছে, তার পুনর্গঠনের জন্য আমাদের তরুণেরা এবং দেশের আপামর জনসাধারণ একমত হয়ে আমার এবং আমার উপদেষ্টা পরিষদের ওপর আস্থা রেখে সরকার পরিচালনার এক মহান দায়িত্ব অর্পণ করেছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর আমরা গভীর বিস্ময় ও হতাশার সঙ্গে দেখতে পাচ্ছি কীভাবে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে, কীভাবে রাষ্ট্রের মূল প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্মম দলীয়করণের আবর্তে বন্দি করে রাখা হয়েছিল, কীভাবে জনগণের অর্থসম্পদকে নিদারুণভাবে লুটপাট করা হয়েছিল, কীভাবে একটি বিশেষ স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সমস্ত ব্যবসা-বাণিজ্যকে অন্যায়ভাবে নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করে দেশের সম্পদ অবাধে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। এককথায়, কীভাবে প্রত্যেকটি পর্যায়ে ন্যায়, নীতি ও নৈতিকতা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। এরকমই এক অবস্থায় দেশকে পুনর্গঠন এবং জনগণের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আমাদের ওপর দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। অতীতের ভুলগুলোকে সংশোধন করে একটি প্রতিযোগিতামূলক ও শক্তিশালী অর্থনীতি এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলাই এই মুহূর্তে আমাদের মূল লক্ষ্য। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, সকল রাজনৈতিক দল এখন স্বাধীনভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারছে। যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় কাজ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত, তাদের প্রত্যেকের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাই আমাদের অগ্রাধিকার। আমরা মানুষের মৌলিক অধিকারকে সমুন্নত ও সুরক্ষিত রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমাদের দেশের মানুষ মুক্তভাবে কথা বলবে, ভয়ভীতি ছাড়া সমাবেশ করবে, তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে এটাই আমাদের লক্ষ্য। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণ এবং সাইবার ডোমেনসহ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সুসংহতকরণেও আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমাদের একজন কৃষক বা শ্রমিকের সন্তানও যেন সমাজের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছতে পারে, সেই লক্ষ্যে বিশালাকার অবকাঠামো নির্মাণের বদলে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির ওপর আমরা গুরুত্ব আরোপ করছি। রাষ্ট্রব্যবস্থার সকল পর্যায়ে সুশাসন ফিরিয়ে আনাই আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য। বাংলাদেশ যেসব আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক এবং দ্বিপক্ষীয় চুক্তির পক্ষভুক্ত, সেগুলো প্রতিপালনে আমাদের সরকার বদ্ধপরিকর। জাতিসংঘসহ বহুপক্ষীয় বিশ্বকাঠামোতে বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও অবদান অব্যাহত থাকবে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, মর্যাদা ও স্বার্থ সংরক্ষণের ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী। মাত্র সাত সপ্তাহের মধ্যে আমাদের সরকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আমাদের অনুরোধে সাড়া দিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার বাংলাদেশের গণআন্দোলনকালে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে বিস্তৃত অনুসন্ধান এবং এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে পরামর্শ প্রদানের জন্য একটি ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন গঠন এবং তার কাজ শুরু করার জন্য দ্রুত বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। দায়িত্বভার গ্রহণের দুই সপ্তাহের মধ্যে আমরা গুম প্রতিরোধে যে আন্তর্জাতিক কনভেনশন রয়েছে, তাতে যোগদান করেছি। তিনি বলেন, মানুষের আস্থা ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে এবং নির্মম অতীত যেন আর ফিরে না আসে, সেজন্য আমরা কিছু সুনির্দিষ্ট খাতে সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। সেই লক্ষ্যে আমরা বিদ্যমান নির্বাচনব্যবস্থা, সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা সংস্কারে স্বাধীন কমিশন গঠন করেছি। সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের সংস্কারের জন্যও পৃথক কমিশনসহ আরও কয়েকটি বিষয়ে কমিশন গঠন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে আমরা ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। কোনো বিদেশি ব্যবসা বা বিনিয়োগ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তা নিশ্চিত করতেও আমরা বদ্ধপরিকর। এসব সংস্কার যেন টেকসই হয়, তা দীর্ঘমেয়াদে নিশ্চিত করতে এবং অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সমতা ও সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক সমাজ হিসেবে আত্মপ্রকাশের অভিপ্রায় বাস্তবায়নে আমি বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতা ব্যাপকতর ও গভীরতর করার আহ্বান জানাই। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ মনে করে যে, শান্তিরক্ষা এবং সংঘাত মোকাবিলা জনগণের সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার মূল চালিকাশক্তি। সাম্প্রতিক বিপ্লবকালে আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিনতম সময়ে জনগণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা পূরণে তাদের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আমাদের সাহসী সশস্ত্র বাহিনীসমূহ আরও একবার শান্তির প্রতি তাদের অঙ্গীকার প্রমাণ করেছে। এটা সম্ভব হয়েছে শান্তিরক্ষায় আমাদের অঙ্গীকারের কেন্দ্রবিন্দুতে মানবাধিকারকে স্থান দেয়ার ফলে। জাতিসংঘের শান্তি বিনির্মাণ কমিশনের সূচনালগ্ন থেকেই শান্তিরক্ষার মতো শান্তি বিনির্মাণেও বাংলাদেশ সমান অঙ্গীকার ব্যক্ত করে এসেছে। সামনের দিনগুলোতেও আমরা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে আমাদের মূল্যবোধভিত্তিক অবদানের ধারাবাহিকতা রক্ষা সমুন্নত ও প্রসারিত করতে বদ্ধপরিকর। জাতিসংঘে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অবদানকারী চতুর্থ বৃহত্তম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ৪৩টি দেশে ৬৩টি মিশনে শান্তিরক্ষী প্রেরণ করেছে। দায়িত্ব পালনকালে ১৬৮ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। আমাদের সকলের এই পৃথিবীতে বৈশ্বিক অগ্রাধিকারগুলোকে সঠিকভাবে নির্ণয় করতে হবে। তিনি বলেন, জলবায়ু-পরিবর্তনজনিত দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবগুলো অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমরা জীববৈচিত্র্য হারাচ্ছি, প্যাথোজেনের পরিবর্তনের ফলে নতুন রোগ বাড়ছে, কৃষি ক্ষেত্রে চাপ বাড়ছে, ক্রমহ্রাসমান পানিসম্পদ ঝুঁকিতে ফেলছে আমাদের বাসযোগ্যতাকে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং লবণাক্ততা আমাদের বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করছে প্রতিনিয়ত। ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ও মাত্রা বৃদ্ধির কারণে যে ক্ষতি হচ্ছে, তাকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। ক্ষুদ্র কৃষক এবং প্রান্তিক পর্যায়ে জীবিকা অন্বেষণকারীরা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। আমি আজ যখন এই বিশ্বসভায় কথা বলছি, তখন বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে পঞ্চাশ লাখেরও অধিক মানুষ তাদের জীবদ্দশায় হওয়া সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা মোকাবিলা করছে। মহাসচিব গুতেরাঁ আমাদের দেখিয়েছেন যে, বিদ্যমান পরিক্রমা অব্যাহত থাকলে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ২.৭ (দুই দশমিক সাত) ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাই, বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোতে অভিযোজনের জন্য ব্যাপক বিনিয়োগের আহ্বান জানাচ্ছি। এ ছাড়াও, উদ্ভাবনী শক্তির প্রয়োগ ও অতিরিক্ত অর্থায়নের মাধ্যমে লস অ্যান্ড ডেমেজ ফান্ডকে কার্যকর করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, আমাদের প্রয়োজন প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি। জলবায়ু সংকটের মোকাবিলা এবং বৈশ্বিক অর্থনীতি সুসংহতকরণে আমাদের যুগপৎভাবে কাজ করতে হবে। বিশ্বসম্প্রদায় এখন কার্বনমুক্ত পৃথিবী গড়ে তুলতে মনোযোগী হচ্ছে। বিশ্বের অধিকাংশ মানুষকে এ ধরনের পরিবর্তনের সুফলভোগী করতে হলে, নেট-জিরো পৃথিবীর লক্ষ্য সমানভাবে পূরণে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে সঙ্গে নিতে হবে। তা না হলে, ‘পারস্পরিক দায়িত্ববোধের’ মাধ্যমে ‘পারস্পরিক সমৃদ্ধি’ অর্জনে আমাদের সর্বজনীন অঙ্গীকার পূরণে আমরা পিছিয়ে পড়বো। ড. ইউনূস বলেন, আমি বিশ্বাস করি যে, সমগ্র বিশ্ব একসঙ্গে ‘তিন-শূন্য’-এর ধারণা বিবেচনা করতে পারে, যার মাধ্যমে আমরা শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ অর্জন করতে পারি। প্রয়োজন উন্নত ও উন্নয়নশীল সকল দেশসমূহ ও বিভিন্ন অংশীদারদের মধ্যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন মূল্যবোধ এবং নতুন একতা। সামগ্রিকভাবে, এই লক্ষ্য অর্জনে জাতিসংঘ ব্যবস্থা, জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে সরকারসমূহ, সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি অংশীজন (এনজিওসমূহ) এবং দাতব্য সংস্থাগুলোকে কাজ করতে হবে একসঙ্গে। তিনি বলেন, বহুমুখী সংকটে জর্জরিত বর্তমান বিশ্বে, যুদ্ধ এবং সংঘাতের ফলে ব্যাপকভিত্তিতে মানুষের অধিকার খর্ব হচ্ছে। বিশ্ববাসীর উদ্বেগ এবং নিন্দা সত্ত্বেও গাজায় গণহত্যা থামছে না। ফিলিস্তিনের বিদ্যমান বাস্তবতা কেবল আরব কিংবা মুসলমানদের জন্যই উদ্বেগজনক নয়, বরং তা সমগ্র মানবজাতির জন্যই উদ্বেগের। একজন মানুষ হিসেবে প্রত্যেক ফিলিস্তিনির জীবন অমূল্য। ফিলিস্তিনের জনগণের বিরুদ্ধে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ হচ্ছে, তার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে দায়বদ্ধ করতে হবে। ফিলিস্তিনের জনগণের ওপর চলমান নৃশংসতা, বিশেষত নারী এবং শিশুদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যে নিষ্ঠুরতা বিশ্ব দেখছে, তা থেকে নিস্তারের জন্য বাংলাদেশ অনতিবিলম্বে সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছে। দ্বি-রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধানই মধ্যপ্রাচ্যে টেকসই শান্তি আনতে পারবে, তাই জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সকলকে এর বাস্তবায়নের জন্য এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। আড়াই বছর ধরে ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এই যুদ্ধের প্রভাব সর্বব্যাপী। এমনকি বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও এর প্রভাব অনুভূত হচ্ছে। আমরা তাই উভয়পক্ষকেই সংলাপে বসে বিরোধ নিরসনের মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান ঘটানোর আহ্বান জানাচ্ছি। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ গত সাত বছরে মিয়ানমার হতে আগত ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়ে আসছে। এর ফলে, আমরা বিশাল সামাজিক-অর্থনৈতিক-পরিবেশগত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে সৃষ্ট এই সংকট বাংলাদেশ ও আমাদের অঞ্চলের জন্য প্রথাগত ও অপ্রথাগত উভয় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের সহায়তা করতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা কার্যক্রম চালু রাখা এবং তাদের টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের পর্যাপ্ত সহায়তা অব্যাহত চাই। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সংঘটিত হওয়া ব্যাপকভিত্তিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালত এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে চলমান বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল অবস্থা বিবেচনায় রেখে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের সঙ্গে একযোগে রোহিঙ্গারা নিজ দেশে মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য পরিবেশ সৃষ্টিতে কাজ করতে প্রস্তুত। তিনি বলেন, রাজনৈতিক মুক্তি এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক জাগরণ ব্যতীত শান্তি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতে সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়। প্রায় এক দশক পূর্বে, বিশ্ব সম্প্রদায় সর্বসম্মতভাবে এজেন্ডা ২০৩০ প্রণয়ন করে। আমরা সবাই আমাদের সামষ্টিক আকাঙ্ক্ষা ও বিশ্বাস অর্পণ করেছি এই সার্বজনীন টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টগুলো (এসডিজি) অর্জনে। তদুপরি, মাত্র পনেরো শতাংশের কম লক্ষ্যসমূহ অর্জিত হয়েছে। স্পষ্টতই, এক্ষেত্রে অনেক উন্নয়নশীল রাষ্ট্র আরও পিছিয়ে আছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এসডিজি অর্থায়নে বছরে প্রায় ২.৫ থেকে ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান ঘাটতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। উন্নয়নশীল বিশ্বের ঋণের বোঝা, ক্ষয়িষ্ণু আর্থিক সক্ষমতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। ড. ইউনূস বলেন, আমরা যে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত বিশ্বে বসবাস করছি, সেখানে অভিবাসন এবং মানুষের অবাধ প্রবাহ এক অলঙ্ঘনীয় বাস্তবতা। বাংলাদেশি নাগরিকরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হিসেবে যাচ্ছেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এ মুহূর্তে প্রায় দেড় কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি আছেন। সকলের জন্য অভিবাসনের উপযোগিতা নিশ্চিত করতে বিশ্বসমাজকে নিরাপদ, সুশৃঙ্খল, নিয়মিত এবং মর্যাদাপূর্ণ অভিবাসনের পথ সুগম করতে হবে। তিনি বলেন, প্রতি বছর প্রায় পঁচিশ লাখ তরুণ-তরুণী বাংলাদেশের শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশের বিপুল জনশক্তির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই তরুণ। এই জনশক্তিকে বর্তমান ও আগামীর জন্য গড়ে তোলা বাংলাদেশের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। ক্রমপরিবর্তনশীল কর্মজগতে একজন তরুণকে প্রতিনিয়ত নতুন দক্ষতা অর্জন করতে হয়; এবং কর্মপরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেয়া শিখতে হয়। এজন্য বাংলাদেশ যখন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে উন্নীত হচ্ছে, তখন আমরা শিক্ষা এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা লাভের ওপর বিশেষ জোর দিচ্ছি। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভাবনীয় বিকাশ এবং এর বহুমাত্রিক প্রয়োগে বাংলাদেশ বিশেষভাবে আগ্রহী। তরুণ সমাজ এর সম্ভাবনা নিয়ে উচ্ছ্বসিত। একজন বিশ্ব নাগরিক হিসেবে তারাও চায় নতুন পৃথিবীতে নিয়োজিত হতে, কর্মক্ষম হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে। তিনি বলেন, আমাদের আসলে দরকার নতুন ধরনের সহযোগিতা কাঠামো, যেখানে বৈশ্বিক ব্যবসা ও জ্ঞানের অধিকারী গোষ্ঠী মানুষের চাহিদাগুলোকে যথাযথভাবে অনুধাবন করবে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এমন একটি রূপান্তরকারী ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে, যা কর্মসংস্থান, আর্থ-সামাজিক প্রতিকূলতা বা জীবিকার জন্য জুতসই সমাধান নিশ্চিত করবে। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এ অর্থনীতিবিদ বলেন, আমাদের প্রচেষ্টা, সক্ষমতা ও সম্পদ একত্রীকরণের মাধ্যমে সকলের সামর্থ্য, উদ্ভাবনী শক্তি এবং সমৃদ্ধিকে কাজে লাগাতে হবে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং জলবায়ু সহনশীলতা নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত যে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছি, সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে তার মোকাবিলা করতে হবে। বৈশ্বিক দক্ষিণের আওয়াজকে বিশ্বব্যাপী জোরালোভাবে তুলে ধরার জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ। তিনি বলেন, কোভিড অতিমারির অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, জনস্বাস্থ্যে ব্যাপক বিনিয়োগ কতোটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় বৈশ্বিক অতিমারি চুক্তির চলমান আলোচনায় বাংলাদেশ নেতৃত্ব প্রদান করছে। আমরা চাই কার্যকর আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় অর্থায়ন, প্রযুক্তি স্থানান্তর, গবেষণা ও উন্নয়ন, চিকিৎসা পরীক্ষা-ভ্যাক্সিন-থেরাপিউটিক্সের উৎপাদন বহুমুখীকরণে এবং সকল ভ্যাক্সিনকে মেধাস্বস্ত-অধিকার মুক্ত ঘোষণা করার ব্যাপারে ঐকমত্য। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এ বছর আমরা জাতিসংঘের সঙ্গে বাংলাদেশের অংশীদারিত্বের সুবর্ণ জয়ন্তী উদ্যাপন করছি। গত পঞ্চাশ বছর ছিল আমাদের জন্য একটি পারস্পরিক শিক্ষণীয়, সম্মিলিত যাত্রা। সীমিত উপায়ে বাংলাদেশ বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তা, ন্যায়, সমতা, মানবাধিকার, সামাজিক অগ্রগতি ও সমৃদ্ধিতে ধারাবাহিকভাবে অবদান রেখে আসছে। আমাদের সমন্বিত প্রয়াস সত্যিকার অর্থে একটি নিয়মভিত্তিক বৈশ্বিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা। তিনি বলেন, আজ, এই মহান বিশ্বসভায় বিশ্ব নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে, প্রতিধ্বনিত হচ্ছে শান্তি, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে সকলের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার আহ্বান। সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের প্রত্যেককে আজকে গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে কীভাবে আমরা নারী, পুরুষ, সকলের জন্য আজ ও আগামীর দিনগুলোতে উদ্যোক্তা হওয়ার সমান সুযোগ সৃষ্টি এবং তাদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে পারি। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের তরুণরা প্রমাণ করেছে যে, মানুষের স্বাধীনতা, মর্যাদা ও অধিকার সমুন্নত রাখার অভিপ্রায় কোনো উচ্চাভিলাষ নয়। বরং, এটা সকলের নিশ্চিত প্রাপ্য।
বাংলাদেশ পুনর্গঠনে সহায়তা করবে যুক্তরাষ্ট্র, প্রধান উপদেষ্টাকে জানালেন ব্লিনকেন: বাংলাদেশ পুনর্গঠনে সহায়তা করতে ওয়াশিংটন একসঙ্গে কাজ করবে বলে জানিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন। তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গৃহীত সংস্কার কার্যক্রম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়তার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে চুরি হয়ে যাওয়া কোটি কোটি টাকা ফেরত আনার ক্ষেত্রে তারা সহায়তা করবেন। নিউ ইয়র্ক স্থানীয় সময় ২৬শে সেপ্টেম্বর একটি হোটেলে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন বৈঠক করেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা ভালো অংশীদার হতে চাই। আমরা বাংলাদেশের জন্য দ্রুত কাজ করবো। যুক্তরাষ্ট্রের প্রফেসর ইউনূসের প্রতি ‘অপরিসীম’ শ্রদ্ধা রয়েছে। বাংলাদেশের সংকটপূর্ণ সময়ে দায়িত্ব গ্রহণ করায় প্রধান উপদেষ্টার প্রশংসাও করেন তিনি। ড. ইউনূস বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের পুনর্গঠনের দায়িত্ব নিয়েছে এবং তিনি বিশ্বব্যাংকের মতো বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সহায়তা চেয়েছেন।
জাতিসংঘের মহাসচিব ও প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক: জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরাঁ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন প্রকাশ করে বলেছেন, জাতিসংঘ বাংলাদেশের সংস্কারে সহায়তা করতে প্রস্তুত। নিউ ইয়র্ক স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ সদর দপ্তরে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিব এ সমর্থন ব্যক্ত করেন। জাতিসংঘের আবাসিক টিম আপনাকে সহায়তা করতে চায় উল্লেখ করে অ্যান্তোনিও গুতেরাঁ বলেন, সদ্য গৃহীত জাতিসংঘের প্যাক্ট অফ দ্য ফিউচার বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং এর প্রণোদনামূলক অর্থায়ন দেশটির জন্য বিশেষ সহায়ক হবে। গুতেরাঁ বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের প্রশংসা করে বলেন, তারা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রধান উপদেষ্টা জুলাই-আগস্ট মাসের ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের কথা উল্লেখ করে বলেন, এই আন্দোলন শেখ হাসিনার নির্মম স্বৈরাচারের অবসান ঘটায়। তিনি বলেন, আমি এখানে উপস্থিত হতে পেরেছি কারণ তরুণরা নতুন বাংলাদেশের জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে। বৈঠকে জলবায়ু পরিবর্তন এবং বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের ওপর এর প্রভাব, রোহিঙ্গা সংকট এবং জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনের সময় সংঘটিত নৃশংসতার তদন্তে জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন অনুসন্ধান মিশনের বিষয়ে আলোচনা হয়।
আইসিসি’র প্রধান প্রসিকিউটরের সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠক: এদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)’র প্রধান প্রসিকিউটর করিম এ এ খান বৃহস্পতিবার নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন (ইউএনজিএ)’র ফাঁকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। সাক্ষাৎকালে করিম এ এ খান ড. ইউনূসকে ২০১৯ সালে আইসিসি কর্তৃক রোহিঙ্গা নির্যাতন তদন্তের সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত করেন। এ সময় তিনি বলেন, তিনি এ বছরের শেষ নাগাদ বাংলাদেশ সফর করবেন। তিনি রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে নতুন গতি আনতে প্রফেসর ইউনূসের তিন দফা প্রস্তাবের প্রশংসা করেন। বুধবার জাতিসংঘ সদর দপ্তরে এক বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা এই প্রস্তাব দেন। এ সময় সেখানে আইসিসি’র প্রধান প্রসিকিউটরও বক্তব্য রাখেন। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার নিমিত্তে জাতিসংঘ প্রধানের একটি জরুরি সম্মেলন আয়োজন ও করণীয় প্রস্তাব, রোহিঙ্গাদের মানবিক সংকটে নিরসনে যৌথ সহায়তা পরিকল্পনা জোরদার এবং ২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত গণহত্যার বিচার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে আন্তরিক আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা। করিম খান বলেন, এ তিন দফা যথার্থ। ড. ইউনূস করিম খানের কাছে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের সময় গণহত্যার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে আইসিসিতে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা দায়ের করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চান। এ বিপ্লবে কমপক্ষে ৭০০ জন শহীদ হয়েছেন এবং ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। করিম খান বলেন, বাংলাদেশ অবশ্যই হেগ-ভিত্তিক আদালতে অভিযোগ দায়ের করতে পারে। তবে তিনি বলেন, আইসিসিতে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা দায়েরের জন্য যথাযথ নিয়মাবলী অনুসরণ করতে হয়।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ইউএনএইচসিআর ও আইএলও প্রধানের বৈঠক: প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর) এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)’র প্রধানদ্বয় সাক্ষাৎ করেছেন। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর)-এর হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা করেন। গ্র্যান্ডি সংকট মোকাবিলায় একটি নতুন পদ্ধতির আহ্বান জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরে থাকা ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার দুর্দশা অবসানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও বেশি কিছু করা উচিত। তিনি বলেন, ড. ইউনূস বাংলাদেশের নতুন নেতা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করায় রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বিশ্বব্যাপী আগ্রহ বেড়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তায় আরও অর্থায়ন হবে। ‘বিশ্বব্যাংকের ৭০০ মিলিয়ন ডলার একটি ভালো সূচনা বিন্দু’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, জাতিসংঘ রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষার জন্য আরও সহায়তা করতে প্রস্তুত রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা সংকটের দ্রুত সমাধান খুঁজে বের করার এবং বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরে বেড়ে ওঠা লাখ লাখ রোহিঙ্গা শিশুর ভবিষ্যতের জন্য আরও বেশি কিছু করার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, খুব দেরি হওয়ার আগেই আমাদের এর সমাধান করতে হবে। আমাদের একটি সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। আইএলও মহাপরিচালক গিলবার্ট হুংবোও বৃহস্পতিবার একটি হোটেলে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। হুংবো বাংলাদেশে আইএলও কনভেনশন বাস্তবায়নের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপে জাতিসংঘের শ্রম সংস্থার সহায়তার প্রস্তাব দিয়ে বলেন, আমরা আপনার সহায়তায় প্রস্তুত আছি। প্রয়োজন হলে আইএলও আপনার আহ্বানে সাড়া দেবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, শ্রম সংস্কার তার সরকারের একটি শীর্ষ অগ্রাধিকার। কেননা তার সরকার এটিকে বাংলাদেশকে বিশ্বমানের উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত করার মূল বিষয় হিসেবে দেখে। প্রফেসর ইউনূস শ্রম সমস্যা নিরসন বাংলাদেশের জন্য অধিক বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ করে দেবে উল্লেখ করে বলেন, আমরা এ বিষয়ে খুবই আন্তরিক।
No comments