সৌদি জর্দান ও কাতারে নির্যাতিত বাংলাদেশী নারী কর্মীরা
সৌদি
আরব, জর্দান ও কাতারে পাড়ি জমানো নারী শ্রমিকদের মধ্যে অনেকে মালিক ও তার
পরিবারের সদস্যদের হাতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বলে
অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার এসব নারীর মধ্যে অনেকে উপায় না
পেয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। সৌদি আরবে পালানো নারীরা বাংলাদেশ দূতাবাসে আশ্রয়
নিচ্ছেন। অনেকের পরিবারের সদস্যরা তাদের আপনজনকে দ্রুত দেশে ফেরত আনতে
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে নিয়োগকারী কোম্পানির
নাম, নির্যাতনের ধরন, বাংলাদেশ থেকে পাঠানো রিক্রুটিং এজেন্সির নাম,
টেলিফোন নম্বরসহ বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করে আবেদন করছেন। পরে ওই অভিযোগের
সত্যতা যাচাইয়ের জন্য পাঠানো হচ্ছে সৌদি আরব, জর্দান ও কাতারে নিযুক্ত
বাংলাদেশ দূতাবাসে।
তবে গত দেড় বছরে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে যত অভিযোগ
জমা পড়েছে তার মধ্যে নির্যাতিত নারীদের দেশে ফেরানোর সংখ্যা খুবই কম বলে
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এ দিকে বিদেশ যাওয়ার পর নারী শ্রমিকের ওপর
নির্যাতন প্রসঙ্গেও রয়েছে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য। রিক্রুটিং এজেন্সির
মালিকদের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, যাওয়ার আগে নারী শ্রমিকের পরিবারের
সদস্যরা বলছেন, তার এবং তার পরিবারের পক্ষ থেকে বিদেশ যেতে কোনো সমস্যা
নেই। কিন্তু যাওয়ার পরই তারা নানা অজুহাত দেখিয়ে বলেন, ‘দেশে আমি দুধের
বাচ্চা রেখে এসেছি। আমি আর থাকতে পারব না’। তখনই তারা দেশে ফিরতে
নির্যাতনের ‘বানোয়াট’ অভিযোগ তৈরি করেন। তবে সবাই না। যদিও ৩০০ টাকার
স্ট্যাম্পে মুচলেকায় উল্লেখ রয়েছে, বিদেশ যাওয়ার পর কোনোভাবেই চুক্তি
মোতাবেক নির্দিষ্ট সময়ের আগে দেশে ফিরতে পারবেন না। অন্য দিকে মন্ত্রণালয় ও
দূতাবাসে জমা পড়া অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নারীকর্মীদের যে সময় পর্যন্ত কাজ
করানোর কথা রয়েছে; সেই সময়েরও বেশি কাজ করানো হচ্ছে। কাউকে কাউকে
আত্মীয়স্বজনেরর বাসাবাড়িতেও অতিরিক্ত কাজ করানোর অভিযোগ থাকলেও বেতন দিতে
গড়িমসি শুরু হয়। আবার অনেক মালিকের দৃষ্টি পড়ছে খারাপভাবেও। এসব অভিযোগের
সত্যতা পেয়ে কিছু নারীকে এজেন্সির পাঠানো টিকিটে ইতোমধ্যে দেশে ফেরত আনা
হয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দফতরে সৌদি আরবের জেদ্দায়
নির্যাতনের শিকার মুক্তা বেগমকে দেশে ফেরত আনার জন্য তার ভাই মো: বোরহান
লিখিত অভিযোগ করেন। তিনি মন্ত্রণালয়ের নির্দিষ্ট ফরমে উল্লেখ করেন,
মোসাম্মৎ মুক্তা বেগম, পাসপোর্ট নম্বর বিএম০৮৬৬৩৭৩, মোবাইল নম্বর
০০৯৬৬৫৫৮২৬৫৫০৯।
বাবার নাম আব্দুল করিম তালুকদার। গ্রামের নাম মাদারীপুর
বাহোরান্দি। চলতি বছরের ২৯ নভেম্বর রিক্রুটিং এজেন্সি তানিয়া ট্রেডিং
ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-৪৩৬) মাধ্যমে সৌদি আরব যান। অভিযোগে মুক্তার ভাই
দেশে ফেরত আসার কারণের জায়গায় উল্লেখ করেন, সৌদি আরবে বিভিন্ন নিয়োগকর্তার
বাসায় শারীরিক নির্যাতন ও যৌন হয়রানির শিকার হন তার বোন। নিয়োগকর্তার বাসা
থেকে পালিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশ দূতাবাসের (জেদ্দা) আশ্রয়ে আছেন। সৌদি আরবের
দালাল তাকে আটকানোর চেষ্টা করছে। তাকে জরুরি ভিত্তিতে দেশে আনা প্রয়োজন। এ
প্রতিবেদকের প্রশ্নের উত্তরে মুক্তার ভাই বোরহান বলেন, তাকে সৌদি আরব
পাঠাতে ৭০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে। শুধু মুক্তা নন- সৌদি আরবে রিক্রুটিং
এজেন্সির পাঠানো এমন কয়েক শ’ নারী শ্রমিক এখন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বলে
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে
লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছে। তবে এসব অভিযোগের বিপরীতে দেশে ফেরা নারীর
সংখ্যা খুবই কম বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কমকর্তা। শুধু
সৌদি আরব নয় ; একইভাবে জর্দান, কাতারে ও অনেক নারী শ্রমিক নির্যাতিত
হচ্ছেন। প্রতিটি পরিবারের পক্ষ থেকেই তাদের দেশে ফেরত আনতে অনুরোধ জানানো
হয়েছে। এর মধ্যে অনেকে আবার নিখোঁজও রয়েছেন মাসের পর মাস। মন্ত্রণালয়ের
অভিযোগে জানা যায়, ফরিদপুরের হাজিগঞ্জের হাজার বিঘা গ্রামের রওশন আরা ২০১৪
সালে বিএমইটির ক্লিয়ারেন্স নিয়ে জর্দান যান। ২০১৬ সালের ৩১ অক্টোবর
মন্ত্রণালয়ের অভিযোগের আবেদন ফরমে তার বোন জুলেখা বেগম দেশে ফেরত আনার
কারণের জায়গায় উল্লেখ করেন, তার বোন জর্দানে ছয় মাস ধরে নিখোঁজ।
নিয়োগকর্তাকে ফোন করলে রওশন আরাকে এজেন্সি অফিসে রেখে আসে বলে জানান। নিয়োগকর্তার শারীরিক নির্যাতনে তার হাত ভেঙে গেছে। এর পর থেকে পরিবারের
সাথে আর কোনো যোগাযোগ নেই। রওশন আরার পরিবার তাকে নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন।
নিয়োগকর্তার কাছ থেকে বকেয়া বেতন আদায়সহ রওশন আরাকে যেকোনো অবস্থায় দেশে
ফেরত আনা জরুরি। একইভাবে কাতারে পাড়ি জমানো নারী শ্রমিকদের মধ্যে অনেকেই
সমস্যায় রয়েছেন। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একটি
সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে সৌদি আরবে নির্যাতিত নারী শ্রমিকদের মধ্যে পালিয়ে
৩৫০ জন বর্তমানে শেল্টার হোমে অবস্থান নিয়েছেন।
এ ছাড়া দেশে ফেরত আসার
জন্য গত দুই দিন ৭০ নারী শ্রমিক জেদ্দা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবস্থান
করছেন। তবে তাদের কী কারণে সেখানে অপেক্ষা করতে হচ্ছে তা জানা যায়নি। সৌদি
আরবে নারী শ্রমিক নির্যাতন প্রসঙ্গে একটি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক নয়া
দিগন্তকে বলেন, আমরা সরকারি নিয়মকানুন মেনেই বাংলাদেশ থেকে নারী শ্রমিক
পাঠাচ্ছি। কিন্তু কিছু মহিলা সেখানে যাওয়ার পর নানা অভিযোগ তুলে দেশে চলে
আসতে পরিবারকে দিয়ে অভিযোগ দিচ্ছেন মন্ত্রণালয়ে। তবে তিনি স্বীকার করেন,
সৌদি আরবে গৃহকর্তা-কর্ত্রীরা নারী শ্রমিকদের ইদানীং কিছুটা নির্যাতন
করছেন। বেতনও পাচ্ছেন না। সময়ের বেশি তাদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। এসব
ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের এখনই গুরুত্ব সহকারে উদ্যোগ নেয়া উচিত বলে তিনি মনে
করেন। এ দিকে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস-২০১৭ উপলক্ষে আজ রোববার বেলা সাড়ে
১২টায় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনের
আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি বক্তৃতা
করবেন বলে মন্ত্রণালয়ের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। চলতি বছরের
নভেম্বর পর্যন্ত সৌদি, কাতারসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছেন এক লাখ ১৩
হাজার নারী শ্রমিক। অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার আন্তর্জাতিক অভিবাসন
দিবস-২০১৭ এ বিদেশে নির্যাতিত নারী শ্রমিকদের কিভাবে বেতনভাতা নিশ্চিতসহ
তাদের সুরক্ষা করা যায় তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের ভাবা উচিত।
No comments