যুদ্ধাপরাধীমুক্ত দেশ গড়ার প্রত্যয়
মহান বিজয় দিবসে শনিবার সাভার স্মৃতিসৌধে বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পর শপথ নেয় জনতা -যুগান্তর |
যথাযথ
মর্যাদায় শনিবার মহান বিজয় দিবস পালিত হয়েছে। শহীদদের প্রতি বিনম্র
শ্রদ্ধা জানিয়েছে জাতি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে এগিয়ে নেয়া এবং
ক্ষুধা-দারিদ্র্য-সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার
প্রত্যয়, শপথ ও দাবির মাধ্যমে দিনটি পালন করে গোটা জাতি। সব যুুদ্ধাপরাধীর
ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে বাংলাদেশকে যুদ্ধাপরাধী মুক্ত করার দাবি জানায়
সর্বস্তরের মানুষ। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় বাঙালি জাতি ভালোবাসা আর অহংকারের
প্রতীক জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুলেল শ্রদ্ধায় কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে শহীদ বীর
মুক্তিযোদ্ধাদের।
ভোরে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে (পুরনো বিমানবন্দর) ৩১ বার
তোপধ্বনির মাধ্যমে বিজয় দিবসের সূচনা হয়। দিনটি উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও
বেতারসহ বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
সংবাদপত্রগুলো বের করে বিশেষ ক্রোড়পত্র। জাতীয় স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার ও
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালার
আয়োজন করা হয়। এদিন ছিল সরকারি ছুটি। সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত
ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও
স্থাপনায় আলোকসজ্জা করা হয়। প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপগুলো সাজানো ছিল জাতীয়
পতাকা ও রং-বেরঙের কাগজে। জেলখানা, হাসপাতাল, এতিমখানা ও শিশু সদনগুলোয়
পরিবেশন করা হয় উন্নত খাবার। সকাল ৬টা ৩৪ মিনিটে রাষ্ট্রপতি এবং
প্রধানমন্ত্রী সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা
জানান। তিন বাহিনীর একটি চৌকস দল এ সময় সালাম জানায়। শহীদদের স্মরণে
শ্রদ্ধাবনত জাতি ফুলে ফুলে ভরে দেয় সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধের বেদি। সেখানে
সর্বস্তরের লাখো মানুষের ঢল নামে। এ ছাড়া দেশের সব বিভাগ, জেলা ও উপজেলা
শহরের চিত্রও ছিল প্রায় অভিন্ন। মানুষে মানুষে বৈষম্য ভুলে সাম্প্রদায়িকতা
প্রতিহত করে নতুন এক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ছিল শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের
চোখে-মুখে। শিশুকিশোর ও তরুণ-তরুণীদের হাতে, কারও গালে কিংবা কপালে আঁকা
ছিল রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা, প্রিয় মাতৃভূমির মানচিত্র। তরুণ প্রজন্মের
ছেলেদের গায়ে ছিল জাতীয় পতাকার রঙে শার্ট, পাঞ্জাবি বা গেঞ্জি এবং মেয়েদের
পরনে ছিল লাল-সবুজের শাড়ি অথবা সালোয়ার-কামিজ। বিজয় দিবসে আনন্দ-উৎসবের
আলোয় সাজে ঢাকাসহ পুরো দেশ। পতাকায় সজ্জিত রাজধানীসহ দেশের বড় শহরগুলোর
প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপ।
সচিবালয়সহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থান আলোর ঝলকানি।
প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের দেয়ালে লাল-সবুজের ছাপ। আলোর সাজে সাজানো হয় জাতীয়
সংসদ ভবনও। মূল ভবন আর আশপাশের সব ভবনে জ্বলে লাল-সবুজ আলো। রাজধানীর
গুরুত্বপূর্ণ ভবনের পাশাপাশি সাজানো হয় রাজপথের দুই পাশ। সন্ধ্যার পর
রং-বেরঙের আলোকচ্ছটায় ঝলমলিয়ে ওঠে এলাকাগুলো। আলো দিয়ে তৈরি করা হয় প্রিয়
লাল-সবুজ পতাকা। মনকাড়া এমন আলোকসজ্জায় মুগ্ধ সবাই। ত্রিশ লাখ শহীদের
রক্তস্নাত লাল-সবুজের পতাকা হাতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শিশু থেকে বৃদ্ধ
সবার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের শপথ আর পরাজিত
শক্তির ষড়যন্ত্র রুখে দেয়ার প্রত্যয়। চোখে ছিল একাত্তরের ঘাতক
রাজাকার-আলবদর-যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দোসরদের প্রতি তীব্র ঘৃণা-ধিক্কার।
কুয়াশার চাদরে মোড়ানো সকালে সূর্য ওঠার আগেই জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও বঙ্গবন্ধুর
প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে ছিল মানুষের দীর্ঘ লাইন। দিনের আলোর উজ্জ্বলতা
যতই বাড়তে থাকে জনতার ভিড়ও তত বাড়তে থাকে। দিনটি পালনে সকাল ৮টায়
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। স্বাধীনতার মহান
স্থপতির স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন।
এরপর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দলীয়প্রধান হিসেবে দলের সিনিয়র
নেতাকর্মীদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। ৪৭তম
বিজয় দিবস উপলক্ষে ১০ টাকার স্মারক ডাকটিকিট ও উদ্বোধনী খাম অবমুক্ত করেন
প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে পাঁচ টাকা মূল্যমানের একটি
ডাটা কার্ড এবং ডাক বিভাগের ইস্যুকৃত একটি স্মারকগ্রন্থ তিনি অবমুক্ত করেন।
সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে সম্মিলিত বাহিনীর
দৃষ্টিনন্দন কুচকাওয়াজে সালাম গ্রহণ করেন রাষ্ট্রপতি। এ সময় প্রধানমন্ত্রী
উপস্থিত ছিলেন। বিকালে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বঙ্গভবনে এক সংবর্ধনার আয়োজন
করেন রাষ্ট্রপতি। এতে প্রধানমন্ত্রীসহ একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর
মুক্তিযোদ্ধা ও বীরশ্রেষ্ঠ পরিবারের সদস্যরা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
এতে বিজয় দিবসের কেক কাটেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গভবনের বিশাল
চত্বর ঘুরে ঘুরে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং
শহীদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন এবং তাদের খোঁজখবর নেন।
আগত অতিথিদের সঙ্গেও কুশল বিনিময় করেন তারা। বিজয় দিবস উপলক্ষে দেশের সব
মুক্তিযোদ্ধাকে (এফএফ) শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এবারও
তিনি নগরীর মোহাম্মদপুরের গজনবী রোডে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন
কেন্দ্রে ফুল, ফল ও মিষ্টি পাঠিয়েছেন। মহান বিজয় দিবসে রাজধানীজুড়ে ছিল
নানা আয়োজন। বিকালে রাজধানীতে বিশাল আনন্দ শোভাযাত্রা করে আওয়ামী লীগ। ৩
কিলোমিটারের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায় লাখো মানুষ অংশ নেন। ঐতিহাসিক
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে এ শোভাযাত্রা শুরু হয়ে শেষ ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর।
দিনের শুরুতে বাঙালির অধিকার সংগ্রামের অন্যতম সূতিকাগার কেন্দ্রীয় শহীদ
মিনারে বিজয় শোভাযাত্রা ও পতাকা মিছিলের আয়োজন করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট
ও শিশু একাডেমি। তরুণ-তরুণী একসঙ্গে শপথ নেয় অসমাপ্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার।
মুক্তি সেনাদের মতো তারাও দেশ মাতৃকার জন্য আমুত্যু লড়াই করে বাঙালির
কাক্সিক্ষত বিজয় ছিনিয়ে আনতে প্রস্তুত। বিজয় শোভাযাত্রাটি কেন্দ্রীয় শহীদ
মিনার থেকে বের হয়ে দোয়েল চত্বর, বাংলা একাডেমি, টিএসসি, জাতীয়
গণগ্রন্থাগার অধিদফতরের সামনে দিয়ে ঘুরে যায়। সকালে রাজধানীর হাতিরঝিলে
বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের উদ্যোগে সাইকেল র্যাবলি অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া শিখা
চিরন্তনে শহীদদের আত্মদানের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন ও তরুণ প্রজন্মের
হাতে পতাকা হস্তান্তর অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম। বিকালে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে ছায়ানটের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান
হয়। সকাল থেকেই ঢাকার রাজপথে চলে লাল-সবুজের মেলা। রিকশা, সাইকেল,
মোটরসাইকেল, বাস কিংবা ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে সবাই মেতেছেন উৎসবের রঙে। কেউ
হাতে পতাকা নিয়ে কেউ বা গালে কিংবা কপালে পতাকা একেছেন। মহান বিজয় দিবসে
বিজয়ের গৌরবগাঁথা নিয়ে পৃথক আলোচনা সভা, বক্তৃতা, রচনা প্রতিযোগিতা, কবিতা
আবৃত্তি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও দোয়ার আয়োজন করে রাজধানীর বেরাইদের বিভিন্ন
সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এগুলো হল- বেরাইদ
গণপাঠাগার, বেরাইদ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠন, একেএম রহমত উল্লাহ
বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, রওশনআরা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, বেরাইদ মুসলিম
হাইস্কুল, আলহাজ রহিমউল্লাহ মাদ্রাসা ও এতিমখানা, বেরাইদ মোহাম্মদিয়া দাখিল
মাদ্রাসা এবং বেরাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে জাতীয় স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় স্কেটিং র্যালি।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে জাতীয় স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় স্কেটিং র্যালি।
No comments