আশাবাদী বাংলাদেশিদের নির্বাচনী আকাঙ্ক্ষা by কামাল আহমেদ

বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্রগুলো অনেক দিন ধরেই জাতীয় পর্যায়ে কোনো জনমত জরিপ পরিচালনা করে না। অথচ গণতান্ত্রিক সমাজে অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে এ ধরনের জরিপের গুরুত্বই আলাদা। অনেকে অবশ্য সংবাদপত্রগুলোর অনলাইন জরিপের কথা বলতে পারেন। কিন্তু ওই জরিপগুলো মোটেও বিজ্ঞানসম্মত নয় এবং তাতে নানা ধরনের প্রভাব বিস্তারের সংগঠিত চেষ্টার কথাও শোনা যায়। সংবাদমাধ্যম বা প্রতিষ্ঠিত গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো বিরূপ রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া এড়াতে এ ধরনের জরিপ পরিচালনা থেকে বিরত থাকলেও জরিপ কিন্তু বন্ধ নেই। সে জন্যই তো গত পৌর নির্বাচনের আগে পুলিশের একটি গোপন জরিপের খবরও প্রকাশিত হয়েছিল। ক্ষমতাসীন দল ও জোটের তরফে নির্বাচনী মনোনয়নেও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার এ ধরনের জরিপের ভূমিকার কথাও আমরা বারবার শুনে আসছি। এ রকম একটি পটভূমিতে সপ্তাহ খানেক আগে প্রকাশিত এক জরিপে বলা হলো, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে অধিকাংশ বাংলাদেশির মধ্যে আশাবাদ বাড়ছে। জরিপটির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দেশটির ৪৫ শতাংশ মানুষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বদলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে বেছে নিচ্ছে। জরিপটি পরিচালনা করেছে ‘বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়ার কাজে নিয়োজিত’ (প্রতিষ্ঠানটির ঘোষিত লক্ষ্য) যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই)।
আইআরআইয়ের এই জরিপটিতে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল ও তার অনুসারীরা খুশি হয়েছেন সন্দেহ নেই। অন্তত জনসমক্ষে প্রকাশিত প্রতিক্রিয়ায় সে রকমটিই দেখা গেছে। তবে অন্য অনেক জরিপের মতোই এই জরিপটিও অনেক প্রশ্নেরও জন্ম দিয়েছে। জরিপটি আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে পরিচালিত হয়েছে বলে উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে সারা দেশের ২ হাজার ৫৫০ জন এতে মতামত দিয়েছেন। সাতটি বিভাগে ২৫০টি নমুনা সংগ্রহকারী ইউনিট এসব মতামত সংগ্রহ করেছে। যার মানে দাঁড়ায়, একেকটি ইউনিট গড়ে ১০ জনের মতামত নিয়েছে। আবার জরিপে অংশগ্রহণকারীদের বিষয়ে যেসব তথ্য দেওয়া হয়েছে, তাতে দেখা যায় যে ৪০ শতাংশের বেশি উত্তরদাতার পারিবারিক আয় মাসিক ১০ হাজার টাকার নিচে। এই সামান্য আয়ের পরিবারগুলো দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে সন্তুষ্টি জানানোতে বলতেই হয়, বাঙালি যে অল্পেই সন্তুষ্ট, জরিপটি তার প্রমাণ!
আইআরআইয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দেশটির ৪৫ শতাংশ মানুষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বদলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে বেছে নিচ্ছে বলা হলেও দেখা যাচ্ছে যে ৫১ শতাংশ মানুষ কিন্তু গণতন্ত্রকেই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মত দিয়েছেন। গণতন্ত্রের আগে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বাণী দুবছর ধরে প্রচারের পরও জরিপের মূল বার্তাটি বলছে গণতন্ত্রের প্রতি দেশবাসীর আস্থা এখনো অবিচল।
আইআরআইয়ের ওয়েবসাইটে দেখা যায় যে তাদের আগের দুটি জরিপও একইসংখ্যক অংশগ্রহণকারীর ওপর একই পদ্ধতিতে চালানো হয়েছিল। গত তিনটি জনমত জরিপের মধ্যে মিল যে শুধু এটুকু তা নয়; জরিপের ফলগুলোতেও অনেক মিল দেখা যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতিসহ সামগ্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশি ধারাবাহিকভাবে একই ধরনের আশাবাদ প্রকাশ করে এসেছেন। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে এই আশাবাদীদের পরিমাণ ছিল ৫৭ শতাংশ, ২০১৫-এর জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬২ শতাংশে। এবারও যথারীতি তা বেড়েছে। গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তার প্রশ্নেও জনসমর্থনের পাল্লা ভারী অবস্থান অব্যাহত আছে। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদ এবং গণতন্ত্রের প্রতি অব্যাহত আস্থার মতো ইতিবাচক দিকগুলোর পাশাপাশি জরিপের যে ফলটি সবার জন্য দুর্ভাবনার বিষয়, তা হচ্ছে বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে। কোনো ধরনের সমঝোতা ছাড়া যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলোপ ঘটানো হয়েছে, দেশের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ এখনো সেই ব্যবস্থাকেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য মনে করে ফিরিয়ে আনার কথা বলেছেন।
এই জরিপের আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এতে কথিত সংসদীয় বিরোধী দল সম্পর্কে কোনো কথা নেই। কোন দলের নেতৃত্ব দৃঢ় বা শক্তিশালী, কোন দল শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করছে, কোন দল নারীদের সমর্থন করে—এসব প্রশ্নে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের অবস্থান ভালো। আবার কোন দল ধর্মের প্রতি বেশি বিশ্বাসী—এমন প্রশ্নে দেখা যাচ্ছে বিএনপি এগিয়ে। জাতীয় পার্টির কোনো নামগন্ধই এতে নেই। রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এখনো যেভাবে বিএনপিকেই সারাক্ষণ তুলাধোনা করে চলেছেন, তাতে এমন পরিণতিই তো স্বাভাবিক!
২.
গেল ৩০ জানুয়ারি ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় আফ্রিকান ইউনিয়নের ২৬তম শীর্ষ সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন, নেতাদের কখনোই অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক পরিবর্তন এবং আইনগত দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা উচিত নয়। তাঁরা যখন এমনটি করেন, তখন তার যে করুণ পরিণতি হয়, আমরা সবাই তা দেখেছি। নেতাদের উচিত নিজেদের সুরক্ষার বদলে জনগণের সুরক্ষা দেওয়া। যেসব নেতা সাংবিধানিক মেয়াদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে সরে দাঁড়ান, আমি সেই নেতাদের প্রশংসা করি। তাঁদের দৃষ্টান্ত অনুসরণের জন্য আমি সবার প্রতি আহ্বান জানাই। জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ বছরে আফ্রিকার বাঘা বাঘা জাতীয়তাবাদী নেতার উপস্থিতিতে আরও বলেন যে ২০১৬ সালে আফ্রিকায় ১৬টি দেশ নির্বাচনে যাবে এবং এ কারণে যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁদের বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের এই বক্তৃতার বিবরণটি পড়ার সময় চোখ যায় আফ্রিকার ওই সব জাতীয়তাবাদী নেতার দিকে, যাঁরা সাম্রাজ্যবাদের ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল ছিন্ন করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার আন্দোলনে সফল হলেও গণতন্ত্র, আইনের শাসন কিংবা অর্থনৈতিক মুক্তি—এগুলোর সবকিছুই রয়ে গেছে অধরা। আফ্রিকার ওই শীর্ষ সম্মেলনে সভাপতি ছিলেন জিম্বাবুয়ের রবার্ট মুগাবে, যিনি স্বৈরাচার হিসেবে একজন জীবন্ত কিংবদন্তি। নির্বাচনকে প্রহসনে রূপান্তরিত করায় তাঁর রেকর্ডটি শিগগির কেউ ভাঙতে পারবে কি না, তা বলা মুশকিল। ৪৪ বছর ধরে প্রেসিডেন্টের আসনে আসীন এই স্বৈরশাসককে পাশে রেখে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার কুফল বর্ণনার সময় মহাসচিব বানের কোনো মর্মপীড়া হয়েছিল কি না, হয়তো ভবিষ্যতে তাঁর জীবনীগ্রন্থে তা জানা যাবে। তবে কূটনীতিকদের জন্য এ ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতি একেবারে অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। ২০০৩ সালের কথা। তখন মহাসচিব ছিলেন কফি আনান। সে বছরের ১ সেপ্টেম্বর থেকে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে ধূমপান নিষিদ্ধ করলেন মি. আনান। রাশিয়ার বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ তখন জাতিসংঘে দেশটির স্থায়ী প্রতিনিধি। মি. লাভরভ অভ্যাসবশত তাঁর সিগারেটে আগুন জ্বালাতে গেলে জাতিসংঘের কর্মীরা তাঁকে নিষেধাজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে গেলে ক্ষুব্ধ লাভরভ তাঁদের বলেন যে মহাসচিবের ওই সিদ্ধান্তের কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। শুধু এটুকু বলেই তিনি থামলেন না। তিনি আরও বললেন, ‘জাতিসংঘ ভবনের মালিক হচ্ছে সদস্যরাষ্ট্রগুলো, আর মহাসচিব হলেন একজন ভাড়াটে ব্যবস্থাপক।’ (এনভয় ফিউমস এট ইউএন সিগারেট ব্যান, বিবিসি, ৯ সেপ্টেম্বর ২০০৩)।
জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব বান কি মুনের অবশ্য কপাল ভালো যে তিনি যখন সংবিধান সংশোধন করে অগণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার প্রবণতার সমালোচনা করেছেন, তখন তাঁকে সে রকম কোনো রূঢ় কথা শুনতে হয়নি। এর অন্যতম কারণ সম্ভবত এই যে আফ্রিকার কোনো দেশই রাশিয়ার মতো ভেটো ক্ষমতার অধিকারী নয়। তা ছাড়া আফ্রিকান ইউনিয়নের এখন সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হচ্ছে সদস্যদেশ বুরুন্ডিতে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার চেষ্টার পরিণতিতে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধ। দুবারের বেশি ক্ষমতায় না থাকার বাধা দূর করতে সংবিধান সংশোধন থেকে শুরু হওয়া সংঘাত থেকে বাঁচতে বুরুন্ডির কয়েক লাখ নাগরিক ইতিমধ্যেই সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোয় উদ্বাস্তু হয়েছেন। আফ্রিকান ইউনিয়ন সেখানে শান্তিরক্ষী পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়ায় দেশটির বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট পিয়ের এনক্রুনজেজা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন।
৩.
বাংলাদেশের নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অস্থিরতায় জাতিসংঘের উদ্যোগ বা ভূমিকার কথা আমরা হয়তো অনেকেই ভুলতে বসেছি। ২০০৬–এ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারে—এমন এক আশঙ্কার কথা শুনিয়ে এক–এগারোর পরিবর্তন আনা হয়েছিল। ২০১৩ সালেও নির্বাচনকেন্দ্রিক বিরোধ মেটাতে আসেন জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ। তবে সংকট মেটেনি। যে কারণে ২০১৪ সালে আবারও মহাসচিব বান তাঁর বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজকে পাঠাতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাঁর আর আসা হয়নি। তবে আশাবাদী বাঙালির গণতান্ত্রিক চেতনায় এখনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষা যে প্রবল, তা বলাই বাহুল্য। সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোর নৈরাজ্য সম্ভবত সে কারণেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা নিয়ে ভোটারদের স্মৃতিকাতর করে তুলছে।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.