প্রসূতিদের আপন ঠিকানা by মাহবুবুর রহমান
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের দুর্গাপুর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে অস্ত্রোপচার ছাড়াই জন্ম নেওয়া নবজাতককে পোশাক উপহার দিচ্ছেন ইউপি চেয়ারম্যান এম এ জলিল। সম্প্রতি তোলা ছবি l প্রথম আলো |
মাত্র
বছর দুয়েক আগেও অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকত স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি। নামমাত্র
স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হতো কেন্দ্রটি থেকে। অন্য রোগীদের মতো প্রসূতিরাও
সব সময় ছুটে যেতেন শহরের দিকে। কিন্তু বদলে গেছে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের
সেবা কার্যক্রম। প্রসূতি সেবাদানে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি আজ অনন্য এক
দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে।
আলোচিত এই সেবা প্রতিষ্ঠানটি হলো নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র। যেটি এখন শুধুই স্বাস্থ্যকেন্দ্র নয়, প্রসূতিদের কাছে নিরাপদ সন্তান প্রসবের এক আপন ঠিকানা। অল্প দিনে এর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে দেশ-বিদেশে। এখানে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা প্রসূতি মায়েরা আসেন নিরাপদে সন্তান প্রসবের জন্য। পরিচ্ছন্ন পরিবেশে বিনা খরচে সন্তান প্রসব শেষে হাসিমুখে বাড়ি ফিরে যান তাঁরা।
তাই এখন শুধু দুর্গাপুর ইউনিয়নের প্রসূতিরাই নন, আশপাশের ইউনিয়ন এবং উপজেলার প্রসূতিরাও আসেন এখানে সেবা নিতে। এক মাসে ১১৪ শিশুর জন্মগ্রহণের সর্বোচ্চ রেকর্ড গড়েছে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি।
হঠাৎ কীভাবে কার উদ্যোগে বদলে গেল স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির চিত্র। সেই মানুষটি হলেন স্থানীয় দুর্গাপুর ইউনিয়ন পরিষদেরই (ইউপি) চেয়ারম্যান এম এ জলিল।
বদলে যাওয়ার কথা: চেয়ারম্যান এম এ জলিল জানালেন, এর আগেও একবার তিনি দুর্গাপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন সরকারি উদ্যোগে তাঁর ইউনিয়নে ওই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়। কিন্তু সেবা কার্যক্রম নিয়ে তখন তিনি ততটা ভাবেননি। এরই মধ্যে তাঁর মেয়াদ শেষ হয়। পরের কয়েকবার তিনি আর নির্বাচন করেননি। সর্বশেষ ইউপি নির্বাচনে তিনি আবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। চেয়ারম্যান হিসেবে ২০১৪ সালের প্রথম দিকে তিনি সেভ দ্য চিলড্রেনের একটি প্রকল্পের অধীনে এক কর্মশালায় যোগদানের সুযোগ পান। ওই কর্মশালায় মা ও শিশু স্বাস্থ্য সম্পর্কে বিশেষ করে নিরাপদ মাতৃত্ব নিয়ে যেসব আলোচনা হয়, তাতে তিনি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন। সিদ্ধান্ত নেন নিজের ইউনিয়নে অবহেলায় পড়ে থাকা স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিকে সেবাবান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার। তিনি জানান, কর্মশালা ঘিরে পরিষদের সদস্যদের এক বৈঠকে তিনি তাঁর আগ্রহের কথা তুলে ধরলে তাঁরাও উৎসাহী হন। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবায় সহযোগী বেসরকারি ওই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গেও যোগাযোগ করে তাঁদের সহযোগিতা চান তিনি।
বেসরকারি ওই প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে তিনজন প্যারামেডিক (নার্স), দুজন আয়া ও একজন নিরাপত্তা প্রহরী দেওয়া হয়। এ ছাড়া স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ থেকে একজন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা, একজন উপসহকারী কমিউনিটি চিকিৎসা কর্মকর্তার (সাকমো) পাশাপাশি দেওয়া হয় একজন চিকিৎসককে। যিনি সপ্তাহে দুদিন এই কেন্দ্রে বসে রোগী দেখেন। দুটি বেড (সিট) দিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়। এখন বেডের সংখ্যা নয়টি।
স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একদিন: গত ১৪ জানুয়ারি বেলা ১১টার দিকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ঢুকতেই চোখে পড়ে আশপাশের পরিচ্ছন্ন ও দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ। ভেতরে ঢোকার পর দেখা যায়, সামনে খোলামেলা কক্ষে বসা ১৩-১৪ জন নারী। কারও কারও সঙ্গে আছেন পুরুষও। তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেরই কোলে বিভিন্ন বয়সের শিশু। কারও কোলে নবজাতক। এরই মধ্যে ভেতরের একটি কক্ষ থেকে ভেসে আসে নবজাতকের কান্নার আওয়াজ। কয়েক মিনিট পর কর্তব্যরত সেবিকা রোখসানা হাসতে হাসতে এগিয়ে আসেন নতুন তোয়ালে মোড়ানো ওই নবজাতককে কোলে নিয়ে। বলেন, কেবলই দুনিয়ার আলোর মুখ দেখেছে এই নবজাতক।
কেমন লাগছে জানতে চাইলে রোখসানা বলেন, ‘অনেক ভালো। মায়ের গর্ভ থেকে সন্তান সুস্থভাবে দুনিয়ায় এলে মা যেমন সব কষ্ট ভুলে যান, তেমনি আমাদের কাছেও খুব ভালো লাগে।’
সেবা গ্রহণকারীদের বক্তব্য: বেগমগঞ্জের শরিফপুর ইউনিয়নের ফাতেমা আক্তার বলেন, তাঁর ছোট বোন আশেয়া গর্ভবতী ছিলেন। তাঁর স্বামীর বাড়ি বেগমগঞ্জের (চৌমুহনী শহরে)। তাঁকে গত ১০ ডিসেম্বর চৌমুহনীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিলে একজন নারী চিকিৎসক বলেন, ‘গর্ভের বাচ্চা উপরে উঠে গেছে, দ্রুত অস্ত্রোপচার করতে হবে।’
তাঁরা দুশ্চিন্তা নিয়ে বাড়ি ফেরেন। পরদিন লোকমুখে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কথা শুনে এখানে আসেন। এখানে বিনা অস্ত্রোপচারে তাঁর বোনের একটি কন্যাসন্তান প্রসব হয়।
শুধু ফাতেমাই নন, সেবা নিতে আসা একই উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়নের লাউতলীর সোনিয়া আক্তার, চৌমুহনী পৌরসভার শাহীন সুলতানা, ঝরনা আক্তার, হাজীপুরের শিরিন আক্তার ও কাদিরপুরের জাহানারা বেগম এবং পার্শ্ববর্তী সেনবাগ উপজেলার বীজবাগ গ্রাম থেকে আসা নুরুল হকও জানান, স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে বিনা অস্ত্রোপচারে নিয়মিত সন্তান প্রসব করানোর কথা।
চৌমুহনী পৌরসভার বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম বলেন, এখানে বিনা খরচে যে ধরনের সেবা পাওয়া যায়, তা বেসরকারি হাসপাতালে টাকা দিয়েও ঠিকমতো পাওয়া যায় না। তাই তিনিও তাঁর স্ত্রীর সন্তান প্রসব এখানে করিয়েছেন। চেষ্টা করেও কর্তব্যরত ব্যক্তিদের কোনো বকশিশ দিতে পারেননি। সন্তান হওয়ার পরও নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা ও পরামর্শ তাঁরা পাচ্ছেন এখান থেকে।
পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা ঝরনা বেগম জানান, পুরো ইউনিয়নের গর্ভবতী মায়েদের তথ্য রয়েছে তাঁদের কাছে। মাঠপর্যায়ে থাকা কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে গর্ভবতী মায়েদের নাম-ঠিকানা ও মুঠোফোন নম্বর নিয়ে আসেন। এরপর মাসিক বৈঠকে ওয়ার্ড ও গ্রামভিত্তিক গর্ভবতী ও প্রসবযোগ্য মায়েদের দুটি আলাদা মানচিত্র তৈরি করা হয়। এসব কাজ সার্বক্ষণিক তদারক করেন ইউপি চেয়ারম্যান।
২৪ ঘণ্টা ক্লান্তিহীন সেবা: স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সামনে এবং আশপাশের বাজারে সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। যাতে লেখা রয়েছে, ‘এখানে ২৪ ঘণ্টা নরমাল ডেলিভারি করা হয়।’ সাইনবোর্ডের লেখা অনুযায়ী সেবাদানের হেরফের হয় না। দিন-রাতের কোনো ভেদাভেদ নেই। যখনই প্রসূতি আসেন, তখনই সেবা দেওয়া হয়। অনেক সময় গভীর রাতেও ঘুম থেকে উঠে সন্তান প্রসব করাতে হয় বলে জানালেন প্যারামেডিক রেবেনা আক্তার ও সিপু মজুমদার।
উপসহকারী কমিউনিটি চিকিৎসা কর্মকর্তা আবদুল মোতালেব বলেন, ২০১৪ সালের ২৩ জুলাই থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রেটিতে প্রসূতি মায়েদের সন্তান প্রসব শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৯০০ নবজাতকের জন্ম হয়েছে এখানে। এর মধ্যে গত ডিসেম্বর মাসেই জন্ম হয়েছে ১১৪ শিশুর।
স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে জানানো হয়, প্রসূতি স্বাস্থ্যসেবায় এই কেন্দ্রের সফলতার খবর শুনে পার্শ্ববর্তী কিছু ইউনিয়নেও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে একই ধরনের সেবা চালু করার জন্য স্থানীয় চেয়ারম্যানরা ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া এই কার্যক্রমের কথা জেনে ইতিমধ্যে তুরস্ক ও মিসরের একজন করে প্রতিনিধি কেন্দ্রটি পরিদর্শন করে গেছেন।
চেয়ারম্যান এম এ জলিল বলেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি সেবামূলক অনেক কাজই করেছেন। কিন্তু নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যে ব্যবস্থা করতে পেরেছেন, সেটি জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সেবা বলে মনে হয় তাঁর। প্রতিটি নবজাতক শিশুর জন্মের পর এক সেট নতুন জামা ও একটি তোয়ালের ব্যবস্থা করেন তিনি।
জলিল সাহেব জানালেন, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সেবাকেন্দ্রটির জন্য সাধ্যমতো সহায়তা করা হয়। ওষুধপথ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকেও ভালো সহায়তা পেয়েছেন। তবে তাঁর ইচ্ছা একটি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মোস্তফা কামাল বলেন, দুর্গাপুর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রটি সারা দেশের জন্য একটি মডেল হিসেবে ইতিমধ্যে পরিচিতি পেয়েছে। উচ্চ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তাও এরই মধ্যে এ সফলতা দেখে গেছেন। একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইচ্ছা করলে কী না করতে পারেন, এম এ জলিল তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
আলোচিত এই সেবা প্রতিষ্ঠানটি হলো নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র। যেটি এখন শুধুই স্বাস্থ্যকেন্দ্র নয়, প্রসূতিদের কাছে নিরাপদ সন্তান প্রসবের এক আপন ঠিকানা। অল্প দিনে এর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে দেশ-বিদেশে। এখানে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা প্রসূতি মায়েরা আসেন নিরাপদে সন্তান প্রসবের জন্য। পরিচ্ছন্ন পরিবেশে বিনা খরচে সন্তান প্রসব শেষে হাসিমুখে বাড়ি ফিরে যান তাঁরা।
তাই এখন শুধু দুর্গাপুর ইউনিয়নের প্রসূতিরাই নন, আশপাশের ইউনিয়ন এবং উপজেলার প্রসূতিরাও আসেন এখানে সেবা নিতে। এক মাসে ১১৪ শিশুর জন্মগ্রহণের সর্বোচ্চ রেকর্ড গড়েছে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি।
হঠাৎ কীভাবে কার উদ্যোগে বদলে গেল স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির চিত্র। সেই মানুষটি হলেন স্থানীয় দুর্গাপুর ইউনিয়ন পরিষদেরই (ইউপি) চেয়ারম্যান এম এ জলিল।
বদলে যাওয়ার কথা: চেয়ারম্যান এম এ জলিল জানালেন, এর আগেও একবার তিনি দুর্গাপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন সরকারি উদ্যোগে তাঁর ইউনিয়নে ওই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়। কিন্তু সেবা কার্যক্রম নিয়ে তখন তিনি ততটা ভাবেননি। এরই মধ্যে তাঁর মেয়াদ শেষ হয়। পরের কয়েকবার তিনি আর নির্বাচন করেননি। সর্বশেষ ইউপি নির্বাচনে তিনি আবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। চেয়ারম্যান হিসেবে ২০১৪ সালের প্রথম দিকে তিনি সেভ দ্য চিলড্রেনের একটি প্রকল্পের অধীনে এক কর্মশালায় যোগদানের সুযোগ পান। ওই কর্মশালায় মা ও শিশু স্বাস্থ্য সম্পর্কে বিশেষ করে নিরাপদ মাতৃত্ব নিয়ে যেসব আলোচনা হয়, তাতে তিনি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন। সিদ্ধান্ত নেন নিজের ইউনিয়নে অবহেলায় পড়ে থাকা স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিকে সেবাবান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার। তিনি জানান, কর্মশালা ঘিরে পরিষদের সদস্যদের এক বৈঠকে তিনি তাঁর আগ্রহের কথা তুলে ধরলে তাঁরাও উৎসাহী হন। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবায় সহযোগী বেসরকারি ওই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গেও যোগাযোগ করে তাঁদের সহযোগিতা চান তিনি।
বেসরকারি ওই প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে তিনজন প্যারামেডিক (নার্স), দুজন আয়া ও একজন নিরাপত্তা প্রহরী দেওয়া হয়। এ ছাড়া স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ থেকে একজন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা, একজন উপসহকারী কমিউনিটি চিকিৎসা কর্মকর্তার (সাকমো) পাশাপাশি দেওয়া হয় একজন চিকিৎসককে। যিনি সপ্তাহে দুদিন এই কেন্দ্রে বসে রোগী দেখেন। দুটি বেড (সিট) দিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়। এখন বেডের সংখ্যা নয়টি।
স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একদিন: গত ১৪ জানুয়ারি বেলা ১১টার দিকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ঢুকতেই চোখে পড়ে আশপাশের পরিচ্ছন্ন ও দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ। ভেতরে ঢোকার পর দেখা যায়, সামনে খোলামেলা কক্ষে বসা ১৩-১৪ জন নারী। কারও কারও সঙ্গে আছেন পুরুষও। তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেরই কোলে বিভিন্ন বয়সের শিশু। কারও কোলে নবজাতক। এরই মধ্যে ভেতরের একটি কক্ষ থেকে ভেসে আসে নবজাতকের কান্নার আওয়াজ। কয়েক মিনিট পর কর্তব্যরত সেবিকা রোখসানা হাসতে হাসতে এগিয়ে আসেন নতুন তোয়ালে মোড়ানো ওই নবজাতককে কোলে নিয়ে। বলেন, কেবলই দুনিয়ার আলোর মুখ দেখেছে এই নবজাতক।
কেমন লাগছে জানতে চাইলে রোখসানা বলেন, ‘অনেক ভালো। মায়ের গর্ভ থেকে সন্তান সুস্থভাবে দুনিয়ায় এলে মা যেমন সব কষ্ট ভুলে যান, তেমনি আমাদের কাছেও খুব ভালো লাগে।’
সেবা গ্রহণকারীদের বক্তব্য: বেগমগঞ্জের শরিফপুর ইউনিয়নের ফাতেমা আক্তার বলেন, তাঁর ছোট বোন আশেয়া গর্ভবতী ছিলেন। তাঁর স্বামীর বাড়ি বেগমগঞ্জের (চৌমুহনী শহরে)। তাঁকে গত ১০ ডিসেম্বর চৌমুহনীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিলে একজন নারী চিকিৎসক বলেন, ‘গর্ভের বাচ্চা উপরে উঠে গেছে, দ্রুত অস্ত্রোপচার করতে হবে।’
তাঁরা দুশ্চিন্তা নিয়ে বাড়ি ফেরেন। পরদিন লোকমুখে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কথা শুনে এখানে আসেন। এখানে বিনা অস্ত্রোপচারে তাঁর বোনের একটি কন্যাসন্তান প্রসব হয়।
শুধু ফাতেমাই নন, সেবা নিতে আসা একই উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়নের লাউতলীর সোনিয়া আক্তার, চৌমুহনী পৌরসভার শাহীন সুলতানা, ঝরনা আক্তার, হাজীপুরের শিরিন আক্তার ও কাদিরপুরের জাহানারা বেগম এবং পার্শ্ববর্তী সেনবাগ উপজেলার বীজবাগ গ্রাম থেকে আসা নুরুল হকও জানান, স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে বিনা অস্ত্রোপচারে নিয়মিত সন্তান প্রসব করানোর কথা।
চৌমুহনী পৌরসভার বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম বলেন, এখানে বিনা খরচে যে ধরনের সেবা পাওয়া যায়, তা বেসরকারি হাসপাতালে টাকা দিয়েও ঠিকমতো পাওয়া যায় না। তাই তিনিও তাঁর স্ত্রীর সন্তান প্রসব এখানে করিয়েছেন। চেষ্টা করেও কর্তব্যরত ব্যক্তিদের কোনো বকশিশ দিতে পারেননি। সন্তান হওয়ার পরও নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা ও পরামর্শ তাঁরা পাচ্ছেন এখান থেকে।
পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা ঝরনা বেগম জানান, পুরো ইউনিয়নের গর্ভবতী মায়েদের তথ্য রয়েছে তাঁদের কাছে। মাঠপর্যায়ে থাকা কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে গর্ভবতী মায়েদের নাম-ঠিকানা ও মুঠোফোন নম্বর নিয়ে আসেন। এরপর মাসিক বৈঠকে ওয়ার্ড ও গ্রামভিত্তিক গর্ভবতী ও প্রসবযোগ্য মায়েদের দুটি আলাদা মানচিত্র তৈরি করা হয়। এসব কাজ সার্বক্ষণিক তদারক করেন ইউপি চেয়ারম্যান।
২৪ ঘণ্টা ক্লান্তিহীন সেবা: স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সামনে এবং আশপাশের বাজারে সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। যাতে লেখা রয়েছে, ‘এখানে ২৪ ঘণ্টা নরমাল ডেলিভারি করা হয়।’ সাইনবোর্ডের লেখা অনুযায়ী সেবাদানের হেরফের হয় না। দিন-রাতের কোনো ভেদাভেদ নেই। যখনই প্রসূতি আসেন, তখনই সেবা দেওয়া হয়। অনেক সময় গভীর রাতেও ঘুম থেকে উঠে সন্তান প্রসব করাতে হয় বলে জানালেন প্যারামেডিক রেবেনা আক্তার ও সিপু মজুমদার।
উপসহকারী কমিউনিটি চিকিৎসা কর্মকর্তা আবদুল মোতালেব বলেন, ২০১৪ সালের ২৩ জুলাই থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রেটিতে প্রসূতি মায়েদের সন্তান প্রসব শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৯০০ নবজাতকের জন্ম হয়েছে এখানে। এর মধ্যে গত ডিসেম্বর মাসেই জন্ম হয়েছে ১১৪ শিশুর।
স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে জানানো হয়, প্রসূতি স্বাস্থ্যসেবায় এই কেন্দ্রের সফলতার খবর শুনে পার্শ্ববর্তী কিছু ইউনিয়নেও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে একই ধরনের সেবা চালু করার জন্য স্থানীয় চেয়ারম্যানরা ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া এই কার্যক্রমের কথা জেনে ইতিমধ্যে তুরস্ক ও মিসরের একজন করে প্রতিনিধি কেন্দ্রটি পরিদর্শন করে গেছেন।
চেয়ারম্যান এম এ জলিল বলেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি সেবামূলক অনেক কাজই করেছেন। কিন্তু নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যে ব্যবস্থা করতে পেরেছেন, সেটি জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সেবা বলে মনে হয় তাঁর। প্রতিটি নবজাতক শিশুর জন্মের পর এক সেট নতুন জামা ও একটি তোয়ালের ব্যবস্থা করেন তিনি।
জলিল সাহেব জানালেন, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সেবাকেন্দ্রটির জন্য সাধ্যমতো সহায়তা করা হয়। ওষুধপথ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকেও ভালো সহায়তা পেয়েছেন। তবে তাঁর ইচ্ছা একটি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মোস্তফা কামাল বলেন, দুর্গাপুর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রটি সারা দেশের জন্য একটি মডেল হিসেবে ইতিমধ্যে পরিচিতি পেয়েছে। উচ্চ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তাও এরই মধ্যে এ সফলতা দেখে গেছেন। একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইচ্ছা করলে কী না করতে পারেন, এম এ জলিল তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
No comments