বঙ্গবন্ধুর অবমাননা by ডক্টর তুহিন মালিক
এক. এবার
আওয়ামী লীগের এক এমপির হাতেই চরমভাবে অসম্মানিত হতে হলো বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমানের ছবিকে। চট্টগ্রাম-১১ আসনের সংসদ সদস্য এম এ লতিফকে
বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃত করার অভিযোগে ‘পাকিস্তানের প্রেতাত্মা’ বলে দাবি
করেছে আওয়ামী লীগ। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করার হুঁশিয়ারি দিয়ে
এমপি লতিফের ছবিতে জুতা ও থুতু নিক্ষেপ করেছে আওয়ামী লীগের বিক্ষুব্ধ
নেতা-কর্মীরা। এম এ লতিফের সংসদ সদস্য পদ খারিজের দাবিতে তারা চট্টগ্রাম
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে।
এমপি লতিফের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি তার নিজের ছবির উপর বঙ্গবন্ধুর মাথা
প্রতিস্থাপন করে নগরে অসংখ্য ফেস্টুন ও ব্যানার টাঙিয়ে গত শনিবার
প্রধানমন্ত্রীকে চট্টগ্রাম সফরে অভিনন্দন জানান। এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমানের শারীরিক কাঠামো বিকৃতির অভিযোগ উঠেছে। আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম
মহানগর সভাপতি সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর অভিযোগ ফেস্টুনের ওই ছবির
মাথার অংশ বঙ্গবন্ধুর। কিন্তু মাথা থেকে পা পর্যন্ত শারীরিক কাঠামো সংসদ
সদস্য লতিফের।...এটি আইনগত দ-নীয় অপরাধ। জাতির পিতাকে নিয়ে লতিফ
ঠাট্টা-মশকরা করেছে।’ বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নেয়া থানা আওয়ামী লীগের
সহসভাপতি বলেন ‘এম এ লতিফ আমাদের দলের এমপি... তবে তিনি জামায়াতের
অনুসারী।...তিনি পাকিস্তানের পোশাক পরিধান করেন। তিনি সেই পোশাকেই
বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করেছেন।’ আওয়ামী লীগের আরেক নেতা হাসান মনসুর বলেন
‘লতিফ পাকিস্তানি ভাবধারায় বঙ্গবন্ধুকে পরিচিত করার চেষ্টা করে সংবিধানকে
বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে।’ অন্যদিকে ছবি বিকৃতি করার অভিযোগ সম্পর্কে এমপি
লতিফ পাল্টা অভিযোগ করে বলেন যে ‘আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি ও
সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। তারই লোকজন
বঙ্গবন্ধুর বিকৃত ছবি দিয়ে আমাকে হেয় করার চেষ্টা করছেন।’ বঙ্গবন্ধুর ছবি
বিকৃতির অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ দুটোই এখন আওয়ামী লীগেরই দুই নেতার
বিরুদ্ধে। আর অভিযোগকারী দুজনও আওয়ামী লীগের এ দুই নেতাই। তবে বঙ্গবন্ধুর
আদর্শের এই দুই সৈনিকের যে-ই এ কাজটি করেছেন তা নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধুর
প্রতি চরম অবমাননাকর। একজন বিনাভোটের অবৈধ এমপির শরীরের উপর বঙ্গবন্ধুকে
ধারণ করে এবং বঙ্গবন্ধুর শরীরে পাকিস্তানি কাবুলি ও সালোয়ার পরিয়ে খোদ
আওয়ামী লীগ তো বটেই পুরো বাঙালি জাতিকেও চরম অসম্মানিত করে দিয়েছে। মাঝখান
থেকে সব দোষ জামায়াতের কাঁধে ঠেলে দিয়ে এমপি লতিফকে ‘জামায়াতের অনুসারী’ ও
তার বিরুদ্ধে ‘জামায়াত সংশ্লিষ্টতার’ অভিযোগ এনে তাকে দল ও সংসদ থেকে
বহিষ্কারের দাবি করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের মধ্যে যে-ই যখন দুই নম্বরী করুক
না কেন, ধরা খেলেই সে হয়ে যায় ‘জামায়াত অনুসারী’ বা ‘অনুপ্রবেশকারী’! আর
আওয়ামী লীগের মধ্যে জামায়াতের এত অনুসারী ও অনুপ্রবেশকারী যদি থেকেই থাকে
তাহলে তাদের চিহ্নিত করে মুখোশ উন্মোচন করা হয় না কেন? তা না হলে তো সেই
বিখ্যাত উক্তিটি আবারও প্রমাণিত হবে, ‘আওয়ামী লীগ এমন এক আজব মেশিন, যার
একদিক দিয়ে রাজাকার ঢুকাবেন, আরেক পাশ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বের হয়ে আসবে।’ আর
এখন এ ঘটনার পর তো দেখি উল্টা ঘটনাও ঘটছে যে, ‘একদিক দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা
ঢুকাবেন, আরেক পাশ দিয়ে রাজাকার বের হয়ে আসবে।’
দুই. সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের সঙ্গে অত্যন্ত নাজুক এক পরিস্থিতির পাড়ি দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বর্বর পাকিস্তানিদের ক্রমাগত কটাক্ষ যখন চরমে ঠিক তখনই ঢাকায় পাকিস্তানি দূতাবাসের পলিটিক্যাল সেক্রেটারিকে গত মাসে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে ইসলামাবাদে বাংলাদেশ দূতাবাসের পলিটিক্যাল কাউন্সিলরকেও পাকিস্তানিরা সে দেশ থেকে বহিষ্কার করে। গত কদিন আগে পাকিস্তানি দূতাবাসের একজন জুনিয়র অফিসারকে আমাদের পুলিশ গ্রেপ্তার করে দূতাবাসের কাছে হস্তান্তর করে। সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানে বাংলাদেশ দূতাবাসের এক জুনিয়র কর্মকর্তা নিখোঁজ হয়ে পরে ফিরে আসে। এ নিয়ে চরম এক অবস্থা! যেন কূটনৈতিক যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। আর এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শরীরে সেই হানাদার পাকিস্তানিদের পোশাক কাবুলি ও সালোয়ার পরিয়ে ছবি বিকৃত করে সড়ক-মহাসড়কে টাঙিয়ে দেয়া হলো খোদ আওয়ামী লীগ থেকেই! তাও আবার এই বিকৃত ছবির ফেস্টুন ও ব্যানার টাঙিয়ে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু কন্যাকেই অভিনন্দন জানানো হয়েছে। অথচ এর অণু পরিমাণ ‘অপরাধ’-এর অভিযোগও যদি দেশের কোন সাধারণ মানুষ কিংবা কোন ছাত্র, শিক্ষক বা বিরোধী দলের কোন কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে উঠতো, তাহলে দেশে এতক্ষণে ঠিকই লঙ্কাকা- বাঁধিয়ে দিতো ক্ষমতাসীন দলের গুণগ্রাহীরা। রাজনৈতিক সমালোচনাকে নিমেষের মধ্যেই রাষ্ট্রদ্রোহিতায় রূপান্তর ঘটিয়ে ডিজিটাল গতিতে একাধিক রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়ে যেত দেশের একাধিক জেলায়। শিক্ষক হলে তিনি পরক্ষণেই চাকরি হারাতেন। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে ধরে নিয়ে আসা হতো। সিন্ডিকেট জরুরি সভা করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে বহিষ্কার করতো। ছাত্র হলে তাকে চিরতরে ছাত্রত্ব হারাতে হতো। বিরোধী দলের নেতা-কর্মী হলে তার বাড়ি পর্যন্ত ঘেরাও করা হতো। আর সবশেষে বিনা চিকিৎসায় অনন্তকাল ধরে জেলের ভাত খেতে হতো। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, বঙ্গবন্ধুর সুবিধাভোগীরাই যেন বঙ্গবন্ধুর অসম্মান করার একমাত্র হকদার। তাদের আবার বিচার কিসের? আর এমপি হলে তো নির্বোধ শিশুকে পর্যন্ত পাখি শিকারের মতো গুলি করলেও কোন বিচার হয় না। এখন এ নিয়ে দলীয় কোন্দল আর পাল্টাপাল্টি যত অভিযোগই আসুক না কেন, দিন শেষে কিন্তু এটাও যথারীতি হয়ে যাবে ‘সাত খুন মাফ।’
তিন. প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান করার অপরাধে গত বছর এক তরুণকে জরিমানাসহ সাত বছরের সশ্রম কারাদ- দিয়েছিল সাইবার অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আসামি তন্ময় মজুমদারের অপরাধ ছিল সে প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি গান রচনা করে তা প্রচার করে। যা তথ্য ও প্রযুক্তি আইনে মারাত্মক অপরাধ। এখন আবার এ ধরনের অপরাধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন সংশোধন করে ন্যূনতম ৭ বছর ও সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদ-ের বিধান করা হয়েছে। তাছাড়া ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে সংবিধানে ৭(ক) নামক নতুন এক অনুচ্ছেদ যোগ দিয়ে এই ধরনের অপরাধকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা নামকরণ করে মৃত্যুদ-ের শাস্তি রাখা হয়। কিন্তু এসব কঠিন কঠিন আইন আর তার কঠিনতম শাস্তিগুলোর প্রয়োগ যেন শুধুমাত্র সরকারের ভুলগুলো ধরিয়ে দেয়া সমালোচকদের জন্যই বরাদ্দকৃত! আর যারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নিত্যদিন বাণিজ্য করে, বঙ্গবন্ধুর নাম বিক্রি করে সংসার চালায়, যারা বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করার পরিবর্তে উল্টা বঙ্গবন্ধুকেই নিজের শরীরে ধারণ করায়, তারাই বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত অবমাননাকারী নয় কি? মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে ব্যবহার করে যারা নিত্যদিন বাণিজ্যিক প্রসারে ব্যস্ত তারাই আজ বঙ্গবন্ধুকে অতিমানব বানাতে গিয়ে পাকিস্তানি কাবুলি পরিয়ে ছেড়েছে। এ অবিবেচকরাই বঙ্গবন্ধুকে তার শারীরিক কাঠামো আর মুজিব কোটে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধু এসব চেতনা ব্যবসায়ী ছাড়াই ইতিহাসের মহানায়ক হয়েছিলেন। আর স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্র পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর ব্যর্থতা নিয়ে তার সমালোচনা করাকে যারা রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে ভয় দেখায় তারাই প্রকৃত অবমাননাকারী। বঙ্গবন্ধুর শারীরিক কাঠামো পরিবর্তন করলে কিংবা তার রাজনৈতিক জীবনের সমালোচনা করলে বঙ্গবন্ধু কখনও খাটো হওয়ার নন। বঙ্গবন্ধু তার শারীরিক কাঠামো বা তার সমালোচকদের চাইতে আরও বিশাল।
চার. আমাদের দেশে প্রতিহিংসা বাস্তবায়নের মারাত্মক একটি অস্ত্রের নাম হচ্ছে মিথ্যা মামলা। আর এক্ষেত্রে যে আইন যত বেশি কঠোর, তার অপব্যবহারও তত বেশিই প্রকট। বিগত সময়ে এদেশে নারী নির্যাতন আইনের জামিন অযোগ্যতা ও শাস্তির কঠোরতা এত বেশিই ছিল যে, সমাজে এ আইনে মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের বহু অভিযোগ রয়েছে। আর এদেশে ক্রসফায়ারের ভয়ে তো প্রতিপক্ষকে সর্বস্ব দিয়ে দিতেও কেউ কণ্ঠাবোধ করে না। তবে এখন নতুন করে যোগ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীকে অবমাননার ভয়। বর্তমানে এদেশে একে অন্যকে ঘায়েল করতে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু বা প্রধানমন্ত্রীকে অবমাননা করে উড়ো চিঠি বা লিফলেট ছেড়ে দিলেই কাজ হয়ে যায়। ফেসবুকে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে এরকম ভুয়া পোস্ট দেয়ার অনেক ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে। এখন এটা এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে যে দলীয় পদ-পদবি থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর কান ভারি করার জন্য এখন এটাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠতম অস্ত্র। কোনভাবে কাউকে এই তকমা দিলে পারলেই যেন কেল্লাফতে। আর এগুলোর অপব্যবহার এমন এক পর্যায়ে পৌছে গেছে যে, তা থেকে দলের মন্ত্রী-এমপিরাও নিষ্কৃতি পাচ্ছে না। রাজনীতির ময়দানে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করতে না পারলে চেতনা অবমাননার অভিযোগে ‘থুতু নিক্ষেপ’ থেকে শুরু করে ‘জুতা পেটা’ দেয়াও এখন বেশ সম্ভব। এ এক আজব আবেগী খেলা! আর অদ্ভুত এক আগুনের খেলা! প্রতিপক্ষের ঘরে নিত্যদিন আগুন লাগাতে লাগাতে সেই আগুনেই এখন পুড়ছে ক্ষমতাসীনের হাত। আগুনের এ লেলিহান খেলা বন্ধ করতে হবে নিজেদের স্বর্থেই। বঙ্গবন্ধুর শারীরিক কাঠামো বিকৃতির অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিচার চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের গণতন্ত্র বিকৃতির দায়ে নিজেদের কৃতকর্মকে স্মরণ করতে হবে।
লেখক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
দুই. সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের সঙ্গে অত্যন্ত নাজুক এক পরিস্থিতির পাড়ি দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বর্বর পাকিস্তানিদের ক্রমাগত কটাক্ষ যখন চরমে ঠিক তখনই ঢাকায় পাকিস্তানি দূতাবাসের পলিটিক্যাল সেক্রেটারিকে গত মাসে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে ইসলামাবাদে বাংলাদেশ দূতাবাসের পলিটিক্যাল কাউন্সিলরকেও পাকিস্তানিরা সে দেশ থেকে বহিষ্কার করে। গত কদিন আগে পাকিস্তানি দূতাবাসের একজন জুনিয়র অফিসারকে আমাদের পুলিশ গ্রেপ্তার করে দূতাবাসের কাছে হস্তান্তর করে। সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানে বাংলাদেশ দূতাবাসের এক জুনিয়র কর্মকর্তা নিখোঁজ হয়ে পরে ফিরে আসে। এ নিয়ে চরম এক অবস্থা! যেন কূটনৈতিক যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। আর এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শরীরে সেই হানাদার পাকিস্তানিদের পোশাক কাবুলি ও সালোয়ার পরিয়ে ছবি বিকৃত করে সড়ক-মহাসড়কে টাঙিয়ে দেয়া হলো খোদ আওয়ামী লীগ থেকেই! তাও আবার এই বিকৃত ছবির ফেস্টুন ও ব্যানার টাঙিয়ে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু কন্যাকেই অভিনন্দন জানানো হয়েছে। অথচ এর অণু পরিমাণ ‘অপরাধ’-এর অভিযোগও যদি দেশের কোন সাধারণ মানুষ কিংবা কোন ছাত্র, শিক্ষক বা বিরোধী দলের কোন কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে উঠতো, তাহলে দেশে এতক্ষণে ঠিকই লঙ্কাকা- বাঁধিয়ে দিতো ক্ষমতাসীন দলের গুণগ্রাহীরা। রাজনৈতিক সমালোচনাকে নিমেষের মধ্যেই রাষ্ট্রদ্রোহিতায় রূপান্তর ঘটিয়ে ডিজিটাল গতিতে একাধিক রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়ে যেত দেশের একাধিক জেলায়। শিক্ষক হলে তিনি পরক্ষণেই চাকরি হারাতেন। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে ধরে নিয়ে আসা হতো। সিন্ডিকেট জরুরি সভা করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে বহিষ্কার করতো। ছাত্র হলে তাকে চিরতরে ছাত্রত্ব হারাতে হতো। বিরোধী দলের নেতা-কর্মী হলে তার বাড়ি পর্যন্ত ঘেরাও করা হতো। আর সবশেষে বিনা চিকিৎসায় অনন্তকাল ধরে জেলের ভাত খেতে হতো। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, বঙ্গবন্ধুর সুবিধাভোগীরাই যেন বঙ্গবন্ধুর অসম্মান করার একমাত্র হকদার। তাদের আবার বিচার কিসের? আর এমপি হলে তো নির্বোধ শিশুকে পর্যন্ত পাখি শিকারের মতো গুলি করলেও কোন বিচার হয় না। এখন এ নিয়ে দলীয় কোন্দল আর পাল্টাপাল্টি যত অভিযোগই আসুক না কেন, দিন শেষে কিন্তু এটাও যথারীতি হয়ে যাবে ‘সাত খুন মাফ।’
তিন. প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান করার অপরাধে গত বছর এক তরুণকে জরিমানাসহ সাত বছরের সশ্রম কারাদ- দিয়েছিল সাইবার অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আসামি তন্ময় মজুমদারের অপরাধ ছিল সে প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি গান রচনা করে তা প্রচার করে। যা তথ্য ও প্রযুক্তি আইনে মারাত্মক অপরাধ। এখন আবার এ ধরনের অপরাধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন সংশোধন করে ন্যূনতম ৭ বছর ও সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদ-ের বিধান করা হয়েছে। তাছাড়া ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে সংবিধানে ৭(ক) নামক নতুন এক অনুচ্ছেদ যোগ দিয়ে এই ধরনের অপরাধকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা নামকরণ করে মৃত্যুদ-ের শাস্তি রাখা হয়। কিন্তু এসব কঠিন কঠিন আইন আর তার কঠিনতম শাস্তিগুলোর প্রয়োগ যেন শুধুমাত্র সরকারের ভুলগুলো ধরিয়ে দেয়া সমালোচকদের জন্যই বরাদ্দকৃত! আর যারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নিত্যদিন বাণিজ্য করে, বঙ্গবন্ধুর নাম বিক্রি করে সংসার চালায়, যারা বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করার পরিবর্তে উল্টা বঙ্গবন্ধুকেই নিজের শরীরে ধারণ করায়, তারাই বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত অবমাননাকারী নয় কি? মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে ব্যবহার করে যারা নিত্যদিন বাণিজ্যিক প্রসারে ব্যস্ত তারাই আজ বঙ্গবন্ধুকে অতিমানব বানাতে গিয়ে পাকিস্তানি কাবুলি পরিয়ে ছেড়েছে। এ অবিবেচকরাই বঙ্গবন্ধুকে তার শারীরিক কাঠামো আর মুজিব কোটে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধু এসব চেতনা ব্যবসায়ী ছাড়াই ইতিহাসের মহানায়ক হয়েছিলেন। আর স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্র পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর ব্যর্থতা নিয়ে তার সমালোচনা করাকে যারা রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে ভয় দেখায় তারাই প্রকৃত অবমাননাকারী। বঙ্গবন্ধুর শারীরিক কাঠামো পরিবর্তন করলে কিংবা তার রাজনৈতিক জীবনের সমালোচনা করলে বঙ্গবন্ধু কখনও খাটো হওয়ার নন। বঙ্গবন্ধু তার শারীরিক কাঠামো বা তার সমালোচকদের চাইতে আরও বিশাল।
চার. আমাদের দেশে প্রতিহিংসা বাস্তবায়নের মারাত্মক একটি অস্ত্রের নাম হচ্ছে মিথ্যা মামলা। আর এক্ষেত্রে যে আইন যত বেশি কঠোর, তার অপব্যবহারও তত বেশিই প্রকট। বিগত সময়ে এদেশে নারী নির্যাতন আইনের জামিন অযোগ্যতা ও শাস্তির কঠোরতা এত বেশিই ছিল যে, সমাজে এ আইনে মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের বহু অভিযোগ রয়েছে। আর এদেশে ক্রসফায়ারের ভয়ে তো প্রতিপক্ষকে সর্বস্ব দিয়ে দিতেও কেউ কণ্ঠাবোধ করে না। তবে এখন নতুন করে যোগ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীকে অবমাননার ভয়। বর্তমানে এদেশে একে অন্যকে ঘায়েল করতে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু বা প্রধানমন্ত্রীকে অবমাননা করে উড়ো চিঠি বা লিফলেট ছেড়ে দিলেই কাজ হয়ে যায়। ফেসবুকে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে এরকম ভুয়া পোস্ট দেয়ার অনেক ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে। এখন এটা এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে যে দলীয় পদ-পদবি থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর কান ভারি করার জন্য এখন এটাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠতম অস্ত্র। কোনভাবে কাউকে এই তকমা দিলে পারলেই যেন কেল্লাফতে। আর এগুলোর অপব্যবহার এমন এক পর্যায়ে পৌছে গেছে যে, তা থেকে দলের মন্ত্রী-এমপিরাও নিষ্কৃতি পাচ্ছে না। রাজনীতির ময়দানে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করতে না পারলে চেতনা অবমাননার অভিযোগে ‘থুতু নিক্ষেপ’ থেকে শুরু করে ‘জুতা পেটা’ দেয়াও এখন বেশ সম্ভব। এ এক আজব আবেগী খেলা! আর অদ্ভুত এক আগুনের খেলা! প্রতিপক্ষের ঘরে নিত্যদিন আগুন লাগাতে লাগাতে সেই আগুনেই এখন পুড়ছে ক্ষমতাসীনের হাত। আগুনের এ লেলিহান খেলা বন্ধ করতে হবে নিজেদের স্বর্থেই। বঙ্গবন্ধুর শারীরিক কাঠামো বিকৃতির অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিচার চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের গণতন্ত্র বিকৃতির দায়ে নিজেদের কৃতকর্মকে স্মরণ করতে হবে।
লেখক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
No comments