শুধুই লাশ দাফন নয় by আব্দুল আলীম
আঞ্জুমানে
মুফিদুল ইসলাম। শতবর্ষী এ প্রতিষ্ঠানের নাম শুনলেই ভেসে ওঠে লাশ দাফনের
দৃশ্য। বেওয়ারিশ লাশ দাফন প্রধান কাজ হলেও এখন প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের
কর্মকাণ্ড করেছে আরও বিস্তৃত। সেবাধর্মী নানা কাজে জড়িয়ে রয়েছে আঞ্জুমানে
মুফিদুল ইসলাম। এ বিরাট কর্মযজ্ঞ প্রতিষ্ঠানটি চালায় মানুষের দানের ওপর ভর
করে । এই দানবীরদের অনেকেই আবার নিজের নামটুকুও প্রকাশ করতে ইচ্ছুক নন।
১৯০৫ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম। তৎকালীন সময়ে বাংলার পিছিয়ে পড়া মুসলিমদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা করার উদ্দেশে এটি প্রতিষ্ঠা করেন সুরাটের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শেঠ ইব্রাহিম মোহাম্মদ ডুপ্লে। সোমবার রাজধানীর ফকিরেরপুল জমিদারবাড়ীর অস্থায়ী কার্যালয়ে কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ইলিয়াস আহমেদের সঙ্গে। তার জবানিতে উঠে আসে প্রতিষ্ঠানটির অতীত-বর্তমান। আঞ্জুমানের প্রতিষ্ঠাতা শেঠ ইব্রাহিম মোহাম্মদ ডুপ্লে সুরাটের অধিবাসী হলেও ব্যবসা করতেন কলকাতায়। প্রতিষ্ঠার সময় তার সঙ্গে ছিলেন মৌলভী মোহাম্মদ ঈসা খান, মৌলভী মোহাম্মদ হেদায়েত হোসেন, মুন্সী চৌধুরী আমানুল্লাহসহ কয়েকজন বিশিষ্ট মুসলিম ব্যক্তিত্ব। প্রতিষ্ঠার পর পিছিয়ে পড়া সংখ্যালঘু মুসলমানের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠাকে তখন মূল লক্ষ্য হিসেবে ধরে নেয়া হয়। পরে ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় নিহত মুসলমানদের লাশ রাস্তায় পড়ে থাকা, নদীতে ভাসা ও মাটিতে পুঁতে রাখতে দেখে ডুপ্লে অত্যন্ত ব্যথিত হন। তিনি তৎকালীন প্রশাসনের কাছে আবেদন জানান যেন এসব বেওয়ারিশ লাশ ইসলামী শরীয়াহ্ মতে কাফন-দাফনের দায়িত্ব আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামকে দেয়া হয়। প্রশাসন এ দাবিতে সাড়া না দিলে তারা তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। পরে প্রশাসন ওই আবেদনে সাড়া দেয়। এর পর থেকে সংস্থাটি বেওয়ারিশ লাশ দাফন শুরু করে। যা এখন পর্যন্ত করে চলছে।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ঢাকায় তার শাখা খোলে। কলকাতা আঞ্জুমানের তৎকালীন প্রশাসনিক কর্মকর্তা এসএম সালাহ উদ্দিন প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করেন। পরে ১৯৫০ সালে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা পায় প্রতিষ্ঠানটি। এখন ঢাকাসহ বাংলাদেশে মোট ৪৩টি জেলায় শাখা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশব্যাপী বিস্তৃতি লাভ করেছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। ইলিয়াস আহমেদ জানান, আঞ্জুমান শুধু মরদেহ দাফনই করে না। একই সঙ্গে অন্যান্য সেবামূলক কাজও করে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে- ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, দাফনসেবা প্রকল্প, চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম, মানবসেবামূলক কার্যক্রম, দুর্যোগকালীন সময়ে সহায়তা প্রদান, শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রম। দাতাদের সহযোগিতা ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছে স্কুল, কলেজ, এতিমখানা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে আঞ্জুমান পরিচালনা করছে ২টি জুনিয়র হাইস্কুল। এর একটি নয়াটোলাতে রেহানা মাহবুব জুনিয়র হাইস্কুল অপরটি গেণ্ডারিয়ায় আঞ্জুমান জামিলুর রহমান হাইস্কুল। এছাড়া গোপীবাগে টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটসহ মোট ২টি টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট রয়েছে আঞ্জুমানের। খুব শিগগিরই শ্যামলীতে একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটেরও নির্মাণ কাজ শেষ হবে। এছাড়া ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদাভাবে ঢাকার গেণ্ডারিয়া, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারে রয়েছে মোট ৮টি এতিমখানা। এর মধ্যে রানা প্লাজা ধসের পর ক্ষতিগ্রস্তদের ছেলে-মেয়ে ও সাভার এলাকার অন্যান্য গরিবদের জন্য প্রতিষ্ঠা করে সাভার এতিমখানা।
এমন সব জনকল্যাণমুখী কার্যক্রম পরিচালনার কারণে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা ও আর্থিক সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন সমাজকর্মী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। দল-মত নির্বিশেষে সকলেই প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে জনকল্যাণে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। এই প্রতিষ্ঠানের অনেক দাতা রয়েছেন যারা এই প্রতিষ্ঠানে বিপুল অঙ্কের টাকা দান করেন। কিন্তু সেটা প্রচার করতে চান না। আঞ্জুমানও তাদের প্রতিশ্রুতি মতো প্রচার বিমুখ এই লোকগুলোর নাম প্রকাশ করেন না। আবার যারা নিজেদের দানের বিষয়টি প্রকাশ করতে চান তাদের দানের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ দাতাদের তালিকায় লিপিবদ্ধ করেন।
প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক বলেন, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রতিমাসে বিজেএমইএ এর পক্ষ থেকে ১ লাখ টাকা অনুদান দেয়া হয়। যদিও রানাপ্লাজা ধ্বসের পর থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা করার জন্য বিজেএমইএ এই অনুদান দিয়ে থাকে। এছাড়া বাংলাদেশ সরকারের এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের জন্য বাৎসরিকভাবে দেয়া হয় ৫৮ লাখ টাকা। বিপুল পরিমাণ খরচ মেটানোর জন্য বড় বড় প্রতিষ্ঠানেরও দারস্থ হয় আঞ্জুমানের কর্মকর্তারা। এছাড়া জাকাতের টাকা গ্রহণ করে প্রতিষ্ঠানটি। একই সঙ্গে ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে মানুষের দান করা কয়েকটি দোকান রয়েছে। যার ভাড়ার টাকা উঠিয়েও কিছু টাকা হয়। এছাড়া, কাকরাইলের প্রধান কার্যালয়ে তৈরি হচ্ছে আঞ্জুমান জামিলুর রহমান (জেআর) টাওয়ার। বাণিজ্যিক এই ভবনে নিজেদের অফিস ছাড়াও বাকি অংশ ভাড়া দিয়ে প্রতিষ্ঠানের আয় বাড়ানো হবে। প্রতিষ্ঠানটি ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল ইউনিটের মাধ্যমে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকে দরিদ্র মানুষদের। ঢাকা মহানগরীতে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্য ফ্রি-অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস দেয়। দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে এ সংস্থার সদস্যগণ কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সংস্থাটি বেওয়ারিশ লাশ দাফন এবং দরিদ্র মানুষের লাশ দাফনের পাশাপাশি নির্ধারিত অর্থের বিনিময়ে পরিচালনা করছে সামর্থ্যবান মানুষের লাশ দাফন-কাফনের কাজ। দাফনসেবা প্রকল্পের আওতায় ধনিক শ্রেণির মানুষের জন্যও সেবার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাকরাইল সেবাকেন্দ্রে অলাভজনকভাবে লাশের গোসল, কাফন পরানো এবং কবরস্থানে লাশ পরিবহনের ব্যবস্থা করে থাকে। দারিদ্র্যবিমোচন প্রকল্প নামে নতুন পকল্প গ্রহণের মাধ্যমে সংস্থা ইতিমধ্যে তার শাখা কার্যালয়গুলোর কর্ম এলাকাধীন দরিদ্র মানুষের আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ছাগল, গরু, সেলাই মেশিন, রিকশা, রিকশাভ্যান, ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য পুঁজি ইত্যাদি প্রদান করে থাকে। এতিম ও দরিদ্র বালকদের বিনামূল্যে সুন্নতে খাৎনা করায় ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল ইউনিটের মাধ্যমে। বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ সামগ্রী, শীতার্তদের জন্য গরম পোশাক এবং অন্যান্য দুর্যোগে দুর্গতদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে সংস্থার রিলিফ কমিটি কাজ করে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির সদস্যদের মাধ্যমে ঈদে নতুন কাপড় বিতরণ করে থাকে। আঞ্জুমান ৩ টি কেন্দ্রের মাধ্যমে অ্যাম্বুলেন্স, লাশবাহী গাড়ির সেবা দিয়ে থাকে। এর মধ্যে ১টি কাকরাইলে, ১টি পুরনো ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় এবং ১ টি মুগদাপড়ায়।
আঞ্জুমানের রয়েছে দুস্থ ও বিধবা মহিলাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ও সাহায্য প্রদান প্রকল্প। দুস্থ, গরিব ও বয়স্কদের মাসিক ভাতা প্রদান এবং অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতা প্রদান করে প্রতিষ্ঠানটি। দুর্যোগকালীন সময়ে দুর্গত এলাকায় ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা ও চিকিৎসাসেবা প্রদান করে আঞ্জুমান। শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য গরিব ও নিঃস্বদের জন্য কোর্স পরিচালনা করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। এতিম ও দুস্থ শিশুদের জন্য স্বতন্ত্র স্কুল পরিচালনা, এতিম ও দুস্থ ছেলেমেয়েদের স্বনির্ভরাতা অর্জনের লক্ষ্যে কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থার আওতায় টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট পরিচালনা করে। অসহায়, এতিম ও মেধাবী ছাত্র ও ছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার জন্য সহায়তা প্রদান করেন। তবে যারা আঞ্জুমানের এতিমখানায় পড়ালেখা করে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছে অথবা ডিপ্লোমা পাস করেছে, কেবল তাদের জন্যই এই উচ্চ শিক্ষার বৃত্তি নির্ধারিত। বাইরের কাউকে এ বৃত্তি দেয়া হয় না।
আঞ্জুমানের সেবামূলক কাজের স্বীকৃতি এসেছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায় থেকে। ১৯৮৪ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার লাভ করে প্রতিষ্ঠানটি। একই সঙ্গে ২০০৪ সালে লাভ করে ডা. ইব্রাহিম স্মৃতি স্বর্ণপদক ও রফিকুল ইসলাম ব্যাংকিং অ্যাওয়ার্ড। পরে আন্তার্জাতিকভাবে আমেরিকার হিল্টন হিউম্যানিটেরিয়ান প্রাইজের জন্য প্রাথমিকভাবে মনোনয়ন লাভ করে। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পুরস্কারপ্রাপ্ত হয় আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। এর মধ্যে রয়েছে- নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ একাডেমি অ্যাওয়ার্ড, কাজী আজাহার আলী স্মৃতি স্বর্ণপদক, কর্নেল মুজিব অ্যাওয়ার্ড এবং ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ফোর্থ ফাউন্ডেশন এনিভার্সারি-২০০৭ অ্যাওয়ার্ড।
১৯০৫ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম। তৎকালীন সময়ে বাংলার পিছিয়ে পড়া মুসলিমদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা করার উদ্দেশে এটি প্রতিষ্ঠা করেন সুরাটের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শেঠ ইব্রাহিম মোহাম্মদ ডুপ্লে। সোমবার রাজধানীর ফকিরেরপুল জমিদারবাড়ীর অস্থায়ী কার্যালয়ে কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ইলিয়াস আহমেদের সঙ্গে। তার জবানিতে উঠে আসে প্রতিষ্ঠানটির অতীত-বর্তমান। আঞ্জুমানের প্রতিষ্ঠাতা শেঠ ইব্রাহিম মোহাম্মদ ডুপ্লে সুরাটের অধিবাসী হলেও ব্যবসা করতেন কলকাতায়। প্রতিষ্ঠার সময় তার সঙ্গে ছিলেন মৌলভী মোহাম্মদ ঈসা খান, মৌলভী মোহাম্মদ হেদায়েত হোসেন, মুন্সী চৌধুরী আমানুল্লাহসহ কয়েকজন বিশিষ্ট মুসলিম ব্যক্তিত্ব। প্রতিষ্ঠার পর পিছিয়ে পড়া সংখ্যালঘু মুসলমানের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠাকে তখন মূল লক্ষ্য হিসেবে ধরে নেয়া হয়। পরে ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় নিহত মুসলমানদের লাশ রাস্তায় পড়ে থাকা, নদীতে ভাসা ও মাটিতে পুঁতে রাখতে দেখে ডুপ্লে অত্যন্ত ব্যথিত হন। তিনি তৎকালীন প্রশাসনের কাছে আবেদন জানান যেন এসব বেওয়ারিশ লাশ ইসলামী শরীয়াহ্ মতে কাফন-দাফনের দায়িত্ব আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামকে দেয়া হয়। প্রশাসন এ দাবিতে সাড়া না দিলে তারা তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। পরে প্রশাসন ওই আবেদনে সাড়া দেয়। এর পর থেকে সংস্থাটি বেওয়ারিশ লাশ দাফন শুরু করে। যা এখন পর্যন্ত করে চলছে।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ঢাকায় তার শাখা খোলে। কলকাতা আঞ্জুমানের তৎকালীন প্রশাসনিক কর্মকর্তা এসএম সালাহ উদ্দিন প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করেন। পরে ১৯৫০ সালে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা পায় প্রতিষ্ঠানটি। এখন ঢাকাসহ বাংলাদেশে মোট ৪৩টি জেলায় শাখা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশব্যাপী বিস্তৃতি লাভ করেছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। ইলিয়াস আহমেদ জানান, আঞ্জুমান শুধু মরদেহ দাফনই করে না। একই সঙ্গে অন্যান্য সেবামূলক কাজও করে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে- ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, দাফনসেবা প্রকল্প, চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম, মানবসেবামূলক কার্যক্রম, দুর্যোগকালীন সময়ে সহায়তা প্রদান, শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রম। দাতাদের সহযোগিতা ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছে স্কুল, কলেজ, এতিমখানা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে আঞ্জুমান পরিচালনা করছে ২টি জুনিয়র হাইস্কুল। এর একটি নয়াটোলাতে রেহানা মাহবুব জুনিয়র হাইস্কুল অপরটি গেণ্ডারিয়ায় আঞ্জুমান জামিলুর রহমান হাইস্কুল। এছাড়া গোপীবাগে টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটসহ মোট ২টি টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট রয়েছে আঞ্জুমানের। খুব শিগগিরই শ্যামলীতে একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটেরও নির্মাণ কাজ শেষ হবে। এছাড়া ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদাভাবে ঢাকার গেণ্ডারিয়া, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারে রয়েছে মোট ৮টি এতিমখানা। এর মধ্যে রানা প্লাজা ধসের পর ক্ষতিগ্রস্তদের ছেলে-মেয়ে ও সাভার এলাকার অন্যান্য গরিবদের জন্য প্রতিষ্ঠা করে সাভার এতিমখানা।
এমন সব জনকল্যাণমুখী কার্যক্রম পরিচালনার কারণে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা ও আর্থিক সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন সমাজকর্মী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। দল-মত নির্বিশেষে সকলেই প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে জনকল্যাণে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। এই প্রতিষ্ঠানের অনেক দাতা রয়েছেন যারা এই প্রতিষ্ঠানে বিপুল অঙ্কের টাকা দান করেন। কিন্তু সেটা প্রচার করতে চান না। আঞ্জুমানও তাদের প্রতিশ্রুতি মতো প্রচার বিমুখ এই লোকগুলোর নাম প্রকাশ করেন না। আবার যারা নিজেদের দানের বিষয়টি প্রকাশ করতে চান তাদের দানের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ দাতাদের তালিকায় লিপিবদ্ধ করেন।
প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক বলেন, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রতিমাসে বিজেএমইএ এর পক্ষ থেকে ১ লাখ টাকা অনুদান দেয়া হয়। যদিও রানাপ্লাজা ধ্বসের পর থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা করার জন্য বিজেএমইএ এই অনুদান দিয়ে থাকে। এছাড়া বাংলাদেশ সরকারের এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের জন্য বাৎসরিকভাবে দেয়া হয় ৫৮ লাখ টাকা। বিপুল পরিমাণ খরচ মেটানোর জন্য বড় বড় প্রতিষ্ঠানেরও দারস্থ হয় আঞ্জুমানের কর্মকর্তারা। এছাড়া জাকাতের টাকা গ্রহণ করে প্রতিষ্ঠানটি। একই সঙ্গে ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে মানুষের দান করা কয়েকটি দোকান রয়েছে। যার ভাড়ার টাকা উঠিয়েও কিছু টাকা হয়। এছাড়া, কাকরাইলের প্রধান কার্যালয়ে তৈরি হচ্ছে আঞ্জুমান জামিলুর রহমান (জেআর) টাওয়ার। বাণিজ্যিক এই ভবনে নিজেদের অফিস ছাড়াও বাকি অংশ ভাড়া দিয়ে প্রতিষ্ঠানের আয় বাড়ানো হবে। প্রতিষ্ঠানটি ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল ইউনিটের মাধ্যমে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকে দরিদ্র মানুষদের। ঢাকা মহানগরীতে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্য ফ্রি-অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস দেয়। দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে এ সংস্থার সদস্যগণ কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সংস্থাটি বেওয়ারিশ লাশ দাফন এবং দরিদ্র মানুষের লাশ দাফনের পাশাপাশি নির্ধারিত অর্থের বিনিময়ে পরিচালনা করছে সামর্থ্যবান মানুষের লাশ দাফন-কাফনের কাজ। দাফনসেবা প্রকল্পের আওতায় ধনিক শ্রেণির মানুষের জন্যও সেবার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাকরাইল সেবাকেন্দ্রে অলাভজনকভাবে লাশের গোসল, কাফন পরানো এবং কবরস্থানে লাশ পরিবহনের ব্যবস্থা করে থাকে। দারিদ্র্যবিমোচন প্রকল্প নামে নতুন পকল্প গ্রহণের মাধ্যমে সংস্থা ইতিমধ্যে তার শাখা কার্যালয়গুলোর কর্ম এলাকাধীন দরিদ্র মানুষের আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ছাগল, গরু, সেলাই মেশিন, রিকশা, রিকশাভ্যান, ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য পুঁজি ইত্যাদি প্রদান করে থাকে। এতিম ও দরিদ্র বালকদের বিনামূল্যে সুন্নতে খাৎনা করায় ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল ইউনিটের মাধ্যমে। বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ সামগ্রী, শীতার্তদের জন্য গরম পোশাক এবং অন্যান্য দুর্যোগে দুর্গতদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে সংস্থার রিলিফ কমিটি কাজ করে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির সদস্যদের মাধ্যমে ঈদে নতুন কাপড় বিতরণ করে থাকে। আঞ্জুমান ৩ টি কেন্দ্রের মাধ্যমে অ্যাম্বুলেন্স, লাশবাহী গাড়ির সেবা দিয়ে থাকে। এর মধ্যে ১টি কাকরাইলে, ১টি পুরনো ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় এবং ১ টি মুগদাপড়ায়।
আঞ্জুমানের রয়েছে দুস্থ ও বিধবা মহিলাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ও সাহায্য প্রদান প্রকল্প। দুস্থ, গরিব ও বয়স্কদের মাসিক ভাতা প্রদান এবং অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতা প্রদান করে প্রতিষ্ঠানটি। দুর্যোগকালীন সময়ে দুর্গত এলাকায় ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা ও চিকিৎসাসেবা প্রদান করে আঞ্জুমান। শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য গরিব ও নিঃস্বদের জন্য কোর্স পরিচালনা করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। এতিম ও দুস্থ শিশুদের জন্য স্বতন্ত্র স্কুল পরিচালনা, এতিম ও দুস্থ ছেলেমেয়েদের স্বনির্ভরাতা অর্জনের লক্ষ্যে কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থার আওতায় টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট পরিচালনা করে। অসহায়, এতিম ও মেধাবী ছাত্র ও ছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার জন্য সহায়তা প্রদান করেন। তবে যারা আঞ্জুমানের এতিমখানায় পড়ালেখা করে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছে অথবা ডিপ্লোমা পাস করেছে, কেবল তাদের জন্যই এই উচ্চ শিক্ষার বৃত্তি নির্ধারিত। বাইরের কাউকে এ বৃত্তি দেয়া হয় না।
আঞ্জুমানের সেবামূলক কাজের স্বীকৃতি এসেছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায় থেকে। ১৯৮৪ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার লাভ করে প্রতিষ্ঠানটি। একই সঙ্গে ২০০৪ সালে লাভ করে ডা. ইব্রাহিম স্মৃতি স্বর্ণপদক ও রফিকুল ইসলাম ব্যাংকিং অ্যাওয়ার্ড। পরে আন্তার্জাতিকভাবে আমেরিকার হিল্টন হিউম্যানিটেরিয়ান প্রাইজের জন্য প্রাথমিকভাবে মনোনয়ন লাভ করে। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পুরস্কারপ্রাপ্ত হয় আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। এর মধ্যে রয়েছে- নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ একাডেমি অ্যাওয়ার্ড, কাজী আজাহার আলী স্মৃতি স্বর্ণপদক, কর্নেল মুজিব অ্যাওয়ার্ড এবং ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ফোর্থ ফাউন্ডেশন এনিভার্সারি-২০০৭ অ্যাওয়ার্ড।
No comments