উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা লেখকদের কণ্ঠ চেপে ধরছে by পঙ্কজ মিশ্র
হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের দলিত পিএইচডি ছাত্র রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যা সৃষ্টি করেছে প্রতিবাদের |
মিসর
ও তুরস্ক সরকার নির্লজ্জভাবে লেখক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের ওপর নানামুখী
হামলা চালাচ্ছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেসিপ তায়েপ এরদোয়ান গত মাসে
তুরস্কের বিদ্যায়তনের মানুষদের সমালোচনা করেছেন, তাঁরা নাকি বিদেশি শক্তির
পঞ্চবাহিনী হিসেবে কাজ করছেন, তাঁরা দেশদ্রোহী। তাঁদের অনেককেই কর্মচ্যুত
বা সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। কিন্তু ভারতে আনুষ্ঠানিক ও দৃশ্যত মুক্ত
গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান থাকলেও বুদ্ধিবৃত্তিক ও সৃজনশীল স্বাধীনতা ভোগ করতে
হলে চাতুর্যের আশ্রয় নিতে হচ্ছে।
ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হাতে, তারা কয়েক মাস ধরে সিলেবাস ও ক্যাম্পাস থেকে ‘জাতিবিরোধীদের’ বের করে দিচ্ছে। গত মাসে এক মর্মঘাতী কাণ্ড ঘটেছে, হায়দরাবাদের এক পিএইচডি ছাত্র রোহিত ভেমুলা আত্মহত্যা করেছেন। ‘জাতিবিরোধী’ রাজনৈতিক মতামত পোষণ করার অভিযোগে তাঁকে প্রথমে বরখাস্ত করা হয়, এরপর তাঁর ফেলোশিপ বাতিল করে ছাত্র হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। এই মানুষটি ছিলেন ঐতিহ্যগতভাবে ভারতের সবচেয়ে নির্মম নিপীড়নের শিকার এক বর্ণের মানুষ। মোদি সরকার দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়কে যে চিঠি লিখেছিল, সেখানে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টি ‘চরমপন্থী ও জাতিবিরোধী রাজনীতির’ বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের নিরন্তর চাপের মুখে ছিল। ভেমুলার হৃদয়বিদারক সুইসাইড নোট থেকে দেখা যায়, তিনি চরম নিঃসঙ্গতার পর্যায়ে চলে গিয়েছিলেন। চিঠিতে একজন প্রতিভাবান লেখক ও চিন্তকের হতাশার কথাও ফুটে উঠেছে।
ভারতের উচ্চবর্ণের হিন্দুরা গণপরিসরের সব ক্ষেত্রে প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা করছে, খুব সহজ-সরলভাবেই তারা সেটা করছে। কিন্তু তারা শুধু প্রকাণ্ড রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাজে লাগিয়েই বিরোধীদের দমন করার চেষ্টা করছে না, তারা লেখকদের বিরুদ্ধে পুলিশি মামলাও দায়ের করছে। তারা একধরনের দায়মুক্তির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, যেখানে বেপরোয়া জনতা সংবাদপত্রের কার্যালয়, শিল্প গ্যালারি ও সিনেমা হল তছনছ করছে।
ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হাতে, তারা কয়েক মাস ধরে সিলেবাস ও ক্যাম্পাস থেকে ‘জাতিবিরোধীদের’ বের করে দিচ্ছে। গত মাসে এক মর্মঘাতী কাণ্ড ঘটেছে, হায়দরাবাদের এক পিএইচডি ছাত্র রোহিত ভেমুলা আত্মহত্যা করেছেন। ‘জাতিবিরোধী’ রাজনৈতিক মতামত পোষণ করার অভিযোগে তাঁকে প্রথমে বরখাস্ত করা হয়, এরপর তাঁর ফেলোশিপ বাতিল করে ছাত্র হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। এই মানুষটি ছিলেন ঐতিহ্যগতভাবে ভারতের সবচেয়ে নির্মম নিপীড়নের শিকার এক বর্ণের মানুষ। মোদি সরকার দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়কে যে চিঠি লিখেছিল, সেখানে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টি ‘চরমপন্থী ও জাতিবিরোধী রাজনীতির’ বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের নিরন্তর চাপের মুখে ছিল। ভেমুলার হৃদয়বিদারক সুইসাইড নোট থেকে দেখা যায়, তিনি চরম নিঃসঙ্গতার পর্যায়ে চলে গিয়েছিলেন। চিঠিতে একজন প্রতিভাবান লেখক ও চিন্তকের হতাশার কথাও ফুটে উঠেছে।
ভারতের উচ্চবর্ণের হিন্দুরা গণপরিসরের সব ক্ষেত্রে প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা করছে, খুব সহজ-সরলভাবেই তারা সেটা করছে। কিন্তু তারা শুধু প্রকাণ্ড রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাজে লাগিয়েই বিরোধীদের দমন করার চেষ্টা করছে না, তারা লেখকদের বিরুদ্ধে পুলিশি মামলাও দায়ের করছে। তারা একধরনের দায়মুক্তির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, যেখানে বেপরোয়া জনতা সংবাদপত্রের কার্যালয়, শিল্প গ্যালারি ও সিনেমা হল তছনছ করছে।
দলিত পিএইচডি ছাত্ররোহিত ভেমুলার আত্মহত্যার ঘটনায় হায়দরাবাদ ছাড়িয়ে প্রতিবাদ ছড়াচ্ছে গোটা দেশে |
গণমাধ্যমকে
তারা নিজেদের বার্তা পরিবেশনের যন্ত্র বানিয়ে ফেলেছে। প্রধানমন্ত্রী
নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির ধামাধরা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো
ভারতীয় টেলিভিশনের ওপর বেরলুসকোনি স্টাইলে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা
করছে। ওদিকে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা নতুন গণমাধ্যম কীভাবে ব্যবহার করতে হয়,
তা শিখে গেছে, কীভাবে তৎক্ষণাৎ মতামত সৃষ্টি করতে হয়, সেটাও। এরদোয়ানের
ভাষায়, তারা সামাজিক মাধ্যমে এক ‘রোবট লবি’ ব্যবহার করে গ্রাহকদের ভুল
তথ্যের তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, যতক্ষণ না দুই যোগ দুই পাঁচ হচ্ছে।
শিক্ষা, ব্যবসা ও গণমাধ্যমে যারা সরকারের কাজের নজরদারি করছে, তাদের চিহ্নিত করা খুব কঠিন কাজ নয়। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তির এই জাল সংঘবদ্ধভাবে কাজ করে মানুষের মেজাজ নির্ধারণ করে, তার ধারণা কেমন হবে সেটার প্রকৃতি নির্ধারণ করে। তারা একত্র হয়ে রোহিত ভেমুলার চেয়েও কিঞ্চিৎ শক্তিশালী মানুষের ওপর নানা দিক থেকে চাপ প্রয়োগ করতে পারে। কিছুদিন আগে লেখক অরুন্ধতী রায়কে যখন ‘আদালত অবমাননার’ দায়ে হঠাৎ করে অপরাধমূলক বিচারের মুখোমুখি হতে হলো, তখন এক খুদে বার্তায় বলা হলো, খ্রিষ্টান মিশনারিরা ভেমুলাকে হত্যা করে ভারত ভাঙার যে ষড়যন্ত্র করেছিল, অরুন্ধতী তার অংশীদার ছিলেন। এতে যে নানা রকম ভ্রম সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা নাকচ করাও খুব সহজ কাজ ছিল না। আর মূলধারার গণমাধ্যমে তাঁর প্রতি বৈরী প্রতিবেদন না করে যদি বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন করা হতো, তাহলে অন্য কেউ হয়তো চিন্তা করত, অরুন্ধতীর প্রমাণ করার কিছু আছে।
বাস্তবে অরুন্ধতীর আদালত ‘অবমাননা’ করার ঘটনাটা এ রকম: গত বছরের মে মাসে তিনি একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন, যেখানে তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের মারাত্মকভাবে বিকলাঙ্গ ইংরেজির শিক্ষক সাইবাবাকে পুলিশের ধরে নিয়ে যাওয়া ও ‘জাতিবিরোধী কর্মকাণ্ডের’ অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তারের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। ওই নিবন্ধে অরুন্ধতী হঠাৎ করেই এক জায়গায় বলেছিলেন, মোদির সহযোগীদের বিরুদ্ধে ডজন ডজন হত্যা মামলা থাকলেও যদি তাঁরা জামিন পান, তাহলে একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীও জামিন পেতে পারেন।
এর সাত মাস পর নাগপুরের এক বিচারক সাইবাবার জামিন আবেদন খারিজ করে অরুন্ধতীর ব্যাপক সমালোচনা করেন, বিচারক তাঁকে ‘নোংরা’, ‘রুক্ষ’, ‘রূঢ়’ ও ‘গেঁয়ো বর্বর’ হিসেবে আখ্যা দেন, যার নিবন্ধটি ছিল সাইবাবাকে জামিনে মুক্ত করার এক দুরভিসন্ধিপূর্ণ পরিকল্পনার অংশ, যেটা আদালত অবমাননার শামিল (নিবন্ধটি লেখার সময় আদালতে সাইবাবার জামিন আবেদন করা হয়নি বা অরুন্ধতী সেখানে আদালতের রায়ের সমালোচনা করেননি বা আইনি প্রক্রিয়ার আবেদন করে কোনো বিচারকের সমালোচনা করেননি)। বিচারক অরুন্ধতীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, তিনি যে ‘মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার জিতেছেন’ বলে জানা যায়, সেটা ব্যবহার করে ভারতের মতো ‘সবচেয়ে সহিষ্ণু’ দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। অরুন্ধতী এই মুহূর্তে তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস নিয়ে কাজ করছেন, এই বিচারকের বজ্র ঘোষণায় ‘যাঁরা অবৈধ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রতিরোধের চেষ্টা করছেন’, অরুন্ধতী তাঁদের শত্রু হিসেবে আবির্ভূত হলেন।
সম্প্রতি জি এন্টারটেইনমেন্টের মালিকানাধীন একটি টেলিভিশন চ্যানেলে অরুন্ধতী রায়কে নিয়ে যে স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমাটি প্রচারিত হয়েছে, সেটি দেখলে আপনার আর ওই বিষয়ে কোনো সন্দেহই থাকবে না। এই জি নেটওয়ার্ক মোদির সবচেয়ে উৎসাহী প্রচারক। এই ছবিতে একজন প্রকৃত জাতিবিরোধী মানুষের প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে। অর্থাৎ, আদালত ও গণপরিসর দুই জায়গাতেই অরুন্ধতী রায়ের মারাত্মক বিরোধিতা হচ্ছে। তাঁদের কুৎসার কারণে অরুন্ধতীর বাক্স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে, ফলে জাগতিক বোঝার ভার উপেক্ষা করে তিনি যে নিভৃতে ঘরের কোণে বসে লিখবেন, সেই ফুরসতও তাঁর থাকছে না। মোদির সরকার শিল্প ও চিন্তার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ কোনো আঘাতের নজির রাখেনি, কিন্তু ভারতের মতো একটি আনুষ্ঠানিক গণতন্ত্রের দেশে শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের দমন করার ব্যাপারটি নানাভাবেই জনসমক্ষে প্রকাশিত হচ্ছে, যেগুলোর মধ্যে আবার আন্তসম্পর্ক আছে।
যেদিন অরুন্ধতী রায়কে নাগপুরে অপরাধের কারণে অভিযুক্ত করা হয়েছিল, সেদিন জয়পুর সাহিত্য উৎসবে বাক্স্বাধীনতার ওপর একটি বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। আর সেই অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল জি নেটওয়ার্ক। সেদিন বিতর্কের বিষয়ের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কঠোর যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন বলিউড অভিনেতা অনুপম খের। বিষয়টি ছিল ‘বাক্স্বাধীনতা কি একদম শর্তহীন হওয়া উচিত?’ অনুপম ভাঁড়ামিপূর্ণ অভিনয়ের জন্য বেশ জনপ্রিয়। তিনজন লেখককে হত্যা এবং মুসলমান ও দলিতদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে তাদের বিনা বিচারে হত্যা করার (লিঞ্চিং) প্রতিবাদে লেখকেরা পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এর প্রতিবাদে গত নভেম্বরে অনুপম খের মিছিল করেছেন। তিনি মোদির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি বাসভবনে ছবি তোলার জন্য এই স্লোগান আর দেননি: ‘লেখকদের জুতাপেটা করো’।
খেরের মতো পর্দার এক ভাঁড় রাজনীতির ভাঁড়ে পরিণত হলে বিপদ। আবার তাঁর মতো ব্যক্তি সাহিত্য অনুষ্ঠানে এসে দর্শকদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে ‘মোদি’ ‘মোদি’ বলে না চেঁচালেও অনুষ্ঠানটি কলুষিত হয়, তিনি ও তাঁর অনুসারীরা রায়ের কণ্ঠ স্তব্ধ করার ব্যাপারে কথা বললেও তাঁর দোষ মোচন হয় না। মোদ্দা কথা হলো, হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা দেখাচ্ছে যে একজন লেখককে হত্যা করার নানা পন্থাই আছে।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
পঙ্কজ মিশ্র: ভারতীয় লেখক।
শিক্ষা, ব্যবসা ও গণমাধ্যমে যারা সরকারের কাজের নজরদারি করছে, তাদের চিহ্নিত করা খুব কঠিন কাজ নয়। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তির এই জাল সংঘবদ্ধভাবে কাজ করে মানুষের মেজাজ নির্ধারণ করে, তার ধারণা কেমন হবে সেটার প্রকৃতি নির্ধারণ করে। তারা একত্র হয়ে রোহিত ভেমুলার চেয়েও কিঞ্চিৎ শক্তিশালী মানুষের ওপর নানা দিক থেকে চাপ প্রয়োগ করতে পারে। কিছুদিন আগে লেখক অরুন্ধতী রায়কে যখন ‘আদালত অবমাননার’ দায়ে হঠাৎ করে অপরাধমূলক বিচারের মুখোমুখি হতে হলো, তখন এক খুদে বার্তায় বলা হলো, খ্রিষ্টান মিশনারিরা ভেমুলাকে হত্যা করে ভারত ভাঙার যে ষড়যন্ত্র করেছিল, অরুন্ধতী তার অংশীদার ছিলেন। এতে যে নানা রকম ভ্রম সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা নাকচ করাও খুব সহজ কাজ ছিল না। আর মূলধারার গণমাধ্যমে তাঁর প্রতি বৈরী প্রতিবেদন না করে যদি বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন করা হতো, তাহলে অন্য কেউ হয়তো চিন্তা করত, অরুন্ধতীর প্রমাণ করার কিছু আছে।
বাস্তবে অরুন্ধতীর আদালত ‘অবমাননা’ করার ঘটনাটা এ রকম: গত বছরের মে মাসে তিনি একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন, যেখানে তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের মারাত্মকভাবে বিকলাঙ্গ ইংরেজির শিক্ষক সাইবাবাকে পুলিশের ধরে নিয়ে যাওয়া ও ‘জাতিবিরোধী কর্মকাণ্ডের’ অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তারের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। ওই নিবন্ধে অরুন্ধতী হঠাৎ করেই এক জায়গায় বলেছিলেন, মোদির সহযোগীদের বিরুদ্ধে ডজন ডজন হত্যা মামলা থাকলেও যদি তাঁরা জামিন পান, তাহলে একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীও জামিন পেতে পারেন।
এর সাত মাস পর নাগপুরের এক বিচারক সাইবাবার জামিন আবেদন খারিজ করে অরুন্ধতীর ব্যাপক সমালোচনা করেন, বিচারক তাঁকে ‘নোংরা’, ‘রুক্ষ’, ‘রূঢ়’ ও ‘গেঁয়ো বর্বর’ হিসেবে আখ্যা দেন, যার নিবন্ধটি ছিল সাইবাবাকে জামিনে মুক্ত করার এক দুরভিসন্ধিপূর্ণ পরিকল্পনার অংশ, যেটা আদালত অবমাননার শামিল (নিবন্ধটি লেখার সময় আদালতে সাইবাবার জামিন আবেদন করা হয়নি বা অরুন্ধতী সেখানে আদালতের রায়ের সমালোচনা করেননি বা আইনি প্রক্রিয়ার আবেদন করে কোনো বিচারকের সমালোচনা করেননি)। বিচারক অরুন্ধতীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, তিনি যে ‘মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার জিতেছেন’ বলে জানা যায়, সেটা ব্যবহার করে ভারতের মতো ‘সবচেয়ে সহিষ্ণু’ দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। অরুন্ধতী এই মুহূর্তে তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস নিয়ে কাজ করছেন, এই বিচারকের বজ্র ঘোষণায় ‘যাঁরা অবৈধ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রতিরোধের চেষ্টা করছেন’, অরুন্ধতী তাঁদের শত্রু হিসেবে আবির্ভূত হলেন।
সম্প্রতি জি এন্টারটেইনমেন্টের মালিকানাধীন একটি টেলিভিশন চ্যানেলে অরুন্ধতী রায়কে নিয়ে যে স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমাটি প্রচারিত হয়েছে, সেটি দেখলে আপনার আর ওই বিষয়ে কোনো সন্দেহই থাকবে না। এই জি নেটওয়ার্ক মোদির সবচেয়ে উৎসাহী প্রচারক। এই ছবিতে একজন প্রকৃত জাতিবিরোধী মানুষের প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে। অর্থাৎ, আদালত ও গণপরিসর দুই জায়গাতেই অরুন্ধতী রায়ের মারাত্মক বিরোধিতা হচ্ছে। তাঁদের কুৎসার কারণে অরুন্ধতীর বাক্স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে, ফলে জাগতিক বোঝার ভার উপেক্ষা করে তিনি যে নিভৃতে ঘরের কোণে বসে লিখবেন, সেই ফুরসতও তাঁর থাকছে না। মোদির সরকার শিল্প ও চিন্তার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ কোনো আঘাতের নজির রাখেনি, কিন্তু ভারতের মতো একটি আনুষ্ঠানিক গণতন্ত্রের দেশে শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের দমন করার ব্যাপারটি নানাভাবেই জনসমক্ষে প্রকাশিত হচ্ছে, যেগুলোর মধ্যে আবার আন্তসম্পর্ক আছে।
যেদিন অরুন্ধতী রায়কে নাগপুরে অপরাধের কারণে অভিযুক্ত করা হয়েছিল, সেদিন জয়পুর সাহিত্য উৎসবে বাক্স্বাধীনতার ওপর একটি বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। আর সেই অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল জি নেটওয়ার্ক। সেদিন বিতর্কের বিষয়ের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কঠোর যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন বলিউড অভিনেতা অনুপম খের। বিষয়টি ছিল ‘বাক্স্বাধীনতা কি একদম শর্তহীন হওয়া উচিত?’ অনুপম ভাঁড়ামিপূর্ণ অভিনয়ের জন্য বেশ জনপ্রিয়। তিনজন লেখককে হত্যা এবং মুসলমান ও দলিতদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে তাদের বিনা বিচারে হত্যা করার (লিঞ্চিং) প্রতিবাদে লেখকেরা পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এর প্রতিবাদে গত নভেম্বরে অনুপম খের মিছিল করেছেন। তিনি মোদির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি বাসভবনে ছবি তোলার জন্য এই স্লোগান আর দেননি: ‘লেখকদের জুতাপেটা করো’।
খেরের মতো পর্দার এক ভাঁড় রাজনীতির ভাঁড়ে পরিণত হলে বিপদ। আবার তাঁর মতো ব্যক্তি সাহিত্য অনুষ্ঠানে এসে দর্শকদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে ‘মোদি’ ‘মোদি’ বলে না চেঁচালেও অনুষ্ঠানটি কলুষিত হয়, তিনি ও তাঁর অনুসারীরা রায়ের কণ্ঠ স্তব্ধ করার ব্যাপারে কথা বললেও তাঁর দোষ মোচন হয় না। মোদ্দা কথা হলো, হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা দেখাচ্ছে যে একজন লেখককে হত্যা করার নানা পন্থাই আছে।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
পঙ্কজ মিশ্র: ভারতীয় লেখক।
No comments