ঘড়ির কাঁটা ডান দিকে ঘোরে কেন? by আব্দুল কাইয়ুম

গণিত উৎ​সবে প্রতিবছরই আমরা তরুণ
শিক্ষার্থীদের বিকাশমান প্রতিভার পরিচয় পাই
আমাদের দেশের তরুণেরা যে কত গভীরে চিন্তা করতে পারে, শিরোনামের প্রশ্নটিই তার প্রমাণ। এই মজার প্রশ্নের উত্তর পরে দিচ্ছি। তার আগে কিছু জানার আছে। এ প্রশ্নটি করেছিল গত ৩১ জানুয়ারি টাঙ্গাইল গণিত উৎসবে একজন তরুণ শিক্ষার্থী। প্রশ্নোত্তর পর্ব চলছিল। সকালে সোয়া এক ঘণ্টার গণিত আঞ্চলিক অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতায় পরীক্ষার পর ঘণ্টা খানেকের জন্য এ পর্বটি চলে। স্কুল-কলেজের তরুণেরা প্রশ্ন করে আর উত্তর দেন মঞ্চ থেকে বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা সাধারণত ওই অঞ্চলের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলের গণিত বা বিজ্ঞানের শিক্ষক।
সেদিনও এসেছিলেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অনুষদের ডিন মো. মতিউর রহমান, পদার্থবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান মাসুম হায়দার, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাজ্জাদ ওয়াহিদ প্রমুখ। আমাদের আমন্ত্রণে তাঁরা যে নিজ উদ্যোগে এসেছেন, সে জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। গণিত উৎসব অনুষ্ঠিত হয় টাঙ্গাইল শহরের বিবেকানন্দ হাইস্কুল ও কলেজের মাঠে। শিক্ষা যে সত্যিই মহান পেশা এবং অধ্যাপকেরা যে তরুণদের জ্ঞানের ভিত্তি আরও একটু প্রসারিত করার জন্য একটা দিন ব্যয় করেন, সেটা সত্যিই গর্বের বিষয়।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ও প্রথম আলোর সহযোগিতায় বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি প্রতিবছর সারা দেশে গণিত উৎসব ও অলিম্পিয়াডের আয়োজন করে। প্রতিবছরই আমরা তরুণ শিক্ষার্থীদের বিকাশমান প্রতিভার পরিচয় পাই। এবারও পেয়েছি। তার প্রমাণ ওই সব প্রশ্ন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজন তরুণ শিক্ষার্থী একটা মজার প্রশ্ন করেছিল, সাবানের রং ভিন্ন হলেও সব সাবানের ফেনা সাদা কেন? কক্সবাজারের এক তরুণ শিক্ষার্থীর প্রশ্ন শুনে তো আমাদের আক্কেল গুড়ুম! তাঁর প্রশ্নটি ছিল, আমাদের দেশের সব মোবাইল ফোন নম্বর শূন্য দিয়ে শুরু কেন?
প্রশ্নগুলো থেকে আমরা বুঝতে পারি আমাদের তরুণ প্রজন্ম অনেক বড় চিন্তাভাবনা করতে শিখে গেছে। ভালো প্রশ্ন করতে হলেও গভীর জ্ঞানের দরকার। বলুন তো, সব মোবাইল ফোনের নম্বর যে শূন্য দিয়ে শুরু হয়, সেটা আমরা যাঁরা বড়, তাঁদের কয়জনের মাথায় এসেছে? অথচ আমাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়ে এ রকম কঠিন প্রশ্ন করতে শিখে গেছে। তাদের আর থামিয়ে রাখা যাবে না। প্রশ্ন যখন করতে শিখেছে, দেশকে তারা এগিয়ে নিয়ে যাবেই।
টাঙ্গাইলে আমি পঞ্চম শ্রেণির তিনজন ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলাম। আতিয়া আদিবা, রুসমিয়া করিম ও জান্নাতুল বুশরা। তাদের মায়েরা শিশুসন্তানদের নিয়ে এসেছেন এই শীতের সকালে গণিত উৎসবে। আতিয়ার মা শারমিনা আকতার বললেন, আমরা চাই মেয়েরা গণিতে পারদর্শী হয়ে উঠুক। রুসমিয়ার মা ইয়াসমিন আরা ও বুশরার মা নুসরাত তানজিন লিজাও একই কথা বললেন। তাঁদের মেয়েরা ক্লাসে ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়। বিজ্ঞানের প্রতি তাদের দারুণ আগ্রহ। মেয়েরা, মায়েরা বুঝতে পারছেন, এগিয়ে যেতে হলে বিজ্ঞান, গণিত ও অন্যান্য শিক্ষায় চৌকস হতে হবে। এটা আমাদের দেশের জন্য একটা বড় প্রাপ্তি।
মোবাইল ফোন নম্বর শুরু হয় একটা শূন্য দিয়ে। কারণ, এই শূন্য হলো আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশনের স্বীকৃত বাংলাদেশের ভেতরের মোবাইল কল সংকেত। যদি দেশের ভেতর থেকে কাউকে মোবাইলে ফোন করি, তাহলে এই শূন্য সংকেত থেকে টেলিকমিউনিকেশনস সিস্টেম বুঝে নেবে যে এই কলটি বাংলাদেশের ভেতরে যোগাযোগ করতে চায়। যদি বাইরের কোনো দেশ থেকে কল করতে হয়, তাহলে প্রথমে ০০৮৮ লিখে তারপর ০ নম্বর টিপতে হবে। কারণ, ০০ অর্থ আন্তর্জাতিক কল, ৮৮ হলো বাংলাদেশ, তারপর ০ দিয়ে শুরু মানে মোবাইলে বাংলাদেশের ভেতর কল যাবে। বাংলাদেশের কোড হলো ৮৮০। যদি নম্বরটি ০১৭.. হয়, তাহলে সেটা হবে গ্রামীণ ফোনের, ০১৫... হলে সেটা হবে টেলিটক ইত্যাদি।
সাবানের ফেনা কেন সাদা? কারণ সাবানের ফেনা যদি আলোর সবগুলো রং প্রতিফলিত করে, তাহলে সেটা সাদা দেখাবে। অনেক সময় ফেনার কোনো অংশ বেগুনি, লাল বা সবুজও দেখায়। তার মানে ফেনার মধ্য দিয়ে কিছু আলো প্রতিসরিত হয়ে চলে যায়, আর নীল, বেগুনি বা সবুজ রং প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে ফিরে আসে, তখন সেই রঙের দেখায়। কিন্তু এটা সাবানের রঙের জন্য নয়। আসলে সাবানের মধ্যে যে ক্ষার থাকে, তার রং সাদা। এর ওপর সবুজ বা গোলাপি রং মিশিয়ে হয়তো সাবান রঙিন করা হয়। কিন্তু পানিতে গোলানোর পর সেই রং আর থাকে না।
এখন দেখা যাক, ঘড়ির কাঁটা কেন ডান দিকে ঘোরে। কারণ, ঘড়ি আবিষ্কার হয়েছিল ইংল্যান্ড বা ইউরোপের কোনো দেশে। এর আগে ছিল সূর্যঘড়ি। ইংল্যান্ড পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে হওয়ায় সূর্য দক্ষিণ আকাশে হেলে থাকে। এ কারণে সূর্যঘড়ির যে দণ্ডের ছায়া দেখে সময় পরিমাপ করা হয়, সেই ছায়াটি বাঁ দিক থেকে ডান দিকে ঘোরে। কারণ, ওই স্থানটি উত্তর গোলার্ধে। ওখানে সূর্য যখন পূব থেকে পশ্চিমে যায়, তখন সূর্যঘড়ির দণ্ডের ছায়াটি বাঁ থেকে ডান দিকে ঘোরে। তাই ঘড়ি আবিষ্কারের সময় স্বাভাবিক ও অভিজ্ঞতালব্ধ চিন্তা অনুযায়ী ঘড়ির কাঁটা ডান দিকে ঘোরানোর পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। ঘড়ি যদি অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ডে আবিষ্কার হতো, তাহলে হয়তো ঘড়ির কাঁটা বাঁ দিকে ঘুরত। কারণ, দক্ষিণ গোলার্ধে সূর্যঘড়ির ছায়া উত্তর গোলার্ধের বিপরীত দিকে, অর্থাৎ ডান দিক থেকে বাঁ দিকে ঘোরে!
গণিতে অনেক মজা আছে। যেমন, আমি টাঙ্গাইলের গণিত উৎসবে বললাম, তরুণেরা বন্ধুর জন্মদিনে গণিতের একটা মজার ধাঁধা ধরতে পারে। প্রথমে সে বলবে ৬১৭৪ একটি ম্যাজিক সংখ্যা। কেন ম্যাজিক? কারণ যে কেউ চার অঙ্কের একটি সংখ্যা বলুক, যার অন্তত একটি অঙ্ক অন্যগুলোর থেকে পৃথক হবে। তাহলে সে ওই চার অঙ্কের সংখ্যা থেকে কিছু সংখ্যা নির্দিষ্ট নিয়মে সাজিয়ে যোগ-বিয়োগ করে ৬১৭৪ সংখ্যাটি বের করে দেবে। এটি একটি চ্যালেঞ্জ। চার অঙ্কের সংখ্যাটি যা-ই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত ৬১৭৪ সংখ্যাটি বের করার কৃতিত্ব সে নিতে পারে। যেমন, কেউ ৩৭২৫ সংখ্যাটি বলল। এখন এই সংখ্যার চারটি অঙ্ক দিয়ে সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে ছোট সংখ্যাটি বের করতে হবে। এরপর বড়টি থেকে ছোটটি বিয়োগ করতে হবে। যেমন, এ ক্ষেত্রে বড় সংখ্যাটি হবে ৭৫৩২ এবং ছোটটি হবে ২৩৫৭। এর বিয়োগ ফল হবে ৫১৭৫। এখন আবার একই নিয়মে ৫১৭৫-এর সবচেয়ে বড় ও ছোট সংখ্যাটি বের করে আবার বিয়োগ। এভাবে কয়েকবার বিয়োগফল বের করলে শেষ পর্যন্ত ৬১৭৪ সংখ্যাটি পাওয়া যাবে। উৎসাহী তরুণেরা নিজেরা এটা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
সামান্য কিছু প্রশ্ন করে বিজ্ঞানের কত কিছু জানা যায়, এটা আমরা কয়জন জানি বা বুঝি?
ছেলেমেয়েরা কিছু জানতে চাইলে বা প্রশ্ন করলে আমাদের অভিভাবক বা শিক্ষকেরা অনেক সময় রেগে যান। কিন্তু এটা একেবারেই উচিত নয়। প্রশ্ন করলে যদি বড়দের বকা খেতে হয়, তাহলে তো শিশুরা দমে যাবে। ওরা প্রশ্ন করতে ভয় পাবে। আর যদি প্রশ্নই না করে, তাহলে তাদের নতুন জ্ঞান অর্জনের সুযোগ ও সম্ভাবনাও নষ্ট হয়ে যাবে। আমরা কি চাই আমাদের সন্তানেরা প্রশ্নবিমুখ হয়ে জ্ঞান অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকুক? না, এটা আমরা চাই না।
আমাদের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বারবার একটা কথা বলেন, স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের শারীরিক বা মানসিক নিপীড়ন করা যাবে না। বেত বা স্কেল দিয়ে মারধর করা, শাস্তি দেওয়া, কাউকে বকাঝকা করা বা সবার সামনে অপমান করে নিচু করা ঘোর অন্যায়। এসবের কারণে শিশুরা দমে যায়। তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। এভাবে আমরা দেশের কত সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানীকে যে হারাচ্ছি, তার হিসাব–নিকাশ নেই। আমাদের এই খারাপ মনোবৃত্তি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
আমেরিকা, ইউরোপের কোনো দেশে শিক্ষার্থীদের মারধর বা হেয় করা যায় না। তাহলে শিক্ষকের শাস্তি হয়। বরং শিশুদের নানাভাবে উৎসাহিত করা হয়। আমাদের সেই উন্নত সংস্কৃতির দিকে যেতে হবে।
আমরা যে গণিত উৎসব ও অলিম্পিয়াড করি, তা হয়তো শিশুদের প্রশ্ন করতে উৎসাহ জোগায়। যত প্রশ্ন করবে শিশুরা, ততই ভালো।
আজকের শিশুরাই ভবিষ্যৎ। আমরা যেন তাদের মনের সুস্থ বিকাশ নিশ্চিত করতে যা কিছু করা দরকার, তা করি।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.