একজন বীরপ্রতীকের উপহার by ডক্টর তুহিন মালিক
এক.
বিজয় দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিয়েও বঙ্গভবনে ঢুকতে দেয়া হয়নি
একজন বীরপ্রতীককে। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ
মুহাম্মদ ইবরাহিম বিগত ৩৫ বছর ধরে প্রায় প্রতিটি সরকারের আমলেই এই দিনটিতে
বঙ্গভবনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছেন। এমনকি কল্যাণ পার্টি নামে একটি
রাজনৈতিক দল গঠন করেও গত আটবছরে যথারীতি বঙ্গভবনের দাওয়াতি থেকে কখনও তাকে
কোন বাধার মুখে পড়তে হয়নি। কিন্তু এবারের বিজয় দিবসের সংবর্ধনায় বঙ্গভবনের
গেটে দন্ডায়মান পুলিশ কর্মকর্তা জেনারেল ইবরাহিমকে জানায়, স্পেশাল
সিকিউরিটি ফোর্সের তালিকা অনুযায়ী বঙ্গভবনে অবাঞ্ছিত ঘোষিত ব্যক্তিদের
মধ্যে তার নাম নাকি এক নম্বরে রয়েছে। অর্থাৎ বঙ্গভবনের নিরাপত্তার জন্য
তিনি নাকি নাম্বার ওয়ান হুমকি! কল্যাণ পার্টির মতো দলের প্রধানও যদি
নাম্বার ওয়ান বিপজ্জনক হয়, তাহলে বাকিরা তো দেখি মহা-ভয়াবহ! অথচ এই ঘটনায়
দেশমাতার জন্য যুদ্ধ করা এই বীরপ্রতীক কতটা লজ্জিত বোধ করলে বলতে পারেন,
‘‘একজন বীরপ্রতীকের জন্য বিজয় দিবসের উপহার। বিজয় দিবসে একজন বীরপ্রতীককে
অপমান করা কী জরুরি?” প্রচ- ক্ষোভে তিনি বলেন, ‘‘আমার তিনটি পরিচয়। প্রথমত,
আমি একজন বীরপ্রতীক। দ্বিতীয়ত, একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল। তৃতীয়ত,
আমি একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের প্রধান। জানি না, এই তিন পরিচয় বা
বৈশিষ্ট্যের কোনটিকে আক্রমণ করতে গিয়ে তারা কোনটিকে অপমান করলো।” আসলে
জেনারেল ইবরাহিম তার তিনটি পরিচয়ের কথা বললেও চতুর্থ পরিচয়ের কথাটি কিন্তু
বলেননি। তিনি বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০দলীয় জোটের শরিক কল্যাণ পার্টির
চেয়ারম্যান। সরকারের কাছে এটাই হচ্ছে তার বড় পরিচয়। আর এটাই তাদের কাছে বড়
অপমানের, বড় যন্ত্রণার!
দুই. আসলে শুধুমাত্র জেনারেল ইবরাহিম একাই নন, কী মুক্তিযোদ্ধা, কী বীরপ্রতীক, আওয়ামী লীগ না করলে বাকি সবাই যেন আজ রাজাকার আর স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি। তাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যারা বাণিজ্য চালায়, তাদের কাছে বীরপ্রতীকের সম্মানহানি তো ফ্যাসিবাদী আচরণেরই বহিঃপ্রকাশমাত্র। ঠিক আছে, রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে কাউকে বঙ্গভবনে নিষিদ্ধ করলেন, কিন্তু দাওয়াত দিয়ে এভাবে অপমানটা করলেন কেন? ইবরাহিম সাহেব দাবি করলেন, তার দলটি নিবন্ধিত ছিল। কিন্তু তিনি হয়তো ভুলেই গিয়েছিলেন যে, শুধু দল নিবন্ধিত হলেই চলবে না, দাওয়াতটিও নিবন্ধিত হতে হবে। একটা ভুল তিনি করেছেন বটে, আওয়ামী লীগের ভজন ও গুণকীর্তনে পারদর্শিতা অর্জন না করেই উনি বঙ্গভবনে গেলেনই বা কেন? অথচ বঙ্গভবনের সেই সংবর্ধনায় মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকারের সুবিধা ভোগ করা লোকজনের কোন কমতি ছিল না। বঙ্গভবনের বিজয় দিবসের সংবর্ধনায় ছিলেন অনেক মুখচেনা স্বাধীনতাবিরোধীরাও। তাই একজন বীরপ্রতীককে ঢুকতে না দিয়ে বিজয়ের উৎসবটি কী গৌরবগাঁথার জন্ম দিলো তা বোধগম্য নয়। আমরা চাইলেও তো এখন আর নতুন করে কোন বীরপ্রতীকের জন্ম দিতে পারবো না। যে দু’একজন ক্ষণজন্মা এখনও বেঁচে আছেন তাদেরকে এভাবে অসম্মান করাটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে অসম্মান করার নামান্তর নয় কী? বঙ্গভবনের বিজয় দিবসের সংবর্ধনায় বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের তালিকা প্রস্তুত করে নিমন্ত্রণ দেয়ার রেওয়াজ দীর্ঘদিনের। কিন্তু এই তালিকায় কখনই থাকে না কৃষকের কোন ক্যাটাগরি। নিমন্ত্রণপত্র পৌঁছায় না কোন কৃষকের ঘরে। অথচ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রাণ বিসর্জনকারী, যুদ্ধাহত এবং যুদ্ধজয়ী মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় সবাই ছিলেন কৃষক পরিবারের। কৃষকের আত্মত্যাগে যে স্বাধীনতা তার বিজয় উৎসবে কৃষকের কোন জায়গা হয় না কেন?
তিন. গত পরশু বিজয় দিবসের একই সময়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসার সামনে স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে অনশন পালন করেন সাংবাদিক প্রবীর সিকদার। প্রবীর সিকদারের বিরুদ্ধে গত ১৬ই আগস্ট ফরিদপুরে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলা করা হয়। এর আগে পুলিশ কোন অভিযোগ ছাড়াই তাকে অফিস থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে বলে তিনি অভিযোগ করেন। যুদ্ধাহত এই মুক্তিযোদ্ধা পরিবার নিয়ে তাই বিজয় দিবসে তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে অনশন পালন করেন। সরকারি দলের গুরুত্বপূর্ণ অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা পালন করেছেন বলে বহু অভিযোগ রয়েছে। স্বয়ং বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী পর্যন্ত এইসব মন্ত্রী-নেতাদের তালিকা পর্যন্ত তুলে ধরেছেন বহুবার। কিন্তু শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ করার সুবাদে তারাই আজ কিনা বড় বড় মুক্তিযোদ্ধা সেজে রাষ্ট্রীয় সব সুযোগ- সুবিধা ভোগ করছে। উল্টা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের হতে হচ্ছে তাদেরই হাতে চরমভাবে নিগৃহীত। সচিবের হাতে অপমানিত হয়ে আত্মহত্যার পথকে পর্যন্ত বেছে নিতে হচ্ছে এদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাকে। অথচ দলীয় আশীর্বাদের কারণে মুক্তিযোদ্ধাকে অপমান ও হত্যার কোন বিচারই হয় না।
চার. এখন অবস্থা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, যে কেহ আওয়ামী লীগের স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকা-ের বিরুদ্ধে মুখ খুলবে তাকেই রাজাকারের খেতাব দিয়ে দেয়া হবে। সঙ্গে মামলা-হামলা, জেল-জুলুম তো আছেই। অথচ তাদেরই বিগত শাসনামলের পরিকল্পনা মন্ত্রী এবং সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সভাপতি মুক্তিযুদ্ধের উপ-প্রধান সেনাপতি একে খন্দকারকে পর্যন্ত রাজাকার উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে স্বয়ং আওয়ামী লীগ থেকেই। এমনকি সত্য ইতিহাস তুলে ধরার অপরাধে তাকে কুলাঙ্গার ও আইএসআই’র এজেন্ট বলেও গালাগাল করেছে নিজ দলের নেতারা। আওয়ামী দেউলিয়া রাজনীতির হিংস্র শিকারে নিষ্কৃতি পাননি বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের মহানায়করা পর্যন্ত। স্বয়ং বঙ্গবন্ধু যাকে বীরউত্তম খেতাব দিলেন সেই জিয়াউর রহমানকে পর্যন্ত তারা কি করে আইএসআই’র এজেন্ট বলতে পারে? অথচ নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও নিজের জীবনকে বাজি রেখে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া জিয়াউর রহমানকে যারা আজকে পাকিস্তানের চর বলে তিরস্কার করছে তাদের কেউ সেদিন মুক্তিযুদ্ধে অংশই নেয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সেই রক্তঝরা দিনগুলোতে তারা পাকিস্তান সরকারের আতিথেয়তায় সুরক্ষিত ছিল। কেউ আবার কলকাতায় বসে নিশ্চিন্তে বিলাসী জীবনে মগ্ন ছিল। তবে আমাদের জাতীয় নেতারাসহ বীর মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন ঠিকই চরম আত্মত্যাগের মহিমায় স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দেন। আমাদের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামে আওয়ামী লীগের অবদান কোন অংশেই কম নয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ও জয়বাংলা সেøাগানেই আমরা হানাদারের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। কিন্তু তাই বলে মুক্তিযুদ্ধ কোন একক দলের অর্জন হতে পারে না। আওয়ামী লীগ ছাড়াও দেশের আপামর সাধারণ মানুষ সেদিন অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও নেতা মেনেই আমরা সবাই দলমত নির্বিশেষে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার, মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতি-উপসেনাপতি, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আর স্বাধীনতার ঘোষকের কি কোনোই অবদান নাই?
পাঁচ. প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান যেদিন মারা যান, সেদিন তার মৃত্যুতে বঙ্গভবনে ছুটে যান সরকারি দল, বিরোধী দলসহ সমাজের সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ। চলমান সংঘাতময় রাজনীতির ভিড় ঠেলে রাষ্ট্রপতির মৃত্যুতে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর একাত্মতা সেদিন আমাদেরকে মুগ্ধ করেছিল। বিশেষ করে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল ও তার নেত্রী যে অভূতপূর্ব সহমর্র্মিতা প্রদর্শন করেছিলেন তা সমসাময়িক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিরল ঘটনাই ছিল। প্রয়াত রাষ্ট্রপতির সম্মানে সেদিন তিনি শুধু হরতাল প্রত্যাহারই করেননি, বরং বগুড়া ও জয়পুরহাটের সফরও স্থগিত করেছিলেন। বিএনপি অফিসে সেদিন জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছিল। তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী কোন প্রটোকল, অভ্যর্থনা বা সৌজন্যতাকে বাহানা না করেই বঙ্গভবনে ছুটে গিয়েছিলেন। নিত্যদিনের সরকারি দলন-পীড়নে আক্রান্ত মীর্জা ফখরুলসহ দলের নেতারা এক কাতারবন্দি হয়েছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতির জানাজার নামাজে। কিন্তু বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সাহেব একজন সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে জনপ্রিয় হয়েও তার বঙ্গভবনের দুয়ার একজন বীরপ্রতীকের জন্য বন্ধ করে দেয়া হলো কার ইঙ্গিতে? এটা নিশ্চয়ই পূর্বপরিকল্পিত কিছু ছিল না। কারণ পূর্বপরিকল্পিত হলে ইবরাহিম সাহেবকে দাওয়াতই দেয়া হতো না। সরকারের মধ্যে অতি উৎসাহী কোন অপশক্তির ইশারায় এহেন লজ্জাজনক ঘটনা কোনোভাবেই সরকারের পক্ষে লাভজনক হয়েছে বলে কেউ বিশ্বাস করতে পারে না। আসলে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আমাদের জাতীয় ঐক্য গড়তে না পারলেও জাতির জন্য অনেক বড় প্রত্যাশার জন্ম দিতে পারে নিঃসন্দেহে। কী সরকারি দল, কী বিরোধী দল, দলমত নির্বিশেষে সকল দলের রংধনুতেই গণতন্ত্রের আসল সৌন্দর্য লুকায়িত। আমাদের দেশে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিরা কেন রাজনৈতিক শত্রুতে পরিণত হবেন? আমাদের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানগুলোতে সকল দলের পারস্পরিক সহাবস্থান কবে নিশ্চিত করা যাবে? এই তো ক’দিন আগে ভারতে কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাড়িতে চায়ের আমন্ত্রণে গেলেন। আর আমরা একদল আরেক দলকে চিরতরে নির্মূল করার শপথ নিয়েই যেন রাজনীতি করছি।
লেখক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
e-mail: drtuhinmalik@hotmail.com
দুই. আসলে শুধুমাত্র জেনারেল ইবরাহিম একাই নন, কী মুক্তিযোদ্ধা, কী বীরপ্রতীক, আওয়ামী লীগ না করলে বাকি সবাই যেন আজ রাজাকার আর স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি। তাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যারা বাণিজ্য চালায়, তাদের কাছে বীরপ্রতীকের সম্মানহানি তো ফ্যাসিবাদী আচরণেরই বহিঃপ্রকাশমাত্র। ঠিক আছে, রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে কাউকে বঙ্গভবনে নিষিদ্ধ করলেন, কিন্তু দাওয়াত দিয়ে এভাবে অপমানটা করলেন কেন? ইবরাহিম সাহেব দাবি করলেন, তার দলটি নিবন্ধিত ছিল। কিন্তু তিনি হয়তো ভুলেই গিয়েছিলেন যে, শুধু দল নিবন্ধিত হলেই চলবে না, দাওয়াতটিও নিবন্ধিত হতে হবে। একটা ভুল তিনি করেছেন বটে, আওয়ামী লীগের ভজন ও গুণকীর্তনে পারদর্শিতা অর্জন না করেই উনি বঙ্গভবনে গেলেনই বা কেন? অথচ বঙ্গভবনের সেই সংবর্ধনায় মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকারের সুবিধা ভোগ করা লোকজনের কোন কমতি ছিল না। বঙ্গভবনের বিজয় দিবসের সংবর্ধনায় ছিলেন অনেক মুখচেনা স্বাধীনতাবিরোধীরাও। তাই একজন বীরপ্রতীককে ঢুকতে না দিয়ে বিজয়ের উৎসবটি কী গৌরবগাঁথার জন্ম দিলো তা বোধগম্য নয়। আমরা চাইলেও তো এখন আর নতুন করে কোন বীরপ্রতীকের জন্ম দিতে পারবো না। যে দু’একজন ক্ষণজন্মা এখনও বেঁচে আছেন তাদেরকে এভাবে অসম্মান করাটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে অসম্মান করার নামান্তর নয় কী? বঙ্গভবনের বিজয় দিবসের সংবর্ধনায় বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের তালিকা প্রস্তুত করে নিমন্ত্রণ দেয়ার রেওয়াজ দীর্ঘদিনের। কিন্তু এই তালিকায় কখনই থাকে না কৃষকের কোন ক্যাটাগরি। নিমন্ত্রণপত্র পৌঁছায় না কোন কৃষকের ঘরে। অথচ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রাণ বিসর্জনকারী, যুদ্ধাহত এবং যুদ্ধজয়ী মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় সবাই ছিলেন কৃষক পরিবারের। কৃষকের আত্মত্যাগে যে স্বাধীনতা তার বিজয় উৎসবে কৃষকের কোন জায়গা হয় না কেন?
তিন. গত পরশু বিজয় দিবসের একই সময়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসার সামনে স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে অনশন পালন করেন সাংবাদিক প্রবীর সিকদার। প্রবীর সিকদারের বিরুদ্ধে গত ১৬ই আগস্ট ফরিদপুরে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলা করা হয়। এর আগে পুলিশ কোন অভিযোগ ছাড়াই তাকে অফিস থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে বলে তিনি অভিযোগ করেন। যুদ্ধাহত এই মুক্তিযোদ্ধা পরিবার নিয়ে তাই বিজয় দিবসে তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে অনশন পালন করেন। সরকারি দলের গুরুত্বপূর্ণ অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা পালন করেছেন বলে বহু অভিযোগ রয়েছে। স্বয়ং বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী পর্যন্ত এইসব মন্ত্রী-নেতাদের তালিকা পর্যন্ত তুলে ধরেছেন বহুবার। কিন্তু শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ করার সুবাদে তারাই আজ কিনা বড় বড় মুক্তিযোদ্ধা সেজে রাষ্ট্রীয় সব সুযোগ- সুবিধা ভোগ করছে। উল্টা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের হতে হচ্ছে তাদেরই হাতে চরমভাবে নিগৃহীত। সচিবের হাতে অপমানিত হয়ে আত্মহত্যার পথকে পর্যন্ত বেছে নিতে হচ্ছে এদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাকে। অথচ দলীয় আশীর্বাদের কারণে মুক্তিযোদ্ধাকে অপমান ও হত্যার কোন বিচারই হয় না।
চার. এখন অবস্থা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, যে কেহ আওয়ামী লীগের স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকা-ের বিরুদ্ধে মুখ খুলবে তাকেই রাজাকারের খেতাব দিয়ে দেয়া হবে। সঙ্গে মামলা-হামলা, জেল-জুলুম তো আছেই। অথচ তাদেরই বিগত শাসনামলের পরিকল্পনা মন্ত্রী এবং সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সভাপতি মুক্তিযুদ্ধের উপ-প্রধান সেনাপতি একে খন্দকারকে পর্যন্ত রাজাকার উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে স্বয়ং আওয়ামী লীগ থেকেই। এমনকি সত্য ইতিহাস তুলে ধরার অপরাধে তাকে কুলাঙ্গার ও আইএসআই’র এজেন্ট বলেও গালাগাল করেছে নিজ দলের নেতারা। আওয়ামী দেউলিয়া রাজনীতির হিংস্র শিকারে নিষ্কৃতি পাননি বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের মহানায়করা পর্যন্ত। স্বয়ং বঙ্গবন্ধু যাকে বীরউত্তম খেতাব দিলেন সেই জিয়াউর রহমানকে পর্যন্ত তারা কি করে আইএসআই’র এজেন্ট বলতে পারে? অথচ নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও নিজের জীবনকে বাজি রেখে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া জিয়াউর রহমানকে যারা আজকে পাকিস্তানের চর বলে তিরস্কার করছে তাদের কেউ সেদিন মুক্তিযুদ্ধে অংশই নেয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সেই রক্তঝরা দিনগুলোতে তারা পাকিস্তান সরকারের আতিথেয়তায় সুরক্ষিত ছিল। কেউ আবার কলকাতায় বসে নিশ্চিন্তে বিলাসী জীবনে মগ্ন ছিল। তবে আমাদের জাতীয় নেতারাসহ বীর মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন ঠিকই চরম আত্মত্যাগের মহিমায় স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দেন। আমাদের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামে আওয়ামী লীগের অবদান কোন অংশেই কম নয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ও জয়বাংলা সেøাগানেই আমরা হানাদারের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। কিন্তু তাই বলে মুক্তিযুদ্ধ কোন একক দলের অর্জন হতে পারে না। আওয়ামী লীগ ছাড়াও দেশের আপামর সাধারণ মানুষ সেদিন অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও নেতা মেনেই আমরা সবাই দলমত নির্বিশেষে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার, মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতি-উপসেনাপতি, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আর স্বাধীনতার ঘোষকের কি কোনোই অবদান নাই?
পাঁচ. প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান যেদিন মারা যান, সেদিন তার মৃত্যুতে বঙ্গভবনে ছুটে যান সরকারি দল, বিরোধী দলসহ সমাজের সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ। চলমান সংঘাতময় রাজনীতির ভিড় ঠেলে রাষ্ট্রপতির মৃত্যুতে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর একাত্মতা সেদিন আমাদেরকে মুগ্ধ করেছিল। বিশেষ করে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল ও তার নেত্রী যে অভূতপূর্ব সহমর্র্মিতা প্রদর্শন করেছিলেন তা সমসাময়িক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিরল ঘটনাই ছিল। প্রয়াত রাষ্ট্রপতির সম্মানে সেদিন তিনি শুধু হরতাল প্রত্যাহারই করেননি, বরং বগুড়া ও জয়পুরহাটের সফরও স্থগিত করেছিলেন। বিএনপি অফিসে সেদিন জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছিল। তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী কোন প্রটোকল, অভ্যর্থনা বা সৌজন্যতাকে বাহানা না করেই বঙ্গভবনে ছুটে গিয়েছিলেন। নিত্যদিনের সরকারি দলন-পীড়নে আক্রান্ত মীর্জা ফখরুলসহ দলের নেতারা এক কাতারবন্দি হয়েছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতির জানাজার নামাজে। কিন্তু বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সাহেব একজন সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে জনপ্রিয় হয়েও তার বঙ্গভবনের দুয়ার একজন বীরপ্রতীকের জন্য বন্ধ করে দেয়া হলো কার ইঙ্গিতে? এটা নিশ্চয়ই পূর্বপরিকল্পিত কিছু ছিল না। কারণ পূর্বপরিকল্পিত হলে ইবরাহিম সাহেবকে দাওয়াতই দেয়া হতো না। সরকারের মধ্যে অতি উৎসাহী কোন অপশক্তির ইশারায় এহেন লজ্জাজনক ঘটনা কোনোভাবেই সরকারের পক্ষে লাভজনক হয়েছে বলে কেউ বিশ্বাস করতে পারে না। আসলে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আমাদের জাতীয় ঐক্য গড়তে না পারলেও জাতির জন্য অনেক বড় প্রত্যাশার জন্ম দিতে পারে নিঃসন্দেহে। কী সরকারি দল, কী বিরোধী দল, দলমত নির্বিশেষে সকল দলের রংধনুতেই গণতন্ত্রের আসল সৌন্দর্য লুকায়িত। আমাদের দেশে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিরা কেন রাজনৈতিক শত্রুতে পরিণত হবেন? আমাদের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানগুলোতে সকল দলের পারস্পরিক সহাবস্থান কবে নিশ্চিত করা যাবে? এই তো ক’দিন আগে ভারতে কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাড়িতে চায়ের আমন্ত্রণে গেলেন। আর আমরা একদল আরেক দলকে চিরতরে নির্মূল করার শপথ নিয়েই যেন রাজনীতি করছি।
লেখক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
e-mail: drtuhinmalik@hotmail.com
No comments