বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং আইনের শাসন by এমাজউদ্দীন আহমদ
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এবং অধিকার সংরক্ষণের জন্য যদি রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়ে থাকে তাহলে বিচার বিভাগ হলো এর যথার্থতার মাপকাঠি। ব্রিটেনের সংবিধান বিশেষজ্ঞ লর্ড ব্রাইস (Bryce) বলেছেন, ‘কোনো জাতি রাজনৈতিক অগ্রগতির কোন স্তরে রয়েছে, তা নির্ণয় করার সবচেয়ে উত্তম উপায় হলো নাগরিকদের পরস্পরের মধ্যে এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নাগরিকদের মধ্যে বিচারব্যবস্থা কতটুকু ন্যায়ানুগ ও আইনানুগ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে তা বিচার করে দেখা। বলা হয়, আইন পরিষদ না থাকলেও রাষ্ট্র চলতে পারে, কেননা আইন পরিষদ ছাড়া আইনের অন্যান্য উৎস রয়েছে। আইন প্রথাভিত্তিকও হতে পারে। কিন্তু বিচার বিভাগ ছাড়া কোনো সুসংগঠিত সমাজ হতে পারে না। বিচার বিভাগ ছাড়া রাষ্ট্র অনেকটা ‘মাৎস্যন্যায়ের’ মতো, যেখানে বলপ্রয়োগই একমাত্র আইন। এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রের আইনবিশারদ রউল (Rawle) বলেছেন, ‘বিচার বিভাগ অপরিহার্য, কেননা তার মাধ্যমে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যায়ের শাস্তি বিধান করা হয়। ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়। নির্দোষ ব্যক্তিগণকে অন্যের হস্তক্ষেপ ও অন্যায় থেকে রক্ষা করা যায়।’
এসব যুক্তির ভিত্তিতেই রাষ্ট্রীয় কাঠামো সংগঠিত হয়েছে আইন প্রণয়ন, আইন প্রয়োগ এবং বিচারকার্য সম্পন্ন করার প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃত্বের সমন্বয়ে এবং প্রাচীনকাল থেকেই এই ব্যবস্থা চলে আসছে। সরকারের শ্রেণিবিভাগে ‘আইনভিত্তিক সরকার’ (The Government of Laws) এবং ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক সরকার’ (The Government of Men)-এর মধ্যে যে পার্থক্য অ্যারিস্টটল তার Politics গ্রন্থের তৃতীয় বিভাগে উল্লেখ করেছেন, তা-ও এই প্রেক্ষাপটে তাৎপর্যপূর্ণ। তাই বিচার বিভাগ হচ্ছে সরকারের এক অপরিহার্য অঙ্গ।
কিন্তু বিচার বিভাগকে তার ব্যক্তিত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হলে সরকারের জন্য দু’টি বিভাগ- আইন পরিষদ ও নির্বাহী কর্তৃত্ব থেকে শুধু স্বতন্ত্র হলেই চলবে না, স্বাধীনও হতে হবে; যেন তা আইন প্রণেতা এবং নির্বাহী কর্তৃত্বের প্রভাবমুক্ত হয়ে শুধু আইনের নিরিখে বিচারকেরা বিচার্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং আইন হলো অ্যারিস্টটলের কথায় ‘এক আবেগমুক্ত যুক্তি’। এই আবেগহীন যুক্তিকে পুরোপুরি ধারণ করতে হলে বিচারকদের শুধু নির্মোহ হলেই চলবে না, রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় তারা যেন কারো ওপর নির্ভরশীল না হন, কারো অনুরাগ অথবা বিরাগের পাত্র হিসেবে পিচ্ছিল পথে চলতে বাধ্য না হন তা নিশ্চিত হতে হবে এবং তা হতে হবে রাষ্ট্রের মাধ্যমে। তাই যুগে যুগে সরকারের তিনটি বিভাগ পৃথক করা এবং তাদের স্বতন্ত্র কার্যক্রমের ওপর জোর দেয়া হয়েছে, বিশেষ করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করা হয়েছে হাজার হাজার মঞ্চ থেকে।
ফেডারালিস্ট পেপার ৫১ (Federalist 51)-তে জেমস ম্যাডিসেন যা লিখেছিলেন তা উল্লেখযোগ্য। তার মতে, জনগণের অধিকার সংরক্ষণের জন্য সরকারের ক্ষমতার সীমারেখা নির্ধারিত হতে হবে এবং সরকার যেন তার ক্ষমতার অপব্যবহার না করতে পারে তারও রক্ষাকবচ থাকতে হবে। মানুষ যে স্বার্থপর এবং ক্ষমতালোভী, সুযোগ পেলেই যে একজন অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করবে এবং এ কারণেই যে সরকারের উৎপত্তি হয়েছে তা যেমন সত্য, তেমনি সত্য যে সরকারও সুযোগ পেলে নাগরিকদের অধিকারে অবলীলাক্রমে হস্তক্ষেপ করবে। তার নিজের কথায়, ‘মানুষ যদি দেবদূত হতো তাহলে কোনো সরকারের প্রয়োজন হতো না। যদি দেবদূতরা শাসনকাজে নিয়োজিত থাকতেন, তাহলে সরকারের ওপর অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক কোনো নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হতো না। মানুষের ওপর মানুষের শাসন পরিচালনার জন্য গঠিত সরকারব্যবস্থার এই হলো সবচেয়ে বড় অসুবিধা। শাসিতদের ওপর শাসকদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সবার আগে করতে হবে এবং এর পরপরই সরকারকে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তথা ফাউন্ডিং ফাদার আলেকজান্ডার হ্যামিলটন জেমস ম্যাডিসন থেকে আরো জোরেশোরে ফেডারালিস্ট পেপার-৭৮-এ (Federalist 78) লিখেছেন, ‘ষড়যন্ত্রকারীদের দুষ্কর্ম অথবা বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী প্রভাবশালীদের বক্তব্য-বিবৃতি প্রচারের মুখে সংবিধান এবং জনগণের অধিকার রক্ষার জন্য বিচারকদের স্বাধীনতাই হলো প্রকৃষ্ট রক্ষাকবচ।’
শুধু তখন কেন, সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা সংবিধান বিশেষজ্ঞরা এ সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করে চলেছেন। ১৯৫৫ সালে American Political Science Review-APSR(49)-এ প্রকাশিত ‘Judicial Self Restraint’ শিরোনামে এক প্রবন্ধে জন রচে (John P. Roche) লিখেছেন- ‘জনগণকে জনগণের কাছ থেকে রক্ষা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে বিচারব্যবস্থার অভিভাবকত্ব ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান উপযোগী নয়, কেননা এটি দেশে আইনের শাসনের অঙ্গীকারে নিবেদিতপ্রাণ’। তিনি এখানেই থামেননি। তার কথায় ‘রাষ্ট্রদেহে সত্যের রস সঞ্চারের প্রশ্নাতীতভাবে সবচেয়ে বড় ভরসা হলো যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত, বিশেষ করে সুপ্রিম কোর্টের ওপর আস্থা।’
উনিশ শতকের শেষপ্রান্তে ব্রিটেনের খ্যাতনামা সংবিধান বিশেষজ্ঞ এভি ডাইসি (AV Dicey) তার খধি Law of the Constitution (1885) গ্রন্থে যেভাবে তিনি ব্রিটেনে আইনের শাসনের ব্যাখ্যা দিলেন তাতে বিচার বিভাগের শ্র্রেষ্ঠত্বকে প্রায় আকাশচুম্বী করে তোলেন। তার মতে, জনগণের অধিকার কোনো সাংবিধানিক আইন থেকে উদ্ভূত নয়; বরং গণ-অধিকারের ভিত্তিতেই সাংবিধানিক আইন রচিত হয়েছে। অন্য কথায়, ডাইসির কথায়, অন্যান্য দেশে জনগণের অধিকারের রক্ষাকবচ যেমন সংবিধানে বিধিবদ্ধ আইন, ব্রিটেনে কিন্তু বিভিন্ন আদালতের রায়ে সুনির্দিষ্ট, সুনির্ধারিত ও প্রতিষ্ঠিত অধিকারগুলোই সাংবিধানিক আইনে রূপান্তরিত হয়েছে। ব্রিটেনের সাধারণ আদালতের সিদ্ধান্তে নাগরিকদের অধিকারের সনদ রচিত হয়েছে। সুতরাং ব্রিটেনে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ভিত্তিতেই নাগরিকদের অধিকারমালা সুপ্রতিষ্ঠিত। তাই এখানে অধিকার রক্ষার জন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কোনো দাবি নেই। দাবি করার আগেই তা প্রতিষ্ঠিত, অনেকটা স্বতঃসিদ্ধের মতোই। অনেকটা সুসভ্য জীবনব্যবস্থার মৌল উপাদান রূপেই, উন্নততর রাজনৈতিক সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ ফল হিসেবে।
সংবিধান গণ-অধিকারের মূল নয়, বরং গণ-অধিকারই সংবিধানের মূল এবং তা সাধারণ আদালতেরই সৃষ্টি। কিন্তু বাংলাদেশে বিচার বিভাগের এই দুরবস্থা কেন? স্বাধীনতার প্রায় তিন দশক পরও কেন বাংলাদেশের জনগণকে আজো বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য মিটিং-মিছিল করতে হয়? কেন এখনো বিচার বিভাগের স্বাধীনতার দাবিতে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখতে হয়? এ দেশে বুদ্ধিজীবীরা জানেন, পাকিস্তান আমল থেকে এখন পর্যন্ত সার্থক যেকোনো গণ-আন্দোলনে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার দাবি সব সময় উত্থাপিত হয়েছে। প্রত্যেকের মনে রয়েছে, ১৯৫৪ সালের ২১ দফা দাবিনামার ১৫তম দাবিটি ছিল প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সময় ছাত্রদের পক্ষ থেকে যে ১১ দফা দাবি উত্থাপিত হয়, এর নবম ও ১১তম দফায় ছিল স্বাধীন বিচার বিভাগের দাবি। এরও আগে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দাবির প্রেক্ষাপটে ১৯৫৬ সাল ও ১৯৬২ সালের পাকিস্তানের সংবিধানে বিচার বিভাগ আলাদা করার প্রস্তাব স্থান পায়।
এক রক্তের নদী সাঁতরে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা চিনিয়ে আনলে নতুন সংবিধানে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নিশ্চিত করে বাংলাদেশে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল সংবিধানের ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদসহ অন্যান্য অনুচ্ছেদে। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের সময়ও তিনদলীয় জোটের যে ক’টি ক্ষেত্রে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয় এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বাংলাদেশে স্বতন্ত্র এবং স্বাধীন বিচার বিভাগ সম্পর্কিত বক্তব্য। সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধন আইনেও এই প্রস্তাবটি স্থান পেয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই জনপদে যে ক’টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, ১৯৫৪ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনে অংশ নেয়া প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে নির্ভুলভাবে এ দাবিটি স্থান পেয়ে এসেছে যে, বাংলাদেশে বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন হবে। এর পরও এই এলাকা আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠল না এখনো। এর পরও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সম্পর্কে বিভ্রান্তির কোনো অবসান হলো না। বিচার বিভাগ প্রশাসন থেকে পৃথক করা হলো না।
শুধু বাংলাদেশে নয়, বিদেশেও বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে প্রকাশিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে প্রচুর হতাশা। বার্লিন-ভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এক প্রতিবেদনে বলেছে, ‘বাংলাদেশের বিচার প্রার্থীদের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যক ব্যক্তিকে বিচার কিনতে হয়। অর্থ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা না থাকলে কর্মকর্তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহের প্রকাশ ঘটে না। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এই বক্তব্য অবশ্য বাংলাদেশের বিচার বিভাগের নি¤œ পর্যায় সম্পর্কে। এত ঘন অন্ধকারের মধ্যেও কিন্তু বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার শীর্ষ পর্যায়, বিশেষ করে সুপ্রিম কোর্ট জ্বালিয়ে রেখেছে গণমনে আস্থা ও বিশ্বাসের উজ্জ্বল এক দীপশিখা। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রকাশিত ‘কান্ট্রি রিপোর্ট’গুলোতে রয়েছে এর উজ্জ্বল স্বাক্ষর। ১৯৯৯ সালের কান্ট্রি রিপোর্টে লিখিত হয়েছে, ‘বিচার বিভাগের উচ্চতর পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ স্বাধীনতা পরিলক্ষিত হলেও এবং এই পর্যায় থেকে ফৌজদারি, সিভিল, এমনকি বিতর্কিত রাজনৈতিক মামলায় বিচার বিভাগ সরকারের বিরুদ্ধে রায় দিলেও নি¤œপর্যায়ের আদালতগুলো এখনো রয়েছে নির্বাহী বিভাগের চাপের মুখে। আইনগত প্রক্রিয়া দুর্নীতিপূর্ণ, বিশেষ করে নি¤œপর্যায়ে।’
এ দেশের বড় দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশের বিচার বিভাগের যে শীর্ষ পর্যায় হাজারো প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও মাথা উঁচু করে রয়েছে তার বিরুদ্ধেও রচিত হচ্ছে ষড়যন্ত্রের কালো কুণ্ডলি। বিষধর সর্প যেন নতুনভাবে ফণা উদ্যত করেছে বিচার বিভাগের শীর্ষের বিরুদ্ধে। নি¤œস্তর তো এরই মধ্যে দুর্নীতি ও নির্বাহী কর্তৃত্বের করালগ্রাসের মধ্যে এসে গেছে, যা এখনো দেশের বিচার প্রার্থীদের শেষ ভরসাস্থল তাও বুঝি নিঃশেষ হয়। ক’বছর আগে, সাধারণ উত্তেজিত জনতা কর্তৃক নয়, বরং ক্ষমতাসীন দলের বেশ ক’জন মন্ত্রী ও দলীয় নেতার নেতৃত্বে পল্টন ময়দান থেকে লাঠি উঁচিয়ে, মাথায় ও গলায় কাফনের কাপড় জড়িয়ে হাইকোর্টের বিচারপতিদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে যে মিছিলের আয়োজন হয়, তা কি কোনো সাময়িক উত্তেজনার ফল? প্রধানমন্ত্রী বিদেশ থেকে ফিরে এসে ওই মিছিলের পক্ষ সমর্থন করে যে বক্তব্য দেন, তা কি কোনো অশনিসঙ্কেত? এই নিবন্ধে তার বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে।
দুই.
বাংলাদেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ইতিহাস মোটেই উজ্জ্বল নয়। অনল কুণ্ড থেকে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার রক্তরঞ্জিত পতাকা ছিনিয়ে আনে। জনগণের প্রত্যাশা ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীন বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশে প্রবর্তিত হবে আইনের শাসন। স্বাধীনতার আগে পাকিস্তানে কারণে-অকারণে সরকার যেভাবে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে, বাংলাদেশে তার অবসান ঘটবে। তাই ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের যে সংবিধান রচিত হয়, ১৬ ডিসেম্বর থেকে যা কার্যকর হয়, সেই সংবিধান জনগণের ২২টি মৌলিক অধিকার স্বীকার করে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগকে মৌলিক অধিকারগুলো বলবৎ করার ক্ষমতা দিয়ে এবং সংবিধানে জরুরি অবস্থা ঘোষণার কোনো ব্যবস্থা না রেখে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। মনে হয়েছিল, জনগণের প্রত্যাশা এত দিন পরে বুঝি পূর্ণ হলো। কিন্তু না, সে অবস্থা বেশি দিন টেকেনি। বাংলাদেশ সংবিধান কার্যকর হওয়ার মাত্র ৯ মাস সাত দিন পরে, ১৯৭৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর, জাতীয় সংসদ সংবিধান (দ্বিতীয় সংশোধন) আইন প্রণয়ন করে নির্বাহী বিভাগের হাতে মৌলিক অধিকারপরিপন্থী ক্ষমতা অর্পণ করে। সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সর্বপ্রথম জাতীয় সংসদকে বিনা বিচারে আটক রাখা সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা দেয়া হয় এই সংশোধনী আইনের মাধ্যমে সংবিধানে এই সংশোধনী আইন সংযোজিত হওয়ার মাত্র চার মাস ১০ দিনের মধ্যেই ১৯৭৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রণীত হয়, যা এখনো বাংলাদেশে বিদ্যমান রয়েছে কুখ্যাত কালাকানুন রূপে। সংবিধানের (দ্বিতীয় সংশোধনী) আইনের মাধ্যমে যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবন বিপন্ন হলে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে প্রেসিডেন্টকে জরুরি অবস্থা ঘোষণার ক্ষমতা দেয়া হয়। জরুরি অবস্থা জারি করা হলে নাগরিকদের ছয়টি মৌলিক অধিকার স্থগিত করার বিধান সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই ছয়টি মৌলিক অধিকার হলো চলাফেলার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের অধিকার, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতা, পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা এবং সম্পত্তির অধিকার। যেকোনো গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি হলো এসব অধিকার। জরুরি অবস্থায় যেকোনো মৌলিক অধিকার বলবৎ করার লক্ষ্যে আদালতে মামলা করার অধিকার স্থগিত করার ক্ষমতাও দেয়া হয় রাষ্ট্রপতিকে। জরুরি অবস্থা ঘোষণা সংক্রান্ত বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার এক বছর তিন মাস পরে ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বরে অভ্যন্তরীণ গোলযোগের ফলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক জীবন বিপদের মুখোমুখি হয়েছে, এই অজুহাতে বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়।
জরুরি অবস্থা কার্যকর থাকাকালেই ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সংবিধান (চতুর্থ সংশোধনী) আইন প্রণয়ন করে বাংলাদেশ থেকে সংসদীয় ব্যবস্থাকে নির্বাসন দিয়ে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রপতি সরকার প্রবর্তন করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে খর্ব করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের মৌলিক অধিকার বলবৎ করার ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়। রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলোর যেকোনো একটিকে কার্যকর করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতিকে একটি মাত্র ‘জাতীয় দল’ গঠনের ক্ষমতা দেয়া হয় এবং বিধান থাকে যে, জাতীয় দল গঠিত হলে দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল আপনাআপনি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এই অবস্থা অব্যাহত তাকে ১৯৭৬ সালের ২৮ মে পর্যন্ত। ২৮ মে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (সপ্তম সংশোধনী) আদেশের ফলে সংবিধান (চতুর্থ সংশোধনী) আইনের মাধ্যমে বিচার বিভাগের যে স্বাধীনতা খর্ব করা হয় এবং সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক মৌলিক অধিকার বলবৎ করার যে এখতিয়ার কেড়ে নেয়া হয়, তা সংবিধানে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর তৃতীয় ঘোষণাপত্র অনুযায়ী মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং এর পাঁচ মাস পরে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিলে তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং মৌলিক অধিকার বলবৎ করার ক্ষেত্রে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।
সংবিধান (চতুর্থ সংশোধনী) আইনের কুপ্রভাব সম্পর্কে অষ্টম সংশোধনীর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ যে রায় ঘোষণা করেছিলেন সেই রায়ে তখনকার অন্যতম বিচারপতি, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারির সংবিধান (চতুর্থ সংশোধনী) বাংলাদেশ সংবিধানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন সব পরিবর্তন আনে, যা তার মৌল কাঠামো পর্যন্ত পাল্টে দেয়। বহুদল-ভিত্তিক সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকার রাতারাতি পাল্টে সৃষ্টি করা হয় একদল-ভিত্তিক কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার। সংগঠনের স্বাধীনতার মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। সরকারি দল ছাড়া অন্যান্য সব দলকে নিষিদ্ধ করা হয়। জনগণের নির্বাচিত সত্ত্বেও জাতীয় সংসদের যেসব সদস্য এই সরকারি দলে যোগ দেননি তাদের আসন শূন্য হয়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে হ্রাস করা হয়।’
এই সংশোধনী আইনে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কিভাবে ক্ষুণ করা হয় তার বিবরণ দিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘প্রধান নির্বাহীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর বিচারপতিদের অপসারণ নির্ভরশীল করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কমানো হয়।’ অধস্তন আদালতগুলোর ওপর সুপ্রিম কোর্টের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার বিলোপ ঘটিয়ে, তা সুপ্রিম কোর্টের পরিবর্তে ন্যস্ত করা হয় সরকারের ওপর। এসব পরিবর্তন এত মারাত্মক এবং তাৎক্ষণিক ছিল যে, স্বাধীনতার বন্ধুরা হন বিভক্ত। স্বাধীনতার শত্রুরা প্রতিশোধ নিলেন। সমালোচকেরা উচ্ছ্বাস ভরে বললেন, ‘গণতন্ত্রের এই বিনাশ সাধনের প্রক্রিয়া একই, তা সে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়েই হোক আর সামরিক অভ্যুত্থানের মতো পদ্ধতিতেই হোক।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও কিন্তু বিচার বিভাগের স্বাধীনতা তার পূর্বতন অবস্থানে ফিরিয়ে নেয়ার কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। মাঝে মধ্যে ছোটখাটো দু-চারটি পদক্ষেপ নেয়া হয় মাত্র। ১৯৭৬ সালের ২৮ মে রাষ্ট্রপতি সায়েম তার দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (সপ্তম সংশোধনী) আদেশে চতুর্থ সংশোধনী আইনে সুপ্রিম কোর্টের মৌলিক অধিকার বলবৎ করার যে ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছিল, তা পুনঃস্থাপিত হয়। তা ছাড়া চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে সংশোধনী এনে যেখানে বলা হয়েছিলÑ ‘বিচারকর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান ও ছুটি মঞ্জুরীকরণসহ) ও শৃঙ্খলা বিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ব্যস্ত থাকিবে’, সে ক্ষেত্রে ১৯৭৯ সালে গৃহীত সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইনের মাধ্যমে ১১৬ অনুচ্ছেদে ‘ন্যস্ত থাকিবে’ শব্দ দু’টির পরে সংযোজিত হয় ‘এবং সুপ্রিম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে’। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে কিন্তু ব্যবস্থা ছিল সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অধস্তন আদালতের বিচার বিভাগীয় পদে অথবা বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনকারী ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগের জন্য সুপ্রিম কোর্টের সুপারিশ ও পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে তারা নিযুক্ত হবেন। চতুর্থ সংশোধনী আইনের বিষক্রিয়া বিচার বিভাগের ওপর এতই মারাত্মক ছিল যে, আজো এতগুলো সংশোধনীর পরও বিচার বিভাগ তার স্বাভাবিক স্বাস্থ্য ফিরে পায়নি।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতার দাবি সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে জোরেশোরে বিঘোষিত হয়েছে। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১১৫ এবং ১১৬ অনুচ্ছেদ ছিল তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। ২২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।’ চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে হাজার হাজার যোজন দূরে ঠেলে ফেলে বরং নির্বাহী বিভাগের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এই অবস্থার আংশিক পরিবর্তন এসেছিল বটে, কিন্তু স্বাধীনতার কাছাকাছি তা আসেনি।
লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এসব যুক্তির ভিত্তিতেই রাষ্ট্রীয় কাঠামো সংগঠিত হয়েছে আইন প্রণয়ন, আইন প্রয়োগ এবং বিচারকার্য সম্পন্ন করার প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃত্বের সমন্বয়ে এবং প্রাচীনকাল থেকেই এই ব্যবস্থা চলে আসছে। সরকারের শ্রেণিবিভাগে ‘আইনভিত্তিক সরকার’ (The Government of Laws) এবং ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক সরকার’ (The Government of Men)-এর মধ্যে যে পার্থক্য অ্যারিস্টটল তার Politics গ্রন্থের তৃতীয় বিভাগে উল্লেখ করেছেন, তা-ও এই প্রেক্ষাপটে তাৎপর্যপূর্ণ। তাই বিচার বিভাগ হচ্ছে সরকারের এক অপরিহার্য অঙ্গ।
কিন্তু বিচার বিভাগকে তার ব্যক্তিত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হলে সরকারের জন্য দু’টি বিভাগ- আইন পরিষদ ও নির্বাহী কর্তৃত্ব থেকে শুধু স্বতন্ত্র হলেই চলবে না, স্বাধীনও হতে হবে; যেন তা আইন প্রণেতা এবং নির্বাহী কর্তৃত্বের প্রভাবমুক্ত হয়ে শুধু আইনের নিরিখে বিচারকেরা বিচার্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং আইন হলো অ্যারিস্টটলের কথায় ‘এক আবেগমুক্ত যুক্তি’। এই আবেগহীন যুক্তিকে পুরোপুরি ধারণ করতে হলে বিচারকদের শুধু নির্মোহ হলেই চলবে না, রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় তারা যেন কারো ওপর নির্ভরশীল না হন, কারো অনুরাগ অথবা বিরাগের পাত্র হিসেবে পিচ্ছিল পথে চলতে বাধ্য না হন তা নিশ্চিত হতে হবে এবং তা হতে হবে রাষ্ট্রের মাধ্যমে। তাই যুগে যুগে সরকারের তিনটি বিভাগ পৃথক করা এবং তাদের স্বতন্ত্র কার্যক্রমের ওপর জোর দেয়া হয়েছে, বিশেষ করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করা হয়েছে হাজার হাজার মঞ্চ থেকে।
ফেডারালিস্ট পেপার ৫১ (Federalist 51)-তে জেমস ম্যাডিসেন যা লিখেছিলেন তা উল্লেখযোগ্য। তার মতে, জনগণের অধিকার সংরক্ষণের জন্য সরকারের ক্ষমতার সীমারেখা নির্ধারিত হতে হবে এবং সরকার যেন তার ক্ষমতার অপব্যবহার না করতে পারে তারও রক্ষাকবচ থাকতে হবে। মানুষ যে স্বার্থপর এবং ক্ষমতালোভী, সুযোগ পেলেই যে একজন অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করবে এবং এ কারণেই যে সরকারের উৎপত্তি হয়েছে তা যেমন সত্য, তেমনি সত্য যে সরকারও সুযোগ পেলে নাগরিকদের অধিকারে অবলীলাক্রমে হস্তক্ষেপ করবে। তার নিজের কথায়, ‘মানুষ যদি দেবদূত হতো তাহলে কোনো সরকারের প্রয়োজন হতো না। যদি দেবদূতরা শাসনকাজে নিয়োজিত থাকতেন, তাহলে সরকারের ওপর অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক কোনো নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হতো না। মানুষের ওপর মানুষের শাসন পরিচালনার জন্য গঠিত সরকারব্যবস্থার এই হলো সবচেয়ে বড় অসুবিধা। শাসিতদের ওপর শাসকদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সবার আগে করতে হবে এবং এর পরপরই সরকারকে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তথা ফাউন্ডিং ফাদার আলেকজান্ডার হ্যামিলটন জেমস ম্যাডিসন থেকে আরো জোরেশোরে ফেডারালিস্ট পেপার-৭৮-এ (Federalist 78) লিখেছেন, ‘ষড়যন্ত্রকারীদের দুষ্কর্ম অথবা বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী প্রভাবশালীদের বক্তব্য-বিবৃতি প্রচারের মুখে সংবিধান এবং জনগণের অধিকার রক্ষার জন্য বিচারকদের স্বাধীনতাই হলো প্রকৃষ্ট রক্ষাকবচ।’
শুধু তখন কেন, সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা সংবিধান বিশেষজ্ঞরা এ সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করে চলেছেন। ১৯৫৫ সালে American Political Science Review-APSR(49)-এ প্রকাশিত ‘Judicial Self Restraint’ শিরোনামে এক প্রবন্ধে জন রচে (John P. Roche) লিখেছেন- ‘জনগণকে জনগণের কাছ থেকে রক্ষা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে বিচারব্যবস্থার অভিভাবকত্ব ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান উপযোগী নয়, কেননা এটি দেশে আইনের শাসনের অঙ্গীকারে নিবেদিতপ্রাণ’। তিনি এখানেই থামেননি। তার কথায় ‘রাষ্ট্রদেহে সত্যের রস সঞ্চারের প্রশ্নাতীতভাবে সবচেয়ে বড় ভরসা হলো যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত, বিশেষ করে সুপ্রিম কোর্টের ওপর আস্থা।’
উনিশ শতকের শেষপ্রান্তে ব্রিটেনের খ্যাতনামা সংবিধান বিশেষজ্ঞ এভি ডাইসি (AV Dicey) তার খধি Law of the Constitution (1885) গ্রন্থে যেভাবে তিনি ব্রিটেনে আইনের শাসনের ব্যাখ্যা দিলেন তাতে বিচার বিভাগের শ্র্রেষ্ঠত্বকে প্রায় আকাশচুম্বী করে তোলেন। তার মতে, জনগণের অধিকার কোনো সাংবিধানিক আইন থেকে উদ্ভূত নয়; বরং গণ-অধিকারের ভিত্তিতেই সাংবিধানিক আইন রচিত হয়েছে। অন্য কথায়, ডাইসির কথায়, অন্যান্য দেশে জনগণের অধিকারের রক্ষাকবচ যেমন সংবিধানে বিধিবদ্ধ আইন, ব্রিটেনে কিন্তু বিভিন্ন আদালতের রায়ে সুনির্দিষ্ট, সুনির্ধারিত ও প্রতিষ্ঠিত অধিকারগুলোই সাংবিধানিক আইনে রূপান্তরিত হয়েছে। ব্রিটেনের সাধারণ আদালতের সিদ্ধান্তে নাগরিকদের অধিকারের সনদ রচিত হয়েছে। সুতরাং ব্রিটেনে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ভিত্তিতেই নাগরিকদের অধিকারমালা সুপ্রতিষ্ঠিত। তাই এখানে অধিকার রক্ষার জন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কোনো দাবি নেই। দাবি করার আগেই তা প্রতিষ্ঠিত, অনেকটা স্বতঃসিদ্ধের মতোই। অনেকটা সুসভ্য জীবনব্যবস্থার মৌল উপাদান রূপেই, উন্নততর রাজনৈতিক সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ ফল হিসেবে।
সংবিধান গণ-অধিকারের মূল নয়, বরং গণ-অধিকারই সংবিধানের মূল এবং তা সাধারণ আদালতেরই সৃষ্টি। কিন্তু বাংলাদেশে বিচার বিভাগের এই দুরবস্থা কেন? স্বাধীনতার প্রায় তিন দশক পরও কেন বাংলাদেশের জনগণকে আজো বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য মিটিং-মিছিল করতে হয়? কেন এখনো বিচার বিভাগের স্বাধীনতার দাবিতে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখতে হয়? এ দেশে বুদ্ধিজীবীরা জানেন, পাকিস্তান আমল থেকে এখন পর্যন্ত সার্থক যেকোনো গণ-আন্দোলনে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার দাবি সব সময় উত্থাপিত হয়েছে। প্রত্যেকের মনে রয়েছে, ১৯৫৪ সালের ২১ দফা দাবিনামার ১৫তম দাবিটি ছিল প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সময় ছাত্রদের পক্ষ থেকে যে ১১ দফা দাবি উত্থাপিত হয়, এর নবম ও ১১তম দফায় ছিল স্বাধীন বিচার বিভাগের দাবি। এরও আগে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দাবির প্রেক্ষাপটে ১৯৫৬ সাল ও ১৯৬২ সালের পাকিস্তানের সংবিধানে বিচার বিভাগ আলাদা করার প্রস্তাব স্থান পায়।
এক রক্তের নদী সাঁতরে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা চিনিয়ে আনলে নতুন সংবিধানে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নিশ্চিত করে বাংলাদেশে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল সংবিধানের ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদসহ অন্যান্য অনুচ্ছেদে। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের সময়ও তিনদলীয় জোটের যে ক’টি ক্ষেত্রে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয় এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বাংলাদেশে স্বতন্ত্র এবং স্বাধীন বিচার বিভাগ সম্পর্কিত বক্তব্য। সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধন আইনেও এই প্রস্তাবটি স্থান পেয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই জনপদে যে ক’টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, ১৯৫৪ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনে অংশ নেয়া প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে নির্ভুলভাবে এ দাবিটি স্থান পেয়ে এসেছে যে, বাংলাদেশে বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন হবে। এর পরও এই এলাকা আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠল না এখনো। এর পরও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সম্পর্কে বিভ্রান্তির কোনো অবসান হলো না। বিচার বিভাগ প্রশাসন থেকে পৃথক করা হলো না।
শুধু বাংলাদেশে নয়, বিদেশেও বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে প্রকাশিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে প্রচুর হতাশা। বার্লিন-ভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এক প্রতিবেদনে বলেছে, ‘বাংলাদেশের বিচার প্রার্থীদের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যক ব্যক্তিকে বিচার কিনতে হয়। অর্থ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা না থাকলে কর্মকর্তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহের প্রকাশ ঘটে না। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এই বক্তব্য অবশ্য বাংলাদেশের বিচার বিভাগের নি¤œ পর্যায় সম্পর্কে। এত ঘন অন্ধকারের মধ্যেও কিন্তু বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার শীর্ষ পর্যায়, বিশেষ করে সুপ্রিম কোর্ট জ্বালিয়ে রেখেছে গণমনে আস্থা ও বিশ্বাসের উজ্জ্বল এক দীপশিখা। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রকাশিত ‘কান্ট্রি রিপোর্ট’গুলোতে রয়েছে এর উজ্জ্বল স্বাক্ষর। ১৯৯৯ সালের কান্ট্রি রিপোর্টে লিখিত হয়েছে, ‘বিচার বিভাগের উচ্চতর পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ স্বাধীনতা পরিলক্ষিত হলেও এবং এই পর্যায় থেকে ফৌজদারি, সিভিল, এমনকি বিতর্কিত রাজনৈতিক মামলায় বিচার বিভাগ সরকারের বিরুদ্ধে রায় দিলেও নি¤œপর্যায়ের আদালতগুলো এখনো রয়েছে নির্বাহী বিভাগের চাপের মুখে। আইনগত প্রক্রিয়া দুর্নীতিপূর্ণ, বিশেষ করে নি¤œপর্যায়ে।’
এ দেশের বড় দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশের বিচার বিভাগের যে শীর্ষ পর্যায় হাজারো প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও মাথা উঁচু করে রয়েছে তার বিরুদ্ধেও রচিত হচ্ছে ষড়যন্ত্রের কালো কুণ্ডলি। বিষধর সর্প যেন নতুনভাবে ফণা উদ্যত করেছে বিচার বিভাগের শীর্ষের বিরুদ্ধে। নি¤œস্তর তো এরই মধ্যে দুর্নীতি ও নির্বাহী কর্তৃত্বের করালগ্রাসের মধ্যে এসে গেছে, যা এখনো দেশের বিচার প্রার্থীদের শেষ ভরসাস্থল তাও বুঝি নিঃশেষ হয়। ক’বছর আগে, সাধারণ উত্তেজিত জনতা কর্তৃক নয়, বরং ক্ষমতাসীন দলের বেশ ক’জন মন্ত্রী ও দলীয় নেতার নেতৃত্বে পল্টন ময়দান থেকে লাঠি উঁচিয়ে, মাথায় ও গলায় কাফনের কাপড় জড়িয়ে হাইকোর্টের বিচারপতিদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে যে মিছিলের আয়োজন হয়, তা কি কোনো সাময়িক উত্তেজনার ফল? প্রধানমন্ত্রী বিদেশ থেকে ফিরে এসে ওই মিছিলের পক্ষ সমর্থন করে যে বক্তব্য দেন, তা কি কোনো অশনিসঙ্কেত? এই নিবন্ধে তার বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে।
দুই.
বাংলাদেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ইতিহাস মোটেই উজ্জ্বল নয়। অনল কুণ্ড থেকে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার রক্তরঞ্জিত পতাকা ছিনিয়ে আনে। জনগণের প্রত্যাশা ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীন বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশে প্রবর্তিত হবে আইনের শাসন। স্বাধীনতার আগে পাকিস্তানে কারণে-অকারণে সরকার যেভাবে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে, বাংলাদেশে তার অবসান ঘটবে। তাই ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের যে সংবিধান রচিত হয়, ১৬ ডিসেম্বর থেকে যা কার্যকর হয়, সেই সংবিধান জনগণের ২২টি মৌলিক অধিকার স্বীকার করে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগকে মৌলিক অধিকারগুলো বলবৎ করার ক্ষমতা দিয়ে এবং সংবিধানে জরুরি অবস্থা ঘোষণার কোনো ব্যবস্থা না রেখে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। মনে হয়েছিল, জনগণের প্রত্যাশা এত দিন পরে বুঝি পূর্ণ হলো। কিন্তু না, সে অবস্থা বেশি দিন টেকেনি। বাংলাদেশ সংবিধান কার্যকর হওয়ার মাত্র ৯ মাস সাত দিন পরে, ১৯৭৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর, জাতীয় সংসদ সংবিধান (দ্বিতীয় সংশোধন) আইন প্রণয়ন করে নির্বাহী বিভাগের হাতে মৌলিক অধিকারপরিপন্থী ক্ষমতা অর্পণ করে। সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সর্বপ্রথম জাতীয় সংসদকে বিনা বিচারে আটক রাখা সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা দেয়া হয় এই সংশোধনী আইনের মাধ্যমে সংবিধানে এই সংশোধনী আইন সংযোজিত হওয়ার মাত্র চার মাস ১০ দিনের মধ্যেই ১৯৭৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রণীত হয়, যা এখনো বাংলাদেশে বিদ্যমান রয়েছে কুখ্যাত কালাকানুন রূপে। সংবিধানের (দ্বিতীয় সংশোধনী) আইনের মাধ্যমে যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবন বিপন্ন হলে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে প্রেসিডেন্টকে জরুরি অবস্থা ঘোষণার ক্ষমতা দেয়া হয়। জরুরি অবস্থা জারি করা হলে নাগরিকদের ছয়টি মৌলিক অধিকার স্থগিত করার বিধান সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই ছয়টি মৌলিক অধিকার হলো চলাফেলার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের অধিকার, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতা, পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা এবং সম্পত্তির অধিকার। যেকোনো গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি হলো এসব অধিকার। জরুরি অবস্থায় যেকোনো মৌলিক অধিকার বলবৎ করার লক্ষ্যে আদালতে মামলা করার অধিকার স্থগিত করার ক্ষমতাও দেয়া হয় রাষ্ট্রপতিকে। জরুরি অবস্থা ঘোষণা সংক্রান্ত বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার এক বছর তিন মাস পরে ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বরে অভ্যন্তরীণ গোলযোগের ফলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক জীবন বিপদের মুখোমুখি হয়েছে, এই অজুহাতে বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়।
জরুরি অবস্থা কার্যকর থাকাকালেই ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সংবিধান (চতুর্থ সংশোধনী) আইন প্রণয়ন করে বাংলাদেশ থেকে সংসদীয় ব্যবস্থাকে নির্বাসন দিয়ে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রপতি সরকার প্রবর্তন করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে খর্ব করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের মৌলিক অধিকার বলবৎ করার ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়। রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলোর যেকোনো একটিকে কার্যকর করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতিকে একটি মাত্র ‘জাতীয় দল’ গঠনের ক্ষমতা দেয়া হয় এবং বিধান থাকে যে, জাতীয় দল গঠিত হলে দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল আপনাআপনি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এই অবস্থা অব্যাহত তাকে ১৯৭৬ সালের ২৮ মে পর্যন্ত। ২৮ মে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (সপ্তম সংশোধনী) আদেশের ফলে সংবিধান (চতুর্থ সংশোধনী) আইনের মাধ্যমে বিচার বিভাগের যে স্বাধীনতা খর্ব করা হয় এবং সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক মৌলিক অধিকার বলবৎ করার যে এখতিয়ার কেড়ে নেয়া হয়, তা সংবিধানে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর তৃতীয় ঘোষণাপত্র অনুযায়ী মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং এর পাঁচ মাস পরে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিলে তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং মৌলিক অধিকার বলবৎ করার ক্ষেত্রে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।
সংবিধান (চতুর্থ সংশোধনী) আইনের কুপ্রভাব সম্পর্কে অষ্টম সংশোধনীর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ যে রায় ঘোষণা করেছিলেন সেই রায়ে তখনকার অন্যতম বিচারপতি, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারির সংবিধান (চতুর্থ সংশোধনী) বাংলাদেশ সংবিধানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন সব পরিবর্তন আনে, যা তার মৌল কাঠামো পর্যন্ত পাল্টে দেয়। বহুদল-ভিত্তিক সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকার রাতারাতি পাল্টে সৃষ্টি করা হয় একদল-ভিত্তিক কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার। সংগঠনের স্বাধীনতার মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। সরকারি দল ছাড়া অন্যান্য সব দলকে নিষিদ্ধ করা হয়। জনগণের নির্বাচিত সত্ত্বেও জাতীয় সংসদের যেসব সদস্য এই সরকারি দলে যোগ দেননি তাদের আসন শূন্য হয়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে হ্রাস করা হয়।’
এই সংশোধনী আইনে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কিভাবে ক্ষুণ করা হয় তার বিবরণ দিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘প্রধান নির্বাহীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর বিচারপতিদের অপসারণ নির্ভরশীল করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কমানো হয়।’ অধস্তন আদালতগুলোর ওপর সুপ্রিম কোর্টের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার বিলোপ ঘটিয়ে, তা সুপ্রিম কোর্টের পরিবর্তে ন্যস্ত করা হয় সরকারের ওপর। এসব পরিবর্তন এত মারাত্মক এবং তাৎক্ষণিক ছিল যে, স্বাধীনতার বন্ধুরা হন বিভক্ত। স্বাধীনতার শত্রুরা প্রতিশোধ নিলেন। সমালোচকেরা উচ্ছ্বাস ভরে বললেন, ‘গণতন্ত্রের এই বিনাশ সাধনের প্রক্রিয়া একই, তা সে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়েই হোক আর সামরিক অভ্যুত্থানের মতো পদ্ধতিতেই হোক।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও কিন্তু বিচার বিভাগের স্বাধীনতা তার পূর্বতন অবস্থানে ফিরিয়ে নেয়ার কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। মাঝে মধ্যে ছোটখাটো দু-চারটি পদক্ষেপ নেয়া হয় মাত্র। ১৯৭৬ সালের ২৮ মে রাষ্ট্রপতি সায়েম তার দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (সপ্তম সংশোধনী) আদেশে চতুর্থ সংশোধনী আইনে সুপ্রিম কোর্টের মৌলিক অধিকার বলবৎ করার যে ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছিল, তা পুনঃস্থাপিত হয়। তা ছাড়া চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে সংশোধনী এনে যেখানে বলা হয়েছিলÑ ‘বিচারকর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান ও ছুটি মঞ্জুরীকরণসহ) ও শৃঙ্খলা বিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ব্যস্ত থাকিবে’, সে ক্ষেত্রে ১৯৭৯ সালে গৃহীত সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইনের মাধ্যমে ১১৬ অনুচ্ছেদে ‘ন্যস্ত থাকিবে’ শব্দ দু’টির পরে সংযোজিত হয় ‘এবং সুপ্রিম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে’। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে কিন্তু ব্যবস্থা ছিল সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অধস্তন আদালতের বিচার বিভাগীয় পদে অথবা বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনকারী ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগের জন্য সুপ্রিম কোর্টের সুপারিশ ও পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে তারা নিযুক্ত হবেন। চতুর্থ সংশোধনী আইনের বিষক্রিয়া বিচার বিভাগের ওপর এতই মারাত্মক ছিল যে, আজো এতগুলো সংশোধনীর পরও বিচার বিভাগ তার স্বাভাবিক স্বাস্থ্য ফিরে পায়নি।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতার দাবি সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে জোরেশোরে বিঘোষিত হয়েছে। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১১৫ এবং ১১৬ অনুচ্ছেদ ছিল তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। ২২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।’ চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে হাজার হাজার যোজন দূরে ঠেলে ফেলে বরং নির্বাহী বিভাগের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এই অবস্থার আংশিক পরিবর্তন এসেছিল বটে, কিন্তু স্বাধীনতার কাছাকাছি তা আসেনি।
লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments