সরদার স্যারের শিক্ষা by কাজল ঘোষ

সময়টা ১৯৯৬। তখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে পাঠচক্রে খ-কালীন দায়িত্বে। রবীন্দ্র অধ্যয়ন চক্র, চিত্রকলার রসাস্বাদন চক্র, দর্শন চক্রসহ নানা কার্যক্রমে মুখর বাংলামটরের ছিমছাম এ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। দর্শন চক্রে বক্তার তালিকা ধরে ধরে অতিথি আনার দায়িত্ব বর্তালো আমার ওপর। এক শুক্রবার বক্তা ছিলেন সরদার স্যার। মানে সরদার ফজলুল করিম। থাকেন গ্রিন রোডের বাসায়। চিরকুটে ঠিকানা লিখে পান্থপথ দিয়ে হেঁটে নির্ধারিত সময়ের ঘণ্টাখানেক আগেই হাজির হই। পাঠচক্রের ক্লাস বিকাল চারটায়। হাতে তখনও ঢের সময়। বইয়ের স্তূপে চাওয়া একটি কক্ষে বসার অনুমতি পেলাম। ভেতর থেকে আওয়াজ এলো, ‘আসছি’। সাদা হাফ শার্ট আর খয়েরি রঙের প্যান্ট পরনে। পায়ে ভারি ধরনের বাটা জুতো। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। বের হওয়ার সময় কাঁধে ঝোলা নিতে ভুললেন না। ঝোলায় পুরলেন দু’তিন খানা বই আর ছোট নোটবুক। লাঠিভর করে হাসিমুখে সম্ভাষণ করে পথে নামলেন। অল্প বয়েস। স্যার সম্পর্কে খুব বেশি জানা হয়নি। শুধু উচ্চ মাধ্যমিকে কলেজ কর্মসূচিতে প্লেটোর সংলাপ পড়ার সময় জেনেছি আমাদের দেশেও একজন সক্রেটিস আছেন। তিনি হচ্ছেন সরদার ফজলুল করিম। এসব ভাবতে ভাবতে স্যারের পেছন পেছন হাঁটছি। হঠাৎ স্যার নিজ থেকেই খোঁজ নিচ্ছেন কি করি? কি পড়ি? পাঠচক্র কিভাবে চলে? এরই মধ্যে গ্রিন রোডের মাথায় এসে দাঁড়াই। একটি রিকশা নিয়ে বাংলামটরের উদ্দেশে যাত্রা। ভাড়া আট টাকা। এখন যদিও ভাড়া দাঁড়িয়েছে তিরিশ থেকে চল্লিশে। তখন ভিআইপি রোড ছিল না পান্থপথ। ছিল না বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সও। রিকশায় যেতে যেতে স্যার বলছিলেন, কিভাবে জীবনকে জানা যায় আর কিভাবে অজানাকে জানার চেষ্টা করতে হয়। একসময় পথ ফুরায়। রিকশার গতি মন্থর হয়। যুবা বলেই চটজলদি নেমে ভাড়া দেয়ার চেষ্টা করতেই স্যার থামিয়ে দেন। এটা তুমি দেবে কেন ধমক লাগায়। হাতে লাঠি আর কাঁধে ঝোলা নিয়ে স্যারের নামতে কষ্ট হচ্ছিল ভেবে আগ বাড়িয়ে যেই ব্যাগটি ধরতে গেছি আবারও বিরক্ত হলেন। আমাকে ক্রুদ্ধ স্বরে বলে উঠলেন, দূর দিয়ে হাঁটো। আমি এখনও দুর্বল হয়ে যাইনি। আমি অথর্ব নই। আমার সবশেষ শক্তি নিঃশেষ হওয়া পর্যন্ত আমার ভার বয়ে যাবো। আর কখনও আমার ব্যাগ বা অন্য কিছুতে আমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করবে না। তুমি, তোমার নিজেকে সাহায্য করো। নিজের জন্য কাজ করো। সেদিন প্রচ-মাত্রায় হোঁচট খেলাম। অপমানিত বোধ করলাম। বেশ ক’দিন পর সম্বিত ফিরে পেলাম নিজ উপলব্ধিতে। স্যার সেদিন যা করেছেন এটাইতো ঠিক। এরপর জীবনের শত আয়োজনে যখনই মনে হয়েছে আমি কি পরনির্ভর হয়ে পড়ছি। ঘুরে দাঁড়িয়েছি। সরদার স্যার নিজের জ্যান্তে বা অজান্তেই আমাকে শক্তিমান মানুষ হতে পথনির্দেশ করেছেন যা পাথেয় হয়ে থাকবে।

২,

সরদার স্যারের খ- খ- দু’তিনটি স্মৃতি খুব ভাবিয়ে তুলছে। যে মানুষ চলে যায় তাকে আর ফিরে পাবো না। কিন্তু তার কীর্তি, রেখে যাওয়া গুণাবলি বেঁচে থাকবে চিরকাল। সরদার স্যার সেই মানুষদের একজন। যিনি আমাদের কালের দার্শনিক। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠচক্রের সুবাদে স্যারকে একবার অতিথি করে আনতে যেতে হয়েছিল টিকাটুলির সেন্ট্রাল উইমেন্স ফেডারেশন কলেজে। দুইটায় স্যার ক্লাস শেষে করে গেটে আসতেই আমি তড়িঘড়ি একটি স্কুটার ডেকে আনতে চাইলে আমাকে থামিয়ে দিলেন। স্যার, আপনার বাংলামটরে যাওয়ার ভাড়াতো বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র দেবে। উল্টো আমাকে জিজ্ঞাসা, আমি কেন তোমাদের অফিসের ভাড়ায় যাবো। আমি এখানে ক্লাস নিতে এসেছি আমার তাগিদ থেকে। তোমাদের এখানেও ক্লাস নিতে যাবো তাগিদ থেকেই। আর আমাকেতো তোমরা সম্মানী দেবে। সুতরাং, আমার খরচায় আমি যাবো। আর যদি এর ব্যতয় ঘটে তবে আমি নেই। আর তোমাদের আনা গাড়িতে আমি চড়লে আমার পরিশ্রম থাকলো কই। হার মানলাম। স্যারের পিছু চুপচাপ পথ চলতে লাগলাম। পিছে যদি স্যার পাঠচক্রের ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করে দেন তাহলে বিপদে পরে যাবো। স্যার আমাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ইত্তেফাক মোড়ে এসে সায়েদাবাদ-গাবতলীর মিনিবাসে চেপে বসলেন। তখন ভাড়া ছিল পঁচাত্তর পয়সা। আমাদের দু’জনের দেড় টাকা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বাংলামটরে পৌঁছলেন। কাঁধে ঝোলা আর হাতে লাঠি ভর করে দু’তলায় পাঠচক্রের কক্ষে প্রবেশ করলেন। এরপর যদ্দিন স্যারকে ক্লাসে আনা-নেয়ার বিষয় এসেছে দেখেছি আমি শুধু সঙ্গী। সব দায়িত্ব স্যারেরই।

৩.

দুটি কথা বলে শেষ করবো। প্লেটো, সক্রেটিস আর অ্যারিস্টটলকে সরদার স্যারের মতো আর কেউ আমাদের চিনাবেন কিনা তা ভবিষ্যতই বলবে। তবে তিনি না এলে রাষ্ট্রচিন্তায়, জীবন দর্শনে এক বড় রকমের শূন্যতা আমাদের বয়ে বেড়াতে হতো। প্লেটোর রিপাবলিক, রুশোর সোশ্যাল কনট্রাক্ট বাংলায় তরজমা করে সরদার ফজলুল করিম বঙ্গের পাঠকদের জন্য সহজপাঠ্য করেছেন। আপাদমস্তক দার্শনিক এই মানুষটির জীবনাচারণ ভাবতে গিয়ে কখনও কখনও ডায়োজিনাসের কথা মনে হয়। আপনারা হয়তো জেনে থাকবেন গ্রিসের বিখ্যাত দার্শনিক ডায়োজিনাসের কথা। সরল-সাদামাটা জীবনযাপনের জন্য তিনি আলোচনায় ছিলেন। বিশ্বজয়ী বীর মহামতি আলেকজান্ডার পারিষদবর্গ নিয়ে এই দার্শনিকের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। নগররাষ্ট্র গ্রিসের মূল রাস্তার পাশেই এক চৌবাচ্চায় বাস করতেন ডায়োজিনাস। পানি পানের কোনও পাত্রও ছিল না এই মানুষটির। তেষ্টা পেলে দু’হাত মুঠো করে পানি পান করতেন। সৈন্যসামন্ত নিয়ে আলেকজান্ডার যখন ডায়োজিনাসের চৌবাচ্চার সামনে পৌঁছলেন দেখলেন, ডায়োজিনাস রোদ পোহাচ্ছেন। পরিচয় দিয়ে আলেকজা-ার বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাইলেন, আপনার কোন সহযোগিতা লাগলে বলবেন। ডায়োজিনাস সঙ্গে সঙ্গে আলেকজান্ডারের দিকে খেয়াল না করেই বললেন, আমার পথ থেকে সরে দাঁড়ান। বিশ্বজয়ী বীর আলেকজান্ডারের বুঝতে বাকি রইলো না তিনি রোদ আটকে আছেন। সরদার স্যার প্রচলিত জীবনের চাঁছে সত্যিই এক ভিন্ন মানুষ। এমন মানুষের দেখা কচ্চিৎ মিলে। বইয়ের পাতায় পাতায় যে অসংখ্য লাইন তা নিয়ে আমরা নিরন্তর ভেবে থাকি, গবেষণা করি। কিন্তু স্যার বলতেন, বইয়ের একেকটি লাইনের পেছনে আরও অসংখ্য লাইন আছে। আছে অনেক কথা। অনেক গল্প। সেগুলো জানার চেষ্টা করো। তবেই জীবনকে জানতে পারবে।

No comments

Powered by Blogger.