বিপর্যয় এবং বিপর্যয় by ড. মাহফুজ পারভেজ
বাংলাদেশে চলছে বিপর্যয়ের বহর। একটির পর একটি বিপর্যয় গ্রাস করছে মানুষ আর সমাজকে। মনে হয় পুনঃপৌণিক বিপর্যয়ের দুষ্টচক্র থেকে উদ্ধারের রাস্তা কারও জানা নেই। রাজনৈতিক বিপর্যয় তো ক্রনিক ডিজিজের মতো পিছু ধাওয়া করছে। থেকে থেকে উত্তপ্ত-রক্তাক্ত-সহিংস হওয়া বাংলাদেশের রাজনীতির সামপ্রতিক বৈশিষ্ট্য। অর্থনীতিও বিপর্যয়ের বাইরে নেই। পোশাক শিল্পের আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা চলছেই। শেয়ারবাজার স্থিতি-স্থায়িত্ব পাচ্ছে না। রাজনীতি ও আইনশৃঙ্খলার বিপর্যয় অর্থনীতিতে থেমে থেমে কুপ্রভাব ফেলে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলার বিপর্যয় নারায়ণগঞ্জ, ফেনী, লক্ষ্মীপুরসহ নানা স্থানে আতঙ্কের বিস্তার ঘটিয়েছে। খুন-গুম-অপহরণ বাংলাদেশের প্রতিদিনের নিত্য-ব্যবহৃত শব্দ। এখন শুরু হয়েছে সামাজিক বিপর্যয়। ঢাকা যানজটে আর চট্টগ্রাম জলজটে বিপর্যয়, স্থবির। প্রাকৃতিক এ বিপর্যয় প্রবল হয়েছে নীতি, পরিকল্পনা ও কার্যক্রমের ব্যর্থতার কারণেই। ঢাকার যানজটের সঙ্গে জলাবদ্ধতা মিশে জন-জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। ঢাকায় বসবাস এখন এক শ্বাসরুদ্ধকর দুঃস্বপ্নের নামান্তর। চট্টগ্রাম প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত কারণে অনেকটাই বসবাসোপযোগী ছিল; ছিল সবুজ ও সুন্দর। পাহাড়-কর্তন আর অপরিকল্পিত বসতি স্থাপনের কারণে বাণিজ্যিক রাজধানী নামের আড়ালের এ শহরটিও গত কয়েক দিনে বিপর্যস্ত। মানুষ যেন এক-একটি পাড়া-মহল্লায় বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো বসবাস করছে। পথঘাট-রাস্তা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। নগরের প্রধান প্রধান সড়ক আর এভিনিউয়ে নৌকা চলার মতো পানি। কোমর-বুকপানি ভেঙে মানুষ চলছে। এ যেন আধুনিককালের এক মানবিক বিপর্যয়ের বাস্তব চিত্র। চট্টগ্রামের পানি-নিষ্কাশন সমস্যা বহুদিনের পুরাতন। নগরের জল পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম চাকতাই খালের অবস্থা শোচনীয়। কর্ণফুলীও দখলে-দূষণে জেরবার। নগরের আভ্যন্তরীন ড্রেনেজ সিস্টেম বহু আগেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। অবিরাম বহুতল ভবন নির্মাণের সময় জল-নিষ্কাশনসহ অন্যান্য বিষয় মাথায় রাখা হয়নি। ফলে বর্ষার মওসুমে নগরের কাঠামোই স্থবির হয়ে গেছে। চট্টগ্রামে একটি স্বাভাবিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে পাহাড় কাটার কারণে। প্রতি বর্ষাতেই পাহাড়-ধসে বহু মানুষের মৃত্যু ঘটছে। বর্ষার আগে বিপজ্জনক এলাকা থেকে মানুষ সরানো বা সেখানে বসবাস বন্ধ করা কিংবা পাহাড়-কাটা থামানো ইত্যাদি কিছুই হয়নি। ফলে জলাবদ্ধতার মতো প্রবল বর্ষণ চলতেই থাকলে কর্তিত পাহাড়-ধস হবেই আর মানুষও মরবেই। এসব ভাবার বদলে তখন চলবে মিডিয়ায় মৃতের ছবি প্রদর্শনী, স্বজনের আহাজারি ও নেতৃবৃন্দের বাগাড়ম্বর প্রদর্শন। আগাম সতর্ক হলে এসব থামানো কঠিন নয়। পৃথিবীর বহু দেশ যথাযথ পরিকল্পনা ও কর্মসূচির মাধ্যমে বিরূপ প্রকৃতিকে জয় করে আরামে জীবনযাপন করছে। আর আমরা সমাজে-রাজনীতিতে-অর্থনীতিতে-নগরে-গ্রামে-পাহাড়ে-সমতলে বহু সমস্যাকে পুষে পুষে ক্রনিক-ক্যান্সারে রূপান্তরিত করছি। এজন্য আলোচনার প্রয়োজন বোধ করা হচ্ছে। রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে আলোচনার কথা উঠলেই বলা হচ্ছে, মেয়াদ শেষ হোক, তারপর আলোচনা। এখনই আলোচনা চালিয়ে নিয়ে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সঙ্কট ও সমস্যার সমাধানের রূপরেখা তৈরিতে আরও আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। সবই হবে, সমস্যা মাথায় আকাশ হয়ে ভেঙে পড়ার পর। বাজারের কথাই ধরা যাক। রমজান আসার পর শুরু হয়েছে কাজ। আগেই দাম কমানো বা ফরমালিন হটানোর ব্যবস্থা করলে এখন এত কথা আর দৌড়াদৌড়ির দরকার হতো না। শেষবেলার দৌড়ঝাঁপে কাজের কাজ যে খুব কমই হয়, সে কথা তো সকলেই বিলক্ষণ জানেন। এখন ঢাকা বা চট্টগ্রামে যে নাগরিক বিপর্যয় চলছে, সেটাও অপরিকল্পিত নগরায়নের কুফল। দিনে দিনে সে কুফল থেকে বিষবৃক্ষ গজিয়েছে। বিপর্যয় মানুষকে যানজটে আর জলজটের অক্টোপাস-জালে জিম্মি ও বন্দি করেছে। অথচ বাংলার-বর্ষার কি অপরূপ শোভাই না আছে। বাংলার কবিরা সেই কালিদাসের ‘মেঘদূতম্’-এর আমল থেকেই বর্ষা-বন্দনায় মুখর। রবীন্দ্রনাথের বর্ষার বিখ্যাত গানগুলো সাংস্কৃতিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য আনন্দধ্বনির মতো বৃষ্টির সঙ্গে টুপটাপ ঝরে পড়েছে আমাদের হৃদয়ে আর সত্তায়। আর এখন? মিডিয়ায় আর ফেসবুক স্ট্যাটাসে জলবন্দি মানুষের বুকচাপা ক্রন্দন আর বিলাপ ভেসে আসছে। বিপর্যয় এখন আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি, এমনকি, বর্ষার মতো প্রকৃতির উচ্ছ্বাস-ভরা লীলা-চাঞ্চল্যকেও আমাদের জীবন থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে। এজন্য দায়ী কে? কার অপরিকল্পনা, কর্মবিমুখতা ও অব্যবস্থায় জীবন হচ্ছে বসবাসের অযোগ্য। প্রকৃতির আলোকোজ্জ্বল রূপান্তরও বিভীষাকার মতো ধেয়ে আসছে। জানি, এজন্যও পরস্পরকে দোষারোপ করা হবে এবং এই কুবির্তকের মধ্য দিয়ে আসল অযোগ্য সটকে যাবে। কিন্তু সেটা আর কতদিন? কেউ দায়িত্ব নেবে না, কিন্তু পুরস্কার আর বাহাবা নেবে, এই ধারাই কি চলতে থাকবে? আর অন্যদিকে এ সর্বাাধুনিক সময়েও দেশের সবচেয়ে নামী ও প্রধান শহরগুলোতেও নাগরিক-জীবন আদিম যন্ত্রণার নরককু-ের দিকে তাবৎ নাগরিক গোষ্ঠীকে নিয়ে যেতেই থাকবে? এ পশ্চাৎপদতার এবং পিছিয়ে পিছিয়ে ভাল থেকে খারাপের দিকে ধেয়ে যাওয়ার শেষ কোথায়! কে জানে?
No comments