কথার যুদ্ধ by শামীমুল হক
কথায় বিশ্ব জয় করা যায়। এই কথায়ই মানুষ বন্ধু থেকে শত্রু হয়। চলে যায় অনেক দূরে। আবার কথার মারপ্যাঁচে কেউ কেউ হন নাস্তানাবুদ। কেউ কথার জোরে টিকে থাকতে চায়। এ কারণেই কথা বলতে হয় হিসেব করে। কথা বলতে হয় মেপে মেপে। কিন্তু আমরা কি তা করছি? গোটা বিশ্বে চলছে এখন কথার যুদ্ধ। কথাই এখন গোলাবারুদ, কথাই এখন কামান। ইউক্রেন নিয়ে আমেরিকা আর রাশিয়ার কথার যুদ্ধ এখন তুঙ্গে। সিরিয়া, ইসরাইল নিয়েও বিশ্ব বিভক্ত। কথার যুদ্ধ কোথায় নেই? বাংলাদেশের রাজনীতিতে তো কথার মার চলছে যুগ যুগ ধরে। সম্প্রতি এর মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে সবকিছুকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে দুই প্রধান দলের কথার যুদ্ধ চলে দীর্ঘসময়। এ নিয়ে রাজনীতির ময়দানে ছড়ায় উত্তাপ। রাজপথে অগ্নিকু-লী। তা নিয়েও চলে কথার মার। সবাই নিজ নিজ পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন বক্তৃতা-বিবৃতিতে। শেষ পর্যন্ত জয় হয় এক পক্ষের। হয় ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন। এ নির্বাচন নিয়েও কি কম কথার যুদ্ধ হয়েছে। কথার যুদ্ধে ঠাঁই হয়েছে বালুর ট্রাকেরও। এক নেত্রীকে এক ঘরে রাখা নিয়েও তো কম কথার যুদ্ধ হয়নি। এক পক্ষ বলেছে, কর্মসূচি দিয়ে ঘর থেকে বেরুনোর সাহস যে দলের নেই সেই দল আন্দোলন করবে কি? আর অন্য দল নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করলেও কথার যুদ্ধে কম যাননি। নিয়ম রক্ষার নির্বাচন বলে ৫ই জানুয়ারি দিনটি পার হয়। সরকার গঠন করা হয় অদ্ভুত কিসিমের। যেখানে বিরোধী দল আছে, বিরোধী দল নেই। এ নিয়েও কথার মার চলছে সমানে। গতকালও বিরোধী দলের এক নেতা বলেছেন, আপনি উরুগুয়ের স্ট্রাইকার, আবার ইতালির গোলকিপার হবেন- এটা হয় না। তবে বিরোধী দলকে কেউ বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। এতে বিরোধী নেত্রী নাকি মাইন্ড করেছেন। বিদেশী কোন অতিথি এ দেশে এলে বিরোধী নেত্রী হিসেবে তার সঙ্গে দেখা করেন না। এ নিয়ে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থও হয়েছেন। তবে এ মুহূর্তে কথার যুদ্ধ চলছে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে নিয়ে। ভারতের নতুন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সে দেশের ৯ বারের এমপি। বিএনপি নেত্রীর সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করবেন কিনা এ নিয়ে ছিল রহস্য। শোনা যায়, তার সঙ্গে যেন সাক্ষাৎ না হয় সে জন্য পর্দার আড়ালে হয়েছে অনেক নাটক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা হচ্ছে, তাদের মধ্যে কথাও হচ্ছে। আজ সকালেই খালেদা-সুষমা বৈঠক হওয়ার কথা। তবে সুষমাকে দু’পক্ষের কথার যুদ্ধের মোকাবিলা করতে হবে দুই পক্ষ থেকেই এটা নিশ্চিত। গতকাল নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের উপনির্বাচন হয়ে গেল। এ আসনের সংসদ সদস্য নাসিম ওসমানের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া আসনে নির্বাচন হলো। এখানে আওয়ামী লীগের কোন প্রার্থী নেই। জাতীয় পার্টি তাদের দলীয় মনোনয়ন দিয়েছে প্রয়াত নাসিম ওসমানের ভাই সেলিম ওসমানকে। আর তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী এ আসনের সাবেক এমপি, আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগকৃত এসএম আকরাম। দুই সপ্তাহের নির্বাচনী লড়াইয়ে এ দু’প্রার্থীর কথার যুদ্ধ চলেছে সমানে। আকরামের পক্ষ থেকে নির্বাচনে পেশিশক্তি ব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়েছে। কেন্দ্র দখল করে ব্যালটে সিল মারার কথাও বলা হয়েছে। তিনি সেনা মোতায়েনের দাবিও জানিয়েছিলেন। দুই প্রার্থীই কথার যুদ্ধও চালিয়েছে সমান তালে। একে অন্যকে দোষারোপ, নিজের গুণগান যে যেভাবে পারে সেভাবে চালিয়েছেন কথার যুদ্ধ। যদিও নির্বাচন কমিশন সব সময় যেভাবে কথা বলে সেভাবেই বলে আসছিল নির্বাচন হবে অবাধ ও সুষ্ঠু। কথায় পটু কমিশন তাদের কথা কতটুকু রাখতে পারে- তা নিয়ে সন্দেহ ছিল। গতকাল অবশ্য ভোটার উপস্থিতি কমের মধ্যেই নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। তবে নির্বাচনের দিনও কথার যুদ্ধ চালিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের আলোচিত এমপি শামীম ওসমান। তিনি এক এএসপিকে হুমকি দিয়েছেন। এ নিয়ে এএসপি তার বিরুদ্ধে জিডি পর্যন্ত করেছেন। তবে শামীম ওসমানের কথার যুদ্ধের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জবাসী অভ্যস্থ। বলাবলি হচ্ছে- তিনি এমনটা না করলে আশ্চর্য হওয়ার মতো ঘটনা ঘটতো। কথার যুদ্ধ নিয়ে বলতে গিয়ে দু’জা’র মধ্যে কথার যুদ্ধের সেই কথা মনে পড়েছে। তারা দুই জা বসে কথা বলছেন। গল্প বলছেন। বাপের বাড়ির গল্প। একজন বলছেন, দেখ আমার বাপের বাড়ির গোয়ালঘরটি এত বড় ছিল যে, এর এক দরজা দিয়ে কোন গাই-গরু প্রবেশ করলে অন্য দরজা দিয়ে বের হতো বাছুরসহ। এই ঘরের মধ্যেই হাঁটতে হাঁটতে গর্ভধারণ, সময় পূর্ণ হওয়া থেকে প্রসব সবই হতো। কথা শুনে অপর জা তাজ্জব। একি বলে সে। এত বড় গোয়ালঘর কি পৃথিবীতে আছে? মনে মনে বলে আমাকেও জিততে হবে। এবার এই জা বলে ওঠে, আমার বাপের বাড়িতে এত বড় একটা কোটা ছিল যা দিয়ে আমার বাপ-চাচারা আসমান থেকে একটা একটা করে তারা পাড়তো। ওই জা বলে ওমা এটা কি বলে? এত বড় কোটা তোর বাপে রাখতো কই? ওই জা সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, কেন তোর বাপের বাড়ির গোয়ালঘরে। কথার যুদ্ধ চালাতে গিয়ে এমন অবাস্তব কথাও গিলতে হয় সাধারণ মানুষের। তারা কিন্তু সবই বোঝেন। শুধু বলেন না। তারা কথার যুদ্ধে জড়ান না।
No comments