প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ১০০ বছর- গাভ্রিলো প্রিন্সিপ: নায়ক না ভিলেন? by মনজুরুল হক
বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে ইউরোপীয়
দেশগুলোতে, নানা রকম আয়োজনের মধ্যে দিয়ে পালিত হচ্ছে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু
হওয়ার শতবার্ষিকী। যুদ্ধ আক্ষরিক অর্থে আগস্ট মাসের গোড়ার দিকে শুরু হলেও
যুদ্ধের সার্বিক প্রস্তুতি আর পাঁয়তারা শুরু হয়েছিল ১৯১৪ সালের ২৮ জুন
থেকে, এ যুগের বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভোতে যেদিন আততায়ীর গুলিতে নিহত
হয়েছিলেন ইউরোপের এক প্রধান শক্তি অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের যুবরাজ
ফ্রাঞ্জ ফার্ডিনান্ড। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে ইউরোপের প্রধান এক শক্তি
হিসেবে গণ্য অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য বিংশ শতকে এসে জরাগ্রস্ত হয়ে
পড়েছিল এবং প্রতিবেশী জার্মানির ঐক্য ও উত্থান হাব্সবুর্গ রাজবংশের দাপটকে
করে দেয় আরও অনেকটা সংকুচিত। সে রকম অবস্থায় সাম্রাজ্যের আওতাধীন বিভিন্ন
রাজ্য ও জনগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা দেওয়া ক্ষোভ পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করে
তোলে এবং বৃহত্তর সার্বিয়া, যুগোস্লাভিয়া এবং একালের হারিয়ে যাওয়া
অস্তিত্ব বুকোভিনাসহ সাম্রাজ্যের আনাচকানাচে দানা বাঁধতে শুরু করে
বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। ঠিক সে রকম এক ঘোলাটে সময়ে বিশেষ এক অনুষ্ঠানে
যোগ দিতে সস্ত্রীক সারায়েভো গিয়েছিলেন যুবরাজ বা আর্কডিউক ফ্রাঞ্জ
ফার্ডিনান্ড। হাব্সবুর্গ সাম্রাজ্যের হাল ধরে তখনো বসে আছেন অশীতিপর বৃদ্ধ
সম্রাট ফ্রাঞ্জ ইওসেফ, যেন ভেঙে পড়ার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা সাম্রাজ্যেরই
প্রতীক হিসেবে।
>>প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একটি দৃশ্য
আজ
থেকে ১০০ বছর আগে নরপতিদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ছিল না
বাড়াবাড়ি রকমের তৎপরতা, ছিল না নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাবলয়। চালচলন আর
আচার-আচরণের দিক থেকে একচ্ছত্র আধিপত্যের প্রতীক তাঁরা হলেও দেশের মানুষের
ওপর কিছুটা আস্থা তাঁরা তখনো রেখে যাচ্ছিলেন, যা কিনা আর্কডিউকের জন্য শেষ
পর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়ায়।
অন্যদিকে সেটা ছিল এমন এক সময়, সাম্যবাদী ভাবধারা, নৈরাজ্যবাদী চিন্তা ও বিপ্লবী চেতনার বিকাশ যখন ইউরোপজুড়ে সাধারণ মানুষের চোখ খুলে দিচ্ছিল এবং সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে মানুষ, বিশেষ করে সেই সময়ের তরুণেরা সংঘবদ্ধ হতে শুরু করেছিল। স্লাভ জাতীয়তাবাদী চেতনার দ্রুত বিস্তার ঘটতে থাকা অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের অংশ সার্বিয়ার বসনিয়া অঞ্চল ছিল সে রকম বিপ্লবী চেতনার প্রসার ঘটতে থাকা উর্বর এক ভূমি। সাম্রাজ্যের দুর্বলতাকে সার্ব জাতীয়তাবাদীরা দেখেছিলেন নিজেদের স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার সুবর্ণ এক সুযোগ হিসেবে। তবে কোন পথে নতুন এক ঐক্যবদ্ধ সার্বিয়ার অগ্রসর হওয়া উচিত, সেই প্রশ্নে ব্যাপক মতপার্থক্য তাদের মধ্যে বিরাজমান ছিল এবং রাজনীতির নিষিদ্ধ অঙ্গনে রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর নৈরাজ্যবাদ নিয়ে চলমান বিতর্ক ছিল নিয়মিত ঘটনা। সমাজতন্ত্র ও নৈরাজ্যবাদী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ বিপ্লবী চেতনার বিকাশ সার্বিয়ায় ঘটে রাশিয়া ও ইতালিতে সেই একই ধারার রাজনীতি বিস্তৃত হতে থাকার সঙ্গে সংগতি রেখে।
নিষিদ্ধ রাজনীতির গোপন এ রকম তৎপরতা সম্পর্কে হাব্সবুর্গ সাম্রাজ্যের গোয়েন্দা বিভাগের জানা থাকা সত্ত্বেও বিষয়টিকে ততটা গুরুত্বের সঙ্গে তারা দেখেনি। ফলে নিরাপদ মনে করেই সস্ত্রীক সারায়েভো সফরে গিয়েছিলেন আর্কডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্ডিনান্ড। স্বাধীনতাপ্রত্যাশী বিপ্লবীরাও ঠিক সে রকম এক সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, যা কিনা বৃহত্তর সার্বিয়ার স্বাধীনতার পথ সুগম করে দেবে বলে তাঁরা মনে করে নিয়েছিলেন। ১৯ বছর বয়সী তরুণ গাভ্রিলো প্রিন্সিপ ছিলেন ‘ম্লাদা বসনা’ বা তরুণ বসনিয়া নামের সে রকম এক বিপ্লবী সংগঠনের সদস্য, বৃহত্তর যুগোস্লাভিয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করে নিতে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে যে দলের সদস্যরা জড়িত ছিল।
আর্কডিউকের সারায়েভোর সফরসূচি জেনে নেওয়ার পর দলের গোপন এক বৈঠকে ছয় তরুণের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয় যুবরাজকে হত্যা করার। ১৯১৪ সালের ২৮ জুন সকালে ছয়জন বিপ্লবী একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হয়ে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। তবে যুবরাজের গাড়ির বহরকে হাতের কাছে পেয়েও শেষ মুহূর্তে বিভ্রান্তি দেখা দেওয়ায় প্রথম তিনজন সুযোগ হাতছাড়া করে ফেলে। চতুর্থ বিপ্লবীর ছুড়ে মারা হাতবোমা যুবরাজকে বহন করা গাড়িতে আঘাত করে পেছনের গাড়ির নিচে গিয়ে বিস্ফোরিত হয়।
গাভ্রিলো প্রিন্সিপের হাতে অস্ত্র হিসেবে ছিল আংশিক স্বয়ংক্রিয় একটি ব্রাউনিং পিস্তল। আকারে ছোটখাটো গাভ্রিলো দায়িত্ব শেষ করতে পারার চিন্তা নিয়ে ঘটনার জায়গায় থেকে গেলেও যুবরাজের গাড়ির বহর পিস্তলের আওতার বাইরে চলে গেলে পরবর্তী সুযোগের অপেক্ষায় সে অনুষ্ঠানের জায়গার আশপাশ জুড়ে অবস্থান নেয়। মধ্য দুপুরের বেশ কিছু আগেই সেই সুযোগ গাভ্রিলোর সামনে দেখা দেয়। অনুষ্ঠান শেষে যুবরাজকে বহন করা গাড়ি ভুল একটি পথে ঢুকে গেলে চালককে যখন গাড়ি উল্টো পথ বরাবর ঘুরিয়ে নিতে হয়েছিল, ঠিক তখনই খোলা গাড়িতে বসে থাকা যুবরাজ ও স্ত্রী সোফি গাভ্রিলোর পিস্তলের আওতায় চলে আসেন এবং বিলম্ব না করে গাভ্রিলো পিস্তলের ট্রিগার চেপে ধরলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন রাজ দম্পতি, আর সেই সঙ্গে ইউরোপে অবসান ঘটে একটি যুগের।
খুনের বদলা নিতে যে শর্তাবলি ও সময়সীমা অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য সার্বিয়ার ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল, সার্বিয়ার পক্ষে তা পূরণ করতে পারা ছিল অসম্ভব। ফলে আগস্টের শুরুতে সাম্রাজ্যের বাহিনী জার্মানির সহায়তা নিয়ে সার্বিয়া আক্রমণ করে বসলে সার্বিয়ার মিত্র রাশিয়া ও ফ্রান্সও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং অল্প সময়ের মধ্যে ব্রিটেনও যুদ্ধের পথে ধাবিত হয়। গাভ্রিলো প্রিন্সিপের পিস্তল থেকে নিক্ষিপ্ত গুলি শেষ পর্যন্ত সর্বগ্রাসী এক যুদ্ধের আকার নিয়ে সমগ্র ইউরোপকে পরিণত করে বিশাল এক সমর ক্ষেত্রে, এক কোটি ৪০ লাখ মৃত্যুর হিসাব টেনে চার বছর পর সমাপ্তি ঘটেছিল যে যুদ্ধের।
সারায়েভোর সেদিনের ঘটনার পর ঘটনাস্থলেই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন গাভ্রিলো প্রিন্সিপ। বিচার চলাকালে নিজেকে তিনি যুগোস্লাভ জাতীয়তাবাদী হিসেবে দাবি করেন এবং দ্ব্যর্থ কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে যুগোস্লাভিয়ার ঐক্যের লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিপ্লবী দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন। বিচার শেষে ২০ বছরের কারাদণ্ড তাঁকে দেওয়া হয় এবং দণ্ডভোগের জন্য হাঙ্গেরির দুর্গম এক কারাগারে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানেই যুদ্ধ শেষ হওয়ার অল্প কদিন আগে যক্ষ্মায় প্রাণ হারান সার্ব বিপ্লবী।
ঘটনার ১০০ বছর পর কিছুটা বিভ্রান্তি আর কিছুটা দোলাচল নিয়ে স্মরণ করা হচ্ছে বিপ্লবী সেই তরুণকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে যুগোস্লাভিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গাভ্রিলো প্রিন্সিপকে দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়া বিপ্লবী হিসেবে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়েছিল। সারায়েভো শহরে ১৯১৪ সালের ২৮ জুনের ঘটনার জায়গায় বসানো হয়েছিল তার একটি নামফলক এবং শহরের একটি সেতুরও নামকরণ করা হয়েছিল তাঁকে স্মরণ করে।
তবে আমরা জানি গত দুই দশকে ইতিহাসের গতি ভিন্ন পথে পরিচালিত হলে অতীতে যা ছিল সত্য তার অনেকটাই ইতিহাসের ওপর বসিয়ে দেওয়া রঙের প্রলেপে হয়ে উঠেছে মিথ্যা। সারায়েভোর যে এলাকায় গাভ্রিলো প্রিন্সিপের নামফলক ও তাঁর নামের সেতু অবস্থান করছিল, সেই এলাকা মুসলিম ও ক্রোয়াট জনবসতির জায়গা হওয়ায় একজন সার্ব বিপ্লবীর সব রকম স্মৃতি সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থসাহায্যে আয়োজিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের স্মারক অনুষ্ঠানে গাভ্রিলো প্রিন্সিপকে নয়, বরং সাম্রাজ্যবাদের প্রতীক যুবরাজ ফ্রাঞ্জ ফার্ডিনান্ডকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরায় সার্বরা অনুষ্ঠান বর্জনের ঘোষণা দিয়ে নিজেরা আয়োজন করে ভিন্ন স্মারক অনুষ্ঠান। একজন সার্ব অভিনেতা সেই অনুষ্ঠানে বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নের প্রচলিত পোশাক পরে রিভলবারের দুটি গুলি ছোড়ার মধ্যে দিয়ে উদ্বোধন করেন গাভ্রিলোর দুই মিটার উঁচু ভাস্কর মূর্তি। এ ছাড়া পূর্ব বসনিয়ার একটি সার্ব গ্রামে তৈরি করা হয়েছে গাভ্রিলোর জাদুঘর, যে জাদুঘরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মূল বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বসনীয় সার্ব মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া সার্বিয়ার বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এমির কুস্তুরিৎসা। অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণে তিনি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘গাভ্রিলো প্রিন্সিপ হচ্ছেন আমাদের গর্ব, দাসত্বের হাত থেকে মুক্ত হতে যিনি আমাদের সাহায্য করেছেন।’
ফলে ১০০ বছর আগে ঘটে যাওয়া সেদিনের ঘটনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিণতির মতোই ইউরোপকে আবদ্ধ করে রাখছে বিভক্তির নষ্ট চক্রে, যার ফলে সেদিনের খলনায়কদের নতুন করে স্মরণ করা হচ্ছে নায়ক হিসেবে, আর আত্মত্যাগী নায়কেরা হচ্ছেন বিস্মৃত।
(টোকিও, ২৯ জুন ২০১৪)
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক৷
অন্যদিকে সেটা ছিল এমন এক সময়, সাম্যবাদী ভাবধারা, নৈরাজ্যবাদী চিন্তা ও বিপ্লবী চেতনার বিকাশ যখন ইউরোপজুড়ে সাধারণ মানুষের চোখ খুলে দিচ্ছিল এবং সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে মানুষ, বিশেষ করে সেই সময়ের তরুণেরা সংঘবদ্ধ হতে শুরু করেছিল। স্লাভ জাতীয়তাবাদী চেতনার দ্রুত বিস্তার ঘটতে থাকা অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের অংশ সার্বিয়ার বসনিয়া অঞ্চল ছিল সে রকম বিপ্লবী চেতনার প্রসার ঘটতে থাকা উর্বর এক ভূমি। সাম্রাজ্যের দুর্বলতাকে সার্ব জাতীয়তাবাদীরা দেখেছিলেন নিজেদের স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার সুবর্ণ এক সুযোগ হিসেবে। তবে কোন পথে নতুন এক ঐক্যবদ্ধ সার্বিয়ার অগ্রসর হওয়া উচিত, সেই প্রশ্নে ব্যাপক মতপার্থক্য তাদের মধ্যে বিরাজমান ছিল এবং রাজনীতির নিষিদ্ধ অঙ্গনে রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর নৈরাজ্যবাদ নিয়ে চলমান বিতর্ক ছিল নিয়মিত ঘটনা। সমাজতন্ত্র ও নৈরাজ্যবাদী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ বিপ্লবী চেতনার বিকাশ সার্বিয়ায় ঘটে রাশিয়া ও ইতালিতে সেই একই ধারার রাজনীতি বিস্তৃত হতে থাকার সঙ্গে সংগতি রেখে।
নিষিদ্ধ রাজনীতির গোপন এ রকম তৎপরতা সম্পর্কে হাব্সবুর্গ সাম্রাজ্যের গোয়েন্দা বিভাগের জানা থাকা সত্ত্বেও বিষয়টিকে ততটা গুরুত্বের সঙ্গে তারা দেখেনি। ফলে নিরাপদ মনে করেই সস্ত্রীক সারায়েভো সফরে গিয়েছিলেন আর্কডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্ডিনান্ড। স্বাধীনতাপ্রত্যাশী বিপ্লবীরাও ঠিক সে রকম এক সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, যা কিনা বৃহত্তর সার্বিয়ার স্বাধীনতার পথ সুগম করে দেবে বলে তাঁরা মনে করে নিয়েছিলেন। ১৯ বছর বয়সী তরুণ গাভ্রিলো প্রিন্সিপ ছিলেন ‘ম্লাদা বসনা’ বা তরুণ বসনিয়া নামের সে রকম এক বিপ্লবী সংগঠনের সদস্য, বৃহত্তর যুগোস্লাভিয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করে নিতে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে যে দলের সদস্যরা জড়িত ছিল।
আর্কডিউকের সারায়েভোর সফরসূচি জেনে নেওয়ার পর দলের গোপন এক বৈঠকে ছয় তরুণের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয় যুবরাজকে হত্যা করার। ১৯১৪ সালের ২৮ জুন সকালে ছয়জন বিপ্লবী একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হয়ে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। তবে যুবরাজের গাড়ির বহরকে হাতের কাছে পেয়েও শেষ মুহূর্তে বিভ্রান্তি দেখা দেওয়ায় প্রথম তিনজন সুযোগ হাতছাড়া করে ফেলে। চতুর্থ বিপ্লবীর ছুড়ে মারা হাতবোমা যুবরাজকে বহন করা গাড়িতে আঘাত করে পেছনের গাড়ির নিচে গিয়ে বিস্ফোরিত হয়।
গাভ্রিলো প্রিন্সিপের হাতে অস্ত্র হিসেবে ছিল আংশিক স্বয়ংক্রিয় একটি ব্রাউনিং পিস্তল। আকারে ছোটখাটো গাভ্রিলো দায়িত্ব শেষ করতে পারার চিন্তা নিয়ে ঘটনার জায়গায় থেকে গেলেও যুবরাজের গাড়ির বহর পিস্তলের আওতার বাইরে চলে গেলে পরবর্তী সুযোগের অপেক্ষায় সে অনুষ্ঠানের জায়গার আশপাশ জুড়ে অবস্থান নেয়। মধ্য দুপুরের বেশ কিছু আগেই সেই সুযোগ গাভ্রিলোর সামনে দেখা দেয়। অনুষ্ঠান শেষে যুবরাজকে বহন করা গাড়ি ভুল একটি পথে ঢুকে গেলে চালককে যখন গাড়ি উল্টো পথ বরাবর ঘুরিয়ে নিতে হয়েছিল, ঠিক তখনই খোলা গাড়িতে বসে থাকা যুবরাজ ও স্ত্রী সোফি গাভ্রিলোর পিস্তলের আওতায় চলে আসেন এবং বিলম্ব না করে গাভ্রিলো পিস্তলের ট্রিগার চেপে ধরলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন রাজ দম্পতি, আর সেই সঙ্গে ইউরোপে অবসান ঘটে একটি যুগের।
খুনের বদলা নিতে যে শর্তাবলি ও সময়সীমা অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য সার্বিয়ার ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল, সার্বিয়ার পক্ষে তা পূরণ করতে পারা ছিল অসম্ভব। ফলে আগস্টের শুরুতে সাম্রাজ্যের বাহিনী জার্মানির সহায়তা নিয়ে সার্বিয়া আক্রমণ করে বসলে সার্বিয়ার মিত্র রাশিয়া ও ফ্রান্সও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং অল্প সময়ের মধ্যে ব্রিটেনও যুদ্ধের পথে ধাবিত হয়। গাভ্রিলো প্রিন্সিপের পিস্তল থেকে নিক্ষিপ্ত গুলি শেষ পর্যন্ত সর্বগ্রাসী এক যুদ্ধের আকার নিয়ে সমগ্র ইউরোপকে পরিণত করে বিশাল এক সমর ক্ষেত্রে, এক কোটি ৪০ লাখ মৃত্যুর হিসাব টেনে চার বছর পর সমাপ্তি ঘটেছিল যে যুদ্ধের।
সারায়েভোর সেদিনের ঘটনার পর ঘটনাস্থলেই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন গাভ্রিলো প্রিন্সিপ। বিচার চলাকালে নিজেকে তিনি যুগোস্লাভ জাতীয়তাবাদী হিসেবে দাবি করেন এবং দ্ব্যর্থ কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে যুগোস্লাভিয়ার ঐক্যের লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিপ্লবী দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন। বিচার শেষে ২০ বছরের কারাদণ্ড তাঁকে দেওয়া হয় এবং দণ্ডভোগের জন্য হাঙ্গেরির দুর্গম এক কারাগারে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানেই যুদ্ধ শেষ হওয়ার অল্প কদিন আগে যক্ষ্মায় প্রাণ হারান সার্ব বিপ্লবী।
ঘটনার ১০০ বছর পর কিছুটা বিভ্রান্তি আর কিছুটা দোলাচল নিয়ে স্মরণ করা হচ্ছে বিপ্লবী সেই তরুণকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে যুগোস্লাভিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গাভ্রিলো প্রিন্সিপকে দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়া বিপ্লবী হিসেবে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়েছিল। সারায়েভো শহরে ১৯১৪ সালের ২৮ জুনের ঘটনার জায়গায় বসানো হয়েছিল তার একটি নামফলক এবং শহরের একটি সেতুরও নামকরণ করা হয়েছিল তাঁকে স্মরণ করে।
তবে আমরা জানি গত দুই দশকে ইতিহাসের গতি ভিন্ন পথে পরিচালিত হলে অতীতে যা ছিল সত্য তার অনেকটাই ইতিহাসের ওপর বসিয়ে দেওয়া রঙের প্রলেপে হয়ে উঠেছে মিথ্যা। সারায়েভোর যে এলাকায় গাভ্রিলো প্রিন্সিপের নামফলক ও তাঁর নামের সেতু অবস্থান করছিল, সেই এলাকা মুসলিম ও ক্রোয়াট জনবসতির জায়গা হওয়ায় একজন সার্ব বিপ্লবীর সব রকম স্মৃতি সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থসাহায্যে আয়োজিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের স্মারক অনুষ্ঠানে গাভ্রিলো প্রিন্সিপকে নয়, বরং সাম্রাজ্যবাদের প্রতীক যুবরাজ ফ্রাঞ্জ ফার্ডিনান্ডকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরায় সার্বরা অনুষ্ঠান বর্জনের ঘোষণা দিয়ে নিজেরা আয়োজন করে ভিন্ন স্মারক অনুষ্ঠান। একজন সার্ব অভিনেতা সেই অনুষ্ঠানে বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নের প্রচলিত পোশাক পরে রিভলবারের দুটি গুলি ছোড়ার মধ্যে দিয়ে উদ্বোধন করেন গাভ্রিলোর দুই মিটার উঁচু ভাস্কর মূর্তি। এ ছাড়া পূর্ব বসনিয়ার একটি সার্ব গ্রামে তৈরি করা হয়েছে গাভ্রিলোর জাদুঘর, যে জাদুঘরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মূল বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বসনীয় সার্ব মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া সার্বিয়ার বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এমির কুস্তুরিৎসা। অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণে তিনি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘গাভ্রিলো প্রিন্সিপ হচ্ছেন আমাদের গর্ব, দাসত্বের হাত থেকে মুক্ত হতে যিনি আমাদের সাহায্য করেছেন।’
ফলে ১০০ বছর আগে ঘটে যাওয়া সেদিনের ঘটনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিণতির মতোই ইউরোপকে আবদ্ধ করে রাখছে বিভক্তির নষ্ট চক্রে, যার ফলে সেদিনের খলনায়কদের নতুন করে স্মরণ করা হচ্ছে নায়ক হিসেবে, আর আত্মত্যাগী নায়কেরা হচ্ছেন বিস্মৃত।
(টোকিও, ২৯ জুন ২০১৪)
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক৷
No comments