উদ্যোগ প্রশংসনীয়, তবে- by আলী ইদ্রিস
রথমবারের মতো ঢাকা শহরের প্রবেশমুখে পুলিশ ও ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ফলমূল ও খাদ্যপণ্যে ফর্মালিনের উপস্থিতি পরীক্ষা করে বিষাক্ত পণ্য ধ্বংস ও দোষীকে জেল-জরিমানার দ- দেয়া হচ্ছে। সরকারের এ কার্যক্রম অত্যন্ত প্রশংসনীয় সন্দেহ নেই। কিন্তু কার্যক্রমে কিছু গলদ রয়ে গেছে বলে মনে হয়। প্রথমত ঢাকা শহরই সারা দেশ নয়, ঢাকা শহরে ধরপাকড় হলে অপরাধ চলে যাবে অন্য শহরে। চুনি-পুটিরা ফর্মালিন মেশায় না, আমদানিকৃত পণ্য যেমন মাছ, ফলমূল, সবজি ইত্যাদিতে বিদেশী রপ্তানিকারকরা অথবা বড় বড় আমদানিকারকরা ফর্মালিন মিশিয়ে গুদামজাত করে। আপেল, মাল্টা, আঙুর, নাশপাতি, আমদানির পর ৩ থেকে ৬ মাস পর্যন্ত তাজা থাকে কিভাবে? দেশীয় পণ্য, যেমন- আম, জাম, লিচু, আনারসেও বড় বড় পাইকাররা ফর্মালিন মেশায়, খুচরা ব্যবসায়ীদের কিছু করতে হয় না। কিন্তু এ অভিযানের ফলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, রাঘব বোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে আছে। এ জন্য আমদানিকৃত পণ্যের প্রবেশপথে অর্থাৎ প্রতিটি বন্দরে পণ্য পরীক্ষা করে ঢুকতে না দিলে ফর্মালিন মেশানো কোনদিন বন্ধ হবে না। ফলমূল ও সমস্ত পচনশীল দ্রব্য দেশের প্রবেশপথে পরীক্ষা করার জন্য প্রতিটি বন্দরে যন্ত্রপাতিসহ স্থায়ী টিম থাকতে হবে এবং তাদের সনদপত্র ছাড়া কোন পণ্য খালাস করা হবে না। উল্লেখ্য, বর্তমানে বন্দরে আমদানি করা পণ্যের বেলায় রেডিয়েশন, ক্ষতিকর পোকা-মাকড়, কীটনাশক নেই তার সনদ নিতে হয় অথচ মারাত্মক বিষ ফর্মালিনের সনদ নেয়ার বাধ্যবাধকতা নেই, অদ্ভুত ব্যবস্থা বৈকি! দ্বিতীয় কার্যকরী পদক্ষেপ হবে ফর্মালিন আমদানি, মজুত ও বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করা। ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান এফবিসিসিআই গত বছর থেকে বনানী, শান্তিনগর, মহাখালি, টাউন হল, কাওরান বাজার, মিরপুর-১, গুলশান-২, উত্তরা রাজউক ইত্যাদি বাজারকে ফর্মালিনমুক্ত বাজার ঘোষণা করে। বাজার বলতে কাঁচাবাজার অর্থাৎ মাছ, মাংস, সবজি ও ফলমূলের বাজার বা কিচেন মার্কেটকেই বোঝানো হয়েছে এবং সেখানে নিয়মিত ফর্মালিন পরীক্ষার ব্যবস্থা করে। এফবিসিসিআই’র উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু প্রতারক চক্র থেমে নেই। সুযোগ পেলেই তারা নানা পন্থায়, নানারূপে ফর্মালিন ব্যবহার করে থাকে। উদ্দেশ্য, ব্যবসায়িক দ্রব্যের পচন রোধ করে মুনাফা বৃদ্ধি করা। এজন্য এফবিসিসিআই’র মহান উদ্যোগ সফল হয়নি। তা ছাড়া এফবিসিসিআই কর্তৃক ব্যবহৃত যন্ত্রটি দামি হলেও এর রিডিং প্রায়ই সঠিক হয় না, ফলে পাল্টা বিতর্ক দেখা দেয়। তবে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৎস্য অধিদপ্তর ও কিছু বেসরকারি সংস্থার আবিষ্কৃত যন্ত্র দিয়েও ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ চালায়। ফর্মালিনকে ভেজাল হিসাবে নয়, প্রাণনাশী বিষ হিসেবে দেখলেই এ অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদ- হওয়া উচিত। মহাজোট সরকারকে সাধুবাদ জানাই সংসদে সর্বোচ্চ দশ বছরের কারাদ- ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান করে ফর্মালিন আইন পাস করার জন্য। কিন্তু এদেশে আইনের অভাব নেই, আছে কঠোর ও লাগাতার প্রয়োগের অভাব। শুধু ভ্রাম্যমাণ আদালতকে নয়, সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকে এ আইনে মামলা করার ক্ষমতা দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, গাছের ডাল ছাঁটাই করে মূলোৎপাটন না করলে যেমন কাজ হয় না, তেমনি ফর্মালিন আমদানি, মজুত ও বিক্রি নিয়ন্ত্রণ এবং আমদানিকৃত পণ্যের প্রবেশপথে অর্থাৎ বন্দরে পণ্য পরীক্ষা করে ঢুকতে না দিলে ফর্মালিন মেশানো কোনদিন বন্ধ হবে না। এফবিসিসিআইয়ের কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির মতে, গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে ৫০০ থেকে ৬০০ টন ফর্মালিন মজুত ছিল। কি ভয়ঙ্কর অবস্থা! তাহলে ফর্মালিন সহজলভ্য এবং সস্তা হবে না কেন। হাসপাতাল, ওষুধ কোম্পানি ও অন্য ক’টি শিল্প ছাড়া খুব কম শিল্পে ফর্মালিন ব্যবহার করা হয়। তাহলে ৬০০ টন ফর্মালিন কোথায় ব্যবহৃত হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। পানির মতো সহজলভ্য ও সস্তা বলেই গ্রামে-গঞ্জেও ফর্মালিন পাওয়া যায় এবং সব কিছুতে ব্যবহৃত হয়। অসুস্থ জনবল যেমন উৎপাদনের জন্য অনুকূল নয় তেমনি দেশের ও জন মানুষের চিকিৎসা ব্যয়ও বৃদ্ধি পায় এবং প্রজন্ম সুস্থতার সঙ্গে বেড়ে উঠতে পারে না। সুতরাং সাময়িকভাবে আইন প্রয়োগ না করে প্রজন্ম ও মানবিকতার স্বার্থে খাদ্য পণ্যকে ফর্মালিনমুক্ত করতে হবে। মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, বিচারক, ধনাঢ্য, ব্যবসায়ী কেউই ফর্মালিনের বিষ থেকে মুক্তি পাবেন না, জেনে হোক, অজান্তে হোক, এই বিষ তাদের দেহে কোন না কোন সময় প্রবেশ করবেই। সুতরাং স্থায়ী ব্যবস্থা হিসাবে নিম্নোক্ত পদক্ষেপসমূহ জরুরি। ১. বর্তমান বিরাট মজুত কমানোর জন্য আগামী ছ’মাস ফর্মালিন আমদানি বন্ধ করা উচিত। ২. যাদের কাছে অবৈধ মজুত আছে এক মাসের মধ্যে তা সেনাবাহিনী বা বিজিবির নিকট জমা দিতে হবে, অন্যথায় ৫ বছরের জেল। ৩. একমাত্র সেনা বাহিনীকে বা অপারগতায় বিজিবিকে ফর্মালিন আমদানির লাইসেন্স দেয়া উচিত এবং সব হাসপাতাল, ওষুধ কোম্পানিগুলোকে আমদানিকারকের নিকট থেকে বৈধভাবে ফর্মালিন কিনে নিতে হবে। ৪. আমদানিকৃত মাছ, ফলমূল ও পচনশীল দ্রব্য দেশের প্রবেশপথে পরীক্ষা করার জন্য প্রতিটি বন্দরে যন্ত্রপাতিসহ স্থায়ী টিম থাকতে হবে এবং তাদের সনদপত্র ছাড়া কোন পণ্য খালাস করা হবে না। সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ হবে ফর্মালিন আমদানি, মজুত ও বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ করা, তাহলেই ৮০% অপরাধ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সরকারকে সেদিকে নজর দেয়ার জন্য নিবেদন করছি।
No comments