শুভেচ্ছা, নাকি চাণক্যের কৌটিল্যশাস্ত্র? by ড. মাহবুব উল্লাহ্
ভারতে লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস
নেতৃত্বাধীন জোটের ভরাডুবি ও বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোটের ভূমিধস বিজয়ের ফলে
ভারতীয় রাজনীতিতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হল। ভারতের রাষ্ট্রদর্শনে
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ একটি প্রধান স্তম্ভ। কিন্তু ভারতীয় জনগণ বিজেপিকে জয়ী
করে প্রমাণ করল এ দর্শন তাদের মন ও মগজে গভীরভাবে প্রোথিত নয়। কার্যত একটি
হিন্দু মৌলবাদী দল ভারতের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের দেশে যারা
ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী তারা কীভাবে ভারতের এ নির্বাচনী ফলাফলকে মূল্যায়ন
করবেন জানি না। এর আগে ১০ বছর ধরে একনাগাড়ে কংগ্রেস ভারতের রাষ্ট্রীয়
ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। প্রথম মেয়াদে কংগ্রেসের যথেষ্ট সাফল্য ছিল। বিশেষ
করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারত অনেক দূর এগিয়ে যায়। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে এই
সাফল্য ম্লান হয়ে যায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির শ্লথ গতি, বেকারত্ব এবং বাজেট
ঘাটতির ফলে। শাসক দলের উচ্চ মহলের বিরুদ্ধে মারাত্মক দুর্নীতিরও অভিযোগ
ওঠে। আমরা দেখেছি এই সময় নারীর নিরাপত্তা শংকাজনকভাবে বিপন্ন হয়েছে।
কংগ্রেসের এ ব্যর্থতাকে পুঁজি করে নরেন্দ্র মোদি নির্বাচনে প্রচারাভিযান
চালায়। নির্বাচনের আগে বিভিন্ন জরিপ থেকে পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছিল
নির্বাচনে কংগ্রেসের পরাজয় ঘটবে। কিন্তু তখনও বোঝা যায়নি কংগ্রেসকে বিশাল
এক পরাজয়ের গ্লানি মাথা পেতে নিতে হবে। নরেন্দ্র মোদি তার দলে এক নম্বর
নেতা ছিলেন না। অথচ তিনিই হয়ে উঠলেন বিজেপির মধ্যমণি। তার ক্যারিশমা
অন্যদের ছাপিয়ে দেদীপ্যমান হয়ে উঠল। নরেন্দ্র মোদির অতীত মোটেও সুখকর নয়।
গুজরাটের মুসলিমবিরোধী দাঙ্গার জন্য তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। এ কারণে
মার্কিন সরকার তাকে যুক্তরাষ্ট্র সফরের জন্য ভিসা দিতেও অপারগতা প্রকাশ
করেছিল। সেই মোদি আজ ভারতীয় জনগোষ্ঠীর গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন। বিশাল
ভারতে তার এ গ্রহণযোগ্যতার বিস্তৃতিও ব্যাপক।
নরেন্দ্র মোদি তার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছেন। এ শপথ অনুষ্ঠানে ভারতের প্রতিবেশী দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য দেশগুলোর সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা এ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর পূর্বনির্ধারিত থাকায় তিনি দিল্লি যেতে পারেননি। এ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান না হওয়ায় ভারতীয় মিডিয়া তাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। মিডিয়ার দৃষ্টিতে যার আগমন সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে, তিনি হলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। এ অনুষ্ঠানে কারা গেলেন বা কে যেতে পারেননি তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, এমন একটি অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদির প্রয়াস ছিল প্রতিবেশী দেশগুলোর সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের নিয়ে শুভ সূচনা ঘটানো। ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পর্ক সুখকর নয়। ভারত এখন বিশ্বশক্তিতে পরিণত হওয়ার আশা পোষণ করছে। কিন্তু প্রতিবেশীদের অসন্তুষ্ট রেখে এ আকাক্সক্ষা পূরণ করা দুরূহ। সে কারণে নরেন্দ্র মোদি একটি ভিন্ন সংকেত দিতে চেয়েছেন। সংকেতটি হল, ভারত প্রতিবেশীদের সঙ্গে নিয়ে এগোতে চায়। এ চাওয়া কতটুকু আন্তরিক কিংবা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। কিন্তু বাংলাদেশসহ কোনো প্রতিবেশীর সঙ্গেই ভারতের সম্পর্ক সুখকর ছিল না। ভারতের জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সাবেক ডিন প্রফেসর অনুরাধা গুপ্ত আশির দশকের শেষ দিকে বিখ্যাত সাপ্তাহিক ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি পত্রিকায় এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে প্রতিবেশীদের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ্যবাদী চিন্তা অনুসরণ করা হয়। ভারত হল এতদঞ্চলের ব্রাহ্মণ। নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলংকার মতো দেশগুলো হল নিু বর্ণভুক্ত। এর মধ্যে পাকিস্তান হল অসুর। একটু ভেবে দেখলে বোঝা যায়, ভারত এ মানসকাঠামো থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। বর্ণভেদ প্রথায় উচ্চ বর্ণীয়দের কাছে নিু বর্ণীয়রা যেভাবে অচ্ছুত, ঠিক সেভাবেই ভারত প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি আচরণ করেছে। এর জন্য খুব বেশি তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এবার নরেন্দ্র মোদির মতো ব্যক্তি তার শপথ অনুষ্ঠানে প্রতিবেশীদের শামিল করে হয়তো একটি ভিন্ন ইঙ্গিত দিতে চেয়েছেন। এ ইঙ্গিত সত্যিকার অর্থে কতটুকু ইতিবাচক, সেটা ভবিষ্যতের দিনগুলো বলে দেবে। এ নিয়ে সাবধানী আশাবাদ পোষণ করাই শ্রেয়। একটি রাষ্ট্র শুধু সরকার পরিবর্তনের মাধ্যমে তার চরিত্র পাল্টাতে পারে কি-না রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অতি পুরনো এ প্রশ্নটির পরীক্ষা হবে মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতকে দিয়ে।
গত সপ্তাহে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। একটি প্রতিবেশী দেশে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এটাই প্রথম সফর। এটি ভারতের দিক থেকে একটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ। হিন্দুত্ববাদী ভারতের নতুন সরকারের পক্ষ থেকে একটি মুসলিমপ্রধান দেশে তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত ঔৎসুক্য জাগায় বৈকি। সুষমা স্বরাজ তার সফরকে একটি শুভেচ্ছা সফর বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধান এ মুহূর্তে দিতে আসেননি। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে তার অবস্থান হল, ভারতের নতুন সরকার এ বিষয়ে অভ্যন্তরীণ ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ ঢাকায় আসার আগে তিনি টেলিফোনে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে কথা বলেছেন। জানি না এ ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে কত বছর লাগবে? কিন্তু বার্তাটি অত্যন্ত স্পষ্ট যে, ঐকমত্য না হলে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু হচ্ছে না। এছাড়াও রয়ে গেছে সর্বমোট ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের সমস্যা। সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সুষমা স্বরাজ ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও সরাসরি কিছু বলতে চাননি। তার কথা হল অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারত হস্তক্ষেপ করতে চায় না। তবে ভারতের বর্তমান সরকারের পূর্বসূরি মনমোহন সিংয়ের সরকার ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ব্যাপারে নাক গলিয়েছিলেন। এ নির্বাচনের আগেই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশ সফরে এসে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নির্বাচনে অংশ নিতে এক ধরনের চাপ দিয়েছিলেন। এর পরপরই দেখা গেল র্যাব এরশাদকে তার বাসভবন থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। তারপর বলা হল এরশাদ অসুস্থ এবং তিনি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অথচ ওই সময় তাকে গলফ খেলতেও দেখা গেছে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, ভারতের বর্তমান সরকার সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানোর নীতি থেকে সরে আসবে। Bangladesh Institute of International studies আয়োজিত সেমিনারে সুষমা স্বরাজ বলেছেন, গণতন্ত্রের ব্যাপারে ভারত তার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের সঙ্গে বিনিময় করতে চায়। এখানেও সুষমা স্বরাজ একটি ভিন্ন ইঙ্গিত দিলেন। এ মুহূর্তে বাংলাদেশে Inclusive democrac নেই। অথচ ভারতীয় গণতন্ত্রের সব দুর্বলতা সত্ত্বেও সেখানে সব রাজনৈতিক দল উৎসাহের সঙ্গে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। সুষমা স্বরাজ কি বলতে চেয়েছেন এমন ধরনের গণতন্ত্র চর্চা বাংলাদেশেও হওয়া উচিত?
সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে কথা বলেছেন। এ মুহূর্তে বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রটোকলগত অবস্থান নেই। তা সত্ত্বেও সুষমা স্বরাজের সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ৪০ মিনিটব্যাপী বৈঠক হয়েছে। এ বৈঠকে বাংলাদেশ সরকারের আপত্তি ছিল বলে সংবাদমাধ্যম থেকে আমরা জেনেছি। কিন্তু ভারতের বর্তমান সরকারের বিঘোষিত নীতি হল, ভারত সরকার বাংলাদেশের কোনো নির্দিষ্ট দলের সঙ্গে নয়, বরং বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। সেই বিবেচনায় বিএনপির মতো একটি বড় দলকে হিসাবের বাইরে রাখা যায় না। সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশ সফরে এসে ভিন্ন রকমের এ নজির স্থাপন করে বাংলাদেশের জনগণকে জানান দিয়ে গেলেন বিজেপি সরকার কংগ্রেসের পথে হাঁটতে চায় না। এ ক্ষেত্রেও ভবিষ্যৎই বলে দেবে বিজেপির সরকার সত্যিকার অর্থে কংগ্রেস থেকে কতটা ভিন্ন। সুষমা স্বরাজের সফর উপলক্ষে শাড়ি কূটনীতি হয়েছে বলে বাংলাদেশের কোনো কোনো পর্যবেক্ষক মন্তব্য করেছেন। শাড়ি নারীর বহিরাঙ্গের ভূষণ। মানুষের ভেতরে অন্তর বলে যে জিনিসটি থাকে, সেখানে পরিবর্তন এলেই বাংলাদেশের জনগণের জন্য সেটা হবে বড় পাওয়া। সেজন্য অনেক পথ হাঁটতে হবে।
ভারতের রাষ্ট্রদর্শনে কৌটিল্য এবং মনুসংহিতার বিরাট প্রভাব। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, প্রতিবেশী দেশ রাষ্ট্রের শত্র“। প্রাচীন দর্শনের এ প্রভাব থেকে ভারতের মোদি সরকার কতটা বেরিয়ে আসতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা অযৌক্তিক নয়। ভারতের আমলাতন্ত্রের ইস্পাত কাঠামো নির্বাচিত সরকারগুলোকে ব্যতিক্রমধর্মী পদক্ষেপ নিতে বাধা দেয়। এটাও ভারতের রাষ্ট্রচরিত্রের একটি বড় বৈশিষ্ট্য। এতদসত্ত্বেও আমরা দেখেছি, অকংগ্রেস সরকারের আমলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের কিছু কিছু অগ্রগতি হয়েছিল। মোদির সরকারের বিশাল শক্তিমত্তা থাকার ফলে অতীতের অকংগ্রেস সরকারগুলোর তুলনায় বর্তমানের অকংগ্রেস সরকারের অধিকতর গতিশীল নীতি গ্রহণ করতে পারার কথা। কিন্তু কৌটিল্য ও মনুসংহিতার নির্দেশিত পথ থেকে ভারতের বর্তমান সরকার কতটুকু বেরিয়ে আসতে পারবে সে ব্যাপারে সংশয় থেকে যায়। তবে সীমান্তের এপারে এবং ওপারে সব যুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই অনুভব করেন, কোটি কোটি মানুষের কল্যাণের জন্য অতীতাশ্রয়ী না হয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকানোই মঙ্গলজনক।
ড. মাহবুব উল্লাহ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
No comments