জনতার জোয়ার: অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না: তারেক রহমান

রাজধানীতে বিপুলসংখ্যক মানুষের ঢল। ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ উপলক্ষে বর্ণাঢ্য র‌্যালি করেছে বিএনপি। র‌্যালিতে অংশ নিতে সকাল ১১টা থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন ওয়ার্ড, থানা এবং ঢাকার আশপাশের জেলা থেকে নেতাকর্মীরা জড়ো হতে শুরু করেন। মোড়ে মোড়ে এবং অলিগলিতে জমায়েত হয়ে বিভিন্ন স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত করে তুলেন তারা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফকিরাপুল থেকে কাকরাইল পর্যন্ত এই র‌্যালি নেতাকর্মীর জনসমুদ্রে রূপ নেয়। এতে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণকে আমি একটি বিষয় আবারো স্মরণ করিয়ে সতর্ক থাকতে অনুরোধ জানাতে চাই, আমি নিজেও সতর্ক থাকতে চাই। সেটি হলো গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্র এখনো কিন্তু থেমে নেই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে পলাতক স্বৈরাচারের দোসররা দেশে-বিদেশে, শাসনে-প্রশাসনে এখনো সক্রিয়। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না। গতকাল বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে র‌্যালিপূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশে লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। কার্যালয়ের সামনে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করা হয়। বেলা ৩টায় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মধ্যদিয়ে সমাবেশ শুরু হয়।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নয়াপল্টন থেকে শান্তিনগর মোড় বা মালিবাগ পর্যন্ত কয়েকটি র‌্যালি করেছিল পুলিশের অনুমতি নিয়ে। এই রুটের বাইরে একযুগের বেশি সময় পরে এই প্রথম মানিক মিয়া এভিনিউ পর্যন্ত র‌্যালি করেছে বিএনপি। র‌্যালিটি নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে শুরু হয়ে কাকরাইল মোড়-কাকরাইল মসজিদ-মৎস্য ভবন-ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট-শাহবাগ-বাংলামোটর-কাওরান বাজার-ফার্মগেট হয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে গিয়ে শেষ হয়। সরজমিন দেখা যায়, র‍্যালিতে অংশ নেয়া নেতাকর্মীরা নয়াপল্টন ও তার আশপাশের এলাকার অলিগলিতে অবস্থান নেন। তারা সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবি সম্বলিত ব্যানার, ফেস্টুন, জাতীয় ও দলীয় পতাকা এবং বিভিন্ন রঙের ক্যাপ পরে র‌্যালিতে অংশগ্রহণ করেন। এ ছাড়া কামান, ধানক্ষেত, কৃষক ও কমান্ডো সাজে নেতাকর্মীরা র‌্যালিতে যোগ দেন এবং ঢাক-ঢোল, ট্রাক নিয়ে ও বিভিন্ন রঙের টি-শার্ট পরে তারা র‌্যালিতে অংশ নেন। বর্ণাঢ্য র‌্যালি নেতাকর্মীদের হাতে ছিল ধানের শীষের ছড়া এবং নানা রঙের উৎসব পতাকা। বিভিন্ন পথ ধরে র‌্যালি চলার সময়ে রাস্তার দু’পাশে হাজার হাজার মানুষ করতালি দিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের অভিনন্দন জানায়। নেতৃবৃন্দ হাত তুলে দর্শকদের অভিবাদনের জবাব দেয়।

ওদিকে ৭ই নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসে বিএনপি’র র‌্যালিতে শেখ হাসিনাকে প্রতীকীভাবে খাঁচায় বন্দি করে উপস্থাপন করা হয়েছে। দেখা গেছে, একটি খাঁচার মধ্যে গোলাপি রঙের শাড়ি ও চোখে সানগ্লাস পরে দাঁড়িয়ে আছে মধ্যবয়স্ক এক নারী। যার সাজগোজ অনেকটা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার মতো। এই নারীর মাথায় চুলের বেণী করে তৈরি করা হয়েছে দুটি শিং।
বিকাল ৩টা ২৫ মিনিটে উদ্বোধনী বক্তব্য শুরু করেন তারেক রহমান। বক্তব্য রাখেন ৪ মিনিট ১৩ সেকেন্ড। বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, নিজেদেরকে সতর্ক করতে চাইলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, এটি আজ জনগণের চাওয়া। আসুন এই লক্ষ জনতার মিছিলকে কোনোভাবেই বৃথা যেতে দেয়া যাবে না। এই প্রত্যাশা রেখে এই মিছিলের সাফল্য কামনা করে এর শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করছি।

ছাত্র-জনতার বিপ্লবে ফ্যাসিবাদের পতন হওয়ায় জনগণকে অভিনন্দনও জানিয়ে তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর ছিল বাংলাদেশের শত্রু-মিত্র চেনার দিন। আর ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট বাংলাদেশের শত্রু চিহ্নিত করার দিন। আমি বলতে চাই, বাংলাদেশের পক্ষের শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে আর কেউ দেশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করতে পারবে না, ইনশাআল্লাহ।

৭ই নভেম্বরের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ লাখো মানুষের মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের অভিনন্দন জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, আজকের এই মিছিল থেকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিজয়ী যে জনতা, সেই জনতাকে জানাই বীরোচিত অভিনন্দন। রাজধানী ঢাকার রাজপথে আজ লাখো জনতার এই মিছিল বাংলাদেশের পক্ষের শক্তিকে ৭ই নভেম্বরের অন্তর্নিহিত শিক্ষায় দীক্ষিত করার মিছিল, লাখো জনতার আজকের এই মিছিল ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে আহত অসংখ্য ছাত্র-জনতা এবং হাজারো শহীদের স্বপ্নে একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক, মানবিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় মিছিল।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী অপশক্তি জেনে রাখুক, রাজধানীর রাজপথের আজকের এই সমাবেশ ও মিছিল কারও বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তোলার মিছিল নয় বরং রাজপথের জনতার আজকের এই মিছিল বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষার মিছিল, নিজের অধিকার রক্ষার মিছিল, নিজের ভোট প্রয়োগের অধিকার প্রতিষ্ঠার মিছিল।

বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশে যাতে আর কখনোই ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচার ফিরে আসতে না পারে, সেজন্য প্রতিটি নাগরিক সরাসরি ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার সক্ষমতা অর্জন জরুরি। জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার থেকে কেন্দ্রীয় সরকার পর্যন্ত জনপ্রতিনিধি হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জনগণের ভোটের প্রতি যতক্ষণ মুখাপেক্ষী করা না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত জনগণ গণতন্ত্রের সুফল পাবে না। এমনকি স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদমুক্ত পরিবেশেও স্বল্প আয়ের মানুষকে বাজার সিন্ডিকেটের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। যদি না মানুষের সরাসরি ভোটের অধিকার আমরা নিশ্চিত করতে পারি।
সভাপতির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই ৭ই নভেম্বর ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার দিন, ৭ই নভেম্বর ছিল বাংলাদেশকে আধিপত্যবাদের কবল থেকে মুক্ত করার দিন। আপনাদের নিশ্চয় জানা থাকার কথা, ৭ই নভেম্বরের আগে ৩রা নভেম্বর একটা অভ্যুত্থান হয়েছিল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে, খালেদ মোশাররফের লক্ষ্য ছিল আবার আধিপত্যবাদকে প্রতিষ্ঠা করা, ওই একদলীয় শাসনে দেশকে নিয়ে যাওয়া। এদেশের দেশপ্রেমিক সৈনিক ও জনগণ অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে তাদেরকে পরাজিত করে সেদিন বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ এক নতুন ইতিহাস রচিত করে। সেই ইতিহাস ছিল বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাস, সেই ইতিহাস ছিল বাংলাদেশকে আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, দেশের মানুষকে একটা স্বতন্ত্র পরিচিত দেয়ার ইতিহাস।
মির্জা ফখরুল বলেন, আজকে এ বছর আমরা আরেকটা অভ্যুত্থান দেখেছি, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। দীর্ঘ ১৭ বছর আমরা লড়াই করেছি, সংগ্রাম করেছি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, এই ১৭ বছরে আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামো ধ্বংস করে দিয়েছিল। বাংলাদেশকে একটা লুটপাটের রাজত্বে মাফিয়া রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। শেখ হাসিনা তার পরিবার, তার সহকর্মীদের নিয়ে এদেশকে লুটপাট করেছে। আল্লাহর অশেষ রহমত আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে, ছাত্র-জনতা অভূতপূর্ব এক অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে নতুন এক বাংলাদেশ সৃষ্টি করবার প্রয়াস পায়। অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও তার দোসররা দেশের সর্বত্র ঘুপটি মেরে বসে আছেন। তাদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে।

র‌্যালিতে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, সিনিয়র নেতা মোহাম্মদ শাহজাহান, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিন্টু, আহমেদ আজম খান, আবদুস সালাম, মাসুদ আহমেদ তালুকদার, মজিবুর রহমান সারোয়ার, খায়রুল কবির খোকন, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, আবদুস সালাম আজাদ, রশিদুজ্জামান মিল্লাহ, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, নাসির উদ্দিন অসীম, শিরিন সুলতানা, মীর সরাফত আলী সপু, মীর নেওয়াজ আলী, সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, রফিকুল ইসলাম, সাইফুল আলম নিরব, রাকিবুল ইসলাম বকুল, নিলোফার চৌধুরী মনি, তাইফুল ইসলাম টিপু, রফিকুল আলম মজনু, আমিনুল হক, এম মোনায়েম মুন্না, নরুল ইসলাম নয়ন, এসএম জিলানি, রাজীব আহসান, হাসান জাফির তুহিন, রাকিকুল ইসলাম রাকিব, নাছির উদ্দিন নাছির, নিপুণ রায় চৌধুরীসহ কেন্দ্রীয় ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বিএনপি মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা একটি খোলা ট্রাকে এই মিছিলে অংশ নেন। ঢাকা সিটি করপোরেশনের সকল ওয়ার্ডসহ মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, নরসিংদীসহ আশপাশের জেলাগুলো থেকে বাসে করে নেতাকর্মীরা র‌্যালিতে অংশ নেয়। রাজধানী ছাড়াও বিভাগীয় শহরগুলোতে বর্ণাঢ্য র‌্যালির এই কর্মসূচি একযোগে আয়োজন করা হয়।

প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার ছিল ৭ই নভেম্বর। দিনটি ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে পালন করে বিএনপি। দিবসটি উপলক্ষে আলোচনা সভা, শোভাযাত্রাসহ ১০ দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলটি।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.