নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডামে স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার রাতে ইসরায়েলি ফুটবল সমর্থকদের ওপর হামলার ধরনকে আঘাত করে পালিয়ে যাওয়া (হিট-অ্যান্ড-রান) ধরনের হামলা বলে বর্ণনা করেছে পুলিশ। হামলাকারীরা স্কুটারে করে এসে আঘাত করে দ্রুত চলে যাওয়ায় হামলা রোধ করা যায়নি বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
বৃহস্পতিবার রাতে ইসরায়েলের ফুটবল ক্লাব ম্যাকাবি তেল আবিবের যেসব সমর্থক হামলার শিকার হয়েছেন, তাঁদের একজন আদি রুবেন (২৪)। ইউরোপা লিগে ম্যাকাবি তেল আবিব বনাম অ্যাজাক্স আমস্টারডামের খেলা দেখার জন্য রুবেন আমস্টারডামে গিয়েছিলেন। তিনি বিবিসিকে জানান, (ম্যাচ শেষে) তিনি হোটেলের দিকে যাচ্ছিলেন। এ সময় একদল যুবক এসে তাঁর গতিরোধ করে তাঁকে মেঝেতে ফেলে লাথি মারতে থাকেন। রুবেন ও তাঁর বন্ধুদের যাঁরা গতিরোধ করেছিলেন তাঁদের সংখ্যা ১০ জনের বেশি। হামলাকারীরা তাঁদের কাছে জানতে চান, তাঁরা কোথা থেকে এসেছেন?
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে বুঝিয়ে ‘তাঁরা ইহুদি, ইহুদি, আইডিএফ, আইডিএফ’ বলে চিৎকার করেন বলেও জানান রুবেন। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী সংক্ষেপে আইডিএফ নামে পরিচিত।
রুবেন বলেন, ‘তাঁরা আমার সঙ্গে হাঙ্গামা শুরু করেন। তখন আমি বুঝতে পারলাম, আমাকে পালাতে হবে। কিন্তু চারদিকে অন্ধকার ছিল এবং আমি বুঝতে পারছিলাম না কোন দিকে যাব। একপর্যায়ে আমি মেঝেতে পড়ে যাই। ১০ জন মিলে আমাকে লাথি মারতে থাকেন। তাঁরা জোরে জোরে ফিলিস্তিন শব্দটি উচ্চারণ করছিলেন।’
হামলাকারীরা এক মিনিটের মতো সময় ধরে তাঁকে লাথি মারতে থাকেন বলে জানান রুবেন। তিনি জানান, লাথি মারার পর তাঁরা হেঁটে চলে যান। তাঁরা কোনো কিছুর ভয় পাচ্ছিলেন না।
রুবেন বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছিলাম, আমার নাক রক্তে ভরে গেছে। আমার নাক ভেঙে গিয়েছিল। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল।’
আঘাতের পর প্রায় ৩০ মিনিট কোনো কিছু স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছিলেন না রুবেন; কিন্তু তিনি আমস্টারডামের কোনো হাসপাতালে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কারণ তিনি শুনেছিলেন, ওই সহিংসতার সঙ্গে ট্যাক্সিচালকেরা জড়িত ছিলেন।
তাই আমস্টারডামের হাসপাতালে না গিয়ে স্থানীয় সময় শুক্রবার বিকেলে একটি ফ্লাইটে করে ইসরায়েলে এসে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে জানান রুবেন। তিনি মনে করেন, আগে থেকে পরিকল্পনা করে সংগঠিতভাবেই এই হামলা চালানো হয়েছে।
ম্যাকাবি তেল আবিবের আরেক সমর্থক পিনাও বৃহস্পতিবার রাতের হামলাকে পূর্বপরিকল্পিত বলে বর্ণনা করেছেন। নেদারল্যান্ডসের সংবাদমাধ্যম এনওএসকে তিনি বলেন, ‘মনে হয়েছে, সংঘবদ্ধভাবে এই হামলা চালানো হয়েছে। অনেক মানুষ এসেছিল। তারা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বাইরে যেতে নিরাপদ বোধ না করা পর্যন্ত আমরা হোটেলে লুকিয়ে ছিলাম।’
আমস্টারডামেই বসবাস করেন সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ডাচ জিউশ–এর সম্পাদক এস্থার ভোয়েট। তিনি জানান, সহিংসতার ভিডিও দেখে তিনি তাঁর বাসার দরজা ইসরায়েলি ফুটবল সমর্থকদের জন্য খুলে দেন। ইসরায়েলের সম্প্রচারমাধ্যম কানকে তিনি বলেন, ‘আমি তাঁদের বলেছিলাম, এটা একজন ইহুদির বাসা। আপনারা এখানে নিরাপদ। মানুষগুলো সত্যিই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। আমি কখনো ভাবিনি, আমস্টারডামে এমন কিছুর ভেতর দিয়ে যেতে হবে।’
ডাচ পুলিশ জানায়, ইসরায়েলি ফুটবল সমর্থকেরা গুরুতর নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। হামলাকারীদের মধ্যে অনেকে ছিলেন তরুণ। তাঁরা স্কুটারে এসে হামলা চালিয়েছিলেন।
আমস্টারডামের পুলিশপ্রধান পিটার হোল্লা বলেন, শহরের কেন্দ্রস্থলেই অনেক পুলিশ থাকলেও এ ধরনের হামলা ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। পুলিশ শেষ পর্যন্ত ম্যাকাবি ক্লাবের সমর্থকদের এক জায়গায় করার ও সুরক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে গাড়িতে করে তাঁদের ওই এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
পিটার হোল্লা জানান, পাঁচজন আহত হয়েছিলেন। তবে চিকিৎসা নিয়ে তাঁরা হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন। এ ছাড়া আরও ২০ থেকে ৩০ জন সামান্য আঘাত পেয়েছেন।
আমস্টারডামের জোহান ক্রুইফ এলাকায় বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের ফুটবল ক্লাব ম্যাকাবি তেল আবিব ও অ্যাজাক্স আমস্টারডামের মধ্যে ইউরোপা লিগের খেলা ছিল। এ ম্যাচে অ্যাজাক্স আমস্টারডাম ৫-০ গোলে জয়ী হয়। খেলা শেষে বৃহস্পতিবার রাতে ওই এলাকায় সংঘাত শুরু হয়।
এই হামলাকে নেদারল্যান্ডস ও ইসরায়েলের শীর্ষ নেতারা ইহুদিবিদ্বেষী বলে তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। ইসরায়েলি সমর্থকদের দেশে ফিরিয়ে আনতে শুক্রবার সকালে নেদারল্যান্ডসে দুটি উড়োজাহাজ পাঠান নেতানিয়াহু। ম্যাকাবির খেলোয়াড় ও অনেক সমর্থক এরই মধ্যে ইসরায়েলে ফিরে এসেছেন।
হামলার পটভূমি
নেদারল্যান্ডসের সরকারি কর্মকর্তারা জানান, ম্যাকাবি তেল আবিব ক্লাবের সমর্থক ও আমস্টারডামের বাসিন্দাদের মধ্যে কয়েক দিন ধরে উত্তেজনা চলছিল। তারপর এই হামলা হয়েছে।
পুলিশপ্রধান হোল্লা জানান, বুধবার ম্যাকাবির সমর্থকেরা একটি ট্যাক্সিতে হামলা চালায় এবং ফিলিস্তিনের একটি পতাকা পুড়িয়ে দেয়। এ ঘটনার পর ট্যাক্সি চালকেরা ম্যাকাবি সমর্থকেরা অবস্থান নিয়েছে এমন একটি স্থানের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। সেখানে ক্লাবটির প্রায় ৪০০ সমর্থক ছিলেন; কিন্তু পুলিশ তাঁদের ওই স্থান থেকে নিরাপদে সরিয়ে নিতে পেরেছিল। এরপর বুধবার দিবাগত রাতে শহরের ড্যাম স্কয়ারেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। কিন্তু তখন পুলিশ মোটাদাগে দুই পক্ষকে দূরে সরিয়ে রাখতে পেরেছিল।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় খেলা শুরু হওয়ার আগে পুলিশ পাহারায় ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভকারীরা মিছিল করেন। অদূরে ইসরায়েলি সমর্থকেরা থাকলেও পুলিশের উপস্থিতির কারণে তখন কোনো সংঘাত হয়নি; কিন্তু খেলা পরবর্তী হামলা ঠেকাতে পারেনি পুলিশ।
আমস্টারডামের মেয়র ফেমকে হালসেমা বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ আমাদের শহরের শান্তিকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এটা ইহুদিবিদ্বেষের এক ভয়ানক বিস্ফোরণ।’
মেয়র বলেন, ম্যাকাবি তেল আবিবের সমর্থকেরা সহিংসতা করতে পারে, এমন ধারণা ছিল না। ম্যাকাবি তেল আবিব ও অ্যাজাক্স আমস্টারডামের সমর্থকদের মধ্যে কোনো শত্রুতাও ছিল না।
ম্যাকাবির কিছু সমর্থক ইসরায়েলে বিভিন্ন বর্ণবিদ্বেষী ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁদের ক্লাবটির ফিলিস্তিনি ও আরব খেলোয়াড়দের কটূক্তি করতে দেখা গেছে। ওই সব খেলোয়াড়কে ক্লাব থেকে বাদ দিতে তারা চাপ তৈরি করেছিলেন, এমন কথাও শোনা গেছে।
ম্যাকাবির সমর্থকেরা প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের ওপরও ইতিপূর্বে হামলা চালিয়েছিলেন।
একটি ভিডিওতে আমস্টারডামে ম্যাকাবি তেল আবিবের সমর্থকদের আক্রমণাত্মক স্লোগান দিতে দেখা গেছে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মেয়র হালসেমা বলেন, গত (বৃহস্পতিবার) রাতে যা ঘটেছে, সেটার সঙ্গে বিক্ষোভের কোনো সম্পর্ক নেই। যা ঘটছে সেটার জন্য কোনো অজুহাত দেওয়া যায় না।
|
ইসরায়েলের ম্যাকাবি তেল আবিব ক্লাবের সদস্য ও আমস্টারডামের কিছু বাসিন্দার মধ্যে বুধবার থেকে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। ছবি : রয়টার্স |
|
হামলার পর একটি বিশেষ ফ্লাইটে নেদারল্যান্ডস থেকে ইসরায়েলের ম্যাকাবি তেল আবিব ক্লাবের সদস্যদের নিয়ে আসা হয়। ইসরায়েলের বেন গুরিওন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ম্যাকাবি তেল আবিব খেলোয়াড় ইসুফ সিসোখো ছবি : রয়টার্স |
No comments