গত ১৫ বছরের নির্বাচনী প্রহসন, ষড়যন্ত্র ও আমার সংস্কার প্রস্তাবনা by মনিরুল হক চৌধুরী
২০০৮ সালে ৮৪টি সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসের কথা বলা হলেও বাস্তবে ৩শ’ আসনের মধ্যে ১৩০টিরই পুনর্বিন্যাস করা হয়েছিল আইন লঙ্ঘন করে অসৎ উদ্দেশ্যে। এর মধ্যে ১২টি জেলা থেকে সাড়ে ১০টি সংসদীয় আসন কর্তন করে ঢাকায় ৭টি আসন বৃদ্ধি করা হয়েছিল। কমিশন আঞ্চলিক অখণ্ডতাভিত্তিক প্রশাসনিক সুবিধা বিবেচনায় না এনে শুধু জনসংখ্যাকেই গুরুত্ব দিয়েছিল। এক্ষেত্রে প্রায় ৪ হাজার আপত্তি পড়লে তা আমলে নেয়নি কমিশন। এভাবে আসন ব্যাপক ওলটপালট করার ফলে সারা দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বঞ্চিত হয়েছে গ্রামাঞ্চলের জনগণ। ২০০৮ সালের সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়কের সময়ে অসৎ উদ্দেশ্যে আসন বিন্যাস করতে গিয়ে পুরো দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির উদ্ভব করেছিল তৎকালীন কমিশন।
১৯৭৩ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সারা দেশের সংসদীয় আসনগুলো একইরূপে থাকলেও ২০০৮ সালে এসে হঠাৎ করে ব্যাপক রদবদল আনে তৎকালীন কমিশন। ফলে ঐতিহ্যবাহী আসনগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো করা হয়। যেসব আসনে দীর্ঘদিন ধরে সেনা-সমর্থিত সরকার ও তার সমর্থকদের বিপক্ষের রাজনীতিকরা নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল কেবল সেসব আসনই পুনর্বিন্যাস করা হয়েছিল। এক্ষেত্রে কোনো আপত্তি বা মামলা আমলে নেয়নি কমিশন। যদিও আসনগুলো পুনর্বিন্যাস করার জন্য অসংখ্য আবেদন জমা পড়েছিল কমিশনে। অধিকাংশ আবেদনে বলা হয়েছে, একটি বিশেষ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কমিশন সীমানা পুনর্বিন্যাস করে। এতে একটি রাজনৈতিক দলই বেশি লাভবান হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জনগণ।
১৯৭৬ সালের সীমানা নির্ধারণ অধ্যাদেশের ৮ ধারায় বলা হয়েছে, ‘আদমশুমারির অব্যবহিত পর অনুষ্ঠিতব্য সংসদ নির্বাচনের জন্য পুনরায় আসনসমূহের সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। ৬ ধারায় বলা আছে, আঞ্চলিক ভিত্তিক প্রশাসনিক সুবিধার বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে এবং তা করতে গিয়ে যতদূর সম্ভব সর্বশেষ আদমশুমারির প্রতিবেদনের জনসংখ্যার বিভাজনও বিবেচনায় রাখতে হবে’। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, আসন পুনর্বিন্যাসের ক্ষেত্রে ১৯৭৬ সালের সীমানা নির্ধারণ অধ্যাদেশ অমান্য করেছিল বিগত কমিশন। কমিশন সেই আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছিল।
জনসংখ্যাকে গুরুত্ব দিয়ে আসন পুনর্বিন্যাস করে ঢাকা মহানগরীর আসন সংখ্যা ৮ থেকে বাড়িয়ে ১৫টি করে কমিশন। পরে অবশ্য কমিশন জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন বিন্যাসকে ‘বড়’ ভুল হয়েছে বলে আখ্যা দিয়েছিল। যে ১৩০টি আসন পুনর্বিন্যাস করা হয়েছিল সেসব এলাকা থেকে ২০০৮ সালের জুনের দিকে ৩ হাজার ৬৯০টি আপত্তি জমা পড়ে। বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকার আপত্তিগুলো আমলে নেয়নি কমিশন। পরে শুনানি শেষে সীমানা পুনঃনির্ধারণ সংক্রান্ত ১৯৭৬ সালের অধ্যাদেশ এর ধারা ৬ (৪) অনুযায়ী আপত্তিগুলো খারিজ করে ১৩০টি সীমানা পুনঃনির্ধারণ করে ২০০৮ সালের ১০ই জুলাই গেজেট প্রকাশ করে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২৫ (ক) অনুযায়ী, সংসদীয় নির্বাচনী এলাকার সীমা নির্ধারণ কিংবা অনুরূপ নির্বাচনী এলাকার জন্য আসন বণ্টন সম্পর্কিত যেকোনো আইনের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপিত করার সুযোগ নেই। তবে সীমানা পুনঃনির্ধারণের বিষয়ে কমিশনের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত ১৩টি মামলা হয়। পরে আদালত মামলায় কমিশনের অনুকূলে রায় প্রদান করেন।
বিশৃঙ্খল অবস্থায় সংসদীয় আসনের সীমানা
জাতীয় সংসদের ৩শ’ সংসদীয় আসনের অধিকাংশ সীমানায় বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। প্রায় আসনকেই কোনো না কোনো বিচ্ছিন্ন এলাকার সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণ সম্মুখীন হয়েছে প্রশাসনিক জটিলতায়। জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন বিন্যাস করে বিগত কমিশন জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এ ক্ষেত্রে ভৌগোলিক অখণ্ডতা, প্রশাসনিক সুবিধা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিবেচনায় আনা হয়নি।
২০০৮ সালের সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসে দেখা গেছে, জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন বণ্টন করায় বিগত সংসদ নির্বাচনে ঢাকা জেলায় ৭টি, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, নেত্রকোনা ও গাজীপুরে ১টি করে আসন বেড়ে যায়। অন্যদিকে, ১২টি জেলার আসন কমাতে হয়েছিল নির্বাচন কমিশনকে।
ঢাকা-২ সংসদীয় আসন যেভাবে গঠন করা হয়েছে তার মধ্যে কেরানীগঞ্জ দক্ষিণ থানার ১টি, কেরানীগঞ্জ মডেল থানার ৬টি, সাভার থানার ৩টি, ঢাকা মহানগরীর কামরাঙ্গীর চর থানার ২টি ওয়ার্ড ও হাজারীবাগ থানার সুলতানগঞ্জ ইউনিয়ন অর্থাৎ ৫টি থানা পুলিশ স্টেশন নিয়ে সংসদীয় আসন গঠন করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ৫টি পুলিশ স্টেশন সমন্বয়ে আসনটি গঠিত হলেও উক্ত নির্বাচনী এলাকার ভৌগোলিক সীমারেখায় কোনো থানা নেই। জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন বণ্টন করার কারণে কেরানীগঞ্জ উপজেলাকে (ঢাকা-২ ও ঢাকা-৩) দিতে হয়েছিল দু’টি সংসদীয় আসন। এক উপজেলা চেয়ারম্যানের এলাকায় সংসদের আসন পড়েছে দু’টি। অন্যদিকে, কোথাও কোথাও তিনটি উপজেলা মিলে আসন দেয়া হয়েছে একটি।
সংবিধানের ১১৯ (গ) অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে জাতীয় সংসদের সীমানা নির্ধারণ করে নির্বাচন কমিশন। সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ৪০ বছরের পুরনো একটি আইন তারা ব্যবহার করেছে। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কমিশন ওই আইনের আলোকে সীমানা নির্ধারণের কার্যক্রম শুরু করার পূর্বে নিজেদের মতো করে একটি নীতিমালা তৈরি করে নেয়। অভিযোগ রয়েছে নিজেদের চিন্তাধারা ও পছন্দ বাস্তবায়নের জন্য তারা তাদের মতো করে নীতিমালা প্রণয়ন করে। বিগত নির্বাচনের আগে তারা যে নীতিমালা প্রণয়ন করে এর ৪ এর (খ) উপধারায় ৩টি গুরুত্বপূর্ণ নীতি অনুসরণ করতে বলা হয়, যথা: (এ) নির্বাচনী এলাকাসমূহের বর্তমান সীমানা যতদূর সম্ভব বহাল রাখা; (আ) যেখানেই সম্ভব, সীমানা পুনঃনির্ধারণকালে উপজেলা অবিভাজিত রাখা; এবং (ই) যেখানেই সম্ভব, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য (যথা- নদী) ও যোগাযোগ ব্যবস্থা (যথা- রাস্তাঘাট) বিবেচনা করা। কিন্তু এই ৩টি নীতিমালাই অনেক ক্ষেত্রে লঙ্ঘন করে নির্বাচন কমিশন। বর্তমান সীমানা যতদূর সম্ভব বহাল রাখার কথা বলা হলেও ৩০০টি আসনের মধ্যে ৮৪টি আসনেরই পূর্বের সীমানা তারা বদলে দেয়। উপজেলা অবিভাজিত রাখার নির্দেশনা থাকলেও গাজীপুর সদর উপজেলাকে ৪টি ভাগে, ভাণ্ডারিয়া উপজেলাকে ২টি ভাগে, মতলব উপজেলাকে ২টি ভাগে, সিরাজগঞ্জ উপজেলাকে ২টি ভাগে এবং রাজধানীর প্রায় সবগুলো থানাকে ৩ থেকে ৪টি ভাগ করে বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এ ছাড়া নদী ও রাস্তাঘাট বিবেচনার কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা মানা হয়নি। ১৯৭৯ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ৮টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভাণ্ডারিয়া ও কাউখালি উপজেলা নিয়ে একটি আসন থাকলেও ২০০৮ সালে এসে তার সঙ্গে যুক্ত করা হয় নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি) উপজেলাকে। যদিও নদীপথ ছাড়া ভাণ্ডারিয়ার সঙ্গে নেছারাবাদের যোগাযোগের কোনো সুযোগ নেই। প্রায় ৩০ কি. মি. দূরত্বের এই দুই উপজেলার মাঝখানে রয়েছে ২টি বড় নদী। এইভাবে অনেক নির্বাচনী এলাকার ক্ষেত্রে ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও প্রশাসনিক সুযোগ-সুবিধাকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। একই অবস্থা যশোর-৬ আসনেও। অভয়নগর ও কেশবপুর উপজেলা নিয়ে এই আসনটি গঠিত হয়। অথচ অভয়নগর উপজেলা থেকে মনিরামপুর উপজেলার উপর দিয়ে কেশবপুরে যেতে হয়। অভয়নগর থেকে কেশবপুরের দূরত্ব প্রায় ৬০ কিলোমিটার। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানাকে চারটি নির্বাচনী এলাকায় ভাগ করে দেয়া হয়। একই অবস্থা হয় রাজধানীর অন্য থানাগুলোর ক্ষেত্রেও। এভাবে ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার নীতিকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়।
নির্বাচন কমিশনের সীমানা পুনঃনির্ধারণ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে শহরাঞ্চলে সংসদীয় আসন বৃদ্ধির ফলে গ্রামাঞ্চলে উন্নয়ন কমছে বলে উল্লেখ করা হয়। একটি উপজেলা নিয়ে গঠিত সংসদীয় এলাকায় যে পরিমাণ সরকারি বরাদ্দ দেয়া হয়-একাধিক উপজেলা নিয়ে গঠিত সংসদীয় এলাকায়ও একই পরিমাণ বরাদ্দ দেয়া হয়। ঢাকায় আসন বাড়ানোর ফলে গ্রামের আসন কমেছে। ফলে গ্রামের উন্নয়ন বরাদ্দও কমেছে।
বিএনপিকে ঠেকাতেই এই নীলনকশা
প্রকৃতপক্ষে বিএনপিকে নবম সংসদ নির্বাচনে পরাজয়ের নীলনকশার অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশন সারা দেশের ৩শ’ সংসদীয় আসনের মধ্যে ১৩০টি আসনে ব্যাপক রদবদল এনেছিল। আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে জয় নিশ্চিত করার স্বার্থে পরিকল্পিতভাবে সেনা-সমর্থিত ওই কমিশন বেছে বেছে বিএনপি’র আসনগুলো পুনর্বিন্যাস করে। সেই সময়ে ঢাকায় আওয়ামী লীগকে বাড়তি সুবিধা দিতে কুমিল্লাসহ ১২টি জেলার সাড়ে ১০টি সংসদীয় আসন কর্তন করেছিল কমিশন। ঢাকা জেলায় ১৩টি থেকে সংসদীয় আসন করা হয় ২০টি। যে ১২টি জেলা থেকে আসন কর্তন করা তার মধ্যে ১০টি জেলায় ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি’র দখলে ছিল। একটি জামায়াতের আর অন্যটি ছিল আওয়ামী লীগের।
যেসব আসনে বিএনপি’র জনপ্রিয়তা বেশি ছিল সেইসব আসনগুলো পুনর্বিন্যাস করে কমিশন। সন্দেহাতীতভাবে আসনগুলোয় বিগত সময়ে বিএনপি’র অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল। বিএনপি’র আসনগুলো পুনর্বিন্যাস করে কিন্তু আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত এলাকাগুলোর কোনো আসনেই ওলটপালট আনেনি বিতর্কিত কমিশন। এলাকাগুলো হলো-গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, বাগেরহাট, নড়াইল, রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, দিনাজপুর, শেরপুর, পাবনা, নাটোর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, গাইবান্ধা, মাগুরা, ঝালকাঠি, ভোলা, রাজবাড়ী, হবিগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ ও জয়পুরহাট। এই ২৬ সহ পার্বত্য তিন জেলায় আসন পুনর্বিন্যাস করেনি আগের কমিশন। কারণ এসব এলাকায় সর্বশেষ নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অবস্থা ভালো ছিল।
যে বারোটি জেলার আসন কর্তন করা হয় সেই জেলাগুলো ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি’র একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। বারোটি জেলার সাড়ে ১০টি আসনের মধ্যে সাড়ে ৮টিরই নিয়ন্ত্রণ ছিল বিএনপি’র। এর মধ্যে ২০০১ সালে বিলুপ্ত কুমিল্লা-৯ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন আলহাজ মনিরুল হক চৌধুরী, বরগুনায় বিএনপি’র মতিউর রহমান তালুকদার, চাঁদপুরে বিএনপি’র মো. নুরুল হুদা, ফরিদপুরে বিএনপি’র কামাল ইবনে ইউসুফ, স্বরূপকাঠি-বানারীপাড়া আসনে (বরিশাল-পিরোজপুর) বিএনপি’র সৈয়দ শহীদুল হক জামাল, সিরাজগঞ্জে বিএনপি’র মেজর (অব.) মঞ্জুর কাদের, ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা আসনে বিএনপি’র ডা. মোহাম্মদ আলী, মুন্সীগঞ্জে বিএনপি’র মো. আবদুল হাই, মানিকগঞ্জে বিএনপি’র হারুন-অর রশিদ খান মুন্নু, কিশোরগঞ্জে আওয়ামী লীগের ড. আলাউদ্দিন আহমদ এবং সাতক্ষীরার বিলুপ্ত ৩ আসনে এমপি ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর মাওলানা রিয়াসাত আলী। বিএনপি’র অধ্যুষিত উপরের আসনগুলো কেটে ইচ্ছাকৃতভাবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, রাজশাহী ও নেত্রকোনায় বৃদ্ধি করা হয়।
প্রতারণার স্বরূপ
জনসংখ্যাকে বিবেচনায় ধরার নামে একপ্রকার প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিল কমিশন। দেখা যাচ্ছে, ২০০৮ সালে বিএনপি প্রভাবিত মুন্সীগঞ্জ জেলার জনসংখ্যা ছিল ১২ লাখ ৯৩ হাজার ৯৭২ জন। এখানে ১৯৭৯ সালের পর প্রথম একটি আসন কমিয়ে চারটির বদলে তিনটি করা হয়। অথচ এখানে চারটি আসন রাখা হলে প্রতিটির জনসংখ্যা হতো গড়ে ৩ লাখ ১৮ হাজারের কিছু বেশি। একইসঙ্গে সাতক্ষীরা জেলার একটি আসন কমানো হয়। পাঁচটির জায়গায় করা হয় চারটি। অথচ এখানেও মোট জনসংখ্যা ছিল ১৮ লাখ ৬৯ হাজার ৭০৪। এক্ষেত্রেও আসন কমানোর কোনো যৌক্তিকতা পাওয়া যায় না। কারণ এখানেও ২০০৮ সালে মোট পাঁচটির মধ্যে প্রতিটি সংসদীয় আসনের গড় জনসংখ্যা ৩ লাখ ৭০ হাজারের বেশি। সিরাজগঞ্জ জেলা থেকেও একটি আসন কমানো হয়। যদিও এ জেলার মোট জনসংখ্যা ছিল ২৬ লাখ ৯৩ হাজার ৮০৪ জন। যদি সাতটি আসন বহাল রাখা হতো তা হলে প্রতিটির জনসংখ্যা হতো ৩ লাখ ৮৪ হাজার। আবার রংপুর জেলায় কোনো আসন কমবেশি করা হয়নি। যদিও এখানে জনসংখ্যার পরিমাণ ছিল ২৫ লাখ ৪২ হাজার ৪৩১ জন। এখানে বিদ্যমান ছয়টি আসন বহাল রাখা হয়। যদি সাতটি আসন করা হতো তাহলে জনসংখ্যার পরিমাণ দাঁড়াতো ৩ লাখ ৬০ হাজারের বেশি। আসন বাড়লে সেক্ষেত্রে উন্নয়ন বরাদ্দও বেশি হওয়া সম্ভব ছিল। আবার বাগেরহাট জেলায় ১৫ লাখ ৪৯ হাজার জনসংখ্যার জন্য চারটি আসন অপরিবর্তিত রাখা হয়। অর্থাৎ প্রতিটি আসনে জনসংখ্যা ৩ লাখ ৮৭ হাজার। অথচ ঢাকা জেলার আসন বাড়ানোর স্বার্থে ঢাকা জেলায় ন্যূনতম ৩ লাখ ৫০ হাজার ১৬৮ জন জনসংখ্যা নিয়ে ঢাকা-২০ নম্বর আসন সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু ৩ লাখ ৮৪ ও ৩ লাখ ৭০ হাজার জনসংখ্যা থাকলেও সিরাজগঞ্জ ও সাতক্ষীরা জেলায় আসন কমিয়ে দেয়া হয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে কয়েকটির উল্লেখ করা হলো। প্রকৃতপক্ষে জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন কম-বেশি করার কথা বলা হলেও কোনো ক্ষেত্রেই তেমন নজির পাওয়া যাচ্ছে না। তাই এখন সকল স্তর থেকে সে সময় আসন পুনর্বিন্যাসের কথা বলে তা কম বেশি করার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।
নির্বাচনে যা ঘটেছিল
৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে ও সিটি করপোরেশন এবং ৮টি পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ঐ নির্বাচন হয়েছিল জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে। এই নির্বাচনটি ছিল পূর্ব প্রস্তুতি। ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন কীভাবে কার্যকরী করা যায় তারই একটি প্রস্তুতি। উক্ত নির্বাচনগুলোতে সবক’টিতে একটি দলের প্রার্থীরা জয়লাভ করেছিল। এই নির্বাচনগুলোতে সবক’টিতে অতিরিক্ত ব্যালটে সিল মেরে কেন্দ্রভিত্তিক ঢুকানো হয়েছিল।
৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২৯শে ডিসেম্বর ২০০৮। প্রতিটি কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যার ভিত্তিতে বাংলাদেশের সব কেন্দ্রে প্রায় ১০% অতিরিক্ত সিল মেরে ব্যালটে ঢুকানো হয়েছিল। যার কারণে বিএনপি’র প্রার্থীরা ২৯টি আসন লাভ করে বাকি সবগুলো তৎকালীন জোট আওয়ামী লীগ জয়লাভ করেছিল। এই বিষয়টি তৎকালীন নির্বাচন কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানতেন।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সকলে বলে থাকেন যে, ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু তথ্যটি সঠিক নয়। কারণ জাতীয় পার্টির যে সব প্রার্থীকে জয়লাভ দেখানো হয়েছিল তাদের সকলকেই মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করার একদিন আগে অথবা প্রত্যাহারের শেষ দিনের আগেই মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছিলেন। সবারই মনোনয়নপত্র ছিল না। কিন্তু জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং অফিসারগণ পরবর্তী সময়ে একটি বিশেষ গোয়েন্দা বাহিনীর প্রেসারে পড়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার হয় নাই বলে ঘোষণা দেন। নিজেরাই একটি আবেদন করে কর্মচারীদেরকে দিয়ে স্বাক্ষর দিয়ে মিডিয়ার সামনে বলেন-জাতীয় পার্টির সকল প্রার্থীর প্রার্থিতা বহাল রয়েছে। জাতীয় পার্টির সকল আসন যোগ করার কারণে ২০০-এর কাছাকাছি হয়। অনুরূপ ভাবে অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থীর বেলায় একই ঘটনা ঘটেছিল।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোর হওয়ার পূর্বেই সকল প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছিল কয়েকটি আসন বাদে। তৎকালীন নির্বাচনের সময় ডিসি, এসপি’র সঙ্গে ইউএনও, ওসি সহ কতিপয় নির্বাচন কমিশনারের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা দেখা করেছিলেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অ্যাপস নামে একটি অ্যাপস তৈরি করেছিল নির্বাচন কমিশন। এই অ্যাপসে যেই প্রতীকে ভোট দেয়া হোক না কেন তা একটি নির্দিষ্ট প্রতীকে জমা হতো। এই অ্যাপস তৈরিতে স্পেশাল দুর্নীতির পাশাপাশি ভোটারের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল।
আমার সংস্কার প্রস্তাবনা
এক.
নির্বাচন কমিশনের মূল করণীয় হচ্ছে-ভোটার তালিকা প্রণয়ন, ভোট গ্রহণ, প্রার্থীর চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ, ভোটারদের ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণ, নির্বিঘ্নে ভোট দেয়ার ব্যবস্থাকরণ, প্রভাবমুক্ত নির্বাচন সম্পন্নকরণ এবং ভোটদান বা জনআকাঙ্ক্ষার আলোকে সঠিক ফল প্রকাশ নিশ্চিতকরণ। এটা করতে যেকোনো পদক্ষেপ নিতে নির্বাচন কমিশন সব সময় ক্ষমতাপ্রাপ্ত। দুঃখের বিষয় হলো-২০০৮ সালের হুদা-সাখাওয়াত কমিশন নির্দয়ভাবে ভোটারের প্রসঙ্গটি চাপা দিয়ে জনসংখ্যা সামনে এনে নির্বাচনের বদলে পরিবার-পরিকল্পনা দপ্তরের দায়িত্বে ব্যস্ত ছিলেন! যেমন, রাজধানী ঢাকা, বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে আসন বৃদ্ধি করেছেন জনসংখ্যার আলোকে। এবং গ্রামের আসন কমিয়েছেন, যেখানে জনসংখ্যার তুলনায় ভোটার বেশি। খোদ ঢাকা শহরেই নির্বাচনের দিন বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনে জনসংখ্যার ৫০ শতাংশও উপস্থিত থাকেন না। সবাই ভোট দিতে মূল ঠিকানা গ্রামে চলে যান। শুনেছি, এ ব্যাপারে সরকারের কাছে কমিশনের একটি প্রস্তাব অনেকদিন ধরে বিবেচনাধীন। ভোটার সংখ্যার আলোকে নির্বাচনী এলাকা পুনর্বিন্যাস করতে হবে জনসংখ্যার আলোকে নয়। আমার বিবেচনায় সংস্কার তালিকায় এটাকেই প্রথমে রাখা উচিত। উল্লেখ্য যে, ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সীমানাকে ভিত্তি ধরে আসন সংখ্যা পুনঃনির্ধারণ করাই উত্তম হবে। এতে সুষম উন্নয়ন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে, ভোটারদেরও আকাঙ্ক্ষা অনেকাংশে প্রতিফলিত হবে। যা প্রতিটি নির্বাচনী আসনে ভোটার সংখ্যার আলোকে নির্ধারিত হয়েছিল।
দুই.
সংস্কার বিষয়ে আমার আরেকটি প্রস্তাবনা হলো-ন্যাশনাল আইডি কার্ড ভোটার আইডি কার্ড হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এতে প্রত্যেক ভোটার নির্বিঘ্নে নির্বাচনী এলাকার যেকোনো কেন্দ্রে ভোট দিতে পারবে- এরকম একটি ভোটগ্রহণ ব্যবস্থা চালু করা উচিত।
তিন.
ঋণখেলাপি আইনকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সুযোগ বুঝে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। যা পৃথিবীর কোথাও হয় না। নির্বাচনকে ঋণ আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ দেয়া সঠিক নয়। কারণ, কেউ ঋণখেলাপি হলে তার বিচারের জন্য জেলাভিত্তিতে অর্থঋণ আদায়ের জন্য আদালত বহু আগে থেকেই চালু আছে। নির্বাচন কমিশনকে ব্যবসায় বিনিয়োগকৃত অর্থ পুনরুদ্ধারে ব্যবহার করা নির্বাচন কমিশন তো বটেই এমনকি রিটার্নিং অফিসারের জন্য সম্মানজনক নয়।
চার,
এ ছাড়া প্রার্থী মনোনয়নপত্র এবং প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া আরও সহজ করা প্রয়োজন। নির্বাচনের জন্য অপ্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান পরিহার করা ভালো। কোনো প্রার্থীই যেন রিটার্নিং অফিসারের অনুকম্পার পাত্র না হন। একবার রিটার্নিং অফিসার কোনো কারণে প্রতিপক্ষ দ্বারা অথবা রাজনৈতিক মনোভাবের কারণে প্রার্থীর মনোনয়নপত্র অবৈধ ঘোষিত করলে হাইকোর্ট পর্যন্ত প্রার্থীকে এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে শ্রম ও অর্থব্যয় সহ মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। এটা থেকে মুক্তি দেয়া এখন সময়ের দাবি।
লেখক: সাবেক সংসদ সদস্য
No comments