রুয়ান্ডা গণহত্যা: বর্বরতার এক নিষ্ঠুরতম উদাহরণ by সঞ্জয় বসাক পার্থ
সময়ের ব্যবধান মাত্র ১০০ দিন। তারমধ্যেই ঝরেছিলো প্রায় ৮লাখ প্রাণ! জাতিগত বিদ্বেষের স্বীকার হয়ে প্রাণ হারানোর ঘটনা ইতিহাসে বিরল নয়, কিন্তু রুয়ান্ডার গণহত্যার মতো এতো নিষ্ঠুর ও বর্বর হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে খুবই কম। কীভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হুতুদের হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন সংখ্যালঘু তুতসিরা, সেই নিষ্ঠুর কাহিনী নিয়ে আজকের আয়োজন।
মূল নায়ক বেলজিয়াম শাসকরা
রুয়ান্ডার গণহত্যা সম্পর্কে জানতে হলে
ফিরে যেতে হবে ১৯১৬ সালে। ১৯৯৪ সালের এপ্রিল ও জুনের মাঝামাঝি সময়ে সংঘটিত
এই বর্বরতম হত্যাকান্ডের বীজবপন করা হয়েছিলো এই সময়েই। সে সময় পূর্ব
আফ্রিকার প্রকৃতির অপরূপ রঙ-রসে ভরা ছোট্ট এই দেশটিকে দখল করে নেয়
বেলজিয়ামের সেনাবাহিনী। জাতিগতভাবে রুয়ান্ডার জনগোষ্ঠী মূলত দুই সম্প্রদায়ে
বিভক্ত ছিল, হুতু আর তুতসি। হুতুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও দুই সম্প্রদায়ের
মানুষ বেশ শান্তিপূর্ণভাবেই মিলেমিশে বসবাস করতো একই দেশে। চালচলন ও আচার
আচরনেও দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য ছিলো না। পার্থক্য
যা ছিলো তা কেবল শারীরিক গঠনে। প্রকৃতিগতভাবে হুতুরা ছিল বেশ খাটো ও মোটা,
আর তুতসিরা ছিল চিকন ও লম্বা প্রকৃতির। হুতুরা বিশ্বাস করতো, তুতসিরা
রুয়ান্ডার আদি নিবাসী নয়, তাদের পূর্বপুরুষেরা ইথিওপিয়া থেকে এই দেশে এসে
বসতি স্থাপন করেছিলো। সে কারণেই উচ্চতার দিক থেকে লম্বা ছিলো তুতসিরা।
শারীরিক এই পার্থক্যকেই বেলজিয়ান শাসকেরা
ব্যবহার করতে শুরু করলো। তারা হুতু ও তুতসিদের জন্য আলাদা পরিচয়পত্রের
ব্যবস্থা করলো, প্রশাসনিক কাজেও হুতুদের চেয়ে তুতসিদের বেশি প্রাধান্য দিতে
শুরু করলো। তুতসিরা এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিলো, কারণ সংখ্যালঘু
হয়েও তারা হুতুদের চেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছিলো। কিন্তু হুতুরা এই
সিদ্ধান্তকে মোটেও স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। আর এভাবেই দুই সম্প্রদায়ের
মধ্যে প্রাথমিক দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হলো।
হুতুদের হাতে যখন ক্ষমতা
নিজেদেরকে বৈষম্যের শিকার মনে করা হুতুদের
মধ্যে দিনে দিনে ক্ষোভের সঞ্চার হতে থাকে। সেই ক্ষোভের প্রথম বহিঃপ্রকাশ
ঘটে ১৯৫৯ সালে। দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে একটি জাতিগত দাঙ্গা লাগে,
যেটিতে প্রায় ২০ হাজারেরও বেশি তুতসি নাগরিক মারা যায়। অনেকে প্রাণভয়ে
প্রতিবেশী দেশ বুরুন্ডি ও তানজানিয়াতেও আশ্রয় নেয়। তবে খুব বেশিদিন আর
বৈষম্যের শিকার হতে হয়নি হুতুদের। ১৯৬২ সালে বেলজিয়ানরা রুয়ান্ডা ছেড়ে চলে
যায়। তবে যাওয়ার আগে আসল চালটা ঠিকমতোই খেলে যায় তারা! শাসনকালে তুতসিদের
প্রাধান্য দিলেও যাবার সময় হুতুদের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করে যায় তারা।
১৯৭৩ সালে প্রেসিডেন্ট হয়ে ক্ষমতায় বসেন
হুতুদের একনায়ক নেতা জুভেনাইল হাবিয়ারিমানা। কিন্তু সাধারণ জনগণের কাছে
জনপ্রিয় হতে পারেননি তিনি। মূলত দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা দিন দিন অবনতি
হবার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলেন তিনি। অপরদিকে এই
একনায়ক নেতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য উগান্ডাতে পালিয়ে যাওয়া তুতসিদের নিয়ে
রুয়ান্ডান প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট (আরপিএফ) নামে একটি সামরিক বাহিনী গঠন করেন
বর্তমানে দেশটির প্রেসিডেন্ট পদে থাকা পল কাগামে। আরপিএফের মূল উদ্দেশ্য
ছিল একনায়ক নেতা হাবিয়ারিমানাকে ক্ষমতাচ্যুত করে পালিয়ে থাকা সব তুতসিদের
আবার নিজ দেশে ফেরত আনা।
আশঙ্কা ও আতঙ্কের সৃষ্টি
আর এটিকেই নিজের জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধারের
হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার দুরভিসন্ধি আঁটেন হাবিয়ারিমানা। তুতসিরা
হুতুদের উপর হামলা করে রুয়ান্ডা দখল করে নিতে চায়, এমন একটি প্রচারণা
চালাতে শুরু করেন তিনি। রুয়ান্ডাতে অবস্থানরত তুতসিরাও আরপিএফকে মদদ
দিচ্ছে, এটিও ছড়িয়ে দেন তিনি। ফলে ধীরে ধীরে রুয়ান্ডার সাধারণ হুতু
জনগোষ্ঠীর মনে একটি আশঙ্কা ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। এদিকে ১৯৯৩ সালে রুয়ান্ডার
সরকারী সামরিক বাহিনী ও আরপিএফের বাহিনীর মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়।
প্রেসিডেন্ট হাবিয়ারিমানা ও আরপিএফের নেতৃবৃন্দের মাঝে একটি শান্তিচুক্তিও
স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু চুক্তি হলেও বাস্তবে সংঘর্ষ পুরোপুরি থামেনি। পুরো
রুয়ান্ডা জুড়েই তখন হুতু ও তুতসিদের মধ্যে বিরাজ করছিল চাপা উত্তেজনা।
সেই উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে হঠাৎ
হাবিয়ারিমানা হত্যাকান্ডের পর। ১৯৯৮ সালের ০৬ এপ্রিল রাজধানী কিগালার
বিমানবন্দর থেকে প্রতিবেশী দেশ বুরুন্ডির প্রেসিডেন্টকে নিয়ে বিমানে
উঠেছিলেন হাবিয়ারিমানা। অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতিকারীরা মিসাইল ছুঁড়ে বিমানটিকে
ভূপাতিত করে ফেলে। ফলে প্রেসিডেন্ট হাবিয়ারিমানার মৃত্যু হয়।
এই ঘটনার পরই…
মূলত এই ঘটনার পরেই রুয়ান্ডায় বিধ্বংসী ও
ভয়াবহ জাতিগত সহিংসতা শুরু হয়। অকাট্য কোনো প্রমাণ না থাকলেও প্রেসিডেন্ট
হত্যার দায় গিয়ে পড়ে আরপিএফ ও তুতসি সম্প্রদায়ের উপর। সাধারণ হুতু
জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। আর এই ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালার
কাজটা করে রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আরটিএলএম ও কাঙ্গুরা নামের একটি পত্রিকা।
এই হত্যাকান্ডের জন্য তুতসিরাই দায়ী, তুতসিরা রুয়ান্ডা দখল করে নিতে চাইছে
তাই যেকোনো মূল্যে তুতসিদের নিধন করতে হবে, সরাসরি এরকম সহিংস বার্তা
প্রচার করতে থাকে তারা।
ফলাফল হিসেবে ৭ এপ্রিল ভোর হবার আগে থেকেই
সাধারণ তুতসি নাগরিকদের উপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালাতে শুরু করে রুয়ান্ডার
সেনাবাহিনী। সকাল হতেই ‘হুতু পাওয়ার রেডিও’তে পরিচিত সব তুতসিদের হত্যা
করার নির্দেশ দেয়া হয় হুতুদের। প্ররোচনায় পড়ে অনেক সাধারণ হুতু নাগরিকও এই
বীভৎস হত্যাকান্ডে অংশ নেয়। এমনকি এতদিনের প্রতিবেশী তুতসিদের হত্যা করতে
একটুও হাত কাঁপেনি হুতুদের। যারা সরাসরি হত্যাকান্ডে অংশ নেননি, তারাও
সরকারী বাহিনীকে তুতসিদের খোঁজ দিয়ে, রাস্তায় তাদের গাড়ি আটকে ধরিয়ে দিতে
সহায়তা করেছেন। তুতসি হত্যার বিনিময়ে খাবার, টাকাসহ নানা ধরনের সুযোগ
সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয় সাধারণ হুতুদের। এমনকি হত্যার পর তুতসিদের
বাড়িঘর লুট করার অবাধ স্বাধীনতাও দেয়া হয় তাদের। শুধু তাই নয়, যেসব হুতুরা
তুতসিদের পক্ষে ছিলেন (এদেরকে মডারেট হুতু বলা হতো) তারাও নিস্তার পাননি এই
হত্যাযজ্ঞ থেকে।
তুতসিদের হাতে যখন ক্ষমতা
প্রায় ১০০ দিন অব্যাহত ছিলো এই
হত্যাকান্ড। অবশেষে জুলাই মাসে আরপিএফের সৈন্যরা কিগালি দখল করে নিলে
সমাপ্তি ঘটে এই হত্যাকান্ডের। তুতসিরা ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে এটা বুঝতে
পারার পর প্রাণভয়ে প্রায় ২০ লাখ হুতু দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, যে প্রেসিডেন্ট
হত্যাকান্ড নিয়ে এতো ভয়ঙ্কর গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, সেটির আজ পর্যন্ত কোনো
সুরাহা হয়নি। হুতুদের দাবি, ক্ষমতা দখলের জন্য কাগামের নির্দেশে তুতসি
বিদ্রোহীরাই প্রেসিডেন্টকে হত্যা করেছিলো। অপরদিকে আরপিএফের দাবি,
প্রেসিডেন্টের দলের লোকেরাই চক্রান্ত করে তাকে হত্যা করেছিলো। আর রুয়ান্ডার
গণহত্যার কথাও ইতিহাসের পাতায় সর্বদা লেখা থাকবে বর্বরতম ধ্বংসযজ্ঞের
উদাহরণ হিসেবে।
No comments