এ কথা বন্ধুত্বের নমুনা নয় by ড. মাহবুব উল্লাহ্
আজ
যখন দৈনিক যুগান্তরের জন্য নিয়মিত সাপ্তাহিক কলামটি লিখছি, তখন যে দিনটি
অতিবাহিত হচ্ছে সেটি ২৫ ফেব্রুয়ারি। আজকের এদিনে ২০০৯ সালে বিডিআর বাহিনীতে
এক কলঙ্কময় বিদ্রোহের নামে হত্যা করা হয় আমাদের সামরিক বাহিনীর ৫৭ জন চৌকস
ও দেশপ্রেমিক অফিসারকে। তাদের সঙ্গে নিহত হয়েছিলেন আরও অনেকে। আমাদের
জাতীয় ইতিহাসে কিছু বেদনাঘন দিন আছে। তার সঙ্গে সেদিন যুক্ত হয়েছিল ২৫
ফেব্রুয়ারি। চ্যানেল আই তৃতীয়মাত্রা অনুষ্ঠানে ২৫ ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে
নিজেদের অনুভূতি সম্পর্কে কথা বলার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ছয়জন শহীদ
সেনা অফিসারের স্ত্রী-পুত্র কন্যাদের। তাদের অনুভূতির কথা শুনে অশ্রু
সংবরণ করা সম্ভব হয়নি। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক জিল্লুর রহমানও একপর্যায়ে
অশ্রুসজল হয়ে পড়েছিলেন। দিবসটিকে ঘিরে আমাদের স্মৃতির বীণায় যে করুণ সুর
জাগিয়ে তোলা হয়েছিল তার জন্য চ্যানেল আই এবং উপস্থাপক জিল্লুর রহমানের
প্রতি রইল অন্তরসিক্ত কৃতজ্ঞতা। একজন শহীদ অফিসারের সন্তান বলতে চাইল, ‘ওটা
বিদ্রোহ ছিল না, ছিল হত্যাকাণ্ড।’ যুক্তিস্বরূপ এ যুবক বলল, বিদ্রোহের
একটা আইডিওলজি থাকে। সে জন্য মানবসমাজে বিদ্রোহ নন্দিত হয়। ১৮৫৭ সালে ইংরেজ
শাসনের বিরুদ্ধে ইংরেজদের ভাষায় যে ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ হয়েছিল, কার্ল
মার্কসের দৃষ্টিতে তা ছিল ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’। যারা ইতিহাসে
উপস্থাপিত ঘটনাবলি সম্পর্কে কোনো বিকৃতি বা বিচ্যুতি মানতে চান না, তাদের
অনেকে মার্কসের দোহাই দিয়ে যে শব্দগুচ্ছ উপস্থাপন করা হয়েছিল, সেগুলো
মার্কসের নিজের কথা ছিল না বলে দাবি করেছেন। মার্কস ভারতে ব্রিটিশ
ঔপনিবেশিক শাসন সম্পর্কে বেশকিছু লেখা লিখেছিলেন। সেগুলো সংকলিত করে প্রকাশ
করতে গিয়ে একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের মার্কস-লেনিন ইন্সটিটিউট এই মহাবিদ্রোহ
সম্পর্কিত লেখাগুলোর শিরোনাম করেছিলেন, ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’।
ইতিহাসের ইতিহাস নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক না কেন, আমাদের কাছে ১৮৫৭-র
মহাবিদ্রোহ ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। তার
সঙ্গে চির অম্লান হয়ে থাকবে মহাবিদ্রোহের মহানায়কদের নাম। যেমন, তাতিয়া
তপী, নানা ফড়নবীশ, সিপাহি মঙ্গল পান্ডে এবং মওলানা আহমদ উল্লাহ। তাদের
সঙ্গে যে নামটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে সেই নামটি হল বাহাদুর শাহ জাফর।
২০০৯-এর ২৫ ফেব্রুয়ারির বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের জন্য এ
দেশের কোনো মানুষেরই সামান্যতম সহানুভূতি থাকবে না। ইতিহাসের ধারায় তারা
তৈরি করেছিল এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। যে বীর সেনা অফিসাররা সেদিন প্রাণ
হারিয়েছিল, তারা জানতে পারেনি তাদের কী অপরাধ। তারা জানতে পারেনি কোন
ষড়যন্ত্রীরা দেশের কোন সর্বনাশ করার জন্য তাদের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। একজন
সৈনিকের জন্য সবচেয়ে গর্বের বিষয় হল তার ইউনিফর্ম। ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায়
তাদের হত্যা করা হয়েছিল। এ ছিল তাদের ইউনিফর্মের প্রতি চরম অবমাননা। একজন
সৈনিক দেশের জন্য প্রাণ দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। বরং দেশের জন্য শাহাদতবরণ
করাটা তারা অতি গর্ব ও বীরত্বের কাজ হিসেবে গ্রহণ করে। মহান মুক্তিযুদ্ধে
এত বিশালসংখ্যক অফিসার শহীদ হননি। তাহলে কি এদের হত্যা করে কুচক্রীরা
চেয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বর্মটিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে
দিতে। এসব সেনা অফিসারের স্বজনরা আজও অপেক্ষায় আছেন দিবসটিকে যেন শহীদ
সেনাদিবস হিসেবে ঘোষণা করে রাষ্ট্র। তারা দিবসটিকে সরকারি ছুটির দিন
হিসেবেও চান না। তাদের একটি মাত্র চাওয়া হল, দিবসটির প্রতি জাতির অকুণ্ঠ
মর্যাদা জ্ঞাপন। কী শোকাবহ ছিল এ সেনা অফিসারদের মৃত্যু! তাদের কফিন যেসব
সেনা অফিসার ইউনিফর্ম পরে কাঁধে বহন করে ধীর পদক্ষেপে শেষ যাত্রায় এগিয়ে
যাচ্ছিলেন, তারাও অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। কী গভীর বেদনাভূতি এ ঘটনাটির
সঙ্গে জড়িয়ে ছিল তা ভাষায় বর্ণনা করা সহজ নয়। এমন শোকে মানুষ ভাষা হারিয়ে
ফেলে, হয়ে যায় বাকশক্তিহীন। তাই তো গায়ক হায়দার হোসেন গেয়েছিলেন, ‘আমি
চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়া করিতে পারিনি চিৎকার।’ শুধু সেনা অফিসার হত্যার
জন্যই স্মরণীয় নয়, ফেব্রুয়ারি আমাদের ভাষার মাস, শহীদদের মাস, মায়ের ভাষার
মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রতিরোধের মাস। মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য
বরকত, সালাম, রফিক ও জব্বাররা আমাদের যেভাবে আত্মসচেতন করে গেছেন, সেটাই
আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
আমরা একটি দেশের উপনিবেশবাদের শৃঙ্খল ভেঙেছি অন্য একটি দেশের উপনিবেশে
পরিণত হওয়ার জন্য নয়। গত দু-তিন দিনের সংবাদপত্র পড়ে মনে হচ্ছে আমাদের
আত্মমর্যাদাবোধকে নতুন করে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে। ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর
২য় পাতায় একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল, ভারতীয় সেনাপ্রধানের
মন্তব্য/‘বাংলাদেশিদের’ ব্যবহার করছে চীন ও পাকিস্তান। এ সংবাদে বলা হয়েছে,
চীনের সহায়তায় পাকিস্তান ‘বাংলাদেশি’ মুসলমানদের ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে
ঠেলে পাঠাচ্ছে- প্রকারান্তরে এ কথাই বলেছেন ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল
দিপিন রাওয়াত। গত বুধবার রাজধানী নয়াদিল্লিতে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল নিয়ে
আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি জানান, ভারতের পশ্চিম প্রান্তের প্রতিবেশীর
কাছে এটা আরেক ধরনের ছায়াযুদ্ধ। ছায়াযুদ্ধের চরিত্র কেমন তা বোঝাতে গিয়ে
রাওয়াত আসামের রাজনৈতিক দল অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের
(AIUDF) উদাহরণ দেন। তিনি বলেন, রাজ্যে এ দলটির বাড়-বাড়ন্ত বিজেপির চেয়ে
অনেক বেশি। বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি মুসলমান জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কথা
বলেন। এই যে বেড়ে যাওয়া, তার একটা বড় কারণ হিসেবে তিনি বন্যার কথা বলেছেন,
যার ফলে নিম্ন প্রবাহিকার দেশ বাংলাদেশে বাসস্থানের জায়গা সংকুচিত হয়ে
পড়ছে। তার ব্যাখ্যায়, চীনের সাহায্যে পাকিস্তান ওই মানুষজনকে উত্তর
পূর্বাঞ্চলে পাঠিয়ে জনবিন্যাস বদলে দিচ্ছে। এটা ওদের এক ধরনের ছায়াযুদ্ধ।
ওদের উদ্দেশ্য এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অশান্তি জিইয়ে রাখা। জেনারেল রাওয়াতের এ
মন্তব্যে হতভম্ব হওয়া ছাড়া কী-ই বা করার থাকে! ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে
বঞ্চনাজনিত কারণে একধরনের সশস্ত্র বিদ্রোহাত্মক তৎপরতা দীর্ঘদিন ধরে চলে
আসছে।
কখনও এই তৎপরতা বেড়ে যায়, আবার কখনও স্তিমিত হয়ে পড়ে। ওখানে যা ঘটছে
সেটি ঘটছে মূলত অভ্যন্তরীণ কারণে। এসব বিদ্রোহাত্মক তৎপরতার সূচনা ১৯৪৮ সাল
থেকে। অর্থাৎ ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পরের বছর থেকে। এ কথা
অনস্বীকার্য, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে পূর্ববঙ্গের গরিব কৃষকরা আসামে
অভিবাসন শুরু করে। অর্থনীতির ভাষায় একে বলা যায়, পুশ অ্যান্ড পুল ফ্যাক্টর।
এ গরিব কৃষক প্রজারাই আসামের বন-জঙ্গল সাফ করে এবং হিংস্র পশুদের দমন করে
আসামকে কৃষির জন্য উপযোগী করে তোলে। অথচ দেখা গেল একপর্যায়ে আসামের মূল
বাসিন্দারা এটা পছন্দ করছে না। তারা ‘বাঙাল খেদা’ আন্দোলন গড়ে তুলল। এই
ঘৃণাশ্রয়ী আন্দোলন প্রতিরোধ করতে গিয়ে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর
নেতৃত্বে লাইন প্রথাবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। সেই সময় থেকেই আসামে বারবার
বাঙালি বিদ্বেষের বিষবাষ্প ছড়িয়েছে। এ থেকে পশ্চিম বাংলার বাঙালিরাও রেহাই
পায়নি। জেনারেল রাওয়াতের দাবি, বন্যা ও জনসংখ্যার চাপের ফলেই আসামে
‘বাংলাদেশি’দের অনুপ্রবেশ ঘটছে। ফলে আসামের জনবিন্যাসে পরিবর্তন হচ্ছে এবং
দিনে দিনে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতের সামরিক
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে এটা হল এক ধরনের জনমিতিক আগ্রাসন বা Demographic
Invasion; কিন্তু গত ২-৩ দশকে বাংলাদেশে যতটুকু অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে
তার ফলে বাংলাদেশিদের আসামে যাওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। কর্মসংস্থানের জন্য
বাংলাদেশিরা ভারতের তুলনায় পৃথিবীর অন্য অনেক দেশকে আকর্ষণীয় মনে করে। এ
ছাড়া আসামে ১৯৪৭-এর পর এমন কোনো অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়নি যার ফলে বাংলাদেশিরা
কর্মসংস্থানের গন্তব্য হিসেবে আসামকে বেছে নিতে পারে। সর্বোপরি চীনের
সহায়তায় পাকিস্তান ‘বাংলাদেশি’ মুসলমানদের ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ঠেলে
পাঠাচ্ছে- জেনারেল রাওয়াতের এমন অভিযোগ উদ্ভটও বটে। কারণ বাংলাদেশে
পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতাকে দমিয়ে দেয়ার জন্য বাংলাদেশের সরকার
প্রচণ্ডভাবে তৎপর রয়েছে। এ কথা নিশ্চয়ই জেনারেল রাওয়াত আমাদের মতো বেসামরিক
নাগরিকদের তুলনায় অনেক বেশি অবগত আছেন। বাংলাদেশ সরকার অনুপ চেটিয়াসহ
উত্তর-পূর্ব ভারতের বিদ্রোহী নেতাদের ভারত সরকারের হাতে তুলে দিয়েছে। এর
ফলে ভারতের নিরাপত্তা শঙ্কা দূরীভূত হওয়ার কথা। কিন্তু তা না হয়ে এখন
ভিন্নতর অভিযোগ তোলা হচ্ছে। এর সঙ্গে চীনকেও যুক্ত করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের কথিত উদ্বেগ প্রশমনের জন্য অতি সম্প্রতি
বলে দিয়েছেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ততটুকুই, যতটুকু প্রয়োজন
অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য। বাংলাদেশ ভারতকে অনেক কিছু দিয়েছে- দিয়েছে করিডোর
সুবিধা এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিদ্রোহ দমনে সহায়তা। এতকিছু করেও
ভারতের মন জয় করা সম্ভব হয়নি। আরও কত কী করলে ভারতের মন জয় করা সম্ভব হবে
বলা দুষ্কর। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ৩-৫ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স যায়
ভারতে। এখন মনে হচ্ছে জনমিতিক বিন্যাসে ভারসাম্য আনার নামে ভারতও
মিয়ানমারের মতো ২০-৪০ লাখ মুসলমানকে বাংলাদেশে ঠেলে দিতে পারে। এটা কি
বন্ধুত্বের নমুনা? ভারত ভালো বন্ধু হলে অন্তত তিস্তাসহ অন্যান্য অভিন্ন
নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা বাংলাদেশকে দিত। আমরা ভারতকে বন্ধু হিসেবে পেতে
চাই, অভিযোগ উত্থাপনকারী প্রভু হিসেবে নয়।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
No comments