কাতারে নতুন প্রজন্মকে বাংলা শেখাবে কে? by তামীম রায়হান
কাতারে
বর্তমানে প্রায় চার লাখ বাংলাদেশি বাস করছেন। নির্মাণ খাতে কর্মরত
বিপুলসংখ্যক শ্রমিক ছাড়াও বিভিন্ন পেশা ও বাণিজ্য খাতে জড়িত হাজার হাজার
বাংলাদেশি। তাঁদের অনেকেই সপরিবারে কাতারে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন। ফলে
গত কয়েক দশকে কাতারে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশি নতুন প্রজন্ম, যাদের অধিকাংশের
জন্ম ও বেড়ে ওঠা এখানে। এই নতুন প্রজন্মের একটি বড় অংশ বাংলাদেশি
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমএইচএম স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ালেখা করছে বা করেছেন।
আবার অনেকে বিদেশি স্কুলে ইংরেজি মাধ্যমে বা কাতারি স্থানীয়
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আরবি মাধ্যমে পড়াশোনা করছে। যারা ইংরেজি বা আরবি মাধ্যমে
পড়ালেখা করছে, স্বাভাবিকভাবে তারা মাতৃভাষা শেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
ইংরেজি বা আরবি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত অধিকাংশ বাংলাদেশি
শিশু-কিশোর ও তরুণ বাংলা লিখতে বা পড়তে পারে না। অনেকের বাংলা শব্দজ্ঞানও
বেশ সীমিত। কিন্তু এই ভিন্নভাবে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের জন্য মাতৃভাষা শেখা ও
চর্চার খুব বেশি সুযোগ কাতারে নেই বললেই চলে। এর ফলে বাংলাদেশি
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে অধ্যয়নরত নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশি অনেক
শিশু-কিশোর ও তরুণের কাছে বাংলা ভাষার সঙ্গে মৌখিক পরিচয় থাকলেও হাতে-কলমে
কোনো চর্চা নেই। এর চেয়েও আশ্চর্যের বিষয়, এটি নিয়ে অভিভাবকদেরও কোনো
মাথাব্যথা নেই। একমাত্র বাংলাদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমএইচএম স্কুল অ্যান্ড
কলেজ ইংরেজি মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে। সেখানে বাংলা ভাষা সম্পর্কে
জানাশোনা বাড়াতে এবং বাংলা সাহিত্যের চর্চায় শিক্ষার্থীদের জন্য একাডেমিক
সিলেবাসের বাইরে বাড়তি কোনো আয়োজন নেই। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পর
চার দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও তৈরি হয়নি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চা এবং
বাংলা বিতর্কসহ সাংস্কৃতিক চর্চার কোনো আলাদা ক্লাব বা সংগঠন। এমএইচএম
স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. জসিমউদ্দীন প্রথম আলোর কাছে বিষয়টি
স্বীকার করে বলেন, ‘একাডেমিক কার্যক্রমের বাইরে বাড়তি উদ্যোগ না থাকলেও
বিভিন্ন জাতীয় দিবসে আমরা বাংলা ভাষায় রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকি।
আমাদের স্কুলে বাংলা বিভাগ রয়েছে। পাশাপাশি প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও শহীদ দিবস উপলক্ষে স্কুলের চারটি ভবন থেকে আলাদা
বাংলা দেয়ালিকা প্রকাশ করা হয়ে থাকে।’প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে অধ্যক্ষ
জসিমউদ্দীন বলেন, ‘বাংলাদেশি কমিউনিটির যেসব নতুন প্রজন্ম এই স্কুলের
শিক্ষার্থী নয়, তাদের জন্য বিনা মূল্যে বাংলা ভাষা শেখাতে ২০১৩ সালে একবার
আমরা উদ্যোগ নিয়েছিলাম।
কিন্তু আমরা খুব অল্প সাড়া পেয়েছি। এরপর আর উদ্যোগ
নেওয়া হয়নি। তবে কেউ যদি বাংলাদেশি কমিউনিটির জন্য বাংলা ভাষা শেখা ও
চর্চার উদ্যোগ নেয়, তবে বাংলাদেশ স্কুল এ ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতা
করবে।’ এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্কুল পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান ও
রাষ্ট্রদূত আসুদ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘একাডেমিক সিলেবাসের বাইরে বছরজুড়ে
স্কুলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় আলাদা গুরুত্ব দেওয়ার জন্য কোনো উদ্যোগ
নেওয়া হয়নি এত দিন। এখন আমরা বিষয়টি নিয়ে ভাবব। এ জন্য উদ্যোগ নিতে আলোচনা
করব।’ তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ স্কুলের বাইরে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোতে
অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জন্য দু-একটি সংগঠন বাংলা ভাষা শেখানোর উদ্যোগ নেয়।
তবে অভিভাবকদের আগ্রহের অভাবে এসব উদ্যোগ সীমিত পর্যায়ে রয়ে গেছে। ২০১৫
সালে কাতারে আরবি ও ইংরেজি মাধ্যমে পরিচালিত বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে
অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলা ভাষা শেখানোর উদ্যোগ নেয় আলনুর
কালচারাল সেন্টার। এই সংগঠনের তত্ত্বাবধানে বাংলা ভাষা শেখা শুরু করে ২২ জন
শিক্ষার্থী। সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক মাওলানা ইউসুফ নুর বলেন, ‘আমরা আরও
বেশি শিক্ষার্থী আশা করেছিলাম। কিন্তু অভিভাবকদের অনাগ্রহ ও অসচেতনতার
কারণে অল্প কয়েকজন শিক্ষার্থী নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি। কার্যক্রম শুরু
হওয়ার পরও অভিভাবকদের কারণে প্রায়ই শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি সংকট দেখা দেয়।’
কোর্সটির প্রশিক্ষক অধ্যাপক এ কে এম আমিনুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা
বর্ণমালা পরিচয় থেকে শুরু করি। সপ্তাহে এক দিন তাদের শেখানো হতো। কিছু
বিরতি দিয়ে হলেও দুই বছর পর আজ তারা সবাই বাংলা পড়তে পারে। তবে চলতি বছর
নতুন করে আবারও এই কোর্স শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।’কাতারে বাংলাদেশি
শিশু-কিশোরদের জন্য গড়ে ওঠা বাংলাদেশ চিলড্রেনস ফোরামের সদস্য তালিকায়
প্রায় ৭৬ জন প্রবাসী শিশু রয়েছে। এই শিশুদের সঙ্গে বাংলা বর্ণমালা পরিচয়
করিয়ে দিতে উদ্যোগ নেয় চিলড্রেনস ফোরাম। তবে এখনো সেই উদ্যোগ বাস্তবায়ন
শুরু হয়নি। ফোরামের অন্যতম উদ্যোক্তা মোহাম্মদ শাহেদ প্রথম আলোকে বলেন,
‘আমরা মূলত জায়গা সংকটের কারণে কার্যক্রম শুরু করতে পারিনি। একটি কমন রুম
পেলে আমরা শিশুদের ভাষা শেখানোর কাজ শুরু করব।’ দিওয়ানে আমিরিতে কর্মরত
ইতিহাস বিশেষজ্ঞ হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ কথাও সত্য,
কাতারপ্রবাসী অনেক বাংলাদেশি অভিভাবক নিজেদের সন্তানদের বাংলা ভাষা শেখাতে
আগ্রহী নন। তাঁরা ভাবেন, তাঁদের সন্তানেরা এখানে পড়ালেখা শেষে উচ্চশিক্ষা
বা জীবনের তাগিদে ইউরোপ-আমেরিকায় চলে যাবে, ফলে পারস্পরিক যোগাযোগের জন্য
প্রয়োজনীয় বাংলার বাইরে বেশি কিছুর প্রতি তাঁদের মনোযোগ নেই।’ নাম প্রকাশ
না করার শর্তে একজন অভিভাবক বলেন, ‘আমরা আমাদের মাতৃভাষা দিবসকে
আন্তর্জাতিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছি। অথচ দেশের সীমানার বাইরে খোদ আমাদের
মধ্যেই ভাষার জন্য মমতা ও ভালোবাসা নেই। এর পেছনে অভিভাবকদের দায়টা বেশি।
কারণ, নতুন প্রজন্মকে শিকড়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হলে সেটির শুরু ঘর
থেকে হতে হবে।’ রাষ্ট্রদূত আসুদ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রবাসে সন্তানদের
বাংলা ভাষা শেখানো ও চর্চায় অভিভাবকদের অনাগ্রহ বা অসচেতনতার বিষয়টি
কোনোভাবেই ইতিবাচক হতে পারে না। বিদেশে বেড়ে ওঠা এই নতুন প্রজন্ম মাতৃভাষা
না জানলে নিজস্ব স্বকীয়তা ও ঐতিহ্য সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যাবে।’ রাষ্ট্রদূত
প্রবাসীদের আহ্বান জানিয়ে বলেন, যেসব বাংলাদেশি শিক্ষার্থী বাংলাদেশ স্কুলে
লেখাপড়া করছে না, তাদের অভিভাবকেরা যেন নিজ সন্তানদের বিভিন্ন জাতীয় দিবসে
বাংলাদেশ এমএইচএম স্কুলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে পাঠান। এর ফলে তারা বাংলা ভাষা ও
সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাবে ও শেখায় উত্সাহী
হবে।
No comments