শ্রমিকের অধিকার ও নিশ্চুপ শ্রম আইন by আদনান সৈয়দ
বাংলাদেশের শ্রম আইন, ২০০৬-এর পাতায় পাতায়
শ্রমিকদের অধিকারের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে এর তেমন কোনো রকম
প্রয়োগ লক্ষ করা যায় না। কলকারখানায় কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকের মৃত্যু এখন যেন
একেবারেই দুধভাতের একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন খবরের কাগজের পাতা
উল্টালেই পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে শ্রমিকের মৃত্যুসংবাদের খবরে এখন আমরা
সবাই কম-বেশি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। যে শ্রমিক তাঁদের জীবন বাজি রেখে আমাদের এই
সভ্য দুনিয়ার চাকা নিত্য সচল রাখেন, দেশের বৈদেশিক অর্থের জোগান দেন এবং
শিল্পোন্নয়ন ঘটিয়ে আমাদের মতন আধুনিক মানুষদের আয়েশি জীবনের সন্ধান জোগান,
সেখানে খুব দুঃখজনক হলেও সত্য যে দেশের অবহেলিত সেই শ্রমিক সমাজের
জীবনযাপনের মান উন্নয়নে তেমন কোনো অগ্রগতি ঘটেনি।
কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা আমাদের শ্রমবাজারে নতুন কোনো ঘটনা নয়। ভবনধসে শ্রমিকের মৃত্যু, কারখানায় আগুন লেগে শ্রমিকের মৃত্যু, দায়িত্ব পালনকালে বহুতল ভবন থেকে পড়ে শ্রমিকের মৃত্যু এখন নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। যেখানে শ্রমিকের জানমালের কোনো নিরাপত্তা নেই, কর্মস্থলে স্বাস্থ্যগত আশাব্যঞ্জক কোনো পরিবেশ নেই, মোট কথা শ্রমিকের জীবন যেখানে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন কারণে হুমকির সম্মুখীন, সেখানে বাংলাদেশের এই কাগজে-কলমে শ্রম আইনের ধারাগুলো আমাদের শ্রমিকদের স্বার্থ কতটুকু রক্ষা করতে পারছে, সেটাই হলো সবচেয়ে বড় কথা। গত বছর ঘটে যাওয়া সাভারের রানা প্লাজায় ভবনধসে নিহত শত শত অসহায় শ্রমিকের লাশের পাহাড়কে সামনে রেখে এই প্রশ্নগুলো আমাদের বিবেকের কাছে বারবারই ঘুরেফিরে আসছে।
গত বছরের রানা প্লাজার ভবনধস থেকে বেঁচে আসা কিছু ভাগ্যবান নারী শ্রমিক জানিয়েছেন যে তাঁরা কেউই মাতৃত্বকালীন কোনো রকম ছুটিছাটা পেতেন না। তবে তাঁদের এই বক্তব্যে আমাদের অবাক হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ, আমরা জানি যে বাংলাদেশের অধিকাংশ পোশাকশিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকই এই অধিকার থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত। অথচ বাংলাদেশের শ্রম আইন, ২০০৬-এর ৪৫ ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে যে ‘কোন মালিক তাহার প্রতিষ্ঠানে সজ্ঞানে কোন মহিলাকে তাহার সন্তান প্রসবের অব্যবহিত পূর্ব ও পরবর্তী আট সপ্তাহ করে মোট ষোল সপ্তাহের মধ্যে কোন কাজ করাতে পারবে না।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা? আমরা তো জানি যে শ্রমিকের জন্য আইন আছে খাতাপত্তরে, অফিস-আদালতের বড় বড় নথিপত্রে। কিন্তু এই আইনের প্রয়োগটি কোথায়?
আমাদের কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য নতুন কোনো ঘটনা নয়। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য যে শ্রমবাজারে আমাদের নারী শ্রমিকেরা প্রতিনিয়ত এই লিঙ্গবৈষম্যের করুণ শিকার হচ্ছেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নারী শ্রমিকের উপস্থিতি ২৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ। পুরুষ শ্রমিকদের পাশাপাশি আমাদের এই নারী শ্রমিকেরা যেকোনো ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে কোনো অংশেই কম নন। বর্তমান গার্মেন্টস শিল্পে নারী শ্রমিকের সংখ্যা মোট শ্রমিকের ৮০ শতাংশ। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের নারী শ্রমিকেরা তাঁদের কর্মক্ষেত্রে এখনো তাঁদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। অভিযোগ পাওয়া যায়, কারখানার মালিকপক্ষ প্রতিনিয়তই অল্প মজুরি বা পুরুষের তুলনায় অর্ধেক মজুরিতে আমাদের এই অসহায় নারী শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে বাধ্য করছে। অথচ বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর ৩৪৫ ধারায় বলা হয়েছে যে ‘কোন শ্রমিকের জন্য কোন মজুরী নির্ধারণ বা নিম্নতম মজুরীর হার স্থিতিকরণের ক্ষেত্রে একই প্রকৃতির বা একই মান বা মূল্যের কাজের জন্য মহিলা এবং পুরুষ শ্রমিকগণের জন্য সমান মজুরীর নীতি অনুসরণ করিতে হইবে এবং এতৎসংক্রান্ত কোন বিষয়ে নারী-পুরুষ ভেদের কারণে কোন বৈষম্য করা যাইবে না।’ আবারও সেই একই কথা। শ্রমিকদের জন্য আইন আছে কিন্তু এই আইনের প্রয়োগ করবে কে?
বাংলাদেশের বিভিন্ন পেশায় শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেল যে তাঁদের বেশির ভাগই শ্রম আইন সম্পর্কে তেমন একটা জানেন না। একজন শ্রমিক জানতেও পারেন না যে শ্রমিক হিসেবে অন্য সবার মতো তাঁরও আইনের আশ্রয় নেওয়ার অধিকার রয়েছে। বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর ২১৩ ধারা অনুযায়ী যেকোনো শ্রমিক তাঁর আইনি অধিকার প্রয়োগের জন্য শ্রম আদালতে দরখাস্ত করতে পারেন। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে শ্রমবাজারে শ্রমিকদের জন্য রয়েছে ভিন্ন বাস্তবতা! দেখা গেছে, শ্রমবাজারে শ্রমিকের আধিক্য হওয়ার কারণে শ্রমিকেরা মালিকদের যেকোনো অন্যায় আবদার চুপ করে মাথা পেতে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। মালিকপক্ষও এই সুযোগের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শ্রমিকের অধিকার আদায়ে এগিয়ে আসার জন্য শ্রমিকদের সংগঠন ট্রেড ইউনিয়ন পর্যন্ত বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যার ফলে আমাদের শ্রমিকেরা যেমন তাঁদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, পাশাপাশি বিপন্ন হচ্ছে মানবতা এবং মানবতার ঈপ্সিত পরিবেশ।
সন্দেহ নেই, বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ আমাদের শ্রমিকদের রক্ষাকবচ। তবে এই আইনের যথাযথ প্রয়োগ খুব জরুরি। আমরা চাই শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ। একজন শ্রমিক তাঁর প্রাপ্য অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকবেন, এই আমাদের প্রত্যাশা। সে জন্য প্রয়োজন মানবিকতা চর্চার পাশাপাশি শ্রম আইনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সর্বোপরি শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধার মানসিকতা তৈরি করা। সরকারপক্ষ, মালিকপক্ষ, শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষাকারী বিভিন্ন রকম সংগঠনসহ দেশের সুশীল সমাজ সবাইকে একসঙ্গেই এই শ্রম আইন প্রতিষ্ঠায় আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, শ্রমিক আমাদের সমাজের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। এই ধারণাটি আমাদের আত্মায় লালন করতে হবে। শ্রমিক বাঁচলেই দেশ বাঁচবে। আর সে কারণেই শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন বাংলাদেশের শ্রম আইন ২০০৬-এর পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠা।
আদনান সৈয়দ: তথ্যপ্রযুক্তিবিদ।
adnansyed1@gmail.com
No comments