কিছুই দিই না, শুধু নিই by আনিসুল হক
ছোট্ট ছেলেমেয়েগুলোর চোখমুখ উজ্জ্বল।
দেখলে আদর করতে ইচ্ছা করে, এমন সব বাচ্চা। এসেছে প্রথম আলোর কার্যালয়ে।
এদের কারও বাবা, কারও মা মারা গেছে এক বছর আগে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনায়।
আমি ওই বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকাতে পারি না।
এই বাচ্চাদের শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে।
একজন বাবা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলেন, ‘আপনারা কত টাকা দিচ্ছেন এটা ব্যাপার নয়, আপনারা যে বলছেন, এই বাচ্চা যত দিন পড়াশোনা করবে, তত দিন আপনারা আমাদের পাশে থাকবেন, এই কথাটা কোটি টাকার চেয়ে বেশি।’
আমার বুকে ব্যথা করে।
আমি ওই বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকাতে পারি না।
এই বাচ্চাদের শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে।
একজন বাবা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলেন, ‘আপনারা কত টাকা দিচ্ছেন এটা ব্যাপার নয়, আপনারা যে বলছেন, এই বাচ্চা যত দিন পড়াশোনা করবে, তত দিন আপনারা আমাদের পাশে থাকবেন, এই কথাটা কোটি টাকার চেয়ে বেশি।’
আমার বুকে ব্যথা করে।
এই মানুষগুলোই আসল মানুষ। এঁরা আমাদের কারখানার চাকা ঘোরান, এঁরা আমাদের প্রগতির চাকা ঘোরান। বিনিময়ে এই দেশ, এই সমাজ, এই রাষ্ট্র এঁদের কী দেয়? এঁদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটাই বা কী!
এই দেশটায় একটা অদ্ভুত নিয়ম আছে, যাঁরা প্রকৃতপক্ষে দেশের জন্য কিছু করেন, তাঁদের অবজ্ঞা করা হয় পদে পদে। আমি একাধিকবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থানুকূল্যে সে দেশ সফর করেছি। আমাদের ওই সব কর্মসূচি দেখভাল করতেন যেসব মার্কিন কর্মকর্তা, তাঁরা প্রতিনিয়ত প্রতিটা পয়সা বাঁচানোর চেষ্টা করতেন, আর বলতেন, এসব ট্যাক্সপেয়ার’স মানি। করদাতাদের টাকা। অপচয় করা যাবে না। আর যাঁরা এই করটা দেন, তাঁদের ওঁরা স্মরণ করছেন পদে পদে।
আর বাংলাদেশে আমরা যখন সরকারি কোনো তহবিল পাই, তখন আমাদের একটাই স্লোগান, কোম্পানি কা মাল, দরিয়া মে ঢাল। সরকারি টাকা যথেচ্ছ লুটপাট করো। সরকারের টাকা তো আসলে সরকারের নয়, জনগণের টাকা, জনগণ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আয় করে, আর সরকারকে কর দেয়। একটা সিনেমা দেখতে গেলেও কর গুনতে হয়, একটা বিড়ি খেলেও গরিব মানুষ কর দিয়েই তারপর খায়। কাজেই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সবাইকেই কর বা শুল্ক দিতে হয়, গরিব কিংবা বড়লোকনির্বিশেষে। কাজেই সরকারের টাকা সরকারের নয়, জনগণের।
আর এই দেশটার অগ্রগতিতে সবচেয়ে বড় অবদান রাখে গরিব মানুষ। আমাদের মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছেন কৃষকেরা। মাছের চাষ, মুরগির চাষের মাধ্যমে তাঁরা নীরব বিপ্লব করে চলেছেন। আমাদের পোশাককর্মীরা নিজের রক্ত পানি করে এনে দিচ্ছেন বৈদেশিক মুদ্রা। আমাদের প্রবাসী শ্রমিকেরা নিজেরা খেয়ে না-খেয়ে ডলার পাঠাচ্ছেন দেশে। দেশে এখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এই দেশে সবচেয়ে কম সম্মান পান এই শ্রমজীবী মানুষগুলোই। বিমানবন্দরে দেখতে পাই, অভিবাসী শ্রমিকদের দিকে তাকানোই হচ্ছে হেয় দৃষ্টিতে। আমরা আমাদের পোশাকশ্রমিকদের কর্মস্থলে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছি শোচনীয়ভাবে। অর্থাৎ, যাঁরা কিনা আমাদের মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছেন, যাঁরা কিনা আমাদের এনে দিচ্ছেন মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা, এই দেশে তাঁদেরই মর্যাদা সবচেয়ে কম। বস্তুত, তাঁদের কোনো মর্যাদাই নেই।
অন্যদিকে, আমরা যারা প্যান্ট-শার্ট-জুতা পরি, যারা সারা জীবন পড়াশোনা করেছি বিনা পয়সায়, স্কুলে-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ৫-১০ টাকার বেশি বেতন দিইনি, এই দেশের গরিব মানুষের শ্রমে-ঘামে অর্জিত টাকায় প্রায় বিনা পয়সায় পড়েছি এবং নানা রকমের ফন্দিফিকির করে নিজেদের পকেট ভরছি, যারা পকেট ভরে ডলার নিয়ে বিদেশে গিয়ে খরচ করে আসি, কিংবা বিদেশে নাগরিকত্ব নেওয়ার জন্য দেশের সম্পদ বেচে বিদেশে ডলার নিয়ে যাই, কিংবা যারা দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করলেও টাকা জমাই বিদেশে, সম্পত্তি করি বিদেশে, কিংবা যারা সরকারি ব্যবসা-বাণিজ্য, নিয়োগ-টেন্ডারে নয়ছয় করে টাকার কুমির হয়েছি এবং বেশির ভাগ টাকা পাচার করছি বিদেশে, আমরা যারা শেয়ারমার্কেট থেকে, ব্যাংক থেকে টাকা লুট করি, যারা ভূমি-নদী-খাল-বিল-মাঠঘাট দখল করি, পুকুরচুরি করি এবং টাকা পাঠাই বিদেশে, আমরা যারা ঘুষ খাই, দুর্নীতি করি এবং সমাজে বড় বড় কথা বলে বেড়াই, তারাই সব ধরনের সামাজিক, সরকারি, রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা ও সম্মান ভোগ করি।
আমি একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। ধরা যাক, স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক কোনো ম্যাচ। এই ম্যাচের টিকিটের জন্য সারা রাত ব্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে হাজার হাজার মানুষ। সকালবেলা টিকিট দেওয়া শুরু হলে ২০-৩০-১০০ জনকে টিকিট দেওয়ার পরেই বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে পুলিশ আসে, লাঠিপেটা করা হয়। একজনকে দুটির বেশি টিকিট দেওয়া হয় না। এত কষ্ট করে টিকিট পাওয়া মানে সোনার হরিণ পাওয়া। তারপর খেলার দিন এই লোকটা যখন স্টেডিয়ামের দিকে যান, তিনি কোনো যানবাহন পান না। তাঁর গাড়ি ওই পথে চলতে দেওয়া হয় না। এরপর তিনি গ্যালারিমুখো হতেই পুলিশের বাধার মুখে পড়েন। ভিআইপি যাচ্ছেন, তাঁকে পথ ছেড়ে দিতে হয়। নিজের পকেটের টাকা খরচ করে খেলা দেখতে যাওয়া লোকটা এরপর পড়েন পুলিশের লাঠিপেটার মুখে। কিন্তু আপনিই যদি তথাকথিত সুবিধাভোগী শ্রেণীর কেউ হন, ব্যাংক থেকে টাকা লুট করা ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে দুর্নীতিবাজ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে আমার মতো গজদন্তমিনারবাসী লেখক, আপনার কাছে টিকিট চলে সৌজন্য হিসেবে, আপনার ভাগনে-ভাগনি, শালা-সম্বন্ধী—সবাই ভিআইপি টিকিট পাবেন, আপনার গাড়িতে থাকবে স্টিকার, সেটা আপনাকে স্টেডিয়ামের গেট পর্যন্ত অবাধ প্রবেশাধিকার দেবে। অর্থাৎ, যিনি টাকা খরচ করে টিকিট জোগাড় করেননি, তিনি পাবেন জামাই-আদর। আর যিনি লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা খরচ করে টিকিট কিনেছেন, তিনি পাবেন লাঠির বাড়ি। অর্থাৎ কিনা সাধারণ ট্যাক্সপেয়াররা, ওয়েজ আর্নাররা, এই দেশের উন্নতির চাকা যাঁরা ঘোরান, সেই সোনার মানুষেরা এই দেশে সবচেয়ে বেশি অপমানিত ও সুবিধাবঞ্চিত। সুবিধাপ্রাপ্তদের জন্য সর্বত্রই সুবিধার কোটা, তাঁরা রাজউকের প্লট পাবেন, বাসে-ট্রেনে-প্লেনে তাঁদের জন্য টিকিট সংরক্ষিত থাকবে, তাঁরা বড় গাড়িতে চড়ে যাবেন, তাঁদের গাড়িতে সাইরেন বাজবে, তাঁদের জন্য অন্য যানবাহন থামিয়ে নির্বিঘ্নে চলার ব্যবস্থা করা হবে। বিনিময়ে তাঁরা টাকা পাচার করবেন বিদেশে। বিনিময়ে তাঁরা ব্যাংক খালি করে ফেলবেন। বিনিময়ে তাঁরা মাঠঘাট-খালবিল ও পুকুর চুরি করবেন।
এই রকমের মাৎস্যন্যায় দিয়ে চলছে এই সমাজ। এত অন্যায় প্রকৃতি সহ্য করতে পারবে? আমাদের লোভের আগুনেই তো পোড়েন পোশাককর্মীরা। সুশাসনের অভাব, নিয়মনীতিহীনতার কারণেই ধসে পড়ে রানা প্লাজা। দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ। হে মোর দুর্ভাগা দেশ যাদেরে করেছ অপমান, অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।
রানা প্লাজা আমাদের উঁচুতলার মানুষদের লোভের পরিণতি, অব্যবস্থাপনার ধস। ওই ভবন পড়ে গেছে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যর্থতা থেকে, সুশাসনের অভাব থেকে, সমাজের দুর্বৃত্তপনার লাগামহীনতা থেকে।
কবে এই দেশে আমরা মর্যাদা দেব মানুষকে। মর্যাদা দেব শ্রমের। মর্যাদা দেব করদাতাদের। মর্যাদা দেব দেশের প্রকৃত সেবকদের। অন্যের দিকে নয়, নিজের দিকে তাকাই। নিজের বিবেককেই এই প্রশ্ন করি। নিজের দেশটাকে কী দিলাম? এই মানুষদের কী সম্মান দেখালাম?
সরকারি স্কুলে পড়েছি। টিফিনের চাঁদা দিতে হতো তিন টাকা। বৃত্তির টাকা পেয়েছি ঢের বেশি। এমনকি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, ২০-৩০ টাকার বেতনও মাফ ছিল বৃত্তি পেতাম বলে। স্যাররা মাঝেমধ্যে স্মরণ করিয়ে দিতেন, তোমার পেছনে বছরে সরকারের ভর্তুকি এত লাখ টাকা। এই ঋণ শোধ করব কী করে? রবীন্দ্রনাথের গান শুনলে তাই বিবেকের যন্ত্রণা টের পাই। ‘অনেক তোমার খেয়েছি গো, অনেক নিয়েছি মা—/ তবু জানি নে-যে কী বা তোমায় দিয়েছি মা!’
কিছুই দিই না, শুধু নিই। আর যাঁরা দেন, শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ মানুষ, তাঁদের অপমান করি পদে পদে।
রানা প্লাজা দুর্ঘটনার বার্ষিকী আসবে-যাবে। আমরা নিয়মমাফিক কতগুলো কথা বলব। কিন্তু আসলে নিরাপদ কারখানা হবে কি? নিরাপদ সমাজ? শ্রমিক-কৃষকবান্ধব রাষ্ট্র?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments